টানা ২ বছর কোভিড আক্রান্ত পৃথিবীর আর অন্যান্য সবাইর মত আন্তর্জালে ১৪তম এবং ১৫তম বইমেলা অনুষ্ঠিত করে ১৬তম টরন্টো বাংলা বইমেলা উন্মুক্তভাবে করার আনন্দে উদ্বেলিত কানাডা প্রবাসী বাঙালী মানুষজনের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ একটা সত্যকে আরেকবার প্রতিষ্ঠিত করেছে যে আমাদের সবার হৃদয়ে আমরা লালন করি বাংলাকে এবং বাংলাদেশকে!
৬ ও ৭ আগষ্ট (শনি ও রবিবার) টরন্টোর বাঙ্গালীপাড়ার বহুলভাবে ব্যবহৃত ভেন্যু ৯ ডজ রোডে অবস্থিত লিজিয়ন হল এর মেইন ফ্লোরের মঞ্চে খুব সাধারণভাবে কিন্তু একান্ত শৈল্পিক একটি ব্যানার ১৬তম টরন্টো বাংলা বইমেলার অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিচ্ছিলো আর অনুষ্ঠানে আসা সব মানুষ ছবিতে ধারণ করতে থাকে বইমেলার স্মৃতিকে!
এবারের বইমেলার উদ্বোধনে সবার প্রিয় কবি আসাদ চৌধুরী উন্মুক্ত বইমেলায় অংশ করতে পারার আনন্দে একটা মিলনমেলার সুযোগের সাথে তুলনা করেন। এর আগে বইমেলার উদ্বোধনে আগত সবাই টরন্টোয় এবংলাদেশের শহীদ মিনারের আদলে স্থাপিত স্থায়ী মাতৃভাষা মনুমেন্ট এর পাদদেশে জড়ো হয়ে বইমেলার আবহসঙ্গীত গাইতে গাইতে মেলার ভেন্যুর দিকে এগিয়ে যান! বইমেলার আবহ সংগীতের রচয়িতা শেখ এস আহমেদ সাদী এবং সুর করেছেন বিজয় মামুন।
২ দিনে অনুষ্ঠিত এবারের বইমেলা টরন্টোর অভিবাসী বাঙালীদের সবাইকে অনেক কাছাকাছি আসার সুযোগের সৃষ্টি করেছে!
উদ্বোধনের পর সুকন্যা নৃত্যাঙ্গনের শিল্পীদের অংশগ্রহণে এবং কণ্ঠশিল্পী ফারহানা শান্তার গানে বইমেলার কার্যক্রম শুরু হয়! এরপর দেখানো মীর সাব্বির পরিচালিত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র “রাত জাগা ফুল” দেখানো হয়! এরপর ছিল কবি তাজুল ইমাম ও কবি জিন্নাহ চৌধুরীর স্মৃতি চারণ ও কবিতা আবৃত্তি।
একক কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠানে নিজের লেখা বহুল প্রশংসিত “জিহ্বা” কবিতা আবৃত্তি করে শোনান কবি হাসান মাহমুদ।
গত ৫ বছর ধরে অনুষ্ঠিত উত্তর আমেরিকা কবিতা উৎসব এর উদ্যোক্তা কবি মেহরাব রহমান মঞ্চে এসে শুরু করেন ৬ষ্ঠ কবিতা উৎসব! এতে অংশ নেন উত্তর আমেরিকায় বসবাসকারী কবিরা এবং আবৃত্তি করেন নিজের সৃষ্টি কবিতাবলী।
মেলায় আসা মানুষজন প্রকাশিত বই নিয়ে সাজানো টেবিল ঘুরে ঘুরে দেখার সাথে সাথে দিনের অন্যান্য অনুষ্ঠান উপভোগ করতে থাকেন। অপরাহ্নের অনুষ্ঠান ছিলো নৃত্যানুষ্ঠান! আরো ছিলো শহরের নতুন সাংস্কৃতিক সংগঠন “কন্ঠ চিত্রণ”। এর পিঠাপিঠি ছিলো টরন্টোর অত্যন্ত পরিচিত আবৃত্তি সংগঠন “অন্যস্বর”।
বইমেলার প্রথমদিনের প্রধান আলোচনা অনুষ্ঠানা অংশ গ্রহণ করেন কবি আসাদ চৌধুরী, টরোন্টোর বাংলাদেশ কনস্যুলেট এর কনসাল জেনারেল মোঃ লুৎফর রহমান, অন্টারিও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ও বিরোধী দলের উপ-প্রধান বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ডলি বেগম, বাংলাদেশ থেকে আগত প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী ও নৃত্য শিক্ষিকা সুলতানা হায়দার ও বইমের আহ্বায়ক শেখ এস আহমেদ সাদী।
