শিকারী
যুথিকা জ্যোতি
পর্ব: এক
পার্ট টাইম হলেও ডিপার্টমেন্ট ষ্টোরে কাজ করতে বেশ ভালোই লাগতো। আমরা বিশজন কর্মচারী। তিনটে করে শিপ্ট্, এক এক শিপ্টে আমরা ছ’জন কাজ করতাম। আর এক ইটালিয়ান ভদ্রলোক ছিলেন ষ্টোরের ম্যানেজার। বছরখানিক পর দেখলাম, নতুন সাজ-সজ্জায় এবং সুন্দর ব্যবস্থাপনায় ষ্টোরের চেহারা সম্পূর্ণ বদলে গেল। বদলে গেল ক’য়েকজন কর্মচারী এবং ম্যানেজার। ভাবলাম, ষ্টোরের মালিক পুরোনো কর্মচারীদের বিদায় দিয়ে নতুন লোক হায়ার করছেন। কিন্তু মাসখানিক কেটে যাবার পরও আমরা ক’য়েকজন কর্মচারী তেমন কোনো নোটিশ পেলাম না। নতুন ম্যানেজারের মতিগতিও ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। মনে মনে ভীষণ টেন্শনে থাকতাম।
একদিন হঠাৎ নতুন ম্যানেজার এ্যন্থনি লরেন্স আমাকে আর্জেন্ট ডেকে পাঠালেন। আমি তো শুনেই ঘাবড়ে গেলাম। একেই নতুন মানুষ। দরাজ গুরুগম্ভীর তার কন্ঠস্বর। যেমন দৈত্যের মতো বিশাল লম্বা চেহারা, তেমনি হ্যান্ডসাম উজ্জ্বল গৌরবর্ণের সুদর্শণ মার্জিত পুরুষ। একবার চোখ পড়লে আর পলক পড়ে না। বেশ হৃদয়াকর্ষক চেহারা। অথচ তার সন্নিকটে গিয়ে দাঁড়ালেই গা কেঁপে ওঠে।
গেলাম মন্ত্রের মতো জপতে জপতে, এবার আমাকেও বোধহয় বিদায় করে দেবেন। এই আশংক্ষায় হৃৎস্পন্দন আরো দ্রæতগতীতে চলতে থাকে। কিন্তু গিয়ে দেখি, অফিস ঘরের দরজাটা আলতোভাবে বন্ধ। ভিতর থেকে ভেসে আসছে মহিলা কন্ঠস্বর। হাসি-কলোতান। কখনো হাস্যরোলের ধ্বনী প্রতিঃধ্বনীত হয়ে বদ্ধ দরজা ভেদ করে বেরিয়ে আসছে বাইরে। আমার কৌতূহল হোলো। শুনলাম আড়ী পেতে। শুনে মনে হোলো তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। চলছে কতগুলি অবান্তর অপ্রয়োজনীয় কথার আদান প্রদান। হাসি-মশকরা।
আমি থমকে দাঁড়াই। হতভম্ভের মতো হাঁ করে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি। মনস্থির করতে পাচ্ছি না কী করবো। ভিতরে বেশ জমিয়ে আড্ডা চলছে বোঝা যাচ্ছে। ডিষ্টার্ভ করাটা কী ঠিক হবে! নাঃ ফিরেই যাই, ভাবলাম মনে মনে। কিন্তু পরক্ষণেই স্বভাবসুলভ কারণে উক্ত মহিলাকে স্বচোক্ষে দেখবার বড় কৌতূহল জেগে উঠলো, কে এই মহিলা! হাসির ফোয়ারায় একেবারে দেওয়াল কেঁপে উঠছে। রীতিমতো আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। পাড়ার ক্লাবঘরও হার মেনে যাবে।
মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে দরজাটা নক্ করে ঠেলে ঢুকে পড়লাম ভিতরে। ঢুকেই চমকে উঠি। স্তম্ভিত হয়ে যাই বিস্ময়ে। বোবার মতো নির্বাক দৃষ্টিতে হাঁ করে চেয়ে থাকি। -এ কি, আমাদের সহকর্মী লিলি যে! ও’এখানে কি করছে! ম্যানেজারের এতো ঘনিষ্ঠ হোলো কবে থেকে! দু’জনেই নিউ কামার। মাত্র মাসখানিক হয়েছে জয়েন করেছে। কখনো কথাবার্তাও তো বলতে দেখিনি। ওকে একেবারে পশমাবৃত দুইবাহুতে আলিঙ্গন করে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দু’চোখের দৃষ্টি মেলে ম্যানেজার এ্যন্থনি লরেন্স আস্বাদন করছে, সৌন্দর্য্যরে পারিজাত লিলির বাঁধ ভাঙ্গা উত্তাল যৌবনের চমকপ্রদ রূপ, আর রং। একেবারে রোমিও-জুলিয়েটের মতো প্রেমলীলায় মশগুল দুজনে।
আশ্চর্য্য, ওরা এর মধ্যেই প্রেমে পড়ে গেল না কী! কিন্তু ম্যানেজার এ্যন্থনি একজন গণ্য-মান্য ব্যক্তি, তার এমন অভিরুচী? এই তার অভিব্যক্তির পরিচয়? বেহায়ার মতো একজন মহিলা কর্মচারীর সাথে অবৈধভাবে এধরণের বিহেইভ তার মোটেই শোভা পায় না। বললাম মনে মনে।
দরজাটা খুলতেই প্রেমালিঙ্গনে বন্দিনী লিলি হকচকিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ আমাকে দেখে হাওয়ার গতীতে অফিস ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। লক্ষ্য করলাম, অপ্রস্তুত ম্যানেজার এ্যন্থনিও হঠাৎ আমার আগমনে থতমত খেয়ে গেল। নড়ে চড়ে বসে একটা ঢোক গিলে আমায় বললেন,-‘সরি ম্যাম, ভেরী বিজি নাউ। কাম লেইটার।’
-‘ও.কে স্যার।’ বলে দ্রুত অফিস ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়েই দেখি, দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে লিলি। আহাল্লাদে যেন ফেটে পড়ছে। উচ্ছাসিত চোখে কিছু বলার ব্যকুলতায় প্রসন্ন চিত্তে দাঁতকপাটি বার করে নৈঃশব্দে মুখ টিপে হাসছে।
দেখে পিত্তি জ্বলে উঠল আমার। রাগে সর্বাঙ্গ রি রি করছে আমার। একটু চক্ষু লজ্জাও নেই! ক্ষণপূর্বের দৃশ্যটি বার বার মনঃশ্চক্ষে ভেসে উঠছে। কেমন নির্লজ্জ বেহায়ার মতো অসংযত অবস্থায় ম্যানেজার এ্যন্থনির পেশীবহুল বাহুদ্বয়ের উষ্ণ আলিঙ্গনে গভীরভাবে লিপ্ত হয়েছিল। হয়তো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এক গভীর রোমাঞ্চকর উন্মাদনায় মেতে উঠতো দুজনে। তন্ময় হয়ে ডুবে যেতো, ক্ষণিক সুখের অতল গহŸরে। হঠাৎ দরজাটা খুলতেই হকচকিয়ে গিয়েছিল প্রেমালিঙ্গনে বন্দিনী লিলি। ঝড়ের বেগে দ্রুত ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল বাইরে। এখন দেখছি, ওর দু’কানই কাটা। লজ্জা শরমের বিন্দুমাত্রও বালাই নেই।
পরদিন যথারীতি ষ্টোরে প্রবেশ করে কর্মচারী ডেভিট আর নাতাশার কানাঘূষোয় অবগত হলাম, শিপ্ট্ চেঞ্জ্ করেছে লিলি। মর্নিং-শিপ্ট্ কাজ করবে। ভাবলাম, তা’হলে তো ওর পোয়া বারো। আফ্টারনুনের আগে কাষ্টোমারের খুব একটা ভীড় হয় না। বিকেল পর্যন্ত ফাঁকাই থাকে প্রায়। চলবে অন্তরঙ্গ আলাপন, অভিসার। চুটিয়ে দুজনে প্রেম করবে, রোমাঞ্চ করবে, আরো কত কি!
