১
নিমতিতা আর নিশিন্দা তিতা বুকে ধরে
সীতার হরণ শুরু বিমানব রাবণের ঘরে।
সীতা, তুমি না বনের, না রাজপ্রাসাদের;
চিরকাল রাণী তুমি মনোসাম্রাজ্যের।
না, তোমাকে নিয়ে যুদ্ধটাও নয় শুধু আমাদের।
২
গুলঞ্চ লতার বুক শুঁকে শুঁকে সীতা
নিজেই নিজের ঘরে যদি অপহৃতা
পাখিরা সন্ত্রস্ত চোখে মুখ তুলে চায়
হানাদার বাহিনীর চোখ ঠুকরে খায়
ভেষজের পাহারায় সীতা নবনীতা
৩
পঞ্চবট পঞ্চবৃক্ষ স্তম্ভ পঞ্চদিক
অনন্ত অতন্দ্র তারা বনে দশদিক
মাঝখানে সুরক্ষিত বেদী বারোহাত
পঞ্চবটী বনে নামে ত্রিলোক-প্রপাত
সতীত্ব সতীর অস্ত্র, সতীত্ব করাত
৪
নয় নির্বাসন, এই বন পুণ্যবতী সতীর আশ্রম;
অশ্বত্থ সটান পুবে, পশ্চিমেও বট সমাগম;
উত্তরে শ্রীফল বিল্ব, আমলকি প্রহরী দক্ষিণে;
অগ্নিকোণে দাঁড়ায় অশোক; মাঝে বেদী নাও চিনে;
সীতা তুমি, সতী তুমি; তুমি নিজে কয়েদি সশ্রম।
৫
দেহের দেয়ালে বন্দি, বন্দি তুমি স্নায়ুর শেকলে;
ডুবে ভেসে জেগে থাকো আসমুদ্র শরীরী শোণিতে;
তোমাকে দেখে না কেউ, দেখে শুধু তোমার বাকল;
কে তোমাকে বেঁধে রাখে সীমানায় হিতে বিপরীতে?
রাম-রাবণের যুদ্ধ চলে, দেহত্যাগী চলে দলে দলে!
৬
অনন্তমানব আমি, তুমি যদি হতে চাও অনন্তমানবী।
অনন্তমানবী তুমি, আমি যদি হতে চাই অনন্তমানব।
পররাজ্য পরনারী অধিকারে কেন তবে অটল অটবী?
শরীরের শৌর্য নিয়ে বিনা তর্কে কেন তবে দাহন খাণ্ডব?
লেজে লেজে সেতু পার, হনুমানও পরবিত্ত-লোভী।
৭
পঞ্চকর্মে দীক্ষাহীন? – তুমিতো আরোগ্যহীন তবে চিরদিন।
বিরেচন বা বমন, নস্য বা নিরুহ : আসলে অনুবাসনাধীন।
সশাস্ত্র চিকিৎসা নাও; রাজা হও, রাণী হও, মানব-মানবী্;
পাহাড়-সাগর-দ্বীপ-সমতলে নভোতলে তুমি আর নও অর্বাচীন।
তা নাহলে আবাসনে-নির্বাসনে মানুষ তো দানব-দানবী।
৮
তোমার ভেতরে তুমি সাজাও সংসার
বিমূর্তের তুলি দিয় মূর্তের আকার
ক্রমেই ভেতরে চলো, অধিক ভেতরে
যা আছে এ চরাচরে নিয়ে আসো ঘরে
পঞ্চবটী বন শুধু সতীকেই ধরে
৯
একা নও একা নও একা নও একা
তোমার ভেতরে তুমি পেয়ে যাবে দেখা
জলাঙ্গীর সরোবরে বাঘিনী হরিণী
এক ঘাটে কেলি করে তরঙ্গ তটিনী
তোমাকে পাহারা দেয় কুহু আর কেকা
