১৬২ বার পড়া হয়েছে
হাসনাহেনা
। ফারহানা আজাদ রচনা ।
বৌ সেজে বসে আছি যে যার অপেক্ষায় সে সারা রাতেও এলো না। রাত গভীর হলে ,অপেক্ষায় আর সারা দিনের ক্লান্তিতে এক সময় ঘুমিয়ে গেলাম। নতুন জায়গা আর আতঙ্কে বার বার ঘুম ছুটে যাচ্ছিল। এক সময় সকালের আলো জানালার ফাঁক গলে ঘরে প্রবেশ করলে জেগে চোখ বুজে নিজের বর্তমান জীবন নিয়ে ভাবছি। গতরাতে যে আতঙ্ক কাজ করছিল আমার মধ্যে, তার কিছু আজ কমেছে। এই রাতটা আমাকে যে সময়টা দিল তাতে নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিতে পেরেছি। তবে যে লোক বিয়ের রাতে বাসর ঘরে অনুপস্থিত তার সম্পর্কে কোন ধারণা করতে পারছিনা। নিজেই খাটে উঠে বসলাম। ঘরের চারদিকে দিনের আলোয় একবার দেখে নিলাম। বাসার আসবাবপত্রের ধাঁচে মনে হয় আমার শ্বশুর বাড়ীর লোকজন আমাদের চাইতে ধনী তবে উচ্চবিত্ত নয়। বিয়েতে আমার মত একদমই ছিল না এমন নয়, তবে বাবার কাছে আর দুবছর সময় চেয়েছিলাম মাস্টার্সটা কমপ্লিট করার জন্য। বাবা তাতে -অসম্মতি জানিয়ে জাফরের সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেন। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় তাদের কষ্ট দিতে চাইনি ।বাসর রাতের এই অপমান বুঝি আমার সামান্য অসম্মতির অভিশাপ ।কি করবো বুঝতে পারছি না। বিছানা ছেড়ে ওয়াস রুমে গেলাম ফ্রেশ হবার জন্য। ঘরের এক পাশে আমার সুটকেসটা রাখা। হাত ব্যাগ থেকে চাবিটা বের করে সুটকেস খুললাম। মায়ের গোছানো জিনিস,সব আমার প্রয়োজনীয়।হাতের কাছে থ্রিপিস পেয়ে তুলে নিতেই ভেতর থেকে একটা চিরকুট পরলো। মায়ের হাতের লেখা। প্রথম দিন থ্রিপিস পরতে নিষেধ করছেন। কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠন। বাসায় থেকেও আমাকে কত সুন্দরভাবে বুঝতে পারে মা।কাল সারা দিন শাড়ি পরে আমি ক্লান্ত হব, মা বুঝে গিয়ে ছিলেন। শ্বশুর বাড়ীতে নতুন বৌ দেখতে পাড়া-প্রতিবেশীরা, আত্মীয় স্বজনরা আসবে। আমি যেন একটা শাড় পরি। বিসন্ন মনে শাড়ি তুলে নিলাম হাতে। গায়ের গয়না গুলো খুলে একটা জামার ওড়নার মধ্যে গুজিয়ে রেখে সুটকেগ বন্ধ করলাম। দরজাটা ভেজানো ছিল, কাপড় চেঞ্জ করার সময় বন্ধ করতে যাবো ঠিক তখনই কেউ একজন দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করল।চমকে তাকাতেই দেখি জাফর!
চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সারা রাত ঘুমায়নি। উদ্ভ্রান্ত মুখ উশখো খুশখো চুল। আর অপরাধি চোখ। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। শাড়ী নিয়ে ওয়াস রমের দিকে যাচ্ছি,
“শোন”, ডাক শুনে দাঁড়ালাম।
জাফর, আমার স্বামী । তার দিকে ফিরতেই,আমার হাত ধরে বিছানায় বসালো। চুপ চাপ বসে থাকলাম।বুঝতে পারছি সেও আমার মতো করে নিজের কথা গুলো গুছিয়ে নিচ্ছে, তাকে সময় দিলাম।
এক সময় বলে উঠলো
-আমরা আসলে খুব একটা সময় পাইনি একে অপরকে জানার। আমি বাবা-মায়ের খুব পছন্দের ছেলে নই। খুব প্রাচুর্য না হলেও স্বচ্ছলতায় বড় হয়েছি আমরা। আমার কিছু বন্ধু আছে যারা সুবিধা বঞ্চিত। তাদের সাথে থেকে তাদের সাথে মিশে আমি জীবনটাকে একটু অন্যভাবে, জেনেছি। আর সবার মতো, মানে ভাইয়া বা ছোটর মতো করে জীবনটাকে দেখিনা। সবাইকে নিয়ে ভালো থাকবার চেষ্টা করি।তুমি কি আমার কথায় বোর feel করছো?
মাথা নারিয়ে নেগেটিভ উত্তর দিলাম। সে আবার বলা শুরু করলো,
—— গতকাল অনুষ্ঠান থেকে ফিরে আসার পর রোডের মাথায় আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা, ওর মায়ের যখন তখন অবস্থা। তোমাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমি খলাম্মাকে নিয়ে হাসপাতাল গিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। রাত তিনটার তিনি মারা গেলেন। ভোরে এম্বুলেন্সে করে ওদের বাড়ী চলে গেল ওরা, আমাকে কেউ যেতে দিল না। আমিও তোমার কথা ভেবে যাইনি। প্রথম রাতটা তোমাকে অপেক্ষায় কাটাতে হল। এই রাত নিয়ে সবারই কত স্বপ্ন থাকে। তোমারও নিশ্চই ছিল, আমাকে ক্ষমা করে দিও।
আমার হাত দুটো ধরে জাফর নিজের হাতে নিয়ে নিল। কিছূই বলতে পারলাম না ওর কথার উত্তরে। শুধু কিছুটা অস্বস্তি, ফিল করছিলাম।
– আমি শাড়ীটা পাল্টে আসি। গোসল করব, বেনারসি পরে আর থাকতে পারছি না। গয়না গুলো খুলে সুটকেসে রেখেছি কোন অসুবিধা নেই তো?
আমার কথা শুনে জাফর অবাক হল। তার
কথার জবাব আশা করেছিল হয়তো,আমি
অন্য এসঙ্গ টানব বুঝতে পারে নাই।
—- না, কোন অসুবিধা নেই। তুমি চাইলে আলমারিতে রাখতে পারো। আমার উপর রাগ পুষে রেখো না। আমি একটু অন্যরকম যদি তুমি আমাকে বুঝে যাও তবে, তুমি সবচাইতে সুখি একজন মানুষ হবে,সাথে আমিও।
—-অন্যরকম মানুষের সাথে অন্যরকম বাসর করবো, এটাই স্বাভাবিক। আর রাগ হবার মতো সম্পর্ক আপনার সাথে এখনও হয়ে ওঠেনি। তাই রাগের প্রশ্নই আসে না। এটা আধুনিক যুগ। বিয়ের রাতে আপনি আমার কথা ভুলেই গেলেন। মোবাইলে একটা মেসেজ দিতে পারেন নাই। এতোটাই ফেলনা আমি?
-তোমার নাম্বার আমার কাছে নাই কথা।
—মিথ্যা কথা।আমি নিজেইতো আপনাকে নাম্বার দিয়েছিলাম, কাগজে লিখে।
—বিশ্বাস করো, মানিব্যাগে রেখেছিলাম কাগজ টা। পরে সেভ করব ভেবে। কিছু কাগজটা আর পাইনি। হারিয়ে ফেলেছি,কাল রাতে কাগজটা খুজলাম তখন পেলাম না। বাসায় জানালেও হতো কিন্তু কি জানো, আমার এমন সব কাজ বাসার সবার অপছন্দ। ফোন করলে বাসার আসার জন্য ইনসিস্ট করতো। চলে এলে আমার অনেক খারাপ লাগতো, পরে যদি শুনতাম খালা মারা গেছে। তাই কাউকে জানাইনি।
আমার থুতনিতে আঙ্গুল ছুঁয়ে মুখটা উঁচু করে তুললো জাফর, সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
—–আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখো ।এই চোখ কি মিথ্যা বলে? কি মনে হয় তোমার?
আমার চোখ থেকে ছলকে দুফোটা গড়িয়ে গেল, নিজের সাথে যুদ্ধ করে চলেছি বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দুলছে মন। জাফর ছটফট করে উঠলো,
—”হেনা, প্লিজ আমাকে বিশ্বাস করো। আমি কোন দিন তোমাকে ঠকাবো না, ধোকা দিবনা”
বলতে বলতে আমাকে একেবারে জড়িয়ে নিল। আমার সারা শরীর অবস হয়ে এলো। কিছু বলতে পারছিলাম না। চোখ বুজে এলো। জাফর আমার দুই চোখের পাতায় চুমু খেলো। আমি কেঁপে কেঁপে উঠলাম।
-তুমি কি ভয় পাচ্ছো আমার?
