নয়ন ভোলানো নয়নতারা
হুমায়ূন কবীর ঢালী
অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম, নয়নতারা নিয়ে লিখব। লেখা আর হয়ে ওঠে না। আর একবার যা পেছনের সাড়িতে চলে যায়, তা সহজে সামনে আসতে চায় না। এই বদ স্বভাবটা ধারণ করছি লেখালেখির শুরু থেকেই। স্বভাবটা দূরও হয় না। কথায় আছে, স্বভাব যায় না ম’লে, ইজ্জত যায় না ধু’লে। তার মানে মরার আগে এই স্বভাব যাবে কিনা আল্লাহ মালুম।
আজ গো ধরেছি, লিখবই নয়নতারা নিয়ে। কোন নয়নতারা বুঝতে পেরেছেন তো? তেলেগু নায়িকা নয়নতারাকে নিয়ে নয়। কিংবা নয় চলচ্চিত্র পরিচালক নয়নতারাকে নিয়ে। বলছিলাম নয়নতারা ফুলের কথা।
সকালে জিপিওর ভেতর দিয়ে হেঁটে পল্টনে আসছিলাম। জিপিওর বাগানে চোখে পড়ল শোভাবর্ধনকারী নয়নতারার। বাগানে ও বিল্ডিং লাগোয়া নয়নতারার অপূর্ব বাহার। কী সুন্দর হাসছে! এমন বাহারি শোভাবর্ধনকারী ফুল দেখলে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায়? মুগ্ধতায় চোখের তারা কাঁপছিল। এজন্যই বুঝি চোখের আরেক নাম নয়ন? তাই বুঝি নয়নতারা? কী জানি সে ব্যাখা থাক এখন। আমার মতো মুগ্ধতায় কত কবি শিল্পী তাঁদের কথায়-গানে নয়নতারাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। কবীর সুমনের গানের কথা মনে পড়ে গেল।
সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল
দেখছি চেয়ে প্রথম তারা
সে যেন চায় আমার চোখে
তার দুখানি নয়নতারা
সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল
এখন ঘরে ফিরছে যারা
তাদের মনে শান্তি আসুক
শান্তি আনুক সন্ধ্যেতারা
সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল
দেখছি চেয়ে প্রথম তারা
সে যেন চায় আমার চোখে
তার দুখানি নয়নতারা
সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল
ক্লান্ত হয়ে দিন ফুরোলো
এখন অবসন্ন যারা
তাদের জন্য সন্ধ্যেতারা
সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল
কখন তুমি আসবে বল
অপেক্ষাতেই তন্দ্রাহারা
থাকবে আকাশ তারায় তারা
সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল
দেখছি চেয়ে প্রথম তারা
সে যেন চায় আমার চোখে
তার দুখানি নয়নতারা
সন্ধ্যে হল সন্ধ্যে হল।
সুজন বড়ুয়ার ছড়ায় বৈশিষ্ট উল্লেখপূর্বক নয়নতারার কথা বলা হয়েছে সরল বর্ণনায়।
একটি দুটি তিনটি চারা
এক টবে তিন নয়নতারা
ফুল ফোটানোর ভীষণ তাড়া
তাই চলে রোজ জলের ধারা
কদিন যেতেই ডালপালারা
লাফিয়ে যেন পাগলপারা
তারপরে দেয় মিষ্টি সাড়া
কা-টা নয় সৃষ্টি ছাড়া
লাল-বেগুনির কী ইশারা
পাতার ফাঁকে ওসব কারা
আকাশ থেকে নামছে তারা?
ফুলকলিদের কড়া নাড়া!
