০১) মিয়ামি বীচে একদিন
অখন্ড সমুদ্র বেলায় মিয়ামি বীচে
সাগর আর আকাশ মিলনের বিন্দুতে
চোখের আয়নায় সন্চিত নীলটুকু মেখে নীলকণ্ঠি
উত্তাল ঢেউয়ের সাথে আকাশে মিশে।
অন্তহীন ভাবনার শেকল ছিঁড়ে
অনঙ্গ নীল ছাদে অস্থির দাঁড়িয়ে
তরঙ্গে তরঙ্গে বোধ জাগানিয়া কবিতা
ওঠে আসে আকবরের দরবারী মজলিশ।
নুপূর নিক্কণে তানসেনের চাঁদ ভাঙ্গা সুরের প্রবাহ
চারপাশে নাগকেশরের ছড়িয়ে পড়া গন্ধ
ডলফিনের বিহু নৃত্য স্পর্ধিত বলয়
গাঙচিলেরা বালুকা বেলায় উষ্ণতার নৈবেদ্য।
বুকের ভেতর স্বপ্ন সময়ের গল্প শতাব্দ
ইট পাথরের শহর ছেড়ে রাত নামে সমুদ্রে
অতলান্তের আবেগঘন স্পর্শ অনুধ্যানে প্রশস্তি
কোলাহলেও নিথর নির্বাক নৈঃশব্দ।
দৃষ্টির সীমানায় একখন্ড নীল আকাশ আর
সহস্র আছড়ে পড়া ঢেউয়ের আর্তি
সৈকতের সীমান্তে প্রেম রচনা
আকাশ আর সাগরের সীমান্তে।
০২) এই আমি
হীরা চুনি পান্না পাথর নই এই আমি
রচনা করি বিশ্ব সংসার,আকাশ সমুদ্র পাহাড়
উষ্ণ উত্তাপে গোলাপ ফুটাই টকটকে লাল
রেখায় আর রঙে ইতিহাস লিখি প্রাচীন বৃক্ষের ছায়ায়।
এরিসের ঈর্ষার সোনার আপেল নিক্ষেপ
স্পর্শ করি অস্তিত্ব,এতটুকু করি না ভ্রুক্ষেপ
প্রমিথিউসের মতো আগুন জ্বেলে
অমিত শক্তির প্রগাঢ় বিশ্বাসে ওঠে দাঁড়াই।
বোধের গভীর থেকে মানবতার কথা বলি
শিকড়ের কন্দরে মহামানবের দুঃসাহস প্রতিনির্মাণ
গালফ সী’র তরঙ্গের দেয়ালে দেয়ালে ওঠে আসে প্রতিবাদ
জীবন মৃত্যুর সীমানায় স্টিক্স নদীর জলে স্নান সারি,এই আমি।
মৃত্যুতে মুছে না অমর লেখনি ইলিয়াড মহাকাব্য
আগামেনন ছিল,এখনও আছে ট্রয় নগরীর প্রেতাত্মায়
বিশ্বকর্মার সংসারে নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে আলো আর আঁধার
লেখনির পাত্রে রঙ রূপ ঢেলে সাজাই ধ্রুবক।
মানুষের ক্লেদ কান্না আকাঙ্খার দুর্মর উচ্চারণ এই আমি
লিখে রাখি অযুত বর্ণচ্ছটা পৃথিবীর পাঁজরে পর্বতে
মর্ত্যলোকের পাতা জুড়ে মেসোপটেমিয় পিরামিডে
ইতিহাসের খাদ্য অনন্ত অসংখ্য সে রঙ,সত্যের সূচি।
যেদিন আকাশ হারাবে নীল,পৃথিবী হারাবে সূর্য
চাঁদ হবে কালশিটে বেগুনী পাথর
ভুলে যাবো ওষ্ঠের জ্যামিতিক আদর
ঝিনুকের নাড়ি নিংড়ে মুক্তো চৌচির
পাহাড় আর সাগর মিশে একাকার
দুর্ধর্ষ শিকারীবেশে মৃত্যু সেদিন,অব্যক্ত শেষ কথা
বলা হবে বিধাতার কলমে
মহাপ্রয়াণে ফুরিয়ে যাবো না এই আমি।
০৩) রক্তজবা শিশু
(মৃত্যুক্রুশ বিদ্ধ রঞ্জিত পোশাকে অনন্ত যাত্রায় যেসব শিশু অকালে ঝরে পড়েছে, প্রতিটি শিশু একটি রক্তজবা। তাদের স্মরণে কবিতাটি রচিত।)
বোধের সঙ্গীতকলায় আত্মশক্তির স্পর্ধায়
অন্তর্গত বেদনার চোরাস্রোতের শেকল খুলে
জিজ্ঞাসু চোখে চেয়েছিল দশ বছরের শিশু
ক্ষিপ্র ক্ষিপ্ত সীসার গতির কম্পাঙ্ক কত?