তার কিছুদিন পর দৃষ্টিগোচর হয়, ম্যানেজার এ্যন্থনির অভাবনীয় পরিবর্তন। কেমন নীরব নিরুচ্ছাস, কাজকর্মেও অমনযোগী। সারাদিন অন্যমনস্ক, উদাসীনভাব। কিসের চিন্তায় যেন ডুবে থাকে। গলা দিয়ে তার আওয়াজই বের হয় না। একদম নরম হয়ে গিয়েছে। কথাবার্তা বলছে অত্যন্ত ক্ষীণ শব্দে।
সাধারণত যুবতী রমণীরাই অনধিকার চর্চায় একটু মাথা ঘামায় বেশী। তেমনি কৌতূহলও। বিশেষ করে প্রণয়মূলক ব্যাপারে। কোনপ্রকারে ইঙ্গিত একটা পেলেই হোলো, সত্য উদ্ঘাটন না হওয়া পর্যন্ত কেউই স্বস্তি পায় না। হঠাৎ বিনা নোটিশে রাতারাতি চব্বিশঘন্টার মধ্যে লিলির শিপ্ট্ পরিবর্তন, ম্যানেজার এ্যন্থনির মন-মানসিকতার পরিবর্তন শুধু বিস্ময়করই নয়, রীতিমতো রহস্যজনকও বটে। সন্দেহ ক্রমশ ঘনীভূত হতে থাকে, ব্যাপারটা কি!
একদিন মুখোমুখি দেখা লিলির সাথে। আমি ঢুকছি, ও’ বের হচ্ছে। চোখে চোখ পড়তেই লিলি ফিক্ করে হেসে ফেলল। অনিচ্ছাসত্তে¡ও আমিও অস্ফুট হেসে ফেলি। তাতে সুপ্রসন্ন হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল লিলি। লজ্জা আর আবেগের সংমিশ্রণে চোখের তারাদু’টি ওর উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে। ওর চেহারায় এতটুকু মলিনতার ছাপ নেই। একগাল অনাবিল হাসি ছড়িয়ে উৎফুল্ল হয়ে আমায় বললো,-‘হায়, হাউ আর ইউ? তুমি বাঙ্গালী আছো, এ্যাম আই রাইট?’
স্ববিস্ময়ে আমিও পাল্টা প্রশ্ন করলাম ওকে। উত্তরে ‘নেহি’ বলে হঠাৎ আমাকে চমকৃত করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলতে শুরু করে। -‘হাঁ তোমার কোতার এ্যাক্সেন্টেই হামি বুঝে লিয়েচি। হাম্লোগ মারাঠি আছি। প্যায়দা হইচি কোলকাত্তায়। বাংলা স্কুলে পাঁচ সাল পড়হাই করেছি। কোলকাত্তায় বহত দিন ছিলাম মায়ের সঙ্গে। এখনও থোড়া থোড়া এয়াদ আছে।’
ওর কথা শুনে কৌতূহল আরো বেড়ে গেল আমার। জিজ্ঞ্যেস করলাম,-‘ম্যানেজার এ্যন্থনি কে হয় তোমার?’
আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো লিলি। মনে হোলো, এই প্রশ্নটির জন্যই অপেক্ষা করছিল। আহাল্লাদে গদগদ হয়ে একগাল অনিন্দ্য সুন্দর হাসি ছড়িয়ে উত্তরে বললো,-‘ও হামার রিলেটিভ্ আছে।’
জানতে চাইলাম ম্যানেজার ইন্ডিয়ান কিনা। কথাটা উপেক্ষা করে চোখের ইশারায় বলে উঠলো,-‘জলদি যাও ব্যাহেন জী! উদেখো, ম্যানেজার সাহাব খাড়া হ্যায় উধার। ও জরুর ওয়াচ্ করছে আমাদের।’
আমি অবিলম্বে ষ্টোরের ভিতরে ঢুকে পড়লাম। যতক্ষণ কাজে ছিলাম, সারাক্ষণ শুধু লিলির কথাই ভাবছিলাম। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলছিল, দারুণ লাগছিল শুনতে। কিন্তু যতটা অনুমান করেছিলাম, অতটা খারাপ ও’ নয়। বেশ মিশুকে মেয়েটা। কথায় কথায় হাসে। হাসির একটা প্রলেপ সবসময় লেগে থাকে ওর মুখে। কখনো বিলীন হয না। সেইসঙ্গে কথাবার্তায় সরলতা আর আবেগের প্রবণতাও কম নয়। মানুষকে কনভিন্স করার অসাধারণ ক্ষমতা ওর। দেখে বোঝা যায় না। যা অত্যাশ্চর্য্যজনকভাবে আমাকে আবিষ্ট করে রেখেছিল। দেখতে খুউবই সুন্দরী। হরিণের মতো আঁখিপল্লব। তীক্ষè নাসিকা। বুদ্ধিদীপ্ত চোখের চাহনি। শ্বেতাঙ্গদের মতোই দুধসাদা গায়ের রং। টোলপড়া গোলাপ গালের বাঁ-পাশে ঝুলে থাকে একগোছা কালো রেশমী চুল। চিবুকের উপরে বড় একটা কালো তিল। যেমন শরীরের গড়ন, কোমরের খাঁজ এবং নিখুঁত নিতম্ব, তেমনি বাঁধ ভাঙ্গা যৌবন যেন উপছে পড়ছে। প্রজাপতির মতো চঞ্চল, উচ্ছলতা এবং মায়ামৃগের মতো প্রাণবন্ত পদচারণায় ওকে দারুণ লাগে। নজর ফেরানো যায় না। আর ম্যানেজার এ্যান্থনির মতো একজন তরুণ সৌন্দর্য্য প্রেমিক মানুষ লিলির প্রেমজ্বালে বশীভূত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। শুধুমাত্র এ্যান্থনি কেন, যে কোনো পুরুষমানুষকেই পলকমাত্র দৃষ্টিপাতে চুম্বকের মতো আকর্ষিত করবে, তাদের হৃদয় হরণ করবে, একেবারে নিশ্চিত, অবধারিত।
কিন্তু প্রথম আলাপেই ওর সঙ্গে এমন বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে, তা কখনো ভাবিনি। কখনোই ভাবতে পারিনি, ওকে অন্তর দিয়ে ভালোবেসে ফেলবো। ওর প্রতি আমার যে একটা খারাপ ধারণা জন্মেছিল, সেটাও বিনষ্ট হয়ে গেল নিমেষে।
