দুই শতাধিক বছর আগের এই ‘দানবীর’ সম্পর্কে যা জানা যায় বাঙ্গালি মুসলমানই শুধু নয়, এই অঞ্চলের শিক্ষা ও সামাজিক, দাতব্য কর্মকাণ্ডে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি- সেই তালিকায় শীর্ষে থাকা একটি নাম হাজী মুহাম্মদ মহসিন।
নিজের সকল সম্পত্তি দান করা, শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারে ব্যয় করার জন্য এই অঞ্চলে ‘দানবীর’ হিসাবে খ্যাতি পেয়েছেন হাজী মুহাম্মদ মহসিন।
অকৃতদার, অবৈষয়িক মহসিন তার জীবনে বহু দেশ ঘুরেছেন। জীবন সম্পর্কে তার গড়ে উঠেছিল আলাদা ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি।
ফলে তিনি যখন বোনের কাছ থেকে বিপুল সম্পত্তির মালিক হলেন, কয়েক বছরের মধ্যে সেগুলোর দানপত্র লিখে দিয়ে কোরান শরীফ কপি করে বাকি জীবন কাটিয়েছেন।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক মুহম্মদ মহসিন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”আইনি জটিলতা কাটিয়ে ওঠার পর এই ফান্ডের তহবিল তখনকার সরকার বাঙ্গালির, বিশেষ করে বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলের মানুষের শিক্ষার কাজে ব্যয় করতে শুরু করে। তাতে আমাদের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বড় রকমের শিক্ষার একটি রেনেসাঁ শুরু হয়-বিশেষ করে অবহেলিত মুসলিম সমাজের জন্য।”
”যদিও মহসিনের নামটা সেভাবে উচ্চারিত হয় না। কিন্তু মূলত তার অবদানেরই মুসলমানদের লেখাপড়ার প্রতি যে আগ্রহটা, সেটার একটা বড় অবদান হচ্ছে মহসিনের সেই তহবিলের,” তিনি বলছেন।
ইরান থেকে বাঙ্গাল মুলুকে
হাজী মুহাম্মদ মহসিনের জন্ম হয়েছিল ১৭৩২ সালের পহেলা অগাস্ট, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের হুগলিতে। তবে হুগলির ইমামবাড়ার তথ্য অনুযায়ী, তার জন্মসাল ১৭৩০।
তিনি অবশ্য তখনো হাজী হয়ে ওঠেননি, হজ করার কারণে সেই পদবি পেয়েছেন আরও প্রায় ২৮ বছর পরে।
তার পরিবারের পূর্বপুরুষরা পারস্য বা ইরান থেকে ভারতবর্ষে এসেছিলেন।
হাজী মোহাম্মদ মহসিনের দানের ইতিহাস জানতে হলে জানতে হলে ফিরে যেতে হবে সতেরোশ শতকের গোড়ার দিকে।
‘দি মহসিন এনডাউমেন্ট অ্যান্ড দ্যা প্রোসেস অফ এডুকেশন ইন কলোনিয়াল বেঙ্গল’ গ্রন্থে কলকাতার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমজাদ হোসেন লিখেছেন, সতেরোশো শতকের মাঝামাঝি মহসিনের পিতামহ আগা ফজলুল্লাহ তার তার তরুণ পুত্র ফয়জুল্লাহকে নিয়ে ইরান থেকে বাণিজ্য করতে এসে মুর্শিদাবাদে বসবাস করতে শুরু করেন।
কিছুদিন পরে তিনি হুগলির বাণিজ্যিক গুরুত্ব বুঝতে পেরে ছেলেকে মুর্শিদাবাদের দায়িত্ব দিয়ে হুগলিতে চলে আসেন। ব্যবসা বেড়ে যাওয়ায় তিনি পরবর্তীতে ছেলেকেও হুগলিতে নিয়ে আসেন।
প্রায় একই সময় দিল্লির মুঘল দরবার থেকে হুগলিতে আসেন আগা মুহাম্মদ মোতাহার। তিনিও পারস্য থেকে এসেছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে ইতিহাসের বইগুলোতে। হাজী ফয়জুল্লাহ তার বোনের ছেলে ছিল বলে একাধিক বইতে উল্লেখ করা হয়েছে।
