১৫০ বার পড়া হয়েছে
হুমায়ুন কবির খোকন-কে নিয়ে স্মৃতিচারণ করছেন তাঁর স্ত্রী কবি শারমিন সুলতানা রীনা:
দুই হাজার বিশ সাল।পৃথিবী এক কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়।যার প্রভাব বিশ্বের সমস্ত দেশেই লেগে যায়। লাগে আমাদের বাংলাদেশেও।দুহাজার ঊনিশকে বিদায় জানিয়ে দু’হাজার বিশকে সবাই সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে বরণ করে নেয়।বরণ করলাম আমরাও।দুহাজার বিশ তার শরীরে বয়ে নিয়ে আসে ভয়াবহ এক মহামারী, এক মরণ ব্যাধি নাম যার কোভিড ১৯ বা করোনা নামক বিষাক্ত বিষের নহর।তাই দুহাজার বিশ ইতিহাসে বিষ হয়েই থাকলো। বিশ্ব জুড়ে মানুষকে সচেতন করা হলো,বলা হলো একে অপরের থেকে দূরে থাকা বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা।কাউকে ছোঁয়া যাবেনা ধরা যাবে না, মুখে মাস্ক হাতে গ্লাভস এবং বার বার হাত সাবান দিয়ে ধুতে হবে তাতে যদি কিছুটা আয়ত্বে এনে জীবন রক্ষা করা যায়।আমাদের সরকার প্রধান মানুষকে সচেতন করেছেন নানাভাবে।সাহায্য সহোযোগিতায় দাড়িয়েছেন সাধ্যমতো মানুষের পাশে।কিছু মানবিক প্রতিষ্ঠান সরকারের এ সহায়তায় হাত বাড়িয়ে দেন। অবস্হা যখন খুব খারাপের দিকে সরকার লগডাউন দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ সরকারী বেসরকারি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার এক নির্দেশনামা জারী করেন।এবং মানুষকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেন।কিছু খাবারের প্রতিষ্ঠান সহ হাসপাতাল পুলিশ বাহিনী ও গনমাধ্যম কর্মীরা মানুষের পাশে দাড়ানোর জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাইরে গিয়ে মানুষকে সেবা দিতে হাতের মুঠোয় মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে বের হলেন।তারা নিজেরা যেমন মৃত্যু ঝুঁকির মধ্যে তেমনি ঝুঁকি তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে।আসলে পৃথিবীর নিয়মে একজন আরেকজনকে বাঁচাতে মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করে নেন।
প্রতিদিন করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বিশ্ব দেখলো করোনায় মানুষের মৃত্যু ও আক্রান্তের নির্মম পরিনতি।মানুষের বুকের ভীতরের ভয় তাদের ভেঙেচুরে চুরমার করে দেয়। তবু কেউ কেউ বুক শক্ত করে জেগে থাকেন।অসচেতন ঘুমকে সচেতন করতে। তাদেরই একজন গণমাধ্যমকর্মী সাংবাদিক হুমায়ুন কবির খোকন।যিনি গনমাধ্যমকর্মী হিসেবে প্রথম মৃত্যুর হীমশিতলতায় নিজেকে সমর্পন করেন।(ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্নাইলাহে রাজিউন)
সাংবাদিক হুমায়ুন কবির খোকন আমার স্বামী বন্ধু অভিভাবক। একদিকে যেমন তিনি তার কর্মস্হলে কাজ করে মানুষকে সচেতন করেছেন তেমনি নিজের ব্যাক্তিগত ফেসবুকের বিভিন্ন স্ট্যাটাসেও করেছেন সচেতন করোনার এই ভয়াবহতা নিয়ে।মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে জীবিকা ও দায়িত্বের তাগিদে নিয়মিত অফিস করেছেন।অথচ বুঝতে পারেননি নিজেই বয়ে বেড়াচ্ছেন মহামারী করোনার ভয়াবহ বিষাক্ত বিষ।
অতঃপর গণমাধ্যমের প্রথম সাংবাদিক তিনি যিনি দুহাজার বিশের আঠাশে এপ্রিল রাত দশটায় আমাদের ছেড়ে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে।
মাথার উপরের ছাদ ভেঙে গেলে থাকে খোলা আকাশ।সেই খোলা আকাশের ঝড়ঝাপটায় রেখে যান আমাদের অকালে প্রয়াত হন খোকন।যাকে আমি সাংবাদিক বলে সম্ভাষণ করতাম।কোনদিনকি ভেবেছিলাম তার অবর্তমানে একদিন তাকে নিয়েই আমাকে কলম তুলে নিতে হবে।যে কালিতে মিশে আছে খোকনের জন্য আমাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ও হাহাকার।অপ্রতিহত এ ক্ষরণ প্রতিটি মুহুর্তে আমার বুকে প্রবাহিত হয়ে একটু একটু করে শুষে নিচ্ছে বেঁচে থাকার শেষ রেণুটুকু।যে নিজে আমাকে হাতে কলম নিয়ে লেখার উৎসাহ জুগিয়েছে। আমার প্রতিটি লেখায় যার উৎসাহ উদ্দীপনা আমাকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।আজ আমাকে এভাবে রেখে মধ্য গগণের সূর্যটা ডুবে যাবে কে জানতো প্রকৃতির এই নির্মমতা। আমাকে একা পথের পথিক বানিয়ে অকালে ঝরে গেলো সে।প্রতিটি মুহুর্ত তার অনুপস্থিতি আমাকে কুরে কুরে খায়।এক মুহূর্তের জন্য পারিনা চোখের আড়াল করতে।দিন বা রাত ঘুমাতে পারিনা। সারারাত জেগে জেগে তার বন্দনায় কাটে।একটু চোখ বুজলেই কেঁপে উঠি।হেলান দিয়ে বসে থাকি বাকি রাত।তার ছবি গুলো দেখি আর চোখের জলে ভাসি।আমার সাংবাদিক তোমার কি এতটাই তাড়া ছিলো তোমার স্বজনদের নিঃশ করে এভাবে চলে যাওয়া।পৃথিবীর অমোঘ নিয়মের কাছে পরাজিত হয়ে মেনে নিতে হয় সব কিছু।কিন্তু মন সব বাঁধার বাইরে তাকেতো বোঝানো যায়না।মেনে নিতে বাধ্য হই ভুলতে পারিনা।এই ক্ষত শুকানোর জন্য কোন ঔষধ কি কেউ আবিষ্কার করতে পারবে?