সাহিত্য বিষয়ক আলোচনার বিষয় ছিলো “অভিবাসী বাঙালীর সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চ।” আলোচনা পরিচালনা করেন খ্যাতিমান লেখক জসিম মল্লিক। অংশগ্রহণ গ্রহণ করেন জিন্নাহ চৌধুরী, মোস্তফা চৌধুরী, ফরিদা রহমান, নাজমুন নেসা পিয়ারী, সিরাজুল ইসলাম মুনির, শাম্মি আখতার হ্যাপি ও আশরাফ আলী।
সন্ধ্যাবেলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নতুন প্রজন্মের উদীয়মান তারকা প্রতিষ্ঠা দেওঘরিয়া চমৎকৃত করে।
বইমেলার প্রথম দিনের শেষ আকর্ষণ ছিল রাগ প্রধান ও আধুনিক গানে গানে সবাইকে মোহিত করা শিল্পী অমিত শুভ্র।
সারাদিনের সমস্ত অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন অজন্তা চৌধুরী, লেসা সুজান অনন্যা ও হিমাদ্রী রায়।
সত্যবাদিতা আর সত্যের জন্যে অন্তপ্রাণ মানুষের সংগ্রাম আর জয়ের আদ্যপ্রান্ত বিধৃত কাহিনীর ওপরে ভিত্তি করে চিত্রিত ছবি “রাত জাগা ফুল” এর দ্বিতীয় প্রদর্শনী দিয়ে বইমেলার শেষ দিনের কার্য্যক্রম শুরু হয়! এরপরে দেখানো হয় বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবেশে সংগীতের জন্যে নিবেদিত প্রাণ কিছু মানুষের ওপর রাসেল রানার তৈরী ডকুমেন্টারী ছবি “হাউসের ধুয়া”! পরবর্তীতে ছিলো লেখক ঔপন্যাসিক জসিম মল্লিকের পরিচালনায় “নতুন বই” শীর্ষক অনুষ্ঠানে অংশ নেন মোস্তফা চৌধুরী, জিন্নাহ চৌধুরী, মেহরাব রহমান এবং সিরাজুল ইসলাম মুনির।
মেলার প্রথম দিনে মহররম ও কবি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু দিবস উপলক্ষ্যে এর পরের পর্বে কবিতা আবৃত্তি অনুষ্ঠানে নজরুলের “মহররম” এবং রবি ঠাকুরের “বর্ষ আবাহন” কবিতাদ্বয় আবৃত্তি করে শোনান দরাজ কণ্ঠের অধীকারী প্রশংসিত আবৃত্তিকার শফিক আহমেদ এবং দেবব্রত সিংহের ‘তেজ’ কবিতা আবৃত্তি করেন জ্যোতি সাত্তার। মেলার প্রথম দিনের ধারাবাহিকতায় নাচের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করে সুকন্যা নৃত্যাঙ্গনের নৃত্যশিল্পীরা।
“আলো দিয়ে যাই” শিরোনামে সংগীত ও কবিতা আলেখ্য পরিবেশনা করে টরন্টোর খ্যাতনামা বাচিক ও গানের শিল্পী ফারহানা শান্তা, ফারহানা, ইভা, মম, মেরী রাশেদীন, শাপলা শালুক, সোমা, দিলারা নাহার বাবু। এর পরপরই মঞ্চে আসেন টরন্টোর খ্যাতিমান বাচিক শিল্পীদের সমন্বয়ে গঠিত আবৃত্তির সংগঠন “বাচনিক”। মনমাতানো ও ভাবগম্ভীর ঢংয়ে অংশগ্রহণকারী সব শিল্পী তাদের নিজস্বতায় পরিবেশন করেন কবিতার ডালি।
“অভিবাসী বাঙালীর সেকাল-একাল” নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে অভিবাসী জীবনের চরাই-উৎরাই নিয়ে নিজ নিজ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন কবি আসাদ চৌধুরী, শেখ এস আহমেদ সাদী, শেলী সেনগুপ্তা। উপস্থাপনায় ছিলেন লেখক জসিম মল্লিক। এবারের বইমেলার শেষ দিনের সংগীতানুষ্ঠানের শিল্পীরা ছিলেন ফারহানা শান্ত, শিক্ষা রউফ ও শহীদ খন্দকার টুকু। সারাদিনের অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন দিলারা নাহার বাবু ও কামরান করিম।