সেদিনের পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয় লিলির সাথে। বন্ধুত্বের সৌজন্যে হায় হ্যালো বলে কুশল বিনিময় করা একটা রুটিন হয়ে গিয়েছিল। মাঝেমধ্যে দেখতাম, লিলি বাড়িই যায় না। ম্যানেজার এ্যন্থনির ব্যক্তিগত ফাই-ফরমাইশও ওকে খাটতে হয়। কোনো কোনোদিন গল্প করেই সময় কাটায়। জীবনে অনেক সংগ্রাম করেছে। কিশোরী বয়সে বাবাকে হারিয়ে পদে পদে অপদস্থ হয়েছে। ভাগ্যবিড়ম্বণায় দারিদ্রপীড়িত জীবনের সংঘর্ষে নানান বিপর্যয়ের সম্মুখীন হোতে হয়েছে। বহু কষ্টও স্বীকার করতে হয়েছে। জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। আজ সমস্ত বাঁধা-বিঘœ অতিক্রম করে মঞ্জিল ওর হাতের মুঠোয়।
একদিন নোটিশ করলাম, অপ্রাসঙ্গিকভাবে বার বার স্বামীর প্রসঙ্গই টেনে আনছে লিলি। স্বামীই ওর আলচ্যের একমাত্র মূল বিষয়। যার প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ। শুধু জীবন দেবতাই নয়, ওর প্রাণপ্রতিম, প্রাণেশ্বর, প্রেমের পূজারী। যিনি প্রথম প্রেম নিবেদনে সহৃদয়ে লিলির স্বোয়াগত করেছিল হীরার নেক্লেস গলায় পড়িয়ে। খুউব রীচ ম্যান্, উচ্চবিত্ত খান্দানি বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারী। লা-জবাব, হ্যান্ডসাম্ ওর স্বামী। দুইখানা ফাইভ-ষ্টার হোটেলের মালিক। ফিল্ম-ষ্টারদের মতো চেহারা। যে কোনো মেয়েই প্রেমের পত্তন ঘটে ওর দেওয়ানা হয়ে যায়। কিন্তু লিলিই ওর স্বামীর একমাত্র ভালোবাসার ফুল। স্বামীর নয়নের মণী। আর স্বামী ওর জান। যে ব্যক্তি পর নারীর মুখদর্শণ করা তো দূর, কখনো না কি তাদের ছায়াও স্পর্শ করেন না।
মনে মনে ভাবলাম, খুব ভাগ্যবতী মহিলা লিলি। বিরল ওর সৌভাগ্য। কত সুখী ও’ জীবনে। এমন সৌভাগ্য ক’জনের হয়। চিন্তাই করা যায় না। কিন্তু লিলি যা বলছে, সত্যিই কী তাই! সত্যিই কী ওর স্বামী এতোবড় রীচ্ ম্যান। সত্যিই ও’ যদি স্বামী সোহাগী হয়, তা’হলে একজন পরপুরুষ ম্যানেজার এ্যন্থনির সাথে এতো কিসের ভাব ভালোবাসা ওর! কিসের এতো ঘনিষ্ঠতা! আর কেনইবা ম্যানেজার এ্যন্থনির সাথে ওর এতো গলাগলি, ঢলাঢলি।
ক্ষণিকের নিরবতায় লিলি বললো, -‘চুপ কিঁউ হো ব্যাহেন জী! কুছ তুম ভি শুনাও!’
পরিহাস করে বললাম,-‘তোমাকে তো সোনার ফ্রেমে বেঁধে রাখা উচিৎ। এমন চাঁদবদন তোমার, রৌদ্রের এই প্রখড় উত্তাপে ঝলসে যাবে যে!
অস্ফূট হেসে বলে,-‘মজাক করছ!’
-‘তা’হলে তোমার চাকুরির কী দরকার? কিসের অভাব তোমার?’
ঠোঁটের কোণায় কৌতূকের হাসি ফুটিয়ে লিলি বললো,-‘আরে এয়ার, ওতো স্রিফ টাইম পাস করার জন্যে। অউর পুরাদিন ঘরমে এ্যকেলা ব্যয়ঠে ব্যয়ঠে কঁরুঙ্গি ভি ক্যায়া! বাল্ বাচ্চা তো হ্যায়ই নেহি!’
ওকে উৎসাহ দিয়ে বললাম,-‘কিঁউ নেহি! প্রটেক্ট্ দেওয়া বন্ধ করো, তা’হলেই তো হয়!’
আবার সেই মুক্তঝরা হাসি লিলির। মশকরা করে এমন কী বললাম, হাসতে হাসতে ও’ একেবারে গায়ের ওপরেই ঢলে পড়ছে।
দুই
পেরিয়ে গেল ক’য়েক পক্ষকাল। সামনেই আসন্ন খ্রীষ্টমাস্, বড়দিন। ইংরেজী নতুন বছর। দৈনন্দিন জীবনের আনুষঙ্গীক প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে, বাচ্চা-বুড়ো-জোয়ান প্রতিটি মানুষ। প্রত্যেকের কেনা কাটাও চলছে পুরোদমে। ষ্টোরে পা ফেলার জায়গা নেই। কাষ্টোমারের প্রচন্ড ভীড়। নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাচ্ছি না কেউ। ওদিকে লিলিও দু’দিন যাবৎ কাজে আসছে না। কোনো খোঁজখরব নেই ওর। গিয়ে ম্যানেজারকে জিজ্ঞ্যেস করবো, সাহসই পাচ্ছি না। কর্মচারীরা সবাই যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। হঠাৎ দেখি লিলি, অন্যদিনের তুলনায় ওকে একটু ব্যতিক্রম লাগছে। কারো সাথে কথা না বলে সে একেবারে লোকের ভীড় ঠেলে উত্তপ্ত মেজাজে সোজা অফিস ঘরের দিকে উর্দ্ধঃশ্বাসে হন্হন্ করে এগিয়ে যাচ্ছে।
অপ্রত্যাশিত হঠাৎ ওর ওই মূর্তি দেখে আমরা ষ্টোরের কর্মচারী সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম বিস্ময়ে। স্বাভাবিক কারণেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেদিকে।
ইতিপূর্বে অফিস ঘরের দরজা বন্ধ দেখে পিছন ফিরতেই চোখে চোখ পড়ে গেল লিলির। ওকে হাতের ইশারায় বললাম-‘ম্যানেজার সাহেব নেই, বাইরে গেছে।’
লম্বা চার-পায়ার একটা টুল ছিল সামনে, টুলটা টেনে নিয়ে লিলি আমার পাশে এসে বসলো। কিন্তু ওর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, রাগে বেলুনের মতো ফুলছে। চোখমুখ লাল হয়ে আছে। চোখ দিয়ে যেন আগুনের গরম শলাকা বের হচ্ছে। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে হাঁপাচ্ছে আর বলছে,-‘ম্যানেজার সাহাব কব্ বাপস্ আসবে জানো?’