মাথা নিচু করে আছি, জাফর আমার হাত থেকে শাড়ী কাপড় নিয়ে একপাশে রেখে দিল।
—-বাসর রাতে বস্ত্র হরণের দায় স্বামীর, তুমি একাই শাড় চেঞ্জ করবে কেন? এসো আমি শাড়ী পরিচয়ে দেই।
জাকরের কথায় আমার কান লাল হয়ে গেল ।বললাম,
—কত মেয়েকে শাড়ী পরিয়েছেন ? যে শাড়ী পরাতে পারেন?
হাত ধরে বলে,
—”এসব কথা কানে কানে বলতে হয়। কেউ শুনলে তোমার জামাইকে খারাপ বলবে ।
আমাকে বুকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো। আমি ছুটতে চাইলে আরো জোরে চেপে ধরলো।বল্লাম,
– আমার জামাই তো খারাপই। বিয়ের রাতে যে জামাই বউ ছাড়া থাকে তাকে আমিও খারাপ বলবো।
-আমি খারাপ বলতে দিবনা।
– আমি বলবো, কানে কানে না। মাইক দিয়ে বলবো……….
নিজের ঠোঁট দিয়ে আমার ঠোঁট বন্ধ করে দিল জাফর।গত রাতটা ছিল যতটা যাতনার, আজকের দিনটা শুরু ততটাই স্মরণীয়। আমরা নিজেদের মাঝে ডুবে থাকলাম অনেক সময়। দরজায় নক হতেই আমাদের টনক নড়লো। সকাল এগারোটা বাজে “গোছল সেরে বেরিয়ে দেখি আমার চাচাতো ননদ সুরমা নাস্তা নিয়ে বসে আছে। জাফর বেলকনিতে দাঁড়িয়ে। সুরমাকে বললাম, “তোমার ভাইকে ডাকো নাস্তা করবে “
সুরমা হেসে বললো, “এসব ডাকাডকি তোমরা করো, আমাকে শুধু নাস্তা পৌঁছে দেবার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ” বলে চলে গেল দরজা ভিজিয়ে। কি বলে ডাকি? অস্বস্তি হচ্ছে লজ্জাও লাগছে ।বেলকনিতে গিয়ে বল্লাম,
-নাস্তা খাবেন না? সুরমা নাস্তা দিয়ে গেছে। চলেন খেয়ে নেই।
-না। খাবো না।
-কেন?
-আমার মন ভরে গেছে। খুব সুখ লাগছে মনে ।বলতে বলতে আমার একদম কাছে ঢলে এলো আমি পিছিয়ে যেতে নিলে কোমরে ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে নিল
-যাবে কোথায় ? এখন থেকে শুধু আমার কাছে একদম বুকের মধ্যে রাখবো।
-কাল রাত থেকে কিছু খাননি। অনেক বেলা হল। তাই জিজ্ঞেস করছিলাম খাবেন কিনা?
-আমার কিছু করতে ভাল লাগছে না। শুধু তোমাকে বুকে নিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে থাকতে দিবে?
– হুম, কিন্তু আমার ক্ষুধা পেয়েছে, চলেন কিছু খাই। তারপর…
—তারপর?
—-তারপর কিছু না। আপাতত চলেন কিছু খাবো”
—চলেন বল্লে তো যাবো না।
আমাকে ছেড়ে দিয়ে। অন্য পাশে চলে গেল জাফর। দু হাত বুকের উপর ভাঁজ করে রেখে বলে,
—সুন্দর করে ডাকলে যাবো, আর তুমি করে
বলতে হবে। “
—-সব কিছু এত দ্রুত হয় না ,হয়ে যাবে এক সময় এখন চলেন তো!
—উমহু। একদম না। আমি তোমার একমাত্র আপন স্বামী। তুমি করে না বলেল মনে হয় প্রতিবেশীর সাথে কথা বলছি।
আমি ফিক করে হেসে দিলাম। মাথায় ঘোমটা খুলে গেল, আমার চুল পিঠে পরে আছে। গোসলের পানি টপটপ করে পরছে পিঠে। পিঠ পুরোটা ভিজে গেছে।বাসায় থাকলে ড্রায়ার দিয়ে মা হালকা করে শুকিয়ে দিত। এখন একটুতেই হাঁচি শুরু হলো। জাফর খেয়াল করলো জিনিসটা। রুমে এসে আগে ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে ছিল। আমরা নাস্তা খেয়ে নিলাম, কিন্তু হাঁচি কমছে না। জাফর বললো,
-ব্লাউজটা খুলে ফেলো। ঠান্ড লেগে যাবে। আতকে উঠলাম আমি,
—-না !
-কেন? ভয় পাচ্ছো?
আমি মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে হ্যাঁ বললাম জাফর জোরে হেসে উঠলো।
– তোমাকে দেখবার অধিকার আমার আছে না?
আমি নিশ্চুপ।
—তুমি অন্য আরেকটা ব্লাউজ পরে নাও।
আমি ঘার নাড়িয়ে চলে গেলাম সুটকেস থেকে ব্লাউজ বের করবার জন্য।ওয়াস রুমের দিকে যাবার পথরোধ করে দাঁড়ালো।
—-আমার সামনেই পাল্টাও, আমার দেখতে
ইচ্ছে করছে।
—আল্লাহ কি অসভ্য আপনি?
—-আবার আপনি?যতক্ষন তুমিনা বলবে অসভ্যতামি চলবে। আমার সামনে পাল্টাতে হবে। হুম!
ব্লাউজ টা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দরজায় নক হল। জাফর দরজার দিকে তাকাতেই আমি তাড়াতাড়ি ওয়াস রুমে চলে গেলাম। ওখান থেকেই শুনলাম মেহমান এসেছে নতুন বউ দেখতে। ড্রইং রুমে যাবার জন্য বলছে সুরমা। ওয়াস রুম থেকে বের হলে সুরমা আমাকে হালকা সাজিয়ে ছিল। পুরোটা সময় জাফর একমনে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। লোকটার লাজ লজ্জা নেই। সুরমার সাথে বেরিয়ে গেলাম ঘর থেকে, ড্রসিং টেবিলের আয়নায় দেখলাম- জাফর উড়ন্ত চুমু ছুরে দিল আমার দিকে।
২
দুই ঘণ্টার বেশি আমি মেহমান বেষ্টিত হয়ে বসে তাদের নানান রকম কথা শুনছি।কেউ বলছে সুন্দর বউ পেয়েছে, জাফর। কেউ বলছে জাফর যেরকম ছেলে, এই বউ থাকবে না ওর সাথে। জাফর মানুষটার সম্পর্কে আসলে তারা কি বোঝাতে চায় আমার জিজ্ঞেস করতে মন চায়। কিন্তু নতুন বউয়ের এতো কথা বলা ঠিক না তাই চুপ চাপ শুনে যাচ্ছি। সুরমাকে ডেকে একবার বললাম জাফর কি করছে দেখে আসতে। সুরমা খবর জেনে বলল তার ভাই ঘুমাচ্ছে। থাক্ ,
বেচারা রাতভর না ঘুমিয়ে দুশ্চিন্তায় কাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে আছে। সুরমা মনে হয় আমার মনের ভাব বুঝতে পারছে। হাত ধরে আমাকে পাশের ঘরে নিয়ে গেল।
– খুব ভাবছো ভাইকে নিয়ে,
আমি লজ্জিত মুখে তাকালাম তার দিকে।
-ভেবোনা তোমার স্বামী তোমাকে তাকে নিয়ে ভাববার জন্য অনেক সময় দিবে।
— মানে সে কোথায় যাবে?
-সে কোথায় কোথায় যায় ,তার কোন হিসাব নেই।তবে সমাজ সেবা বোঝ? সে তাই করে। প্রকৃত অর্থেই তাই করে ।খাবার আর অঢেল টাকা থাকলে এমন সমাজসেবা সবাই করতে পারে।
—-সবাই পারে না। তোমার বড় ভাই,ছোটভাই তো করে না। শুধু তোমার মেঝভাই করে। তার মানে সে কিছুটা ভিন্ন ভাবে চিন্তা করে।
সুরমার মুখে অবাক ভাব। বলে,
-এক রাতেই তাকে চিনে গেছো? ঐ পাঠ তবে পড়ানো শেষ?তুমি কি ভাইয়াকে তার কথায় সায় দিয়েছো?
