২৫৭ বার পড়া হয়েছে
এক টুকরো গরুর মাংস
[লুৎফর রহমান রিটন]
গরুর মাংস আমার খুবই প্রিয়।
ডাক্তারের বারণ সত্বেও যে দু’টো নিষিদ্ধ খাবার আমি ছাড়তে পারি না বা ছাড়ি না, তার একটি হচ্ছে গরুর মাংস আর দ্বিতীয়টি মিষ্টি। এই বিষয়ে আমার নিজস্ব থিয়োরি হচ্ছে–যে জীবনে রসগোল্লা বা মিষ্টি আর গরুর মাংস নেই সেই জীবন লইয়া আমি কী করিবো?
পৃথিবীতে গরুর মাংসের সেরা রান্নাটা করতেন আমার মা। মায়ের হাতের রান্নায় গরুর মাংস খাই না আজ প্রায় তেত্রিশ বছর। এখনো, প্রতি বছর ঈদের সকালে মায়ের হাতের পোলাও আর গরুর মাংসের স্মৃতি আমাকে ব্যাকুল করে তোলে।
গরুর মাংস রান্নায় মা আমার চ্যাম্পিয়ন হলেও রানার্স আপ হচ্ছে শার্লি। শার্লির রান্না করা গরুর মাংসই আমার এখনকার পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ আইটেম।
শার্লির পরে অটোয়ায় গরুর মাংসের সেরা রাঁধুনি হচ্ছে আমার এক বন্ধুপত্নী। সিমি নামের ছোটবোনসম সেই মেয়েটি গরুর মাংস রান্না করলেই আমাকে পাঠিয়ে দেয় এক বাটি। গতকাল শার্লি আর আমি অটোয়ার বিখ্যাত এন্ড্রু হেইডেন পার্কে ঝকঝকে রোদের উজ্জ্বল সামারের দুর্দান্ত বিকেলটা কাটাচ্ছিলাম। এমন সময় অনুজপ্রতীম বন্ধু জিয়া আর ওর বউ এলো আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে দুর্ধর্ষ স্বদের গরুর ভুনা মাংসের বাটি। রাতে মহা আনন্দে সেই গরুর মাংস খেলাম।
সমস্যা হলো গরুর মাংস খেতে গেলেই একটা ঘটনার স্মৃতি আমাকে কাবু করে ফেলে। ঘটনাটা কষ্টের। বেদনার।
আমাকে যাঁরা চেনেন তাঁদের জানতে বাকি নেই যে আমি পরিবার থেকে বিতাড়িত। ফাইনালি বাড়ি ছেড়ে বেরুবার আগে দশ দশটি বছর শার্লি ওর শশুর বাড়িতে এক ধরণের নির্যাতন সেলে অবর্ণনীয় কষ্টের জীবন পার করেছে। আমাকে ভালোবেসে নিজের বাবা মা আত্মীয় স্বজন সবাইকে ফেলে দুই বিনুনির কিশোরী মেয়েটা আমার হাত ধরে চলে এসেছিলো আমাদের বাড়িতে,বাবা মায়ের একান্নবর্তী সংসারে। ওর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই সেই বিবেচনায় আমাদের সংসারে একটা অসহায় কাজের মেয়ের ভূমিকায় নামানো হয়েছিলো তাকে। সবার আগে সুবহে সাদেকের সময় ঘুম থেকে উঠে রাত দেড়টা দুইটার আগে সে ঘুমাতে যেতে পারতো না। মা আর বাবা একের পর এক কাজ দিয়ে তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখতো। ভাইবোনসহ এগারোজন সদস্যের পরিবারের সমস্ত রান্নাবান্না, ঘরদোর ঝাড়মোছ,পুরো পরিবারের গাট্টিগাট্টি কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে চাপকল থেকে চেপে ড্রামে পানি ভর্তির সমস্ত কাজ ওকে দিয়ে করাতেন আমার মা। এভাবে শার্লি প্রাণপণ চেষ্টা করেছে মা বাবার মন যোগাতে। নিষ্ঠুর বাবা মা এবং আমার ভাইবোনদের অকথ্য নির্যাতনের কারণে