মাথা নেড়ে বললাম,-‘না। কিন্তু কি ব্যাপার বলো তো! চেহারার এ কি হাল হয়েছে তোমার? কেমন শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে! কেশ বিন্যাস এলোমেলো। ড্রেস্ও চেঞ্জ করো নি। খুব জরুরী তল্লাসী মনে হচ্ছে।’
গম্ভীর হয়ে লিলি বললো,-‘কিঁউ হবে না, গলত কদম জো উঠায়া। আবতো জুরমানা ভড়না পড়েগী না, ইসি লিয়ে।’
কিছুটা সময় নিরবতায় কেটে গেল। আমার নিরুত্তরে লিলি বললো,-‘সরি এ্যায়ার, খামাখা দুঃখ লিবে না। কসুরবার তো ম্যায় হু।’
হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে-‘ও আগয়ি।’
দেখলাম, খট্ খট্ শব্দে বুটের আঘাত করতে করতে একেবারে মিলিটারি মেজাজে ষ্টোরে ঢুকছে ম্যানেজার এ্যন্থনি লরেন্স। লিলিকে দেখামাত্রই মুখখানা বির্বণ হয়ে গেল। কটাক্ষ দৃষ্টিতে একপলক তাকিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলতে বলতে ঢুকে পড়লেন অফিস ঘরে। ওর পিছন পিছন লিলিও ঢুকে পড়লো ভিতরে। তার ঠিক মিনিট কুড়ি পরই যেন বিরাট একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। আমরা চমকে উঠি। হঠাৎ বজ্রকণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন ম্যানেজার এ্যন্থনি,-‘আই সেইড গেট আউট্ ফ্রম হীয়ার! আউট্!’
গলা টেনে দেখি, লিলিকে ধাক্কা দিয়ে অফিস ঘর থেকে বের করে দিলেন ম্যানেজার এ্যন্থনি। লিলি দু’হাতে মুখ ঢেকে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে ফ্যাঁচ্ ফ্যাঁচ্ করে কাঁদছে। আচমকা বিভ্রান্তিতে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে ওঠেন ম্যানেজার এ্যান্থনি। চোখমুখ রাঙ্গিয়ে কটাক্ষ দৃষ্টিতে এমনভাবে তাকালেন, যেন চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে লিলিকে। চোখদু’টোতে যেন তার আগুন জ্বলছে।
ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,-‘আই ডু নট ওয়ান্ট টু সি ইওর ফেইস এনি মোর, আন্ডারষ্টুড্? ননসেন্স!’ বলেই বিকট শব্দে অফিস ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন।
ইতিমধ্যে আমার চোখে চোখ পড়তেই মোমের মতো গলে নরম হয়ে গেল লিলি। ছোট্ট শিশুর মতো হিচ্কি তুলে কেঁদে কেঁদে বললো,-‘ব্যাহেন জী, ম্যায়তো লুট গয়ী! বরবাদ হো গয়ী! ও’ শালা হাড়ামী, বদমাশ, হামার সবকুছ্ লুটে লিয়েচে!’
বলেই আঙ্গুল থেকে হিরের আংটিটা খুলে অফিস ঘরের দিকে ছুঁড়ে ফেলে অশ্লীল ভাষায় গালি দিতে থাকে।
আচমকা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি লক্ষ্য করে ষ্টোরের উপস্থিত কাষ্টোমার সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। একে অন্যের দিকে জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। মাঝখানে আমিই পড়ে গেলাম ফ্যাসাদে। কি করি! অগত্যা, লিলিকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম ষ্টোরের বাইরে। পাশেই টিম হর্টনস, বললাম,-‘চলো, টিম হর্টনস এ গিয়ে বসি।’
লিলি বললো,-‘নেহি, ওহা নেহি! ও শালা ভাগ যাবে। ইধারিই ব্যায়ঠো। আজ ম্যায়ভি দেখ লুুঙ্গী!’
রাতের উন্মুক্ত আকাশের নীচে একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম আমরা। শিহরণে অনুভব্য হয়, আসন্ন শীতের মিহিন বাতাস। ঠান্ডা আবহাওয়া। একটু একটু কূয়াশাও পড়ছে। লিলি ফোঁস করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,-‘এ্যকভি নেহি মিলা, জিসকো আপনা কহে সকু। সব শালা ঝুট্, বিশ্বাসঘাত, ধোকেবাজ, ধান্দাবাজ। শালা বেইমান কঁহিকা!’
আমি প্রতিবাদ করলাম।-‘তুমি সব পুরুষমানুষকে গালি দিচ্ছো কেন? মেয়েরাও সব স্বতী সাবিত্রী না কী? ছলা-কলায় তো একেবারে এক্সপার্ট। বাগে পেলে পুরুষমানুষদের কম নাচায় না!’
গায়ে ফোসকা পড়ে গেল লিলির। মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অসন্তোষ গলায় বললো,-‘ঘাঁও মে মরিচ ঢালছ। আরে এ্যায়ার, ম্যায়নে কোই গুনা নেহি কী। স্রিফ দিলসে চাহা। প্যায়ার কিয়া। লেকিন ও’ শালা হামাকে ধোকা দিবে, তা কে জানতো!’
মুখ ফসকে আমিও বলে ফেললাম,-‘কেন, তুমি না বলেছিলে, তোমার স্বামী তোমাকে খুব ভালোবাসে। তুমি তার পতীব্রতা স্ত্রী, তার নয়নের মণী। সেও একেবারে রাজপুত্রুর। তুলনাই হয় না। খুব আমির লোক। তা এমন স্বামী ছেড়ে ম্যানেজার এ্যন্থনির সাথে প্রেম করতে গিয়েছিলে কেন? দোষ তো তোমার!’
লিলি নিরুত্তর। অপরাধীর মতো অব্যক্ত ভাষায় মলিন ম্রিয়মান হয়ে বেশ কিছুক্ষণ নিঃশ্চুপ হয়ে বোবা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। হঠাৎ বড় বড় চোখ পাকিয়ে হাতের বুড়ো আঙ্গুলটা দেখিয়ে বলে,-‘ঘোড়েকা আন্ডা। তুমকো নেহি মালুম, শালা মরদলোগ স্রিফ আপনা পিয়াস বুঝায়। অউরত জাত্কো খিলোনা সমঝতে হ্যায়। সব ঝুট্, বকওয়াস, পেয়ার বেয়ার কুছ নেহি।’
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,-‘আরে এ্যায়ার, ছোড়ো ইন বাতোকো। আপনি দিমাক কিউ খারাপ করছো। ইয়ে সব বেকার কি বাত। মেরি কিসমতই হ্যায় এ্যাসি।’
বিস্মিত হয়ে বললাম,-‘তা তুমি যে এসব করছ, তোমার পতীদেব জানে?’
ফিক্ করে একটা বিষন্ন হাসি হেসে ফেললো লিলি। হাসিটা বজায় রেখে বললো,-‘কিতনি ভোলে হো তুম! অউর বুদ্ধু ভি।’
লিলির হাতে ছিল একশো ডলারের একটা নোট। নোটটা রোল করে মুড়াতে মুড়াতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হতাশার সুরে বললো,-‘পতী, কিসকি পতী? ক্যাসি পতী? সব দিখাওয়া হ্যায়। আভি তক্ হামারি সাদিই নেহি হুয়ি। অউর আপনি পতীকি প্যায়ার মিলনা, কিসমত কি বাত হ্যায়। তুমতো সাদী শুধা হো, মালুম হ্যায় তুমকো। জানতি হো, কিতনি অভাগন হু ম্যায়! ক্যায়া শোচা থা, অউর ক্যায়া পায়া!’