– আমার সম্মতির কথা এখানে আসেনি। আমি শুধু তোমার যুক্তি খন্ডন করলাম, মাত্র তো বউ হয়ে এলাম। যার বউ হলাম তাকে চিনি। এরপর না হয় তার কথার সম্মতি- অসম্মতির প্রশ্ন।
সুরমা বললো বুঝেছি,
—-ভাইয়া তোমাকে পটকে ফেলেছে ,ইনফ্যাক্ট এই পাড়ার সব মেয়েকেই পটকে ফেলেছে শুধু আমি ছাড়া।
—কেন, তুমি পটলে না কেন?
—-আর যাই হোক নেতা ফেতার বউ হবার ইচ্ছা আমার নাই। সমাজ সেবার আরেক নাম রাজনীতি। ঐ সবে আমি নাই।নিজের খাই, নিজের চরকায় তেল দেই। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার কারবার আমার ধাঁচে নাই । পছন্দ ও নয় তাই । যাই ,চাচিমা কে খবরটা দেই যে তোমার বউ তোমার মন মতো হয়নি, হয়েছে তার বরের মন মতো।
আমি তাড়াতাড়ি সুরমার হাত ধরলাম,
—এই কি হচ্ছে। তুমি সত্যি সত্যিই মায়ের কাছে এসব বলতে যাবে নাকি? আমাকে আর একটু সময় দাও, বুঝে নেই ব্যাপারটা।
—তাহলে তো খবরটা ভাইয়াকে দিতে হয়। তোমার বউ তোমাকে একটুও বিশ্বাস করে না। কি দুঃখের কথা!
আমি অবাক হলাম এই মেয়ের কথায়।আমার চেহারার অবস্থা দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পরে সুরমা। হাসতে হাসতে পেট ধরে বসে পরে চেয়ারের উপর,
—-“তুমি এতো বোকা কেন ভাবি, আমিতো ভাইকে মজা করছিলাম তোমার সাথে। মেঝ ভাইয়ার মতো ভালো মানুষ এই তলাটে আছে একটাও?চাচিমাও ভাইকে খুব ভালোবাসে।সব সময় বলে আমার ছেলেটা একটু পাগলাটে। কিন্তু এতো সুন্দর একটা মন আছে ওর। যদি মনের মতো বউ না পায়, এই ছেলেকে তো সংসারে কেউ বেঁধেও রাখতে পারবেনা। তুমি আমার ভাইটাকে খুব ভালো রেখো ভাবি, দেখবে ও তোমার জন্য জীবন দিয়ে দিবে ।পাড়ার অনেক প্রপোজাল ছিল ভাইয়ার জন্য, ভাই রাজি হলোনা। বলে এরা তো আমার বোন। এদের বিয়ে করবে কিভাবে?
কথা বলতে বলতে অনেক কিছুই জানা হল এবাড়ি সম্পর্কে। আমার শ্বশুরেরা দুইভাই।প্রথম বাড়ীটাই সুরমাদের, ওদের অবস্থা বেশি ভালো না। চাচা যে বাবসাই করে, লস – যায়। শুধু বাসা ভাড়া দিয়ে তাদের চারজনের সংসার চলে। চাচার বাড়ীটা এতো বড়ও নয় শুধু তিন তলা। আমার শ্বশুর যে বাবসায় হাত দেন তাই ফুলে ফেঁপে ওঠে। তাইতো নিজের অংশে তিনি নয় তালা দালান করেছেন। ভাড়াও পান মোটা অংকের, দুটো দোকানও আছে। কথায় কথায় আমার ঘরের সামনে চলে এলাম। সুরমা খাবার ঘরে দিয়ে যাবে বলে চলে গেলে। আর শাসিয়ে গেল এই বলে যে এই যে আমাদের খাবার দিয়ে যাচ্ছে তার জন্য তাকে পুরস্কার দিতে হবে। সুরমা সময় মতো নিজেই চেয়ে নিয়ে।
৩
ঘরে ঢুকে আস্তে করে দরজাটা আটকে দিলাম।খুব চেষ্টা করলোম যাতে করে ঘরে কোন শব্দ না হয়। বেলকনিতে একটু দাঁড়ালাম ।বসে থেকে আর মুরুব্বিদের কথা শুনে শুনে মাথাটা জ্যাম হয়ে গেছে। শুদ্ধ বাতাসে জোরে জোরে শ্বাস নিলাম। ঘরে এসে দেখি তিনি এখনও ঘুমুচ্ছেন। আমি আমার বিছানায় কোনাকোনি হয়ে শোয়াতে আমার শোবার কোন উপায় নেই। অগ্যতা খাটে হেলান দিয়ে বসে রইলাম। দুই দিন পর ধৌভত অনুষ্ঠান। তেমন বেশি কিছু করবে না শুনেছি, কিন্তু বুঝতে পারলাম না কেন।সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে জাফরের মুখে দৃষ্টি গেল।ভাবছি লোকটাকি আসলেই ছন্নছাড়া? পাগলাটে? তাহলে আমার সংসার কেমন হবে? মনের অজান্তেই মায়ায় একটা হাতে জাফরের চুলগুলোতে বুলাতে লাগলাম। ভালো লাগছিল। জাফর মুচকি হাসতেই, হাত সরিয়ে নিলাম। জাফর চোখ না মেলেই একবারে আমার কোলে মাথাদিয়ে কোমর জড়িয়ে নিল।আল্হাদের সুরে বল্লো,
-দেওনা বউ চুলে হাত বুলিয়ে। আমি ভাবছিলাম স্বপ্ন দেখছি। পরে বুঝলাম সত্যি সত্যিই আমার বউটা আমাকে আদর করছে।আমার চোখ খুলতে ইছে করছে না, প্লিজ বউ!
হাত বাড়িয়ে আবার জাফরের মাথার রাখলাম। এবার কিন্তু আমার লজ্জা লাগছিল প্রথমের মায়াটা নেই। কিন্তু ভালো আমারও লাগছিল।
—জানো বউ!
—বলেন।
—-তুমি কি এখনও আমাকে তুমি বলবেনা?
—-আমি চুপ।
হুট করে আমার কোল থেকে সরে গেল জাফর।
নিঃশব্দের হাসি হেসে আমি কাছে যাই আর জাফর আরো দূরে যায়।
-কি হলো?
-তুমি আমাকে আপন ভাবতে পারছোনা এখনও তাই না?
—-কেন এমন মনে হলো? পর ভাবলে কি ঘুমন্ত আপনার তোমার মাথায় হাত বুলাতাম।
এক ঝটকায় আমার কাছে চলে আসে জাফর।আমাকে একটু সতর্ক হবার সময় না দিয়ে আমার ঠোঁটে চুমু খেয়ে নেয়। বলে
-তাহলে এমন করে একটা চুমু খাও।
– আপনি আমার পরীক্ষা নিতে চান? তুমি আমাকে তুমি বলতে পারবে না। চুমু খেতে পারবে না। তাহলে আমাকে আপন ভাবছো
বুঝবো কি করে?সব কি এক তরফা হয়?
জাফরের ঠোট ফুলিয়ে রাগ হবার কাণ্ড আমার কি হল। আমিও ওকে ধরে টপাটপ কটা চুমু খেলাম।সে আমাকে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিল। আমি শুধু কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, —-“আমার পাগল প্রেমি। “
পুরো পাগল হয়ে গেল , আমাকে কোলে তুলে নিয়ে বেলকনিতে গেল’ আমি ওর গলা ধরে বুকে মুখ লুকালাম। দিনে দুপুরে বউকে কোলে নিয়ে বারান্দায় কেউ যায়?আস্ত পাগল একটা!
তিনটার দিকে সুরমা দুপুরের খবার দিয়ে গেল, আমরা খেয়ে নিলাম। বাসায় বসে মায়ের বকুনি ছাড়া খাবার শেষ হতো না।আমি ধীরে ধীরে খাই, জাফর খেয়াল করলো জিনিসটা।ওর অনেক গল্প আছে। যতক্ষন থাকে পাশে ভীষণ গল্প করে। খাওয়া শেষে সব একপাশে রেখে আমি শুলাম।ঘুম ঘুম লাগছে। জাফর একমনে গল্প করছে, আমি হু, হ্যাঁ করছি। হঠাৎ মনে হলো জাফর চুপ কেন? দেখি আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি তাকাতেই বললো,
—ঘুমপাচ্ছে?
