আঁধারের গালিচা পাতা রাত
সেলিনা আখতার।
আঁধারের গালিচা পাতা রাত
দুর্গম দাম্ভিকতা নিয়ে
দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপ।
জানালার শিকের মত আমি
নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে
গুনে চলেছি নিয়তির ঘন্টা।
টিকটিক করে এগিয়ে আসছে
আগামীর আর্তনাদ!
এইডসের মতো ভয়ার্ত করে দিচ্ছে
জীবনের পথ চলা। আর আমি
নুইয়ে পড়া নিয়তির সাথে
ভঙ্গুর মনটাকে বেঁধে
পেরিয়ে চলেছি সহস্র শোক ।
বাস্তবতার করিডর ভেঙে
প্রতিমুর্তির মতো চেয়ে আছি
আজীবন হারিয়ে চলা পথে।
কি বিশাল শূন্যতা !!
শুধু আপনেরই ছাড়াছাড়ি
বাবা নেই!!
স্নেহের জনক নানা নেই!!
নানি ও রেখে গেলেন সমস্ত স্মৃতি।
মুঠোই ধরা শক্ত হাত
খসে পড়ছে একটার পর একটা।
কেউ থাকবে না!!
আঁধারের গালিচা পাতা রাত
মৃত্যু হয়ে তুলে নেবে সব
পরাস্ত পৃথিবীতে
অলিক স্নেহের ছায়ায়
পথ চলতে হবে আমাকে ।
সম্ভ্রান্ত হৃদয় বিধ্বস্ত প্রায়
জীবন মেলা সাঙ্গ করে
বিধাতার উইল
ফিরিয়ে দিতে হবে তাকে ।
চিতায় বেঁকে ওঠা মানুষের মতো
নির্মম কষ্টে টানটান হয়ে পড়ে
হৃদয়ের লাশটি ।
সংগ্রামমুখর জীবন থেমে যায়
ক্ষণিকের স্তব্ধতায়
নিলিপ্ত জীবনের আনাচে কানাচে
ছেঁয়ে যায় শুধু
আঁধারের গালিচা পাতা রাত।
রোদহীন দুপুর
সেলিনা আখতার
রোদহীন দুপুর, মেঘাচ্ছন্ন আকাশ
সারা দিন টুপটাপ বৃষ্টি,
ছুঁয়ে আছে অরন্যকে।
গাছের পাতাগুলো জীবনের
সতেজ হাওয়ায় দুলছে।
অনাহারী পাখি জুবুথুবু বৈরী হাওয়ায়।
প্রতীক্ষারক্ষণ গুনছে
আকাশের মন ভালো হবার।
রোদহীন দুপুর, মেঘাচ্ছন্ন আকাশ।
নির্বুদ্ধিতার দুয়ার খুলে নিশীথের আবেগ তখনও প্রতীক্ষায় কারো।
ভিজে স্যাঁতসেঁতে ভাবনায়
এলোমেলো বর্ণমালা পথ খুঁজে ফেরে
পরিপূর্ণ কথামালার।
রোদহীন দুপুর, মেঘাচ্ছন্ন আকাশ।
টোকাই ছেলেটি কচুপাতার ছাতায়
নিজেকে লুকিয়ে, ছুটছে ক্ষুধার বায়নায়।
পাশের গলিতে সন্তর্পনে পা বাড়াচ্ছে
ক্ষুধার্ত শিয়াল।
রোদহীন দুপুর, মেঘাচ্ছন্ন আকাশ
খোলা জানালায় মুখ রেখে
সুখের সাধক ছন্দ বাঁধছে জীবনের।
সোহাগী সময় আঁচলে বেঁধে চলছে
তার নববধূর নম্র পদচারণা।
পাহাড়ি ঝর্ণার মতো কন্ঠবেয়ে
নেমে আসছে সুরের মূর্ছনা।
রোদহীন দুপুর, মেঘাচ্ছন্ন আকাশ
কলাপাতার ছিন্ন শরীরে
কখনো সন্ত্রাসী বাতাসের উশৃঙ্খলতা
আচড় কাটে ,কোন এক বিমর্ষ কবি কে।
প্রকৃতির ছেড়া- ভাঙ্গায় –
কবির জীবনের কোথাও কি মিলে যায়?
মধ্য বয়সী কবি, রোদহীন দুপুরের
সমবয়সী বন্ধু কি? জানি না–
হিসেবের খাতাটা বড়ই অগোছালো।
প্রকৃতির এক ই দুপুর সহস্র জানালায়
মুখ রেখে একেক হৃদয়ে একেক রকম
স্বপ্ন বিলাই; স্বপ্ন বিকায়।
মানুষ হবো একদিন
সেলিনা আখতার
একদিন আমিও মানুষ হবো,
নারী নয়।
আসমান জমিনের ফারাক
খুঁজবো না আমিও।
বুকের অতলে জমা রাখবো
সাত আসমানের স্বপ্ন।
প্রবল উন্মাদনায় সাগরের
সর্বোচ্চ ঢেউয়ের মাথা ভেঙে
সমতল করে দাঁড়িয়ে থাকবো
অথবা চাবুক হাতে ছুটে চলবো
সাগরের সাথে আগামীর টানে।
নারী নয়, মানুষ হবো।
নারী বড়ই আটপৌরে!
