১১৮ বার পড়া হয়েছে
গল্প:
রাতের শহরের “মিস্ টুম্পা”
সুচেতনা
তারিখ–২৯/০৯/২০২১
বারুইপুর দক্ষিণ কলকাতা…বারুইপুর কথাটি শুনলেই আমাদের পেয়ারার কথা মনে পড়ে যায়, দক্ষিণ কলকাতার বারুইপুরের পেয়ারা যেমন বিখ্যাত তেমনি কিন্তু এই পেয়ারার মতো টুম্পাও শেষের দিকে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।” টুম্পা ” …..বারুইপুর এর বয়স ২৩ এর যুবতী। বাড়িতে বাবা,মা,ভাই ও দুই বোনের সাথে সে থাকে। তিন মাস হলো বাসের ধাক্বায় টুম্পার বাবার দুটি পা বাদ যায়,সেই থেকেই গৃহবন্দী মানুষটি।বিছানায় শয্যাশায়ী ,মা বাতের ব্যথার কারণে নরতে পারে না, হাত পা বেঁকে যায়, কোনরকম রান্নাটা করে, আর বাবা কে দেখভাল করতে করতে মার সময় চলে যায়।নিদারুন দারিদ্রতা এবং অভাব গ্ৰাস করছে টুম্পার পরিবার কে।
টুম্পা বহুকষ্টে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে বটে, কিন্তু বহু জায়গায় নানাভাবে দৌড়েও কোন কাজ জোগাড় করতে পারে নি সে, যে কোন কোলকাতার নামি দামি জায়গার বড়ো অফিসে গেছে ,সবার ঐ একই কথা ,বাহ্যিক দিক থেকে এসব অফিসের আড়োম্ভর চাকচিক্য খুব বেশী, কিন্তু ভেতরে ততোধিক লোলুপ দৃষ্টি। যেখানেই যায় সবাই একি কথা বলে..’ এ কটা টাকায় কি আর হবে তোমার অল্প বয়স,দেখতে এতো সুন্দর কতো আর পাবে ৮/৯ ঘন্টায় ২০০/৩০০ টাকা,এই কটা টাকায় তোমার চলবে কি.? তার চেয়ে এক ঘন্টা, দু ঘন্টা বেড শেয়ার করো তোমাকে পুষিয়ে দেবো.. ..’। কাঁদতে কাঁদতে টুম্পা সে সব জায়গা ছেড়ে চলে যায়,এইসব নানা প্রলুব্ধতা টুম্পা কে বারবার গ্রাস করে, সে ভাবে, টাকার জন্য…. ছিঃ ছিঃ সে ভদ্র বাড়ির মেয়ে, কটা টাকার জন্য সে নিজেকে বিক্রি করে দিতে পারবে না।সব অফিস থেকেই পুনরায় বিবেচনার জন্য টুম্পা একটি করে চকচকে ভিজিটিং কার্ড ও পায় …।
এর মধ্যে হঠাৎ একদিন টুম্পা দুপুরে খেয়ে উঠে যখন এঁটো বাসন মাজার জন্য কলপারে যাচ্ছিল তখন ঘর থেকে টুম্পা মার গলা শুনতে পায়। দৌড়ে গিয়ে দেখে টুম্পার মা মাটিতে এমন ভাবে পরে আছে ওঠার ক্ষমতা নেই। দিনটি ছিল শুক্রবার, সেদিন সকাল থেকেই টুম্পার মা পায়ের ব্যথাটা এতো বেড়েছে যে চলতেই পারছিল না। সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় তুলে কোনরকম বসালো টুম্পা,বাতের ব্যাথায় পায়ের গিঁট গুলো এমন টান দিয়েছে যে চলতে না পেরে বসে পরেছে মেঝেতে। ডাঃ বলেছিল দু’টো ইনজেকশন এর কথা, দেবো দেবো করে অভাবের সংসারে আর হয়ে উঠছিল না, বাবা যে ঘরে বসা, টুম্পা তিন টে টিউশন করে, সন্ধ্যায় মার সাথে সেও ঠোঙা বানায়। জমানো টাকা শেষের পথে।এই তিন মাসে সংসারে অভাব টা যেন সংসার টাকে গ্ৰাস করে একেবারে নিস্তেজ করে দিয়েছে।
মা’র অমন অবস্থা দেখে বাবার চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছিল,মনেই হচ্ছিল টুম্পার যে ,তার বাবা নিজেকে অসহায় ভাবছে,কাজ নেই টাকার জোর ও নেই যা ছিল জমানো তার ভেঙে আর ক’দিন তাই সংসারে মানুষটির বলার ভাষা ও নেই। ছোট ছোট ভাই বোনেরা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে মার দিকে।