—-চোখ লেগেএলো। আসলে নতুন জায়গা, গতরাতে টেনশানও হচ্ছিল খুব, তাই ভালো ঘুম হয়নি।
-গতরাতের জন সত্যিই খুব দুঃখিত। তোমার আমার জীবনের স্মৃতিময় রাত হতে পারতো, আমি পাশে থাকলেও তোমাকে ঘুমাতে দিতাম না ।-বলে হাসলো জাফর।আমার গাল লাল হলো আবার। লোকটা দুষ্টু, আছে। যেমন পাগল তেমই দুষ্টু।
জাফর আমায় খুব কাছে একদম বুকে নিয়ে শুলো, তারপর বললো,
-বউ, বাসর রাতে সবাই বউকে কত কিছু উপহার দেয়, আমারও ইচ্ছে ছিল দিব। কিছু বাবার টাকায় কিছু কিনে দেবার ইচ্ছা নাই।আমার একান্ত আমার একটা জিনিস তোমাকে দিব। এখনও ভালো করে করতে পারিনি সেটা।আমার বিশ্বাস সেটা তোমার খুব পছন্দ হবে। তুমি কি মন খারাপ করবে এখন দিতে পারিনি বলে?
– না, মন খারাপের কিছু নেই। কিছু জিনিটা কি?
—-সারপাইজ কি বলতে আছে?সময় হলে পাবে।
– এখন আমার খরাপ লাগছে, নামটা শুধু বলেন?
– তুমি এখনও আমাকে আপনি বলবে ?
—-ঠিক আছে আপনি যে দিন উপহারটা দিবেন সেদিন থেকে আমি আপনাকে তুমি করে বলবো
—-বউ! এটাতো এক একার শাস্তি।
—-গতরাতের পাওনা জিনিস এতো দেরীতে
দিবেন এটাকি তবে?তার জন্যে এই শাস্তি তো কিছুই না। গতরাতে না থাকবার জন্য শাস্তি তো এখনও বলিই নাই।
কথা বলতে বলতে কথা যেন ফুরোয় না আমাদের ।দুজন দুজনের ভালো লাগা, খারাপ লাগা জানলাম, প্রিয়-অপ্রিয় সব।
৪
আজ বউভাত অনুষ্ঠান, পার্লারে বসে সাজগোজ করছি। সুরমা সহ আরো কিছু মেয়েরা এসেছে আমার সাথে। সুরমা পার্লারের মেয়েগুলোকে বলে দিচ্ছে কিভাবে সাজাবে। খোঁপা করতে নিষেধা করে, বেনি করে পুরো বেনিতে ফুল দিয়ে সাজাতে বলল। লেহেঙ্গার সাথে বেশ মানাবে। আমারও ভালো লাগলো। সুরমা কানে কানে বললো যে তার ভাই এভাবে সাজার জন্য বলেছে।আমি হাসলাম আর ভাবছি ,আমি হাসনাহেনা এখন কারো বউ। তার মনের মতো হব, ভালো লাগছে ভাবতে। এই ভালো লাগাটা কিসব সময় থাকবে ? নাকি দিন- গেলে আস্তে আস্তে ম্লান হয়। গত রাতে খাবার টেবিলে আমার শ্বশুর রহমান সাহেব বসেছিলেন আমাদের সাথে শেষ উঠে যাবার বেলা বলেলন, একবার যেন তার ঘরে যাই। তার কিছু কথা বলার ছিল। মায়ের সাথে গিয়েছিলাম তার রুমে। ভয় পাচ্ছিলাম বেশ।হাতে মৃদু চাপ দিয়ে মা আস্বস্ত করলেন,বেশি ভয় না পেতে।তবু বুকের ধুক পুকানি যেন নিজের কানে পৌছাচ্ছিল, রহমান সাহেব শুধু নিজের অপারগতা স্বিকার করলেন ছেলেকে মানুষ করতে নাপারার জন্য। অন্য দুই ছেলে তার কথা ছাড়া কোন কাজ করে না। কিন্তু জাফর একটু জীবন নিয়ে উদাসিন।আমার উপর দায়িত্ব দিলেন জাফরকে, সঠিক পথে আনার।এটা কি করে সম্ভব তাই ভাবছিলাম। বাবা-মা যা পারেন নাই, আমি হঠাৎ এসে জাফরকে বললে সে শুনবে আমার কথা? মায়ের সাথে কথা বলতে হবে।
আমার মায়ের বাড়ির সবাই আসলো একটু দেরি করে। দুপুর পায় শেষ, অভিমান হোল খুব, আমার দুইভাই এসেই জড়িয়ে ধরলো।কেমন আছি?কেমন ছিলাম কতপশ ওদের?এই দুই দিনে একবারও কল করেনি। আমি মান করেছি বুঝে নিয়ে বলল,
—তুই নতুন জায়গাড় আছিস, এদের সাথে তোর বুঝে নিতে সময় লাগবে, সেই সময়ে আমরা কল করে তোকে বিরক্ত করতে চাইনি। তুই ভালো থাক, এর চাইতে বড় চাওয়া আমাদের আর কি আছে?
আমি কান্না করে দিলাম। এদের ছেড়ে কিভাবে আছি আমি?অনুষ্ঠান ঠিকঠাক হয়ে গেল। আজ আমি আমাদের বাসায় যাবো। জাফরেরও যাবার কথা, কিন্তু ওর কোন পাত্তা নাই। হঠাৎ করেই কিন্তু সে লাপাত্তা। শ্বাশুরী মা খুব রাগলেন। আজকের দিনটাও মানে নাই, আজকের দিনেও ছেলেটার এমন করতে হলো।আমি ব্যাপারটা হেন্ডেল করলাম। সুরমার কাছে বললাম,
—তোমার মেঝ ভাই হয়তো কোন প্রয়োজীয় কাজে গেছে। আমি আমার ফেমিলিকে বুঝিয়ে বলছি, তুমি এদিকটা সামলাও, আম্মা বোধ হয় রেগে আছেন। তোমার ভাই বাসায় এলে আমাদের বাসায় পাঠায়ে দিও।
সুরমা হাসলো। আমি আমাদের বাসার সবাইকে নিয়ে চলে গেলাম আমাদের বাসায়। রাত হয়ে গেছে জাফরের কোন খবর নেই, নিজেই কল দিলাম, নাম্বার বিজি বলছে।মেসেজ দিলাম।
“কোথায় তুমি, আমার চিন্তা হচ্ছে।”
কিছুক্ষণ পর মেসেজের রিপ্লাই এলো
“তোমাকে বলে আসতে পারিনি। একজনকে রক্ত দিতে হবে ইমার্জেন্সী তাই ঢাকা মেডিকেল চলে এসেছি। একটু রাত হবে। সামলে নিও।”
আমি লিখলাম,
“আমি আমাদের বাসায় চলে এসেছি, রাত হলেও চলে আসবেন। আমি জেগে থাকবো”
রিপ্লাই শুধু চুমুর ইমোজি। বদ লোক একটা, একা একাই আমার লজ্জা লাগলো।দরজায় নক করে মা ঘরে প্রবেশ করলো,
-কিরে। কি করিস?
-কিছুনা মা, এইতো চেঞ্জ করে একটু ফ্রেশ
হলাম।
—জামাইয়ের খবর কিরে? এলোনা এখনও, আসবে তো রাতে? এতো আয়োজন করলাম।
—-আসবে মা, তবে একটা জরুরী কাজে আটকে গেছে বলল।একটু দেরী হতে পারে। তোমরা বেশি রাত জেগো না, টেবিলে খাবার ঢাকা দিয়ে রেখো। উনি এলে আমি গরম করে দিব।
-তোর বাপ ভাই বসে আছে একসাথে খাবে বলে। যাই তবে ওদের খেয়ে নিতে বলি। হ্যাঁরে, তোর কথা বল। ও বাসায় তোর কেমন লাগছে। শ্বশুর-শ্বাশুরী জামাই কেমন? তোর সাথে ভালো ব্যাবহার করছে? আমি খুব চিন্তায় ছিলাম। তোর বাবা এমন হুট করে তোর বিয়ে দিল। জানি তোকে নিয়ে আমার টেনশান করার কিছু নেই। তবু মাতো, চিন্তা এসেই যায়।
মাকে জড়িয়ে ধরে বলি,
– এতো চিন্তার কিছু নেই ।আমাকে তুমি তোমার মতো তৈরী করেছো, সব পরিস্থিতি আমি উতরে যেতে পারি।ওবাড়ির সবাইকে আমার ভালো লেগেছে। সুরমা মেয়েটা খুব ভালো আর নির্ভর করার মতো মেয়ে। এই দুই দিনে শুধু এটুকুইবুঝছি ।
—আর জামাই?