ক্রসিং রেলের মুখ থুবড়ে থাকা
অচলের ভঙ্গিমায় সচল ট্রেন।
সময়ের মূল্যহীন জটলায়
আবদ্ধ জীবন।
তাই নারী নয়, মানুষ হবো একদিন।
পায়ে থাকবে সদ্য পালিশ করা
চকচকে বুট জুতার শক্ত আবরণ ।
দু ‘পায়ে পিষে এগিয়ে যাবো
সমাজের যত অসামঞ্জস্যতা ।
লুটতরাজ আর নির্যাতনের মুখে
করবো তীব্র পদাঘাত।
মুখের দিকে চেয়ে থাকা
মানুষগুলোর ভরসা হবো।
আকাশের মত খোলা রাখবো
বিশ্বাসের আঙ্গিনাটাকে ।
মৃত সুখ-দুঃখের প্রান্ত ছুঁয়ে
আমি একদিন সত্যিই
মানুষ হবো, নারী নয়।
নারীর মৌনতা অসহ্য আমার।
মগজের মাঝে ঘুনপোকার বাস
ক্যানসার নয় ,এইডস নয়,
করোনা ও নয়। নিখাঁদ দুর্ভাবনার মৃত্যু।
নয় থেকে নব্বইয়ের ঘরের নারী ও
গৃহহীন আমৃত্যু।
পায়ের জমিনে চোরাবালির আস্তরণ।
তাই সাধ মানুষ হবার ।
প্রকৃতির সমস্ত ভরসার বাতাস
প্রাণভরে শুষে নেবো।
নির্ভয়ে কাটাবো সকাল থেকে সাঁঝ।
পাখির ডানার ফাঁকে শব্দ করে
উড়িয়ে দেবো ভাবনাগুলোকে
মুক্ত হাসির ঢেউ গুলো শব্দতরঙ্গ
হয়ে মুখরিত করবে চারিদিকে।
বিধাতা, আর নয় নারী
মানুষ হতে চাই ।
একদিন মানুষ হবো আমিও।।
আমি হতে চাই
সেলিনা আখতার
সমাজের সন্ধি টুটে,
হৃদয়ের গ্রন্থি কেটে ,
আমি হতে চাই নবনির্মিত
জীব এক।
যে জীব দেহ গঠিত হবে
প্রেমহীন রক্তের ধারায়।
রিক্ততার গাঢ় যন্ত্রণা
মধ্যমনি হবে না যার ।
যেখানে সুখের সূর্য্য
পাবে না শ্মশানচারীর শোক।
আমি হতে চাই প্রেমহীন
সেই প্রাণের বিকাশ।
যার অতলান্তে জ্বলবেনা
ব্যর্থতার চিতা।
আমার বুকের রক্তে প্রবাহিত
দুঃসহ যন্ত্রণা ছুঁয়ে আমি চাই না
দুঃখের চেয়ারে বেষ্টিত হয়ে
সুখের চর্চা হোক।
নির্ভেজাল দুঃখ অথবা সুখ
প্রাপ্য হোক আমার ।
লিপ্সিত প্রেম, স্বচ্ছতার হাসি
হারিয়ে যাক সম্বন্ধহীন জগতে।
আমি ওদের সঙ্গ বিলাই
প্রতিষ্ঠিত হতে চাই। পেতে চাই
অজ্ঞতার আলো ।
যন্ত্রণার বিকাশ যেখানে থাকে না।
দুঃখের দ্বন্দ্ব, সুখের ছন্দ
স্পর্শের পূর্বেই আমি হতে চাই
অনুভূতিহীন জীব এক।
মেয়ে তুমি
সেলিনা আখতার
মেয়ে তুমি মুক্তি খুঁজো না আর
মেলে ধরা হাতের তলাটা
গুটিয়ে তোলো এবার।
মৃত্যুও তোমাকে মুক্তি দেবে না
ধর্ষিত হবে আর কতবার?
মৃত্যুর আগে প্রেমিক ছুঁয়েছে
মৃত্যুর পরে ডোম!!
কবরে তোমার আশ্রয় হলেও
শাস্তি হবে না কম।
হাতের মুঠি শক্ত করে তোল
আর নয় এলো চুল কপালে টিপ,
যাদের জন্য সাজছো বসে
সে কি তোমার যাচ্ছে সাথে?
