কবি সিদ্ধার্থ সিংহের তিনটি কবিতা:
01) আজ বাড়ি ফাঁকা
ফোনে না পেয়ে শুধু মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপ কল নয়,
যেহেতু বলে রেখেছিলাম, আমাকে না পেলে একটা হোয়াটসঅ্যাপ
বা ম্যাসেজ করে রেখো,
তাই ও কী বলতে চাইছে জানার জন্য
হোয়াটসঅ্যাপ খুলতেই দেখি
ও লিখেছে, ‘আজ বাড়ি ফাঁকা’
সঙ্গে সঙ্গে আমি ফোন করলাম, মা কোথায়?
ও বলল, মা পুরী বেড়াতে গেছে।
আমি সব কাজ ফেলে মেট্রো ধরে দমদম
সেখান থেকে টোটো ধরে নাগেরবাজার
ওখান থেকে রিকশা নিয়ে ১০ নম্বর গলি
যেতে যেতে বারবার ওর সঙ্গে কথা হচ্ছিল ফোনে
রিকশা থেকে নেমে দেখি, গলির মুখে ও
বললাম, চলো।
ও বলল, কোথায়?
আমি বললাম, কেন, তোমাদের বাড়িতে।
ও বলল, বাড়িতে তো মা আছে…
— তুমি যে বললে মা পুরী গেছে!
ও একগাল হেসে বলল, ওটা না বললে কি তুমি এখন আসতে!
এখনও ফোনে না পেয়ে ও যখন লেখে, আজ বাড়ি ফাঁকা
আমি সঙ্গে সঙ্গে লিখি, তা হলে পড়তে বসে যাও।
————————–
02) সতর্কীকরণ
বয়স্কদের থেকে একটু সাবধানে থাকবেন।
দেখবেন, ছেলেদের দিকে তেমন ভিড় না হলেও
লেডিজ সিটের সামনে মেয়েদের ঠিক পিছনে
কিংবা গা ঘেষে দাঁড়ানোর জন্য,
বাবা-জ্যাঠা-মামাদের সে কী প্রাণপণ লড়াই
কয়েক দিন খেয়াল করলেই টের পাবেন
গভীর রাতে উঠে শাশুড়ি কান পাতছেন
ছেলের ঘরের দরজায়
না না, ছিঃ, ও সব শোনার জন্য নয়,
কান পাতছেন, বউমা তাঁর ছেলের কানে কোন মন্ত্র দিচ্ছেন,
তা শোনার জন্য
বয়স হলে মানুষেরা ফুটপাতের এত ধার ঘেঁষে হাঁটেন যে,
নোংরা তাঁরা মাড়াবেনই।
বয়স্কদের থেকে একটু সাবধানে থাকবেন।
এমনকী, যখন আমার বয়স হবে, তখন আমার থেকেও
অবশ্য আমার বয়স কি আর বাড়বে!
————————–
03) বালিশ
মাথার তলায় থেকে থেকে এত তেলচিটে হয়ে গেছ !
সেই কবে রতির সঙ্গে এ বাড়ি এসেছিলে
তার আর আমার কত ভাব জমে উঠেছিল
তুমি সব জানো।
রাত থেকে গভীর, গভীর থেকে গভীরতর
কত কথার সাক্ষী হয়ে আছ তুমি
যেমন জানো ওকে, আবার আমাকেও
ঠিক তেমন করে নিজেরাও জানিনি একে অন্যকে।
তোমার উপর মাথা রেখেছি, ঠোঁট রাখিনি কোনও দিন বলিনি নিতান্ত সাদামাটা কোনও কথাও
বললে বলব, মাথায় করে রেখেছি
কিন্তু নিজে তে৷ জানি!
মাথার তলায় থেকে থেকে কত তেলচিটে হয়ে গেছ !
————————–
কবি, কথাসাহিত্যিক সিদ্ধার্থ সিংহের পরিচিতি:
——————————————————
২০২০ সালে ‘সাহিত্য সম্রাট’ উপাধিতে সম্মানিত এবং ২০১২ সালে ‘বঙ্গ শিরোমণি’ সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। ১৯৬২ সালে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ই তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় ‘দেশ’ পত্রিকায়। প্রথম ছড়া ‘শুকতারা’য়। প্রথম গদ্য ‘আনন্দবাজার’-এ। প্রথম গল্প ‘সানন্দা’য়। যা নিয়ে রাজনৈতিক মহল তোলপাড় হয়। মামলা হয় পাঁচ কোটি টাকার।
ছোটদের জন্য যেমন লেখেন, তেমনি বড়দের জন্যও লেখেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং মুক্তগদ্য।
‘রতিছন্দ’ নামে এক নতুন ছন্দের প্রবর্তন করেছেন। চালু করেছেন রিয়্যালিটি উপন্যাসের। ‘ঝলক-গল্প’ তাঁরই প্রবর্তন করা অণুগল্পের নতুন ধারা। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিনশো ১৬টি। তার বেশির ভাগই অনুদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। বেস্ট সেলারেও উঠেছে সে সব।
একক ছাড়াও যৌথ ভাবে সাতশোর ওপর সংকলন সম্পাদনা করেছেন লীলা মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেবসেন, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভঙ্কর সিংহের সঙ্গে।
তাঁর লেখা নাটক বেতারে তো হয়ই, মঞ্চস্থও হয় নিয়মিত। তাঁর শ্রুতিনাটক নিয়মিত করেন জগন্নাথ বসু থেকে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়রা। তাঁর কাহিনি নিয়ে How about ছায়াছবিও হয়েছে বেশ কয়েকটি। গান তো লেখেনই। মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতে। তাঁর ইংরেজি এবং বাংলা কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কয়েকটি সিনেমায়। বানিয়েছেন দু’টি তথ্যচিত্র। লিখেছেন বেশ কয়েকটি ছায়াছবির চিত্রনাট্য। তিন-তিন বার রাজ্য চ্যাম্পিয়ন এই মুষ্টিযোদ্ধা এক সময় আনন্দবাজার সংস্থায় নিয়মিত মডেলিংয়ের কাজও করেছেন।
আশির দশকের অত্যন্ত জনপ্রিয় এই সব্যসাচীর লেখা পাঠ্য হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের পাশাপাশি
সিবিএসই এবং আইসিএসসি বোর্ডেও।
আনন্দবাজার পত্রিকার এই প্রাক্তনী ইতিমধ্যেই পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, স্বর্ণকলম পুরস্কার, সময়ের শব্দ আন্তরিক কলম, শান্তিরত্ন পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, সন্তোষকুমার ঘোষ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, নতুন গতি পুরস্কার, ড্রিম লাইট অ্যাওয়ার্ড, কমলকুমার মজুমদার জন্মশতবর্ষ স্মারক সম্মান, সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, বিশ্ব মৈত্রী পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের ‘শ্রেষ্ঠ কবি’ এবং ১৪১৮ সালের ‘শ্রেষ্ঠ গল্পকার’-এর শিরোপা।
আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘পঞ্চাশটি গল্প’ বইটির জন্য তিনি সম্প্রতি ‘সৃজনী ভারত সাহিত্য পুরস্কার’ পেয়েছেন।