সমুদ্র আর সূর্যের গর্জন
মহাত্মন সভ্যতার নির্মম কথন
শিরদাঁড়ায় গেঁথে যাওয়া সূঁচ
উত্তুঙ্গ ফেনার বেদনার শীর্ষে
বুক চাপড়ে তখনও ডাকছে ভয়ার্ত শিশু
যিশু, সুরক্ষা দাও মহামানব হে যিশু।
ততক্ষণে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর চারপাশে
লাল আলোর রঞ্জিত প্রভা
ফুটে উঠেছে অযুত কোটি রক্তজবা
শিশুটি আকাশের দিকে ছুটে চলেছে
ভার্জিন উপগ্রহের চিবুক বেয়ে সৌরপল্লী ভেদ করে
অপ্রতিহত ছুটে চলা লক্ষ্যভেদী চিৎকার।
ভয়ার্ত দু’টি চোখ বিস্ফারিত
গলে পড়ছে সীসার দানা
ঘুমচোখে অশ্রুর অনুকণা
রসায়নের পাতায় পাতায় খনিজের তরল
মাউন্ট অলিম্পাস থেকে বজ্রবৃষ্টি জিউস
অগ্নিভূক নীহারিকার জ্বলে ওঠা চোখ।
ঝলসে যাওয়া দৃষ্টি খুঁজে ফেরে শান্তির দেবদূত
ভূগোলের প্রান্ত ছুঁয়ে উত্থিত কণ্ঠ প্রশান্ত
অমোঘ ইতিহাস,সভ্যতার নীল আলোর নির্মম বলি
হে রক্তজবা শিশু
নেমে আসার নিমিত্তে অনন্ত অপেক্ষায়
ক্রুশবিদ্ধ যিশু।
০৪) নদী ও নীল
ছোট্ট নদী মেঘ-পাহাড়ের বুক ছুঁয়ে
সুঠাম নীলের স্পর্শে নিতান্ত অক্লেশে সমুদ্র
পরিসংখ্যানবিহীন অগুনতি ঢেউ
প্রেমের সৈকত বিশাল তোমার বুকের ‘পর।
হলুদ নদীর বনে নীড়ে ফিরে সন্ধ্যার পাখি
জ্যোৎস্না নামে ঝাউ এর সরু ডালে
অন্ধকার প্রাচীন সেই জারুলের তলে
মোম গলা ছোট্ট নদী নিঃসঙ্গ কুমারী।
নুড়িদের বুক ছুঁয়ে কত লক্ষ ঢেউ গিয়েছে বয়ে
জোনাকের কত পাখা ওড়েছে ডুমুরের ফুলে
কত নিশিন্দা খসে পড়ে ক্রান্তির ক্ষণে
জলহীন বৃক্ষহীন মরুর বেদিতে অর্ঘ্য ধূধূ বাতাসে।
অনন্ত অতীত মনে পড়ে কি নীল?
সেই নদী চৈত্রের অপ্রেমে নিঃসঙ্গ চিল
তিরতিরে নির্ঝর পূর্ণ হলো যৌবন দূরের মোহনায়
ফিরলে না কেবল তুমি জীবনের এ খেলায়।
০৫) কল্লোলে জেগে থাকবো
হাজার বছর আরও হেঁটে যাব এই পথে
ওই পাহাড় নদী সমতটে জাগ্রত কলরবে
অতৃপ্ত অন্তরাত্মা পিপাসার্ত হয়তো বা ক্লান্ত
তবু হেঁটে যাব বহুদূর,বহুদূর !
বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে বিস্তৃত মহাসমুদ্রে
সুমাত্রা জাভা বালিদ্বীপ সিসিলি হয়ে
ফিরে আসবো দক্ষিণের মলয় বসন্তে
বিস্তীর্ণ বৃক্ষ ছায়ায় জ্যোৎস্নার কোমল মায়ায়।
শীতলপাটি আঁচলে এই পথে সেই পথে
মাটির ঘরে আউল বাউল লালনের একতারা সঙ্গীতে
নবান্নের দিনে পিঠা উৎসবে ছায়াঘেরা বনবীথি তলে
হিম হিম শীতে ভাপা পুলির মৌ মৌ ঘ্রাণে।
বৈশাখী ঝড়ে মাতাল হাওয়ায়
শ্রাবণ মেঘের ভিজে হাওয়ায় বুনো হাঁসের ডানায়
শরতের পাল্কি চড়ে কাশবনে দোলনা দোলায়
কোন এলোকেশী নৃত্যপটিয়সী ওড়না উড়ায়।
মহাসাগরের কল্লোলে জেগে থাকবো
সূর্যদয় প্রভাতে কিংবা ষোলোকলা চাঁদের রাতে
নিদ্রামগ্ন হবো না,হবো না
পায়ে পায়ে হাঁটবো যতদূর যেতে চাও।