অধ্যাপক আমজাদ হোসেন লিখেছেন, বাদশাহ আওরঙ্গজেব তার বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতায় খুশি হয়ে তাকে এই অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। সেই সময় তাকে জমিদারিও দেয়া হয়।
রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি লবণ ব্যবসার মতো নানা খাতে বিনিয়োগ করে অনেক সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন আগা মোতাহার।
তার তিনজন স্ত্রী থাকলেও কোন পুত্র সন্তান ছিল না। আগা মোতাহার যখন মারা যান, তখন তার স্ত্রী জয়নাব খাতুনের গর্ভে জন্ম নেয়া সাতবছর বয়সী একটি মেয়ে ছিল, মরিয়ম খাতুন ওরফে মুন্নুজান। আগা মোতাহার তার সমস্ত সম্পত্তি মেয়ের নামে দিয়ে যান।
আগা মোতাহার মারা যাওয়ার পর জয়নাব খাতুনকে বিয়ে করেন হাজী ফয়জুল্লাহ। সেই ঘরেই জন্ম হয় মুহম্মদ মহসিনের।
বড় বোনের হাত ধরে ছোট ভাইয়ের দাতব্য কর্মকাণ্ড শুরু
পিতা আলাদা হলেও সাতবছরের ছোট ভাইয়ের প্রতি মুন্নুজানের ভালোবাসা ছিল অনেক বেশি। তারা দুজন একই বাড়িতে বড় হয়ে ওঠেন।
আগা মোতাহার ও হাজী ফয়জুল্লাহ- উভয়েই অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন এবং অনেক দানখয়রাত করতেন। জাকাতের পাশাপাশি তারা নানারকম দাতব্য কর্মে ব্যয় করতেন।
ফলে মরিয়ম ওরফে মুন্নুজান এবং মহসিন- উভয়েই পরিবারের ধর্মীয় ও দাতব্য কর্মকাণ্ড দেখতে দেখতে বড় হন।
অধ্যাপক আমজাদ হোসেন লিখেছেন, সেই সময়ের রীতিনীতি অনুযায়ী, উভয়েই বাড়িতে থেকে শিক্ষকের কাছে পড়াশোনা শিখতে শুরু করেন। তাদের একজন শিক্ষক ছিলেন ইরান থেকে আসা আগা সিরাজি- যিনি ইসলামি শিক্ষার পাশাপাশি নানা দেশ ভ্রমণের কারণে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন। ধারণা করা হয়, মুন্নুজান ও মহসিনের ওপর তার উদার দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব পড়েছিল।
ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার পাশাপাশি কুস্তি, তরবারি লড়াই এবং অন্যান্য খেলাধুলা করতেন মুহাম্মদ মহসিন। তারা দুই ভাইবোন সঙ্গীতের শিক্ষাও পেয়েছিলেন, সেতার বাজাতেন এবং গজল গাইতেন।
হুগলির পড়াশোনা শেষ করে মাদ্রাসায় উচ্চশিক্ষার জন্য মহসিনকে মুর্শিদাবাদে পাঠানো হয়। সেখানে পড়াশোনা শেষ করার পর ভারত ভ্রমণে বের হন তরুণ মহসিন।
মহসিন যখন ভারত ভ্রমণে গিয়েছেন, তখন বিপুল সম্পত্তি গ্রাস করার উদ্দেশ্যে অনেকেই তার বোন মুন্নুজানকে বিয়ে করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন। সেই সময় তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল বলেও ধারণা করা হয়। খুব তাড়াতাড়ি মুন্নুজান মির্জা সালেহ অথবা সালেহ-উদ-দিনকে বিয়ে করেন। তিনিও ছিলেন একজন জমিদার এবং অনেক ধনসম্পত্তির মালিক।
এই দম্পতির কোন সন্তান ছিল না। তাদের জমিদারির আয়ের বেশিরভাগ অংশই তারা দাতব্য কাজে ব্যয় করতেন।
১৭৬৩ সালে সালেহ-উদ-দিন মারা যাওয়ার পরে মু্ন্নুজান তার দাতব্য কর্মকাণ্ড আরও বাড়িয়ে দেন।