একজন হুমায়ুন কবির খোকনকে আমি শুধু মাত্র সন্তান স্বামী ভাই পিতা বা কোন সম্পর্কে মূল্যায়ন করিনা।ব্যাক্তি মানুষ হিসেবে খেকন একজন অতুলনীয় মানুষ। যার তুলনা একমাত্র সে নিজে।ব্যাক্তি মানুষ হিসেবে তার কর্মে সে আরো বেশী মূর্তমান।সেটা তার চারপাশের স্বজন- শুভাকাংখী,কলিগরাই আরো ভালো বলতে পারবেন।তিনি কখনও কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষন করতেন না। মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন সর্বদা।অর্থ দিয়ে না পারলেও শ্রম বুদ্ধি মানবিকতা দিয়ে মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন। মানুষের বিপদের সহায় হয়েছেন।অমায়িক নির্লোভ দুর্নীতিমুক্ত এই মানুষটিকে পৃথিবীর সেরা ভালো ও সুন্দর উপমায় ভূষিত করলেও কম হয়ে যাবে।তাকে কোনদিন আমি রাগতে দেখিনি সর্বসংহা এ মানুষটি শত দুঃখ কষ্ট দারিদ্র্যতা হাসিমুখে তুচ্ছ করে গেছেন।কাউকে কোনদিন দুটো বেশী কথাও বলেননি।দূরের কাছের সবাইকে লক্ষী ভাই লক্ষীসোনা বলে সন্মোধন করে গেছেন।অফিসের কাজেও ছিলেন পরম দায়িত্বশীল। কোন ছোট ভাই বোনের সাংবাদিকতার চাকরীর কথা বললে তিনি বিভিন্নজনকে বলে অনেকের চাকরীর ব্যাবস্হা করেছেন।উপর লেভেল থেকে নিচ লেভেল পর্যন্ত সবার সাথেই ছিলো আত্মিক সম্পর্ক কিন্তু কখনও নিজের বা পরিবারের কারো জন্য সুযোগ সন্ধানী হননি।কুমিল্লা সাংবাদিক ফোরমের সভাপতি ছিলেন তিনি।এবং আরো অনেক সংগঠনের তিনি সদস্য ছিলেন। কৈশরে পিতৃহীন খোকন তার মায়ের বড় ছেলে ছিলেন।পাঁচ ভাইবেনের মধ্যে মা তার অন্য সন্তানদের চেয়ে খোকনকে বেশী ভালো বাসতেন।ভাই বেনেরাও তাকে যেমন ভালোবাসতো তেমন শ্রদ্ধা করতো।ছোট ভাই বোনদেরও কখনও তিনি ধমক দিয়ে কথা বলতেন না।তিনটি সন্তান ছিলো তার চোখের মণি।সন্তানদের কোন দাবী পূরণ করতে না পারলেও হতাশ করতেননা। সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতেন।স্বামী হিসেবে খোকনের তুলনা নেই।বন্ধু স্বামী অভিভাবক হিসেবে তার প্রতি ছিলো আমার পরম নির্ভরতা। আমারই বড় বোন কবি দীলতাজ রহমানকে তিনি দেবীর মতো জানতেন ভালোবাসতেন।তার ও আমার বাবার বাড়ির প্রতিটি মানুষকে তিনি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন।অন্যেরাও ঠিক তেমনি তাকেও ভালোবাসতেন পছন্দ করতেন।সকল মানুষের ভালোবাসা পাবার এক সন্মোহনী শক্তি ছিলো তার।তাকে নিয়ে লিখলে এক মহাকাব্যেও শেষ হবার নয়।
খোকন মাঝে মাঝে কাজের ফাঁকে কবিতা লিখতেন। একটা গানও লিখেছিলেন তিনি শিল্পি আর ডি হিল্লোল সেই গানটির সুরকার ও শিল্পি ” এমন একটা আকাশ চাই যে আকাশে তুমি আমি ছাড়া আর কেউ নাই”।যাই হোক দুইহাজার একুশে বেহুলা বাংলা প্রকাশনী থেকে তার বইটি বের হচ্ছে।হুনায়ুন গালিব নামে তিনি যে কবিতাগুলো লিখে গেছেন সেগুলে আমি বিভিন্ন ডাইরি ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করে ছাপানোর ব্যবস্হা করেছি।তার বইটি যেন আলোর মুখ দেখতে পারে সেই সাথে তার অপূর্ণ স্বপ্নকে যেন রুপায়িত করার তৌফিক মহান আল্লাহ আমাকে দান করেন।
পরিশেষে রবী ঠাকুরের সেই পংতি দিয়ে মহান হৃদয়ের এই মানুষটিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাই।
“নয়নো সমুখে তুমি নাই নয়নের মাঝখানে নিয়েছো যে ঠাঁই”
করোনা যুদ্ধে প্রথম শহীদ হওয়া মহান এই গণমাধ্যমকর্মীর জন্য গভীর শ্রদ্ধা ভালোবাসা।