প্রায় প্রতিদিনই কাঁদতে হতো মেয়েটিকে। শুধু কি তাই? গালাগাল কিংবা কটুবাক্য ছাড়াও নানান কায়দায় মা আমার কষ্ট দিতো মেয়েটাকে। বলতে কষ্ট হয়, সারাদিন কাজ করা রান্নাবান্না করা মেয়েটাকে মা খাওয়ার কষ্টও দিতো! শার্লি তাও আমাকে ছেড়ে যায় নি। শুধু আমাকে ভালোবেসে অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে সে নির্যাতিত হয়েছে দশটা বছরের প্রায় প্রতিটা দিন। একেকটা সকাল আসতো ওর জীবনে কহতব্য নয় এমন নিপীড়নের বারতা নিয়ে। ওর প্রতিটা সকাল আর প্রতিটা রাত্রি ছিলো তখন অশ্রুভেজা।
”তবুও মা, তবুও বাবা” কিংবা ”মা-তো মা-ই, বাবা তো বাবাই” ধরণের তথাকথিত হাস্যকর একটা সোকল্ড সামাজিক ভ্যালুজের কারণে আমার মা বাবা ভয়ংকর নিষ্ঠুর এবং অমানবিক হলেও অন্ধ মাতৃপ্রেম আর পিতৃপ্রেমে বিস্ময়কর একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম আমি। যে কারণে মানসিক ভাবে এতোটাই অসহায় হয়ে পড়েছিলাম যে শার্লিকে নিয়ে বাড়ি ছাড়ার কথাটাও আমি ভাবতেই পারতাম না।
তখন, সকালে বেরিয়ে সমস্ত দিন আমি বাইরে বাইরে কাটাই। ফিরি বেশ রাতে। আসলে সারাটা দিন আমি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই। শার্লির অসহায়ত্ব দেখার কষ্ট থেকে পালিয়ে বেড়াই। আমার কাজ শেষ হলেও ফিরে আসি না বাড়িতে। কারণ আমি দরিদ্র এক তরুণ লেখক। খুবই অল্প আমার আয় রোজগার। সুতরাং পরিবারে আমার দাম কমতে কমতে একেবারে তলানীতে এসে ঠেকেছে। এমনকি ছোট ভাইবোনরাও আমাকে অপমান করে। তাচ্ছিল্য দেখায়। ‘বুদ্ধিজীবী’ বলে হাস্য করে উপহাস করে।
এরকম এক রাতে, সবাই শুয়ে পড়েছে এমন একটা সময়ে আমি ফিরে আসি বাড়িতে। বেলকনিতে বসে আমার ফেরার পথের দিকে তাকিয়ে ছিলো শার্লি। আমাকে পেয়ে অসহায় চেহারার শার্লির চোখে এক রাশ আনন্দ এসে ভর করেছিলো। ওর অসহায় মুখটা ব্যথায় কাতর ছিলো। মলিন ছিলো। কিন্তু আমাকে দেখার পর থেকে এক ধরণের চাপা উচ্ছ্বাস ফুটে উঠেছিলো ওর ব্যথাতুর ক্লান্ত চোখ দু’টিতে।
খাবো না বলার পরেও ডায়নিং টেবিলে সে আমাকে ভাত বেড়ে দিলো। এই ঘরের মূল লাইটটা না জ্বালিয়ে বাথরুমের লাইটটা জ্বালিয়ে সে ডায়নিং টেবিলটাকে আধো আলো আঁধারির পরিবেশে খেতে দিলো আমাকে। বললো খা, আজকে গরুর মাংস রান্না করেছি।
গরুর মাংসের কথা শুনে আমি খেতে বসলাম। শার্লি ছোট্ট একটা বাটিতে এক টুকরো গরুর মাংস আর একটা আলু রেখেছিলো। আমি তখনও জানতাম না মায়ের অগোচরে এই এক টুকরো মাংস বা এক বাটি মাংস সে লুকিয়ে রেখেছিলো আমার জন্যে। গরুর মাংসের ঝোলে মাখানো এক লোকমা ভাত মুখে তুলে মাংসের টুকরোটায় হাত দিতেই খুব নিরবে মা এসে ঢুকলেন সেই রুমে। তারপর রাগান্বিত কণ্ঠে শার্লির কাছে জানতে চাইলেন–এই মাংসের বাটিটা কোত্থেকে এলো?