অধ্যাপক আমজাদ হোসেন লিখেছেন, তার যেহেতু কোন সন্তান ছিল না, তিনি প্রজাদেরই সন্তান বলে মনে করতেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুদান, মসজিদ তৈরি, কুয়া ও বিশাল পুকুর খনন, রাস্তাঘাট ও বাজার তৈরি করতে শুরু করেন।
তিনি চেয়েছিলেন, তার মৃত্যুর পরেও যেন এসব কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকে। তার বিশ্বাস জন্মে, এজন্য একমাত্র তার ভাই মুহাম্মদ মহসিনের ওপর নির্ভর করা যায়। হুগলিতে ফিরে এসে বিষয় সম্পত্তির দায়িত্ব নেয়ার জন্য তিনি ভাইকে চিঠি লিখে পাঠান।
ধারণা করা হয়, বোনের এসব দাতব্য কর্মকাণ্ড মুহাম্মদ মহসিনকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে হাজী মহসিনের ফিরে আসা
অধ্যাপক আমজাদ হোসেনের বই পড়ে জানা যাচ্ছে, বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে কিছুটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠা মহসিনের সংসার জীবনে প্রবেশ করার কোন ইচ্ছাই ছিল না। তবে তিনি ফিরে এসে সত্তরের দুর্ভিক্ষে মানুষজনকে সহায়তা করতে শুরু করেন। সেই সময় তিনি ‘জনতার রান্নাঘর’ চালু করেছিলেন।
দুর্ভিক্ষ কেটে যাওয়ার পর হজের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েন মুহম্মদ মহসিন। ধর্মীয় স্কলারদের সাথে তিনি মক্কা, মদিনা, কারবালা, নাজাফ ভ্রমণ করেন। এরপর মিশরে যান, সেখান থেকে তুরস্কে।
তারপর যান তার পূর্বপুরুষদের দেশ ইরানে। ভারতে ফিরে এসে অনেক বছর তিনি লক্ষ্মৌতে কাটান।
প্রায় ২৮ বছর পরে আবার হুগলিতে ফিরে আসেন হাজী মুহম্মদ মহসিন। এতদিন ধরে অবশ্য তার বোন মুন্নুজান অনেক চিঠি পাঠিয়েছেন তাকে ফিরে আসার জন্য।
নানা দেশ ভ্রমণ করে আসা হাজী মুহাম্মদ মহসিনের ব্যক্তিগত চাহিদা তেমন ছিল না। ফলে জমিদারির বিপুল আয়কে তিনি আল্লাহর দান মেনে নিয়ে সামাজিক ও জনগণের কাজে ব্যয় করতে শুরু করেন।
”১৭৫৭ সালে ব্রিটিশদের কাছে স্বাধীনতা চলে যাওয়ার পর একটি স্বাধীন জাতি যেভাবে ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছে নিগৃহীত হয়েছে, তার পেছনে জাতীয়তাবোধ না থাকা, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর স্পৃহা তৈরি না হওয়ার পেছনে অশিক্ষাই প্রধান বিষয় বলে তার কাছে মনে হয়েছিল। এই জন্য তিনি দানে চেয়েছিলেন যেন শিক্ষার পেছনেই বেশি ব্যয় হয়।” বলছেন গবেষক ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মহসিন।
মুন্নুজান তার সমস্ত সম্পত্তি হাজী মুহাম্মদ মহসিনের নামে লিখে দেন। তার মৃত্যু হয় ১৮০৩ সালে। সেই সময় হাজী মহসিনের বয়স প্রায় ৭০ বছর।
অধ্যাপক আমজাদ হোসেন লিখেছেন, হাজী মুহাম্মদ মহসিনের নিশ্চয়ই চিন্তা এসেছিল যে, তার মৃত্যুর পরে এই বিপুল সম্পত্তির কি হবে? তাই ১৮০৬ সালে তিনি পুরো সম্পত্তির ওয়াকফ করে দেন। সেখানে এই সম্পত্তির আয় কীভাবে বিলি বণ্টন করা হবে, তার বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়া হয়।