—-তার কথা এখনই বলবো না।তাকে তো আর আগে থেকে চিনতাম না। তাই এতোটাও বুঝতে পারছি না।
—-কথা বার্তা কম বলে সে?
-না মা, তুমি যেমন ভাবছো এমন কিছু নয়। সে সারাক্ষন আমার সাথে কথা বলতে থাকে। সেরকম কোন কিছু নয়, তোমাকে বোঝাতে পারবো না মা। তবে নেগেটিভ কিছু তুমি ভেবো না। আমি নিজে, আগে বুঝে নেই তারপর তোমাকে বলবো উনার কথা।
মা কপালে একটা চুমু খেলেন। এই আদরে আমার সারা দিনের ক্লান্তি ফুশ করে উঠে গেল।
—তুই বিশ্রাম নে তাহলে খাবার দেই আমি টেবিলে।
– না মা, আমিও তোমার সাথে যাবো চলো। টেবিলে খবার বেড়ে সবাইকে ডাকতেই, হৈ হৈ করতে করতে সবাই খেতে এলো। তিনজন কাজিন আর দুই ভাই, বাবা বসলো খেতে।
—আরমান কোথায় মা?
আমি জিজেস করলাম মাকে।
ছোটন বলল, -‘তুই জানিস না আপু, আরমান ভাইতো আমেরিকা যাচ্ছে। স্কলারশীপের কাগজ কমপ্লিট। আগমী সপ্তাহে ফ্লাইট।
আরমান আমাদের বাসায় থাকে।আমার যখন পাঁচ বছর বয়স তখন থেকে সে আমাদের বাসায় আশ্রিত। কোথা থেকে এসেছে কেউ জানে না। বাড়ী নিয়ে এসে বাবা বলেছিল রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে। সেই থেকে আরমানকে বাবা আমাদের মতন আদর করেই মানুষ করে চলেছেন, আমরাও একসাথে বড় হলাম। কবে থেকে আরমান আমাকে মনে মনে ভালোবেসেছে আমি জানতে পারিনি। যখন জেনেছি, তখন বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন। ভার্সিটির এক সিনিয়র আপু হঠাৎ আমাকে ডাকলেন।
-তুমি হেনা ?
—জি, কেন বলুন তো? আমরা কি পূর্ব পরিচিত?
—না,আমি আরমানের পরিচিত। তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।
—-কি বিষয়ে? আরমান ?
—- হুম, আরমান তোমার থেকে বয়সে তোমার থেকে বড় না? তুমি ওকে ভাই ডাকো না কেন?
—- মানে কি? আপনি কি এই বিষয় কথা বলতে চান?
—-আসলে, চলো এক জায়গায় বসে কথা গুলো বলি। আমার কথাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। গুছিয়ে নিয়ে বলি।
কৌতুল নিয়ে আপুর সাথে গেলাম একটা কফি শপে। দুটো কোল্ড কফি অর্ডার করে চুপ চাপ বসে আছি। ভেতরে ভেতরে কৌতূহলে ফেটে যাচ্ছি, কিন্তু মুখে কিছুই বলছি না। আপুকে সময় দিচ্ছি। আপু বল্লেন,
– আমি মিতুল, আমি আর আরমান একসাথেই পড়াশুনা করি। ভার্সিটির প্রথম থেকেই আমার আরমানকে পছন্দ ছিল। ওর দিক থেকে কোন আগ্রহ দেখতে না পেয়ে আমি এক দিন সরাসরি ওকে বলি আমার অনুভুতির কথা, সে ভীষণ চুপ ছিল সেদিন। কিছু দিন সময় চাইল আমার কাছে। পরে তোমার কথা আরমান আমাকে বলে, বল্লো সে তোমাকে ভালোবাসে। আমি খুব আঘাত পেলেও আমার একতরফা ভালোবাসার অনুভূতি দিয়ে বুঝেছিলাম এমন হতে পারে।তোমাকে সে তার অনুভূতির কথা জানাতে পারেনি তার অবস্থানের জন্য। আরমান স্কলারশীপের জন্য এপ্লাই করেছে। হয়েও যাবে কারন আরমান অনেক মেধাবী। কিছুদিন যাবত দেখছি আরমান ভীষণ ভেঙ্গে পরেছে। জিজ্ঞাস করে জেনেছি তোমার বিয়ের কথা। তুমি কি বিয়ের জন্য রাজি?যদি সম্ভব, হয় তুমি আরমানের সাথে কথা বল, ও খুব কষ্ট পাচ্ছে। ভালোবাসার মানুষের কষ্ট দেখে মুখ ফিরিয়ে রাখা যায় না। আমাকে আরমান পাঠিয়েছে, এমনটি যেন ভেবোনা। ওর কষ্ট আমাকে কষ্টদিচ্ছে, তাই……..।
আমি কি উত্তর দিব বুঝতে পারছিলাম না, শুধু ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এসেছিলাম। ঐ ভার্সিটি তে গিয়েছিলাম কিছু কাগজ উঠাতে। বিয়ের ঝামেলায় পরে আর হয়তো সময় পাবোনা। জাফররা দেখতে আসার দুসপ্তাহ পর বিয়ের দিন ছির হল।বাসায় ফিরে আমি ছাদের চিলে কোঠার ঘরে চুপি চুপি গিয়েছিলাম। এলোমেলো ঘর, দুই একটা সিগারেটের গোড়া পরে আছে। যদিও আমি ডানতাম না আরমান সিগারেট খায়। সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ঘুরতেই আরমানের মুখোমুখি হলাম।
—তুমি?
আমি চুপ করে থাকলাম। সথে সাথে কিছু বললাম না। পরে বল্লাম,
—তুমি সাগারেট ধরলে কবে?
—-আমি খাই না, কাল এক বন্ধু এসেছিল। , ভুল করে রেখে গেছে।
—মিথ্যা বলছো কেন? নেশার জিনিস কেউ ভুলে কারো কাছে ছেরে যায় না। মিতুল আপুর সাথে আজ কথা হল, তুমি নাকি স্কলারশীপ নিয়ে আমেরিকা যাচ্ছো? বাসায় বলনিতো?
—-চাচা জানে। তার কাছে সব বলেছি
—- কি জানেন ?
—-সব জানে।
——কি বলেছো তুমি? বলেছোযে তুমি আমাকে ভালোবাসো?
চমকে তাকালো আরমান।মিতুলের কাজ এটা বুঝে জবাব দিল,
—-হুম বলেছি। দুবছর সময় চেয়েছিলাম তোমাকে বিয়ে করার জন্য। তিনি সময় দিলেন না।
– আপনি কি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন আমি আপনার ব্যাপারে রাজি কিনা?
– আমি আমার ভালোবাসার উপর ভরসা করেছিলাম। ভালোবাসা দিয়ে তোমাকে জয় করে নিবো ভেবে ছিলাম। তাছারা তুমি অন্য মেয়েদের মতো নও।চাচা যার সাথে তোমাকে বিয়ে দিবে আমি জানি তুমি তাকেই গ্রহন করবে।তাই তোমার চিন্তা আমার মাথায় ছিল
না। চাচাকেই সবার আগে বলেছিলাম তোমার কথা। দুইটা বছর শুধু সময় চেয়েছিলাম।
—-বাবা আমাকে বিয়ের কথা বলার সময় আমিও একই কথা বলেছিলাম। আমার মাস্টার্স করতে মাত্র দুইটা বছর লাগবে। দিলেন না বাবা এখন বুঝতে পারলাম এর কারন কি। বাবা হয়তো ভেবেছেন আমিও আপনার সাথে পরামর্শ করে উনাকে এই কথা বলেছি।ছিঃ !আমি কিছু না করে, কিছু না বুঝে? তাদের কাছে কত ছোট হয়ে গেলাম, শুধু মাত্র তোমার জন্য আরমান। তোমার জন্য পড়াটাও শেষ করার সুযোগটা পেলাম না। বাবা ঠিক কাজ টাই করেছে আমার বিয়ে ঠিক করে। আর মনে রেখো আমি বাবার পছন্দের মানুষকেই ভালোবাসবো মন প্রান দিয়ে আর তোমাকে ঘৃণা করবো।
আর দাঁড়ালাম না। চলে আসার জন্য ঘুরতেই বাবার সাথে ধাক্কা খেলাম। বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে নীচে নিয়ে গেলেন।আমার মনটা খারাপ থাকলো, কিছু দিন। আরমান কেন এমন করলো এটা ভেবে।ভাইয়া আর ছোটনের মতোই আরমানকেও সব সময় ভাই হিসেবে ভালোবেসেছি। নিজের মানুষ ভেবে এসেছি।ও কষ্ট পাক আমার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু এখানে আমার আর কিছুই করার ছিল না।
৫
রাত একটা বাজে আমার ফোন বেজে উঠলো। জাফর কল করেছে।
– হ্যালো!