গলা ভারি হয়ে আসে লিলির। দুহাতে মুখ ঢেকে ফ্যালে। তার পরক্ষণেই হৃদয়ের পূঞ্জীভূত সমস্ত কষ্ঠ, বেদনাগুলি তরল হয়ে ওর দু’গাল বেয়ে শ্রাবণধারায় অঝোরে ঝড়তে থাকে।
ওর কথা যতো শুনছি কনফিউজ হয়ে যাচ্ছি। বলে কী লিলি! এতোদিন যা শুনেছিলাম, এখন তার কিছুই মিলছে না। মনে মনে ভাবলাম,-বড় গভীর জলের মাছ লিলি। যতোটা সোজা মনে হয়েছিল, অতোটা সোজা মেয়ে ও’ নয়। জল ঘোলা করতেও জানে।
বিষন্ন হয়ে বললাম,-‘অমন করে কাঁদছো কেন? ম্যানেজারের সঙ্গে হয়েছে কি তোমার বলো না! খুব তো দোস্তী ছিল তোমাদের। হঠাৎ কী এমন ঘটলো!’
বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে বেঞ্চিতে মাথা ঠুকে সাশ্রæনয়নে বসে থাকে লিলি। মুখ দিয়ে একটা শব্দও আর বের হয়না। আমিও নাছোড়বান্দা। প্রশ্নটা পূনারাবৃত্তি করলাম। লিলি নিরুত্তর। ততক্ষণে আকাশের গায়ে সন্ধ্যে ঢলে পড়েছে। রাস্তার বিজলীবাতিগুলি জোনাকীর মতো হালকা কূয়াশায় মিটিমিটি করে জ্বলছে। সুদূর গগনে একঝাঁক পাখী উড়ে চলে আপন ঠিকানায়। লিলি শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সেদিকে। ক্ষীণ মৃদু আলোয় মুক্তোর মতো বিন্দু বিন্দু অশ্রæকণায় চোখদু’টো ওর চিক্চিক্ করছে। ভিতরে ভিতরে বুকের পাঁজরখানা ভেঙ্গে যে গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে, তা ওর মুখদর্শণে বেশ অনুমেয় হচ্ছে। তবু মুখ ফুটে কিছুই বলছে না। হঠাৎ চোখে চোখ পড়তেই শুকনো মুখখানা ওর আরো ফ্যাকাশে হয়ে গেল। চেয়েছিল গোপন করে রাখতে কিন্তু অবলীলায় তা আর পারে নি। ধীরে ধীরে উন্মোচণ হতে থাকে লিলির রহস্যাবৃত জীবন কাহিনী।
তিন
এ্যন্থনির সাথে লিলির প্রথম দেখা হয়, বান্ধবী সুলোচনার ম্যারেজ সেরিমোনিতে। সেদিন সন্ধ্যে থেকেই সুবর্ণের ঝাঁড়বাতির ঝিকিমিকি আলোর কণার সুসজ্জিত সাজে মেতে উঠেছিল আলো আঁধারির খেলা। প্রচুর আয়োজন। বিরাটাকারে বিস্তৃত টেবিল জুড়ে সাজানো ছিল সুস্বাদু বিভিন্ন খাদ্যসম্ভার। সেইসঙ্গে ছিল স্যাম্পেন, হুইস্কি আর সফ্ট ড্রিংক্স। ক্রমাণ্বয়ে শুরু হয়, চমকপ্রদ প্রসাধনের বাহার ছড়িয়ে, আতরের গন্ধ উড়িয়ে, মুক্তাঝরা হাসির ফোয়ারা তুলে বাহুবেষ্টিত যুগলবন্দী কপোত-কপোতীর পালা করে আগমন। কথোপকথনের গুঞ্জরণ। বেশ আনন্দোৎচ্ছল সমারোহে ছেয়ে গিয়ে সৃষ্টি হয় এক নিদারুণ মনোরম রোমাঞ্চকর পরিবেশ। আমন্ত্রিত অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য বসেছিল সহেলিদের লাস্যভরা নৃত্য-গীতের আসর। চলছে অপূর্ব সঙ্গীতের মূর্ছনা। সবাই মশগুল হয়ে শুনছে। ইতিমধ্যে এ্যন্থনি লরেন্সের সন্ধানি চোখের দৃষ্টি ওর প্রতিটি মুভমেন্টের সঙ্গে চড়কির মতো ঘুরতে ঘুরতে একসময় তীরের মতো ছুটে গিয়ে বিদ্ধ হয়, লিলির উর্দ্ধাংশের অনাবৃত নরম মসৃণ শুভ্র বক্ষের মধ্যস্থলে।
এ্যন্থনির হাতে ছিল হুইস্কির গ্লাস। ক্ষীণ পায়ে নৈঃশব্দে লিলির সন্নিকটে এগিয়ে এসে লিলির গা-ঘেষে দাঁড়িয়ে হাতের কনুই-এর সংস্পর্শে অনুভব করছিল, যুবতী নারীর কোমল মসৃণ অঙ্গের উষ্ণ অনুভূতি। গল্পে এতোটাই মত্ত হয়েছিল যে, সেদিকে ভ্রক্ষেপই ছিলনা লিলির। হঠাৎ পুরুষালি দেহের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের এক অন্যতম অনুভূতি আর হুইস্কির উগ্রগন্ধ্যে বিদ্যুতের শখ খাওয়ার মতো চমকে ওঠে। পিছন ফিরতেই দ্যাখে, মাথায় পাগড়ীপড়া সুঠাম সুদর্শণ মার্জিত চেহারার এক তরুণ যুবক সহাস্যে মুগ্ধ বিস্মিত চোখের দৃষ্টি মেলে ওর মুখপানে পলকহীন নেত্রে চেয়ে আছে। চোখের পাতা পর্যন্তও পড়ছে না। তার দুইবাহু ভর্তি তৃণের মতো ঘন পশম। গালের দু’পাশে সুসজ্জিত দাড়ি এবং সর্বোপরি পুরুষোচিত চেহারা এবং মিশ্রব্যক্তিত্বের এক অন্ধ আকর্ষণে মায়াবী পরীর মতো সুদর্শণা লিলির রক্তগোলাপ ঠোঁটের কোণায় চকিতে হাসির ঝিলিক দিয়ে ওঠে। অকারণেই পুলক জাগা শিহরণে দোল খায় ওর শরীর ও মন। মহলের মধ্যস্থলে ঝুলন্ত ঝাঁড়বাতিটার ঝিকিমিকি আলোয় সেদিন ওকে আরো উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। তখনই এ্যন্থনি লরেন্স দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত হয়, ওর বর্শিতে আজ নতুন শিকার ধরা পড়েছে। চিড়িয়া ফেঁসে গেছে। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে সকৌতূকের হাসি ফুটিয়ে সৌজন্যমূলক আলাপচারিতায় এ্যন্থনির প্রথম প্রশ্ন-‘আর ইউ ম্যারেইড্?’