সেখানে বলা হয়, ধর্মীয় স্থাপনার পাশাপাশি শিক্ষা, জনকল্যাণে এসব অর্থ ব্যয় করা হবে।
হাজী মুহাম্মদ মহসিন মারা যান এর ছয় বছর পরে, ১৮১২ সালে। কিন্তু এই ছয় বছরে দান করা সম্পত্তি থেকে তিনি এক টাকাও গ্রহণ করেননি। তার চমৎকার হাতের লেখায় কোরান শরিফ কপি করে তিনি নিজের ব্যক্তিগত খরচ চালিয়েছেন। হুগলি ইমামবাড়ায় এখনো এইরকম একটি কপি সংরক্ষিত রয়েছে।
শিক্ষায় হাজী মহসিনের অবদান
মুন্নুজান অথবা হাজী মুহাম্মদ মহসিনের দান করা সম্পত্তির পরিচালনা নিয়ে পরবর্তীতে কিছু মামলা-মোকদ্দমার তৈরি হয়। যাদের পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। অবশেষ ১৮৩৪ সাল নাগাদ এই তহবিল ব্যবহারের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয় তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকেরা।
সেই সময় এই তহবিলের আকার ছিল পাঁচ শতাংশ সুদে সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করা আট লাখ আটানব্বই হাজার চারশো রুপি এবং নগদ পাঁচ হাজার দুইশ ৪৩ রুপি। সরকারি বন্ড থেকে বছরের আয় ছিল ৪৪ হাজার ৩৯৪ রুপি।
১৮৩৫ সালে এই তহবিল দিয়ে ‘মহসিন এডুকেশনাল এনডাউমেন্ট ফান্ড’ তৈরি করে ব্রিটিশ সরকার।
হাজী মোহাম্মদ মহসিন যেভাবে দানপত্র লিখেছিলেন, তাতে কিছু পরিবর্তন এনে ব্রিটিশরা দুইটি আলাদা তহবিল গঠন করে। তার একটিতে হাজী মহসিনের ইচ্ছা অনুযায়ী ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে ব্যয় যেমন ইমামবাড়ার খরচ, পেনশন প্রদান ও মোতোয়ালির বেতন ইত্যাদি খাতে ব্যয় হবে। সাধারণ ফান্ড নামের আরেকটি ফান্ড থেকে শিক্ষার পেছনে ব্যয় হবে।
পরবর্তীতে এই তহবিল থেকে ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হুগলি মহসিন কলেজ। এরপরে হুগলি কলেজিয়েট স্কুল, হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুল, হুগলি মাদ্রাসা, সিতাপুর মাদ্রাসা, ঢাকা চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।
এই তহবিল থেকে একটি শিক্ষাবৃত্তিও চালু করা হয়, যা মেধাবী কিন্তু দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য আজও সহায়তা দিয়ে আসছে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ মহসিন বলছেন, ”নবাব আব্দুল লতিফ, খাজা আব্দুল গনি, তাদের চেষ্টায় ১৮৭৩ সালে এই ফান্ড থেকে স্কলারশিপ চালু করা হয়। শুধু এটাই না, তখনকার স্কুলগুলোয় একজন আরবি শিক্ষকসহ বিশেষ করে মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষার ব্যাপারে এই ফান্ড থেকে সহযোগিতা আসতো। ”
”তবে ওনার অর্থে প্রথম যে কলেজটি শুরু হয়, হুগলি মহসিন কলেজ- সেখানে কিন্তু সবাই পড়তে পারতেন। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গুরুদেব মুখোপাধ্যায়, দিজেন্দ্রনাল রায়, অক্ষয় চন্দ্র সরকার, স্যার উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়- এরকম বিখ্যাত বাঙ্গালিরা এই কলেজ থেকে পড়াশোনা করেছেন। তাদের সবার অবদান সম্পর্কে আমরা জানি।”