—বউ ! তোমাদের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছি। এতো রাতে কলিং বেল বাজিয়ে সবার ঘুম ভাঙ্গাতে চাই না।
– আপনি দাঁড়ান, আমি আসছি।
বিছানা থেকে নেমে চলে গেলাম দরজার কাছে। আস্তে করে খুললাম দরজা। শব্দ শুনে মা জেগে গেলে, নিজেই উঠে আসবে সব গরম করে দেবার জন্য। আজকে নিজেই সব রান্নার ঝামেলা করেছে। তারপর আমার শ্বশুর বাড়ীর অনুষ্ঠান শেষে বাসায় এসেও সবার খাবার দেয়া, কত কাজ যে মা করতে পারে। এখন একটু বিশ্রাম করুক।জাফর ও আস্তে করে ঢুকে ফিসফিস করে বলে,
—সবাই ঘুম?
—হুম
—-চলো রুমে যাবো আগে।
আমি দরজা আটকালাম। আমার পেছন পেছন আমার রুমে এসে রুমের দরজা আটকে দিল।
—-কি হল খাবেন না?
কথা শেষ হবার আগেই আমাকে কোলে তুলে ঘুরতে লাগলো। দু পাক দিয়ে নিজেই থেমে গেল, আমার মাথা ঘুরছে। কোন ভাবে পরে যাওয়াটা আটকালাম, আমার অবস্থা দেখে তিনি হাসছেন।আমিও উনার হাসিতে হারিয়ে গেলাম।
খুব ভোরে আমাকে ঘুম থেকে উঠালেন।
– বউ ? বউ?
—হুম
—-আমার চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। সবাই ঘুমাচ্ছে ? আমি আস্তে করে বাইরে গিয়ে একটু চা খেয়ে আসি?
—কটা বাজে?
—-পাঁচটা।
—এই সকালে কোথায় পাবেন ?চা আমি বানিয়ে
আনছি।
—আরে না। তুমি এত আরাম করে ঘুমাচ্ছো, ডাকতে চাইনি কিন্তু দরজাটা আটকানোর জন্য ডাকতেই হলো।
—এই সকালে বের হবেন নাকি? আপনি ফ্রেশ হয়ে বসেন। দুকাপ চা বানাতে আমার দশ মিনিট লাগবে।
জাফর টুক করে আমার গানে চুমু দিয়ে বললো,
-“ধন্যবাদ বউ। এটাই বিয়ে করার প্রথম সুখ”
-কোনটা?’ দুষ্টুমীতে আমিও জিজ্ঞেস করলাম।
-এইযে যখন খুশি বউকে চুমু খাওয়া যায় ।যখন খুশি চা খাবার বায়না করাটা বোনাস।
—- বউ ,চুমুতে যে এত মিষ্টি লাগে বিয়ের আগে বুঝিনি।
—-বুঝলে কি হতো? মেয়েদের ধরে ধরে চুমু খেতেন?
দুষ্টু হাসি দিয়ে বল্লো,
-যাহ্, কিযে বলনা তুমি? বাসর রাতটা কিছুতেই মিস করতাম না। একটা রাত মিস হয়ে গেলনা?
— আপনি না …….কথাটা শেষ করলাম না।
চা বানিয়ে এসে দেখি বারাদায় দাঁড়িয়ে, সকালের শহর দেখছেন তিনি। চা হাতে নিয়ে
বলেলন,
—আচ্ছা হেনা। তুমি সকালের আকাশ বেশি পছন্দ করো নাকি সন্ধ্যার আকাশ?
– আমি সব সময়ই আলোর আগমনের পক্ষে। সব অন্ধকার আলোর আসায় দূরে চলে যা।। সন্ধ্যায় তো আলো হারিয়ে যায়। তাই সন্ধ্যা আমার ভালো লাগে না।সব প্রানিকুল নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য যে যার মতো গন্তব্যে ফিরে। দুই একটা নিশাচর রাতেই বের হয় তবে তা খুবই কম। তাদের আমার অস্বাভাবিক মনে হয়। আমি আলো পছন্দ করি, আধার আমার ভয় করে। তাই সকাল আমার প্রিয়। আপনার?
—-আমার দুটোই ভালো লাগে। সকালে আমার রাতের আধারের কথা মনে পরে।সন্ধ্যায় দিনের আলোকে মিস করি, দিনের শুরু আর শেষের সংযোগের সময় গুলো আকাশ কেমন রঙ্গিন সাজ সাজে বলো।আলো আধারিটা আমার উপভোগ্য বিষয়।
– হম, তাই তো আপনি এমন।
জাফর অবাক হয়ে শুধায়,
—-‘কেমন?”
– এই যে সবার থেকে ভিন্য, সবাই নিজের কথা ভাবে, আপনি সবার কথা ভাবেন ।আপনাকে আপনি এই আলো আধারির মতো অস্বচ্ছ রাখেন ।সবাই যেন আপনার সম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট ধারনা করতে না পারে।সেই চেষ্টা করেন আপনি।
—আমি তো আমার নিজেকে তোমার সামনে খোলা বইয়ের মতো রেখেছি। তুমি যেন বুঝতে পারো।
-সে ক্ষেত্রে আমি ভাগ্যবতি, তবু বুঝতে পারছি কই?
—তুমি যদি মন থেকে চাও, তবেই পারবে।
– কিন্তু, যদি, হয়তো এসবের মাঝে যে সম্পর্ক গুলো শুরু হয় তা কিন্তু সবচাইতে কঠিন।
আমার মুখটা দু হাতে তুলে নিজের দিকে নিয়ে জাফর বলে,
—আমি কি এতো কঠিন ?
—-সত্যি করে যদি বলি তবে সত্যিই আপনি অনেক কঠিন। না হলে সমাজ পৃথিবী যে মেথডে চলছে, আপনি উল্টো পথে কেন চলতে চান। আর আপনার কঠিন না হয়ে উপায় কি? কঠিন না হলে আপনার ধ্বংস তো অনিবার্য।কিন্তু তখন আমার কি হবে ভেবেছেন কখনও? আপনার লড়াই যদি হয় এই সমাজের বিরদ্ধে তখনতো আমিও সমাজ চ্যুত হবো। তাই না?
জাফর চুপ চাপ শুনছে আমার কথা, মলিন মুখটা দেখে মায়া হল। বললাম,
– আপনি একদম পাল্টে যান, আপনার ভাইদের মত নয়টা পাঁচটা অফিস করুন। এমনটা আমি চাই না, আপনি যেমন আছেন তেমনই থাকেন। এ কারন এমন আপনাকেই আমার ভালো লেগে গেছে, আমাকেই আপনি আপনার মতো বানিয়ে দেন।
এসে জড়িয়ে ধরে বুকে নিয়ে নেয়।আমিও কি এক পাওয়ার সুখে তাকে কাছে টানি ।আমি খুবই মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। তেমন করে নিজের জন্য কিছু চাওয়া পাওয়ার হিসেব করিনি। খুব অনুভূতি প্রবন মেয়ে। আমার চারপাশের মানুষ গুলোর মুখের হাসি যেমন আমাকে হাসায় ,
তাদের কষ্টগুলো আমাকে ছুঁয়ে যায়। জাফর যে খুশি হয়েছে আমার কথাগুলোতে এটা আমাকে ও আনন্দ দিয়েছে, আমার আলাদা করে সুখ খোঁজার প্রয়োজন পরে না।
৬ অধ্যায়
শ্বশুর বাড়ী চলে এসেছি চার দিন। শ্বাশুরীকে আম্মা ডাকি, তিনি নামাজ শেষে ঘুমান বলে একটু বেলা করে ওঠেন। সকালে বড় ভাবি উঠেন নাস্তা বানানোর জন্য, মাঝে মাঝে আমি তাকে সাহায্য করি টুক টাক ।এবাড়ীতে দুজন কাজের লোক আছে।বাজার করা আর বাহিরের কাজের জন্য ছালেক ভাই, আর ঘরের সাহায্যকারী নয়নতারা। সকালেই একটু বেশি ঝামেলা হয় রান্না ঘরে।বড় ভাই ফাহিমের জন্য লাঞ্চ বক্স রেডি করা, দেবর তানভিরের জন্য খাবার রেডি করা।তানভির লাঞ্চ নেয় না, অফিসের কেন্টিনে খেয়ে নেয়। আজ ওর জন্য আমি লাঞ্চ বক্স রেডি করে দিলাম। মনে হচ্ছে ভাবি এটা পছন্দ করেননি। তানভির অবাক হলেও খুশি বলেই মনে হলো। তাই দেখে বড় ভাবি বললো,
—”ওর তো আর নিজের হাজবেন্ডের জন্য সকালে কিছু করতে হয় না, তাই এত সময় পায়।দেবরের জন্য লাঞ্চ বক্স তৈর করে, আমার তো সকালে ফুরসতই মিলেনা। বাচ্চার টিফিন, বাপের লাঞ্চ বক্স সব এক হাতে। “
হেসে তানভির উত্তর দিল,
—”তোমাকে আমি কিছু বলেছি কখনও? কেন কৈফিয়ত দিচ্ছ বড় ভাবি?ছোট ভাবি করে দিল নিয়ে যাচ্ছি। না করে দিলেও কিছু হতো না। তুমি শুধু শুধু এত কথা বলছো, আর ছোট ভাবি তুমি, কষ্ট করে খাবার দেবার জন্য ধনবাদ। তোমার এই আমার জন্য ভাবনাটা আমার ভালো লেগেছে, এর পুরষ্কার তুমি সন্ধ্যায় পাবে।”
আমি কারো কথার কোন উত্তর না করে শুধু একট হাসলাম। নিজের ঘরের দিকে যাবার বেল ভাবির গম্ভির মুখ দেখে নিজেরও খারাপ লাগলো। রূমে জাফর এখনও ঘুম। সকালের এই ব্যাস্ততা, ব্যাস্ত শহর জাফরের দেখা হয়না।কি করে জাফরের দিন কাটে, আজকে তাকে জিজ্ঞেস করবো।রুমে ঢুকে বারান্দায় চলে গেলাম। সকালে ভাবির কথাগুলো ভালো লাগেনি। মনটা আঁধারে ভরে গেল যেন। এমন মুহুর্ত গুলিতে আমি একা থাকতে চাই। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রবোধ দেই। হঠাৎ পেছন থেকে জাফর এসে জড়িয়ে ধরলো।
-গুড মরনিং বউ!