স্বভাবতঃই লিলি ষ্ট্রেইটফরওর্য়াড মেয়ে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখলে হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা রাখে। খুব শক্ত মেয়ে। সহজে গলে যাবার নয়। কিন্তু ওকে যে কোণ ভূতে পেয়েছিল, একজন অচেনা অজানা অপরিচিত তরুণ যুবকের মুগ্ধ আকর্ষণে নিজের অজান্তেই সলজ্জে মুচকি হেসে মাথা নেড়ে বলল,-‘ওঃ নো! নট্ ইয়েট? আই যাষ্ট ফিনিশড মাই গ্র্যাজুয়েশন।’
সেদিন সহজ সরল নিস্পাপ মনা লিলি কখনো কি ভাবতে পেরেছিল, ঐ সৌজন্যমূলক হাসিটুকুই একদিন ওর জীবনে বিপদ ডেকে আনবে।
সততা ও নৈতিকতার সিঁড়ি বেয়ে এ্যন্থনি লরেন্স অনায়াসে পোঁছে যায় লিলির অন্তরের অন্তরস্থলে। যার ইশারায় একটানা ন’মাস কাঠপুতুলের মতো নেচেছিল লিলি। যাকে ভালোবেসে মন-প্রাণ উজার করে ঢেলে দিয়ে মনে মনে স্বামীরূপে গ্রহণ করেছিল। যাকে ওর হৃদয়পদ্মে দেবতার আসনে বসিয়ে স্বেচ্ছায় সঁপে দিয়েছিল স্বামীত্বের পূর্ণ অধিকার।
এ্যন্থনি লরেন্স কখনো স্থায়ীভাবে এক জায়গায় বসবাস করেনা। প্রতি ন’মাস অন্তর ওর ডেরা বদলায়। সেখানেই চলে তার রাজত্ব। কৌশলে, বুদ্ধির চাতুর্য্যে প্রাইভেট ফার্মের ছোট চাকরি থেকে জেনারেল ম্যানেজারের পদ অনায়াসে হাসিল করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা তার জন্য ছিল বাচ্চা ছেলের হাতের মোয়া। কখনোবা টেলিফোন অপারেটর থেকে চিফ্ অফিসার। সেই সঙ্গে পরিবর্তিত হয় তার চেহারা, বেশভূষা এবং নামের পদবীটাও। যার অন্তরালে সাপের খোলসের মতো এক পৈশাচিক অমানবিক আত্মায় রূপান্তরিত হয় এ্যন্থনি লরেন্স। যখন মনুষ্য শিকারের সন্ধানে লোভ লালসার জ্বাল বিছিয়ে সহজ সরল কচি সুদর্শণা যুবতী মেয়েদের মোটা বেতনের চাকরি, লাক্সারী গাড়ি-বাড়ি, অভাবনীয় আরাম-আয়েশের জীবনের প্রলোভন দ্যাখিয়ে তাদের কব্জা করবার প্রচেষ্টায় হায়নার মতো হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায় রাজ্যের বিভিন্ন নীরব নির্জন নিড়িবিলি এলাকায়। কার্য সিদ্ধি হলেই এ্যন্থনি লরেন্সের পোয়া বারো। ওর শিকারের প্রাথমিক পদ্ধতি হলো, উদার মনোভাব ও সদাচারে মহান ব্যক্তিত্বের পরিচয় প্রমাণিত করে মাসুম মেয়েদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জাগানো। যার অনিবার্য কারণে লিলির প্রথম পরিচয়েই বন্ধুত্বে পরিণত হওয়াটাও ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে ঘনিষ্ঠতা, হৃদ্যতা। কখনো বা চমকিত বিজলীর আলোর মতো বাঁকা চোখের ইশারায় রহস্যাবৃত হাসির ঝিলিকে চুম্বকের মতো আর্কষণে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে দিনের পর দিন চলতে থাকে গোপন অভিসার, ভালোলাগা আর ভালোবাসার নাটক। প্যায়ার, ইস্ক, মহব্বত। অবশেষে জানায় বিবাহের প্রস্তাব। আর তখনই নীরিহ দুর্বল যুবতী মেয়েরা মিথ্যে বিবাহের সম্মতি দিয়েই ব্যাভিচারী ও ধূর্ত এ্যন্থনি লরেন্সের শিকার হয়ে অচীরেই পতিত হয় নিরাপত্তাহীন, গন্তব্যহীন, অনিশ্চিত জীবনের এক ভয়াবহ অন্ধকার গুহায়। যখন অমানবিক এবং পৈশাচিক আচরণে গভীরভাবে লিপ্ত হয়ে, দৈহিক ক্ষুধা মিটিয়ে বাসররাতের গহীন নিশীথে স্বামী বনাম ধূর্ত এ্যন্থনি লরেন্স ঐ মাসুম মেয়েদের অজ্ঞাতসারে ঘুমের বড়ি সেবনে নিদ্রাবস্থাতেই গুপ্তচরের সহায়তায় তাদের সঁপে দেয়, আরব দেশের রাজা বাদশাদের হাতে। দয়া-মায়াহীন অত্যাচারী পাষন্ডদের হাতে। সেই সঙ্গে পাচার করে তোলা তোলা হীরা-জহর, মণী-মুক্তোও। যার বিনিময়ে এ্যন্থনি লরেন্স উপার্জন করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। হাজার হাজার ডলার, পাউন্ড।
কিন্তু লিলির বেলায় ঘটে যায় সম্পূর্ণ বিপরীত। যা স্বপ্নেও কখনো কল্পনা করতে পারেনি এ্যন্থনি লরেন্স। মিরাকলের মতো অত্যন্ত চমকৃতভাবে বিবাহের রাতেই লিলি আবিস্কার করতে সক্ষম হয়, এ্যন্থনি লরেন্স একজন স্মাগলার, ফ্রড্, ধূর্ত। যার আসল নাম সন্দীপ আগরওয়াল। ওরফে এ্যন্থনি লরেন্স, বির্জু সিং, মুহম্মদ জামাল, আরো কত কি নাম। যাকে এশিয়ান বলে কখনো মনে হয়নি। অথচ সে একজন ভারতীয়, শিখ পাঞ্জাবী। যার আঁখেড়া দেশ-বিদেশের অলিতে গলিতে, পৃথিবীর সর্বত্রই। বিদেশে মেয়ে পাচার করাই ওর ব্যবসা। যা ঘূণাক্ষরেও কোনোদিন টের পায়নি লিলি।
এককথায় বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হোলে ওকে নিয়ে আসে শহর থেকে বহুদূরে অবস্থিত এক বিশাল সুসজ্জিত সুদর্শণ কারুকার্যময় একটি বাংলোতে। যেখানে শুধুমাত্র একটা পালঙ্ক ছাড়া আর কিছুই ছিল না। নিঝুম নিস্তব্ধ পরিবেশ। চারিদিকে ঘন জঙ্গল। আশেপাশে লোকজন কোথাও নেই। ভয়ে আঁতকে ওর বুক কেঁপে উঠছে। শূন্যতায় একেবারে খাঁ খাঁ করছে।