ফুলের শোভায় মাতল পাড়া
টবের মালিক আত্মহারা।
মনে পড়েছে। নয়নতারার আরেকটি নাম কি সন্ধ্যাতারা? নাকি আরেকটি জাত? গত বছর নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে দেখেছিলাম। বিখ্যাত সপিংমল ‘মেসি’র সামনে সাজানো। আমি চিনতে পারছিলাম না ফুলগুলো। কাজিন রিভিন বলল, সম্ভবত সন্ধ্যাতারা বলে এগুলোকে। নয়নতারার মতোই দেখতে।
মেসির সামনে গ্রাফ করে সন্ধ্যাতারা লাগানো হয়েছে। দেখে মনে হলো, Vinca rosea প্রজাতির হবে। ঝাউগাছের আদলে লোহার মাচায় উপরের দিকে তুলে দেওয়া হয়েছে। দেখতে লাগছিল বেশ। নয়নাভিরাম। সেলফিযুগে এমন সৌন্দর্যের সাথী হতে কার না মন চায়! প্রথমে সেলফি। পরে রিভিনের ক্লিকে কয়েকটি ছবি তুলে সৌন্দর্যসাথী হলাম।
বাংলাদেশেও অসংখ্য ক্লিক করেছি নয়নতারার। কী কারণে যেন ফুলটি ভালো লাগে। নামের মধ্যেই তো ভালোলাগার একটা ব্যঞ্জনা রয়েছে। কাব্যিক। নয়নের তারা। চোখের মণি। স্বভাবে বিনীত। গন্ধহীন। গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। বর্ষজীবী। দুই থেকে তিন ফুট লম্বা হয়। প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মার ভাষায়, “কোনো দাবি-দাওয়া নেই গাছটির। অযত্নে বাড়ে। বাগানের বাইরেও অজস্র ফুল ফোটায়। আশপাশ আলো করে রাখে।”
নয়নতারার আদি নিবাস মাদাগাস্কার। ওয়েস্টইন্ডিজ। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও আফ্রিকা মহাদেশসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশে এর দেখা পাওয়া যায়।
পুস্তকের ভাষায়, লালচে গোলাপি পাঁচ পাপড়ির ফুলের জন্য পরিচিত নয়নতারা। সাধারণভাবে গাছটি বর্ষজীবী তবে অনেক সময় বহু বছরও বাঁচে। নয়নতারার পুরনো বৈজ্ঞানিক নাম ভিনকা রোসিয়া এবং নতুন বৈজ্ঞানিক নাম ক্যাথারানথাস রোসিয়া। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামেও পরিচিত। আরেকটি প্রজাতি হলো Vinca rosea। আদি উৎপত্তিস্থল মাদাগাস্কার। চিরহরিৎ লতাপাতা সংক্রান্ত উদ্ভিদ। ৬০-৮০ সেমি উঁচু। এদের কাণ্ড কোনাচে বেগুনি। এদের পাতা আয়তাকার,গোড়ার দিকে অনেকটা ডিম্বাকার, ৪-৭ সেমি লম্বা, মসৃণ। এসব গাছে প্রায় সারা বছরই ফুল ফোটে। ফুল সাদা বা গোলাপি রঙের। পুরো ফুল একরঙা হলেও ফুলের মধ্যবিন্দুটি অন্য রংয়েরও হয়। সাদার মাঝে লাল,গোলাপীর মাঝে হলুদ। ফুলের মাপ ৩-৩.৫ সেমি চওড়া, দলনল সরু, ২.৫ সেমি লম্বা, ৫ পাপড়ির মাঝখানে একটি গাঢ় রঙের ফোঁটা। এদের বীজ চাষ করা হয়।
নয়নতারা গাছে সারাবছরই ফুল ফোটে এবং ফল ধরে। শুঁটি ধরনের ফল, সরিষার দানার চেয়ে সামান্য বড়। এই ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে গাছ লাগানো যায়। আবার গাছের কলম তৈরি করেও গাছ লাগানো যায়। টবে করে বাসার ছাদে বা বারান্দায় লাগানো যায়। গভীর ও লম্বা টব ব্যবহার করাই উত্তম। টবের তলায় একটু বড় করে ছিদ্র করুন। সাধারণ মাটিতেই এই গাছ হয় তবে পানি নিয়মিত দিতে হবে। নয়নতারা গাছে মাঝে মাঝে ভাইরাসের আক্রমণ নয় এবং সেক্ষেত্রে গাছটি বাঁচে না। তাই উপযুক্ত সাবধানতা অবলম্বন করা ভালো। মাঝে মাঝে খুব লম্বা ডালগুলো খানিকটা ছেঁটে দিন, নয়তো কাণ্ড কাষ্ঠল হয়ে যাবে এবং ফুলও কমে আসবে।
পাতা বিপরীত, মসৃণ, আয়তাকার বা ডিম্বাকৃতি। গোলাপি, হালকা গোলাপি ও সাদা রঙের ফুল ফোটে। কাণ্ড কোনাচে ধরণের, রঙ বেগুনি বা সাদা,বারমাসি উদ্ভিদ, বীজের সাহায্যে বংশ বৃদ্ধি হয়।
আয়ুবের্দিক ও ইউনানী চিকিৎসায় একটি উত্তম ঔষধি গাছ। গাছটির পাতা, ফুল ও ডালে বহু মূল্যবান রাসায়নিক উপাদান পাওয়া যায়। তিক্ত ভেষজ নয়নতারা। গাছটির সম্পূর্ণ অংশই স্বাদে তিতা। ভিনক্রিস্টিন ও ভিনব্লাস্টিন নামের উপক্ষার দুটি লিউকেমিয়া রোগে বিশেষ ব্যবহার রয়েছে। ডেলটা-ইহোহিম্বিন নামের এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া যায়।
ক্রিমি রোগে, মেধাবৃদ্ধিতে, লিউকোমিয়া, মধুমেহ, রক্ত প্রদরে, রক্তচাপ বৃদ্ধিতে, সন্ধিবাত, বহুমূত্র সহ নানা রোগে এর ব্যবহার রয়েছে। বোলতা প্রভৃতির হুলের জ্বালায়, কীট দংশনে দ্রুত উপশম পেতে নয়নতারা ফুল বা পাতার রস ব্যবহারের প্রচলন লক্ষ্য করা যায়।
লেখক: শিশুসাহিত্যিক ও সংগঠক।
২ Comments
ধন্যবাদ সম্পাদক মহোদয়।
দারুণ প্রকাশ; শুভকামনা