অন্ধকারের সাক্ষী হয়ে
হারাবে শুধু জীবন প্রদীপ
তাইতো বলি ওগো মেয়ে
শক্ত করো চুলের বেনী,
চাবুক গড়ে রুখে দাঁড়াও
সাহস ভেঙ্গো না আর।
মৃত্যু তোমাকে মুক্তি দেবে না
লাঞ্ছিত হবে আরেকবার।
মা তোমাকে জন্ম দিয়েছেন
মৃত্যুর কষ্ট সয়ে,
তুমিই মেয়ে ঘোঁচাতে পারতে
যত অন্যায়ের আঁধার,
লাশকাটা ঘরে না যেয়ে।
হেরে যাচ্ছি কি
সেলিনা আখতার
প্রতিদিন জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে,
একবার অন্তত প্রশ্ন করি- ‘হেরে যাচ্ছি কি ?’
কবিতার শেষ লাইনে আমাকে দাঁড়
করিয়ে জীবন সরে যাচ্ছে ক্রমশঃ।
আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত:
কবিতার মতন।
জীবনের কমা নেই, নেই সেমি কোলন।
প্রশ্নের আশ্রয়হীনতার মাঝে
দুঃখের ধারক। জীবনের
সমস্ত বাক্য শেষ হয়ে
দাড়ির কাছে দণ্ডায়মান।
এখানে সব কেমন অভিন্ন অঙ্গীকার।
কোন কিছুই আপোসহীন নয় ।
শান্ত নদীর তীরে-নৌকায় সাদা
পতাকার মতো উড়ছে জীবনের
চাওয়া পাওয়ার শেষ নিশান।
মৃত্যুর মতো অসহায়-বিগত চল্লিশটি
ফাগুনের ঐতিহ্য।
প্রকৃতি আজ জমা নিতে চলেছে সব-অঘোষিত নোটিশে।
নিমীলিত দৃষ্টি শেষ ফাগুনের,
শেষ অস্তমিত সূর্যের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে
হেরে যাওয়া ক্ষণ বিদ্রুপ করছে আমায়।
প্রদীপের শেষ শিখার মত
আয়ুষ্কালের ক্ষীণ দৃষ্টি ,
শেষ পলক ফেলে প্রশ্ন করে ফিরছে
‘হেরে গিয়ে ছেড়ে যাচ্ছি কি?’
এভাবে ই শেষ হচ্ছে নারী সত্তার
রংধনু চেতনার উচ্ছ্বাস।
ধর্ষণ নীতির দুর্বার উম্মাদনায়
তলিয়ে যাচ্ছে সুশীল সমাজ।
লালসার আগুনে পুড়ছে সবুজেরা
নুসরাত ,মুক্তা ,সাথী।
বিষের প্রলেপ দেয়া প্রশ্নেরা আর
সাড়া ফেলে না বিজ্ঞদের পাড়ায়।
ধর্ষণের স্তুপ গুনছে সবাই।
কাকের বিলাপ নিয়ে তাই
বারবার প্রশ্ন করি নিজেকেই
‘হেরে যাচ্ছি কি?’
মৃত্যুর মিছিলে নিজের ছায়া ফেলে
হাজার মৃত্যুর কষ্ট গিলছি।
আর ভাবছি হেরে যাচ্ছি সবাই।
অনাদৃত জীবন
সেলিনা আখতার
অনাদৃত জীবনের সারাটি দুপুর
মেঘের শীতলতা
উঠোনময় বিষাদের কালোছায়া ।
বেড়ে উঠছে না মনের কোনের
ভালোবাসার পুরনো বৃক্ষটি।
অবিরাম মেঘের গর্জন আর বজ্রপাত,
দুপুরের উচ্ছলতাকে ছিনিয়ে নিয়েছে
অতি দাপটের সাথে।
অসুস্থ কাক তাই, পথ পেলো না ভাগাড়ের।
ঝড়ে পড়ে যাওয়া সদ্যফুটে বেড়ানো
পাখির বাচ্চার মত অসহায়
হৃদয়ের স্বপ্নগুলো।
কি জানি শিকার হবে কখন!
অনাদৃত জীবন, লটারির কাগজের ভাঁজে।
টিকটিকির মুখ থেকে
ছাড়া পাওয়া পোকার মতন।
সন্ধ্যার আয়োজনে হয়তো
ফিরে পাবে আরেকটি সকাল।
৩ Comments
Thanks,It’s good.
অপূর্ব শব্দ চয়নে ,কাব্যিক ভাবনার বিস্তার। জীবনের সব অলিন্দে সাহসের পদ স্পর্শ । ভেংগে চুরে নুতনের আবাহন , কবিকে বড় বেশী বিচলিত করে।
নারী যে মানুষ এই বোধ কে জাগরিত করা , পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মূল শেঁকড়ে পদাঘাত করা কবির মন জগৎ কে বুঝা যায়।
শুভ কামনা কবি সেলিনা আখতার কে ।
very good response. congratulations.