শার্লি বললো,আমি ওর জন্যে তুলে রেখেছিলাম।
মা আরো রেগে গেলেন–কেনো তুমি ওর জন্যে তুলে রাখবে আমাকে না জানিয়ে?
সেই প্রথম শার্লি কেমন সাহসী হয়ে উঠলো–আমি সারাদিন কষ্ট করেছি। এই এতোগুলো মাংস আমিই রান্না করেছি। তাই আমি আমার ভাগের এক টুকরো মাংস ওর জন্যে তুলে রেখেছি…
আর এইদিকে মাংসের টুকরোটা মুখে তুলতে গিয়ে আমি নিঃশব্দে কেঁদে উঠলাম। আমার হাত থেকে মাংসের টুকরোটা পড়ে গেলো প্লেটে। মায়ের এই অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতায় আমার পৃথিবীটা একেবারেই ঝাপসা হয়ে গেলো। সেই রাতটা আমার কাছে ভয়ংকর একটা রাতের স্মৃতি হয়ে গেলো।
সেই রাতের দুঃসহ ঘটনাটার আপাত সমাপ্তি ঘটলেও মুহূর্তটা আমার জীবনে জড়িয়ে থাকলো ধারাবাহিক দুঃস্বপ্নের মতো। নেভার এন্ডিং ট্রমার মতো।
০২
নানা চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে ২০০১ সালে আমি দেশ ছাড়লাম। তারপর প্রথমে জাপান তারপর আমেরিকা ঘুরেটুরে ২০০২ থেকে মোটামুটি স্থায়ীভাবে থিতু হলাম অটোয়ায়,কানাডায়।
২০০৫ সালের এক দুপুর।
আমাদের অটোয়ার বাসায় ডায়নিং টেবিলে জুঁই ফুলের মতো শাদা ভাত আর গরমাগরম গরুর মাংস দিয়ে আহার করতে বসেছি। নদী গিয়েছে স্কুলে। শার্লি আমাকে খাবার বেড়ে দিয়ে নদীর ঘরটা গোছাচ্ছে। মনের আনন্দে আমি শার্লির অপূর্ব রান্নার দুর্ধর্ষ স্বাদের গরুর মাংস দিয়ে ভাত খাচ্ছি। সহসা আমার স্মৃতিতে ওয়ারির সেই ভয়ংকর রাতের দুঃসহ অপমানের দৃশ্যটা হামলে পড়লো।
খাওয়ার টেবিলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম আমি।
পাশের ঘর থেকে ছুটে এলো শার্লি।
তারপর চেয়ারের পাশ থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকলো সে অনেকক্ষণ! সে-ও কাঁদছে। আর কাঁদতে কাঁদতে বলছে কেনো ওটা মনে করিস তুই! ভুলে যা।
কিন্তু আমি ভুলতে পারি না।
(আমাকে আমার জীবনের চতুর্দিক থেকে জড়িয়ে ধরে রাখা মেয়েটার আজ জন্মদিন।
হ্যাপি বার্থ ডে শার্লি…।)
অটোয়া /কানাডা। ২১ জুন ২০২২
[ ক্যাপশন/ গতকাল বিকেলে অটোয়ার বিখ্যাত এন্ড্রু হেইডেন পার্কে শার্লির তোলা সেলফিতে আমরা দু’জন।]
১ Comment
Congratulations