১০
রচনা করেছো তুমি তোমার কুণ্ডলী
ধূলিশয্যা আলো করে সপ্তর্ষিমণ্ডলী
পত্রপল্লবেরা সুখে বাজায় কাঁসর
ত্রিলোক যাপন করে সতীত্ব বাসর
তোমাকে সুরক্ষা দেয় জোনাকির কলি
১১
পুরুষ রসনাজীবী কামনাবিলাসী
নৃপতি মুখোশ পরে পালে দাসদাসী
রাজ্যলোভী নারীলোভী লোভী পরকীয়া
রাণীর বশ্যতা মাগে, পতিত্বে স্বকীয়া
সতত স্বাধীন সীতা, সতী অবিনাশী
১২
না-পুরুষ না-রমণী না-রাম-রাবণ
মানুষ আপন মিত্র, আপন বিধান
নিজের ভিতরে করে নিজেকে ধারণ
দশ দিক চেনে, চেনে আপন শিথান
অমানুষ খোঁজে শুধু শত্রু অকারণ
১৩
দেবতার ছায়া থেকে মানুষের কায়া
দেবলোকে মর্ত্যলোকে যুগলাঙ্গ মায়া
মূর্ত-বিমূর্তের রজ্জু সে কি আবছায়া?
দেবসিদ্ধি অনন্তের, – মুহূর্তে মানব।
রূপবদলের দৃশ্যে শুধু আসা-যাওয়া।
১৪
লঙকায় রাক্ষসরাজ রাবণ যখন
প্রচণ্ড প্রতাপে করে ভুবন শাসন,
যেহেতু ব্রহ্ষার বরে অমর তখন;
সুমাত্রার গর্ভে বিষ্ণু মানবস্বরূপ
জন্ম নিলো; লক্ষ্য তার রবাণ-হনন।
১৫
শোধ নয়, প্রতিশোধ নেয় অযাচারী,
ক্ষমতা ও ছলনার ষড়যন্ত্রধারী;
মানবের গর্ভে তার জন্ম হয় বটে,
মুখে তবু বর্ণহর মুখোশ বাহারি:
রাক্ষসের সেই রাজা মনুষ্য-আহারী।
১৬
জনক তখন রাজা ছিলো মিথিলার
লাঙল-রেখায় লাভ সুকন্যা সীতার—
চাষের কর্ষণ রেখা : সীতা নাম তার;
আসলে তো বিষ্ণুপত্নী, লক্ষী সত্যবতী;
রামসীতা বিষ্ণুলক্ষী অনন্ত-সংসার।
১৭
ঋষ্যশৃঙ্গ যজ্ঞ করে স্বর্গমর্ত্যময়
জননের ঊর্বরতা সুফলা সময়
সর্বচাষে ফলনের নামুক অভয়;
জল, মাটি, অগ্নি আর বায়ুর প্রবাহ;
চেতনায় দ্যুতি জ্বালো , জীবজন্মময়।
১৮
সতী যদি ব্রতবতী আছে তারো ভাগ
সতীনও স্নেহের অংশী, নেই তার রাগ;
অর্ধফল দুই ভাগ করে দুই জনা –
সতীনে সতীনে সখ্য, ভগ্নী অনুরাগ;
কৌশল্যা সুমাত্রা রচে সংসার-সংরাগ।
১৯
মাটির মানুষ গড়ে ভিটেমাটিঘর
আপন সীমানা গড়ে আপন মাটিতে
সংসার বাঁশের বেড়া, সোনাদিয়াচর
পাশাপাশি শুয়ে-থাকা বালিতে পাটিতে
সংসারী সংসারসুখী দুধের বাটিতে
২০
নিজেকে নিজের মধ্যে যতদিন ধরো
ততদিন চাষ করো সতীর ফসলে
গুহাবাসে দূরতম গ্রহের নিবাসে
আমাদের আত্ম-সজ্জা অর্জুন বল্কলে