টুম্পা কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না, দৌড়ে এক ছুটে পাড়ার এক ডিস্পেনসারি তে যায় । সুকুর ডিস্পেনসারি নামেই বিখ্যাত। আলুথালু বেশে দৌড়ে যায় আর প্রেসক্রিপশন টা দেখায়,সুকু দেখে বলে ১২৯৫ টাকা দাম ইনজেকশন দুটির,অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে টুম্পা। তার কাছে ২০০ টাকা ছাড়া আর টাকা ছিল না, বাকিটাকা টা পরে দেবে এমন কথা শুনে খুব রেগে গেছিল পাড়ার সুকু কাকু। তার কাছে আর নেই, করুন সুরে সে বলে ও এমন ও বলে কন্যাশ্রীর টাকা পেলেই দিয়ে দেবে প্রতিশ্রুতি ও দেয়। কিছু তেই মানবে না সুকু, কন্যাশ্রীর কথা শুনে বলে ওঠে সেটা তো ঢের দেরি। তার চেয়ে একটা কাজ করতে বলে টুম্পাকে, নিচের ঘরে যেতে বলে।টুম্পা গেলো নিচের ঘরে, ঘরে যেতেই টুম্পার সাথে একটু গল্প করবে সুকু কাকু ইনজেকশন তো দেবেই ও তাকে ৫০০ টাকা নগদ ও দেবে এমন বলে উঠলো।এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে পাড়ার সুকু কাকু তাকে আদর করতে লাগলো। প্রস্তাবে সেদিন অসহায় টুম্পা মা’র মুখ টা মনে করে, নাম লেখালো যাকে সমাজের লোকেরা বাজে মেয়ে, পতিতা , শহরে যাকে বেশ্যা বলে তার দলে। কিন্তু মেয়েটি সেদিন অসহায় হয়েই ঐ দলে নাম লিখিয়েছিল।
শুরু হলো টুম্পার জীবনে নতুন এক অধ্যায়। পৌঁছে গেলো ইনজেকশন সঙ্গে নগদ ৫০০ টাকাও ,খুশি হলো সুকু, বাঁচলো টুম্পার মা, মার ব্যথাটা খানিকটা কমলো। বাবার মুখে হাসি ফুটলো ঐ ৫০০ টাকা টার থেকে পরের দিন ভালো বাজার ও হলো। দরিদ্র পরিবারে সেদিন সবার মুখে হাসি, অনেকদিন পর বাড়িতে মাংসের গন্ধে সবাই খুব খুশি। ছোট ছোট ভাইবোনেদের কি আনন্দ, দুপুর কখন হবে, সকাল থেকে বসে তারা, কখন পেট ভরে মাংস ভাত খাবে।সন্ধ্যায় টুম্পা দেখলো তার পরিবারের সবাই আজ খুশি, ভাই খেলতে খেলতে বলেই বসলো ” দিদি জানিস ,আজ আমি ৫টাকা দিয়ে চটপটি কিনেছি রে…”। কিন্তু পরিবারের কেউ সেদিন খোঁজ নিল না অর্থ টা কোথা থেকে এসেছিল….। পরিবারের সবার মুখে হাসি দেখে একদিন শহরের যে কার্ড গুলো টুম্পা লুকিয়ে রেখেছিল, সেই কার্ডগুলো একটা একটা করে বার করলো টুম্পা।হয়ে উঠলো টুম্পা ,দক্ষিণ কলকাতার রাতের বাবুদের ‘মিস্ টুম্পা’। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, সুন্দর গন্ধ পারফিউম ও নিত্য নতুন শরীর দেখানো পোশাকে সে সেজে উঠলো।
সন্ধ্যা নামতেই কখনো পাঁচতারা হোটেলের কোন বড়ো লোক বাবুদের সাথে, কখনও বড়ো নামজাদা লোকের গাড়িতে, আবার কখনও বা কয়েক ঘণ্টার জন্য কারো বাড়িতে এক দু ঘন্টা সময় কাটানো। নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবার সাহস বা ক্ষমতা থাকে না কারোরি, এরাই যে মুখোশধারী মানুষ হয়। সমাজের বুকে কতো নামডাক তাদের কিন্তু বাড়িতে ততোধিক ভদ্র ও ভালো মানুষ। টুম্পা ও জীবনে নতুন নতুন খদ্দের কে চিনতে থাকে। ধীরে ধীরে সমাজের বুকে এক জলন্ত ইস্পাতে পরিনত হয় মিস্ টুম্পা। সংসারে কোন অভাব তার আজ নেই, মা আজ অনেক টাই সুস্থ,ভাই বোনদের মুখে হাসি। টাকা ছাড়া এই দুনিয়াটা খোলা আকাশের মতো, চাইলেও ধরা যায় না। এই বয়সেই টুম্পা আস্তে আস্তে বুঝতে পারলো জীবনে টাকার প্রাধান্য….।
এমন টুম্পা আমাদের এই সমাজে হাজার হাজার ঘুড়ে বেড়াচ্ছে,আমরা তাদের নাম তো দুরের কথা, তাদের কষ্টের কথা শোনার সময় ও নেই,তারা কি ভাবে এই জীবনে এলো কেন ই বা এলো বোঝার চেষ্টা করি ক’জন..? নিজেকে তাদের জায়গায় রেখে কখনো ভাবি না তাদের কষ্টের কথা, আগের থেকে কিছু টা পরিবর্তন হয়তো হয়েছে সরকারের নজরে, কিন্তু তাদের নামের তকমার কি কোন পরিবর্তন হয়েছে..? আর পাঁচটা মেয়ের মতো যেদিন ওরাও সমাজের বুকে নির্দ্ধিধায় ঘুড়তে পারবে সেদিন মনে হয় পৃথিবীটা আরো রঙিন ও সুন্দর হয়ে উঠবে……।