ধারাবাহিক:
মীরসাহেবের সরাই
সেলিম ইসলাম খান
পর্বঃ এক
গোধূলির লগ্নে বালির ধোঁয়া তৈরি করে দুটি ঘোড়ার গাড়ি ধুৃমের গঞ্জে এসে থামল। তাদের আগমনে গঞ্জের বটতলায় হৈ চৈ পড়ে গেল। উতসুক মানুষজন ছুটে এল বটতলার দিকে। তাদের চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি।
ততক্ষণে সামনের গাড়ি থেকে নেমে এলেন এক তরুণ নওজোয়ান। তার ঝাকড়া চুল আর শশ্মুমন্ডিত চেহারা দেখে উপস্থিত সকলে মাথা ঝুঁকিয়ে তাকে সম্মান জানাল। বোঝা গেল, এই তরুণ বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।
এমন সময় গঞ্জের সরাইখানার দিক থেকে ছুটে এলেন লম্বা আলখাল্লা পরা এক পৌঢ়। তিনি উর্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে ভিড় ঠেলে বটতলায় এসে হাজির হলেন। তারপর “মহামান্য ছোট খান সাহেবের আগমনে আজ ধন্য হল ধুমঘাট” বলতে বলতে তিনি তার সামনে এসে কিঞ্চিৎ মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম দিলেন। তারপর বেশ তাজিমের সঙ্গে তাকে সরাই খানার দিকে আহ্বান করলেন।
ছোট খান সাহেবের নাম ছুটিখান। তিনি চিতাগাং থেকে পানুয়াঘাট পর্যন্ত বিশাল এই রাজ্যের যুবরাজ। সরাইখানার তত্ত্বাবধায়ক এই লম্বা আলখাল্লা পরিহিত পাঠান পৌঢ় তারই অধীনস্থ একজন কর্মকর্তা।
তিনি যুররাজ ছুটিখান সাহেবকে বেশ তাজিমের সঙ্গে সরাইখানার সবচেয়ে শানশওকতপূর্ণ কক্ষে নিয়ে গিয়ে গদির উপর বসালেন। তারপর এক কর্মচারীকে ইশারা দিতেই মাটির গ্লাসে ডাবের পানি আর পুয়া পিঠায় পূর্ণ মাটির একটি সানকি সামনে পরিবেশন করল।
ছুটিখান সাহেব বললেন, আকরাম চাচা আপনি এত তাড়াতাড়ি ব্যস্ত হবেন না। আপনার ব্যস্ততাগুলো জমিয়ে রাখুন সুলতানপুত্র নসরত শাহ শিগগির ঘাটে এসে পৌঁছবেন। তাঁর মেহমানদারির যেন কোন কমতি নাহয় আপনি তা খেয়াল রাখবেন।
– জি সাহাব। আমি সকলই এন্তেজাম করেছি। মহামান্য সুলতান তনয়ের খেদমতের কোন ত্রুটি হবে না।
– তা সত্ত্বেও আমি নিজ চোখে সব দেখব আকরাম চাচা। সেই গৌড় থেকে সোনারগাঁ, সেখান থেকে মেহেরকুনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এই ধুমঘাট। ছোট সুলতানের যাত্রাপথ বেশ দীর্ঘ চাচা। সাথে আছে জনা পঞ্চাশ লস্কর।
– সাহাব, শুনেছি ছোট সুলতানচিতাগাঙ যাবেন লস্কর নিয়ে, মগেরা নাকি আবারও ঘাটে হামলা করেছে।
-জি আকরাম চাচা। উনার সাথে আমিও যাব, সেজন্য জোয়ারগন্জে একশত লস্কর তৈরি করেছি। সীতাকুন্ডের পন্চাশ, কুমিরার একশত আর চৈতাগাঙের দুইশো মিলে আমাদের পাঁচশো লস্কর হার্মাদদের হাজার লস্করের বিরুদ্ধে যথেষ্ট নয় কি চাচা?
– যথেষ্ট সাহাব। যুদ্ধে বিজয় সংখ্যা দিয়ে হয় না, জয়লাভ হয় কৌশল আর মনোবল দিয়ে।
– আপনি ঠিকই বলেছেন চাচা। যৌবনকালে আপনিও বাবার সাথে হার্মাদদের বিরুদ্ধে লড়েছেন, হার্মাদদের কতো সাম্পান আপনি মাঝদরিয়ায় ঢুবিয়ে দিয়েছেন তার গল্প ছোটকাল থেকেই বাবার কাছে শুনে আসছি। আপনি বেশ সাহসী ছিলেন।
ছুটিখানের কথা শুনে বয়োবৃদ্ধ আকরাম খানের চোখের কোণে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আহা বড় সাহাব কত দয়ালু মানুষ। মানুষকে নিজের মনের কন্দরে এভাবে কোন সুলতান কি ধারণ করতে পারেন? একমাত্র পরাগল খান সাহাবই তা পারেন। আহা! তার সাথে হার্মাদ তাড়ানোর দিনগুলো কতই না মধুর ছিল। তিনি কোন লস্করকেই একা ছেড়ে দিতেন না। তার রণকৌশল কোনদিন ব্যর্থ হয়নি।
ছুটি খানের কথায় আকরাম খান সম্বিত ফিরে পেলেন।
– চাচা! চাচা! বুঝেছি আপনি অতীত স্মৃতিতে চলে গেছেন। কিন্তু সে সব গল্প আপনার কাছ থেকে পরে শুনব। আগে যুবরাজের আগমনের এন্তেজাম দেখি। ঠিকঠাক না হলে আমাদের মান যাবে চাচা।ছোট সুলতান নসরত শাহ যখন বজরা থেকে ধুমঘাটে নামলেন, তখন চারদিকে গভীর অন্ধকার নেমেছে। কেবল আকাশে দুএকটি তারা উঁকি দিচ্ছে। সরাই খানার মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুরু হয়েছে।
১ Comment
good; congratulations.