-গুড মরনিং, এতো তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙ্গলো?
-হুম আজকে একটু কাজ আছে। বেরুতে হবে, নাস্তা রেডি?একটু ডায়নিংয়ে গিয়ে দেখবে?
– আপনি ফ্রেস হয়ে আসুন। আমি চা নিয়ে আসি।
– আজকে তোমার এই আপনি আপনি করাটা আমি ঘুচাবো।
—মানে? আজ কি আমি আমার উপহার পেতে
চলেছি।
—আপনি ?আরেক বার আপনি বল্লে তোমার ঠোঁট আমি সুপার গ্লু দিয়ে আটকে দিব।
—-ঠিক আছে তাই হবে, বাসায় কি সুপার গ্লু আছে নাকি দোকানে যেতে হবে? আপনি যোগার করুন আর আমি চা টা নিয়ে আসি। ‘
আমি হাসতে হাসতে বললাম।
আমাকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরে বললো,
—-যাও তো দেখি। কিভাবে যাবে?
—বাহ্, আপনিই তো বলেলেন তাড়াতাড়ি বাইরে যাবেন। নাস্তার ব্যাবস্থা দেখতে। আবার আপনি?
—যাও তোমার সাথে কথাই বলবো না।
—-সুপার গ্লুটা তাহলে আপনার ঠোঁটে লাগিয়ে নেন। হা হা হা
—-তুমি একটা কঠিন হৃদয়ের মানুষ।
-সত্যিই তাই।কঠিন হৃদয় আমার। এই হৃদযে এক বার যে ঢোকে তার বেরিয়ে যাবার কোন উপায় নেই, আমি আমার এই কঠিন হৃদয়ে আপনাকে রেখেছি। আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন আমার হৃদয়ে আপনাকে থাকতে হবে। যেতে চাইলেও পারবেন না, যেতে দিব না।
ঘোর লাগা কন্ঠে কথাগুলো বলে গেলাম আমি। ভালোবাসার কথা আমি এই প্রথম কাউকে বললাম।কন্ঠ কিছুটা কাঁপলো, হাত ঘেমে যাচ্ছিলো। জাফর আমাকে ছেড়ে দিল, আমি মুখোমুখি হলাম জাফরের। জাফর খুব গম্ভির কণ্ঠে বললো,
—ভালোবাসো?
—হুম, বাসি
—কতটা?
—- কতটা চান ?
—-সবটা?
– দিলাম।
আমার হাত মুঠি করে চুমু খেলো। জাফর আস্তে আস্তে ওয়াস রুমে চলে গেল, একটা প্রচন্ড ভালো লাগা নিয়ে রান্না ঘরের দিকে যাব তখনই আম্মার সাথে দেখা। ডাক দিলেন
– হেনাবৌমা?
– জি আম্মা
-আসবে আমার ঘরে ? কথা আছে।
– আম্মা, আপনার ছেলে বাহিরে যাবে। নাস্তা দিতে বললো। ওকে বিদায় দিয়ে আসবো নাকি এখনই আসবো?
—জাফর উঠেছে? তুমি ওকে বিদায় দিয়ে শুনে যেও।
—আচ্ছা আম্মা।
কোন দুষ্টামী না করে খুব শান্ত হয়ে জাফর নাস্তা খেলো। বাহিরে যাবার বেলা শুধু বল্লো,
-বিকেলে তৈরি থেকো, আমি তোমাকে নিতে
আসবো।
– আচ্ছা,
-জিজ্ঞেস করলেনা কোথায় নিয়ে যাবো।
-আমি, আপনার সাথে যাবো, এটা জানাই আমার জন্য যথেষ্ট।
হাত বাড়িয়ে আমার গাল স্পর্শ করলো।বেরিয়ে সিঁড়ি কাছে গিয়ে আবার পিছন ফিরে তাকালো। আমি তাকিয়েই ছিলাম, চোখের ইশারায় শুধালাম, কি?
উত্তরে জাফর শুধু মুচকি হাসলো। দরজা লাগিয়ে। আম্মার ঘরে গেলাম। আম্মা চাশতের নামাজ পরছেন, আমি গিয়ে বিছানার পাশে চেয়ারে বসলাম। নামাজ শেষে আম্মা কিছুক্ষন দোয়া পড়লেন। তারপর হাত ইশারায় কাছে ডাকলেন, কাছে গেলে মাথায় ফুঁ দিয়ে বলেলন,
– বস, আমি আসছি।
আম্মা উঠলে আমি জায়নামাজ টা ভাঁজ করলাম।
—তানভির বল্লো তুমি নাকি ওর জন্য লাঞ্চ বক্স তৈরী করে দিয়েছো। আমি খুব খুশি হয়েছি তাতে। কিন্তু বড় বৌমার কথাও শুনলাম। তাই তোমাকে ডাকলাম। লাবনীর কথায় কিছু মনে করো না তুমি। সংসারে সবাই সবার মন মতো হয় না। লাবনী কিন্তু খারাপ মনের মেয়ে না। শুধু কাজে একটু ধীর। নিজের অপারোগতা ঢাকতে রাগ দেখানোটা বেশির ভাগ মানুষের স্বভাব।তানভির খুব খুশি হয়েছে, অফিসে গিয়েই আমাকে ফোন করেছে। আমি তো ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমাই। মাঝে ফজরের নামাজ পরে আর না ঘুমিয়ে পারি না। উঠতে উঠতেও দেরী হয়ে যায়। কেন্টিনের খাবার খেয়ে খেয়ে ছেলেটা যে বিরক্ত হয়ে গেছে ,আজ ওর কথায় বুঝলাম। তুমি যদি সকালে শুধু ওর খাবারটা প্রতিদিন দাও তাহলে খুব ভালো হয়। লাবনীর কথায় তুমি লাঞ্চ বক্স দেয়া বন্ধ করে দিবে তানভির সেই ভয় পাছে। আমি বলেছি তোমার সাথে কথা বলবো। তোমার কোন অসুবিধা নেই তো? জাফর আবার কিছু বলে নাকি?
—না, মা। এমনটা ভাববেন না, উনি আমাকে কিছু বলবেন না। উনি সমাজে সবার কথা ভাবছেন আর আমি যদি ও এই সংসারের জন্য ভাবি তাতে উনার কিছু বলার থাকবে বলে মনে হয় না। আর লাবনী ভাবীর কথায় আমি কিছু মনে করিনি মা ।সবার কথা বলার ধরন এক রকম নয়। আমি বুঝতে পারি। আর একটা কথা মা, উনি আজ আমাকে তৈরী থাকতে বলেছেন। কোথায় যেন নিয়ে যাবেন। আমি যাবো মা ?