স্বাভবিক কারণে বিকেল থেকেই ওর গা ছমছম করছিল। তবু মনের মধ্যে কোনরকম সন্দেহের বীজ দানা বাঁধেনি। কিন্তু বিয়ে সাধী বলে কথা, ছেলে খেলা নয়। বিবাহ মানে দু’টি মানব-মানবীর পবিত্র ভালোবাসার অনিবার্য পরিণতি। দু’টি আকাক্সিক্ষত হৃদয়ের মধুর সঙ্গম। একান্ত নিবিড় নিঃভৃতে সংগোপনে পরশে পরশে উষ্ণ উত্তাপে দু’টি মাংসল শরীর একাকার হয়ে মিশে যাওয়া। এ তো নতুন কিছু নয়। আবহমানকালের নারী-পুরুষের চাওয়া-পাওয়ার এক চিরন্তন খেলা, আদিম খেলা। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই তার যৌবনের প্রারম্ভকাল থেকেই এক পুলক জাগা শিহরণে আকুল হয়ে অপেক্ষা করে থাকে, জীবনের পরম আকাক্সিক্ষত এই শুভ দিনের শুভ মুহূর্তটির জন্য।
তেমনি লিলিও কত না স্বপ্ন ওর দু’চোখে এঁকে রেখেছিল। কত আশা নিয়ে গোধূলির শুভ লগ্নের শুভ ক্ষণের অপেক্ষা করে বসেছিল। অথচ রীতি-নীতি অনুসারে সামাজিক বিবাহের কোনো আয়োজনই নেই! বাজনা বাজজে না, সানাই বাজজে না। এমনকী এ্যন্থনি লরেন্সের পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, কেউ নেই। চারদিকে শ্মশ্বান পুরীর মতো নির্জন, গাঢ় নিঝুম নিস্তদ্ধতা।
অজানা আশক্সক্ষায় বুকটা ধুক্ধুক্ করে কাঁপতে থাকে লিলির। যেন কার শ্রাদ্ধ হচ্ছে। সাড়া বিশ্বজুড়ে প্রতিটি মানুষ যেন মৌনমনে শোক পালন করছে। কিন্তু এ যে কত বড় নিষ্ঠুর পরিণতির পূর্বাভাষ, তখনও মনের মধ্যে ওর চৈতন্যোদয়ই হয়নি।
সন্ধ্যে থেকে একটানা গভীর নিস্তদ্ধতায় যাপন করে একসময় নানান দুঃশ্চিন্তা দুর্ভাবনায় ঘিরে ধরে। আঁতঙ্কে বুক কেঁপে উঠছে। সময় ক্রমশ বয়ে যাচ্ছে। অচীরে নেমে আসে অন্ধকারে। উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় লিলি অস্থির হয়ে ওঠে। গলা টেনে এদিক ওদিক দ্যাখে, কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না।
ইত্যমধ্যে হঠাৎ ঝট্ করে নিভে গেল বিজলীবাতি। আঁতকে ওঠে লিলি। একেলা নির্জন ঘরে দিশা হারিয়ে ফ্যালে। চোখে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। জানালার কপাটগুলি খুলে দিতেই বাইরের শীতল হাওয়া হু হু করে ঢুকতে থাকে ঘরের ভিতর। বৃষ্টিও পড়ছে গুড়ি গুড়ি। চারিদিকে জোনাকিরা উড়ছে। জন-মানব শূন্য। একটি প্রাণীও নেই কোথাও। রাস্তার কুকুরগুলি ঘেউ ঘেউ করছে। মাঝেমধ্যে দু-একখানা গাড়ি দ্রুতবেগে পাস করে যাচ্ছে।
হঠাৎ কর্ণগোচর হয়, বার বার টেলিফোন রিং হচ্ছে, কেউ পিক্ করছে না। আতঙ্কে শিউড়ে ওঠে। বুক ধুক্ ধুক্ করে উঠছে। ভয়-ভীতিতে বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। চোখেমুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, মনে বিভীষিকা। অথচ লিলি তখনও জানে না এ্যন্থনি লরেন্স কত বড় ধূর্ত, ক্রিমিনাল।
হঠাৎ থেকে কোথা আর্বিভূত হয়ে ফিস্ফিস্ শব্দে কি যেন বলে আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল এ্যন্থনি। ইত্যবসরে নামাবলি ধারণকৃত একজন পুরোহিত মহাশয় উৎকন্ঠিত হয়ে বলছে,-‘বাড়ির লোকজন সব গেল কোথায়? কামাল হ্যায়! কোইভি নেহি হ্যায়।’ বলতে বলতে সেও অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
এদিকে সুগন্ধি ফুলের গহনায় সুসজ্জিত বধূবেশে লিলি ক্রমশ অস্থির হয়ে ওঠে। ডাঙ্গায় ওঠা মাছের মতো ক্রমাণ্বয়ে ছট্পট্ করতে থাকে। দম আঁটকে আসছে। আন্কম্ফোর্টেবল ফিল করে। স্বগতোক্তি করে ওঠে,-‘হে ভগবান, ইয়ে সাধী হ্যায় এয়া বরবাদী? দুলহা ভি গায়েব। কিন্তু এ্যন্থনি গেল কোথায়?’
বিশাল আয়তন জুড়ে তিনতলা বাড়ি। চারদিক নীরব নিস্তদ্ধ। কারো সাড়া শব্দ নেই। ইঁদুর কতগুলো চিচি আওয়াজ করে খালি ঘরে দৌড়াচ্ছে। সময় যতো অতিবাহিত হচ্ছে সন্দেহ ততো ঘণীভূত হতে থাকে। চাপা উত্তেজনায় লিলি পালঙ্ক ছেড়ে নেমে এসে দাঁড়ায়। গলা টেনে জানালায় উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দ্যাখে, বাইরে বারান্দার বিজলীবাতিটা ক্ষীণ মৃদু আলোয় জ্বলছে।-আশ্চর্য্য, বাইরে আলো জ্বলছে, অউর ভিতরে অন্ধকার! মাথায় বজ্রাঘাত পড়ে লিলির। বন্বন্ করে মাথাটা ঘুরে ওঠে ওর। জরুর ডা মে কুছ কালা হ্যায়।
বিড় বিড় করতে করতে দ্রæত ঘরের দরজাটা খুলতে গিয়ে টের পায়, দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। ওকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। কিন্তু কেন? কিসের জন্য? চায় কি এ্যন্থনি? তা’হলে সবই কি ওর পূর্বপরিকল্পিত? ষড়যন্ত্র? তবে কি এ্যন্থনি বিশ্বাসঘাতকতা করলো ওর সাথে? কিন্তু কী যে ঘটতে চলেছে, তা কল্পনাই করতে পারছে না।
হাজার প্রশ্নের ভীড়ে বিচলিত হয় ওঠে লিলি। তবু মন মানে না। কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। ভালোবেসেই তো ওকে বিয়ের প্রোপোজাল দিয়েছিল এ্যন্থনি। ললাটে চুমা দিয়ে বলেছিল, ওকে রাজরানী করে রাখবে। হৃদয় নামক ওর বিশাল সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্ঞী করবে। না, না, এ্যন্থনি কখনো বেইমানী করবে না। করতে পারেনা। জরুর কোই মুসিবতে ফেঁসে গিয়েছে। লেকিন দরওয়াজা বন্ধ কিউ? কিস লিয়ে? কেনইবা ওকে বন্দী করে রেখেছে?