– অবশ্যই যাবে। তোমার স্বামী তোমাকে নিয়ে কোথাও যেতে চায় এটাতো ভীষন ভালো কথা।আমিতো জাকরকে বউ, সংসার এগুলোর মধ্যেই বেঁধে রাখতে চাই।কেমন ছন্নছাড়া স্বভাব হয়েছে ছেলেটার, তুমি ওকে বোঝাতে থেকো সংসারী হবার জন্য। কাজ বাজ করার প্রয়োজন হয়তো হবে না। ওর বাবার কম নেই। কিন্তু উড়ন চণ্ডি হলে এই সম্পদ ধরে রাখতেও তো সে পারবে না।
— আমি খুব চেষ্টা করব মা
আম্মা আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলেন। আমি হেনা, বাবা-মায়ের অতান্ত বাধগত সন্তান।আমার নিজের কাছে মনে হয় বাবা-মায়েরা কখনও সন্তানের খারাপ চান না। আমি মাস্টার্সটা পড়তে পারিনি বলে বাবার উপর কিছুটা রাগ মনে মনে পুষেছিলাম। কিন্তু যত সময় যাচ্ছে সেই রাগ মিলিয়ে যাচ্ছে। আমার বিবাহিত জীবন হয়তো বাবা মায়ের দোয়াতেই এতো শান্ত যাচ্ছে। সবার জীবন কেমন যায় সেটা আমার ভাবার বিষয় নয়।আমি আমার জীবন নিয়ে বর্তমানে ভালো আছি।ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ কেউ চিন্তিত হলেও, আমার আপাতত চিন্তার কিছু নেই, জাকরকে নিয়ে ভাববার থাকলেও আপাতত তাকে ভালো মতো বুঝবার চেষ্টা করছি।ভালো লাগা কাজ করছে আমার মধ্যে। ঘরে বসে গুন গুন করছি ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে
৭ অধ্যায়
দুপুরে খাওয়ার পর আমার আবার ঘুমের অভ্যাস নেই, আজ কেন জানি চোখ খুলে রাখতে পারছিনা। দুচোখ ভেঙ্গে যেন ঘুম আসছে। কখন ঘুমিয়েছি মনে নেই। মা এসে বাবার নামে এতো এতো নালিশ করলো! তুই আসার পর কোন কথা শুনে না। খালি অনিয়ম করে। সকালের খাবার বেলা করে খায়। আর দুপুরের খাবার খায় সন্ধ্যায়। আমি আর পারছি না। কাল থেকে প্রেশার এতো বেড়েছে। তুই কিছু বল, আমার কথা শুনছে না।’ মা নাকি সুরে কান্না করছে। বাবার কথা শুনে আমারও খারাপ লাগছে, আর মায়ের কান্না দেখে আমিও কাঁদছি।
—-হেনা। এই হেনা, বউ তুমি কাঁদছো কেন?
কারো ডাকে চোখ খুলে দেখি জাফর ডাকছে আমায়। তার মানে এতো সময় স্বপ্ন দেখছিলাম। তবু মন টা খারাপ হল, জাফরকে ধরে কাঁদতে লাগলাম। জাফর কিছু না বলে আমায় বুকে করে রাখলো ।কিছু পরে নিজেই শান্ত হলাম। জাফরের বুক থেকে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করি,
-কখন এসেছো?
– এই তো কিছুক্ষন। ঘরে ঢুকে দেখি তুমি কাঁদছো।ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কার জন্য এই কান্না? স্বপ্নে এসে কে আমার এমন বউটাকে কাঁদালো?মুচকি হেসে বলে,
-বাবা অসুস্থ্য ছিল স্বপ্নে। মা খুব কাঁদছিল, তাই আমারও কান্না চলে এলো।
– বাবা-মাকে খুব মনে পরছে তাই না, যাবে নাকি ওখানে? যেতে পারো তবে এবার কিন্তু আমি যেতে পারবো না। আর তোমাকে ছাড়া থাকতেও পারবোনা, জীবনেও এমন দোটানায় ছিলাম না কখনও কি করি বলতো?
-কিছু করতে হবে না আপনাকে, আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমার একটা জামাই আছে। একটা সংসার আছে। আমার অনেক দায়িত্ব আমি জানি। আচ্ছা আমরা যেনো এখন কোথায় যাবো?
আমার কথার ঢংয়ে জাফর হো হো করে হাসলো। কোলে করে মিশে গেল ,জড়িয়ে ধরে দুষ্টুমী করলো কিছুক্ষন । তারপর বল্লো,
—দ্রুত তৈরি হও, বেরুবো আমরা।
একটা হালকা গোলাপি টাঙ্গালের শাড়ী পরে নিলাম। ছাই কালার পারের সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ। ছোট টিপ আর দু হাতে কাঁচের চুড়ি পরলাম। নো মেকাপ লুক নিলাম। চুল খোলা রেখে ঠোঁটে ভেজলিন মেখে নিলাম। জাফর বললো,
—শেষ ?
—-হুম।
—-তাইলে যে সবাই বলে মেয়েদের রেডি হতে অনেক সময় লাগে?
—-লাগেই তো, আমি একটু অন্যরকম। সব মেয়েদের মতো মেকাপে ডুবে থাকতে ভালো লাগে না। আপনি যেমন সবার থেকে আলাদা,আমিও। আপনি আর আমি সবার থেকে আলাদাই থাকব কি বলেন?
—-একশো বার। ‘হেসে জবাব দিলো। কাছে এসে কপালে চুমু দিয়ে বললো,
-খুব স্নিগ্ধ লাগছে। তোমাকে যার সাথে মানায় আজ তার কাছে নিয়ে যাবো।
-মানে?
– চলো, গেলেই বুঝবে।
একটা রিক্সা নিলাম আমরা। পাশাপাশি বসে আমাকে এভাবে ধরে রাখলো যেন ধরে না রাখলে আমি বসতে পারবো না, পরে যাবো। আমি উনার পাগলামীতে মনে মনে হাসলাম। বিকেলটা খুব সুন্দর। হঠাৎ আমার মোবাইলে কল এলো। নাম্বার চিনি না, তবুও ধরলাম।
-হ্যালো।
– হেনা, আমি আরমান।
আমি চুপ করে কানে থেকে মোবাইলটা রাখতে যাবো আরমান বলে উঠলো ,
– ফোনটা কেটে দিও না। শেষ বিদায়ের জন্য ফল করেছি। আজ রাতে আমি চলে যাচ্ছি। তোমার তো আমাকে নিয়ে সমস্যা। আমি আর থাকছি না। এখন যখন খুশি তখন চাচার বাসায় যেতে পারবে। আমার বিরুদ্ধে তোমার সকল অভিযোগ মাথা পেতে নিলাম। পারলে ক্ষমা করে দিও।তোমার হাজবেন্ড কাছে থাকলে দাও কথা বলে বিদায় নেই।
মোবাইলটা জাফরের দিকে এগিয়ে দিলাম।অবাক চোখে আমাকে দেখছিল জাফর।হাত বাড়িয়ে মোবাইল নিয়ে কানে ধরলো,
-হ্যালো?
—আসসালামু আলাইকুম। ভাই ভালো আছেন?
—হ্যাঁ, হ্যাঁ আলহামদু লিল্লাহ ভালো।আপনি আমাকে আপনি বলছেন কেন? আপনি হেনার বড় ভাই, আমাকে তুমি করে বলবেন। কেমন আছেন আপনি?
—-বেশি ভালো নেই, আজ আমেরিকায় চলে যাচ্ছি রাতের ফ্লাইটে। সবাইকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। সব চাইতে কষ্ট হচ্ছে হেনার জন্য। আমরা তিন ভাইয়ের এতো আদরের বোন। তুমি ওকে ভালো রেখো ভাই, আমার আর কিছু চাওয়ার নাই।
—ভাই আমি তো জানি না আপনার যাবার কথা তাহলে হেনাকে নিয়ে আসতাম আপনার ওখানে।
_________________________
লেখক পরিচিতি:
আমি ফারহানা আজাদ রচনা, ১৯৭৩ সালের ১৫ই জুলাই কুমিল্লায় জন্ম । বাবা আবুল কালাম আজাদ, তাঁর চাকুরি সুবাদে ঢাকায় বসবাস এবং পড়াশোনা। মা মর্জিনা আজাদ গৃহিনী। লেখালেখির জগতে নতুন। কিছু প্রকাশনী থেকে যৌথ কবিতার বই বেরিয়েছে। ম্যগাজিনে ছোট গল্প লিখে গল্পের হাতে খড়ি।