ভাবতে ভাবতে কেটে যায় কয়েক প্রহর। ততক্ষণে চারিদিকে গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যায়। লিলি চিৎকার করে ওঠে,-‘দরওয়াজা খোলো। এ্যন্থনি তুম কাঁহা হো? দরওয়াজা খোলো।’
ইতিমধ্যে টেলিফোনটা ঝন্ঝন্ করে বেজে ওঠে। লিলি দৌড়ে যায় দরজার কাছে। শোনে আড়ি পেতে।-‘হ্যাঁ হ্যাঁ আমি সন্দীপ আগরওয়াল বলছি। গুরু, মাল আভি তক্ নেহি পঁহউচা। আউর সর্দারজী ভি। জী হাঁ, লন্ডিয়াভি নাকাবন্দি আছে। ও মেরে কব্জেমে হ্যায়।’
শুনে মাথায় বজ্রাঘাত পড়ে লিলির। কিছুতেই নিজের কানদু’টোকে বিশ্বাস হয় না। যা ক্ষণপূর্বেও কল্পনা করতে পারে নি। বড় বড় স্বপ্ন দ্যাখিয়ে জীবনের চরম মুহূর্তে এত বড় ধোকা, ষড়যন্ত্র! ভালোবাসার নাটক রচিয়ে এ্যন্থনির এত বড় ছলনা, বিশ্বাসঘাতকতা! তুমি এ্যন্থনি লরেন্স নও, সন্দীপ আগরওয়াল! একজন পিওর ইন্ডিয়ান। ছদ্মনাম ব্যবহার করে তুমি মেয়ে মানুষের ব্যবসা করো! দেশ বিদেশে মেয়ে পাচার করো! মেয়ে মানুষের ধান্দা করো। আজ রাতে নিশ্চয়ই আমাকেও বেঁচে দেবে। এত বড় বেইমানী? আমার সাথে প্রতারণা করলে এ্যন্থনি? করতে পারলে তুমি? প্রাণ থাকতে এ আমি কিছুতেই হোতে দেবো না।
ক্ষোভে, দুঃখে-অপমানে জর্জরিত লিলি মুহূর্তের জন্য ভারসাম্য হারিয়ে মানসিকভাবে অত্যন্ত ভেঙ্গে পড়ে। আবেগের বশীভূত হয়ে আর্তকণ্ঠে স্বগতোক্তি করে ওঠে,-’কেন এমন করলে সন্দীপ! কী অপরাধ করেছিলাম আমি? এমন তো কথা ছিল না! এ তুমি কী করলে?’
অনুভব করে, পায়ের নিচের মাটি যেন সরে যাচ্ছে। শরীরের সমস্ত অনু-পরমানুগুলি ক্রমশ অসার হয়ে আসছে। ভাটা পড়ে যায় ওর প্রেম যমুনায়। সম্মুখে চোরাবালির চড়। কিন্তু না, এ মুহূর্তে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। ওকে শক্ত হোতে হবে। জীবনে চরম মুহূর্তে এক অভিনব আনন্দের একটা তীব্র অনুভূতি জাগ্রত হবার পূর্বেই ওর সুকোমল হৃদয়কে ভেঙ্গে চৌচির করে দেয়! ভেঙ্গে যায় ওর স্বপ্ন। এ কিছুতেই মেনে নেবে না।
অস্ফূট আর্তনাদ করে ওঠে লিলি । -‘মাল, কিসকা মাল? ক্যাসা মাল? কৌন সর্দার জী? ও’ কেন আসবে এখানে? হে ভগবান, এ তুমি কোন্ পরিক্ষায় ফেলে দিলে আমায়!’
মনে পড়ে যায়, যেদিন সুখের অণ্বেষণে অধিকতর উন্নতমানের জীবন যাপন কারবার ইচ্ছা পোষণ করে কানাডার টরোন্টো মহানগরীতে স্বপ্নের তাজমহল গড়তে চলে এসেছিল, সেদিন কী ভাবতে পেরেছিল, ওর মতো সুশিক্ষিতা, সৃজনশীল, রুচীশীল মেয়ে হয়ে একজন ধূর্ত, স্মাগলার,ক্রিমিনাল সন্দীপ আগরওয়াল, যার অন্ধ মোহে মনে প্রাণে ভালোবেসে ওর সর্বস্ব উজার করে ঢেলে দিয়েছিল, একদিন ওই ওর জীবনের চরম সর্বণাশের কারণ হয়ে দাঁড়াবে!
লিলি বুদ্ধিমতী ও সহনশীল মেয়ে। মুহূর্তের জন্য মনকে দুর্বল করে দিলেও সহজে ভেঙ্গে পড়ার নয়। মনে মনে বলে,-‘বাপ কো ভি বাপ হ্যায় এ্যন্থনি। আজ তক্ স্রিফ্ বিল্লিই পাকড়াও কিয়া। আব দেখ্না, খেল্ ক্যাসে খতম করুঙ্গী ম্যায়!’
ইতিমধ্যে হঠাৎ মেসেজ আসে,-পরিস্থিতি আশক্সক্ষাজনক। বিপদ অবশ্যম্ভাবী। নিরাপদ নয়। সীমান্তের চারিধারে পুলিশ টহল দিচ্ছে। ওরা যে কোনো মুহূর্তে ধরা পড়ে যেতে পারে। সর্দার জী বাপস চলে গেছে।
মেসেজটি পড়ে টেনশন বেড়ে গেলেও লিলির মতো একজন সুন্দরী লাবণ্যময়ী যুবতী নারী দেহের গন্ধে ও ভোগের লালসায় ক্ষুধার্ত হায়নার মতো সন্দীপকে ধাবিত করতে থাকে। লিলির ঘরের দরজার সামনে এসে ঘুর ঘুর করে। ওদিকে প্ল্যান-প্রোগ্রাম সবই ভেস্তে গেছে। মাথায় বজ্রাঘাত পড়ে সন্দীপের। ভেবে কূল পায় না, মিথ্যে বিবাহের সরঞ্জাম, নানা আয়োজন একেলা হ্যান্ডেল করবে কিভাবে!
অগত্যা, একটা হুইস্কির বোতল নিয়ে ঢুকে পড়ে লিলির ঘরে। নেশাগ্রস্থের মতো টলতে টলতেই লিলির বিছানায় গিয়ে বসে পড়ে। বিড় বিড় করে কীসব বলতে বলতেই মানসিকভাবে ঘায়েল হয়ে পড়ে।
লিলি পাথরের মতো শক্ত হয়ে থাকে। ওয়াচ্ করে সন্দীপকে। ওকে অস্বাভাবিক লাগলেও মনে মনে বলে,-স্পর্ধার বলিহারী! এতো কান্ডকীর্তনের পরও ওর চোখেমুখে কোনো বিকার নেই, প্রতিক্রিয়া নেই। ওর এতটুকু চোক্ষু লজ্জা, আত্মমর্যাদা কিছুই নেই।
অথচ সন্দীপ আগরওয়াল একজন ফ্রড্, ধান্দাবাজ, চরিত্রহীণ নির্দয় নিষ্ঠুর জেনেও সেইরাতে লিলি অমত করলো না, বাঁধাও দিলো না। বিনা মন্ত্র উচ্চারণে বধূবেশে যুগলবন্দি হয়ে বাসররাতের খেলাঘরে নিজেকে উজার করে ঢেলে দেবার উন্মাদনার মিথ্যে অভিনয়ে গভীরভাবে মেতে ওঠে। অপেক্ষা করেছিল সুযোগের। আর সেই সুযোগে ওর সুকোমল যৌবনের নেশায় অমানবিকভাবে পৈশাচিক আচরণে গভীরভাবে লিপ্ত হয়ে কামনা নদীর অতল গহŸরে সন্দীপ যখন ডুবে যায়, ওকে ব্রান্ডির সাথে কড়া ডোজের ঘুমের ঔষধ সেবন করিয়ে নেশাগ্রস্থের মতো অচৈতন্যে বেহুঁশ হয়ে পড়লে ওর বৈষয়িক সম্পত্তির সমস্ত ডকুমেন্ট, টাকা-পয়সা, দামী গহনা একে একে সব হাতিয়ে নিয়ে চেয়েছিল, সন্দীপকে সর্বস্বান্ত করে ওর ঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে। ও’কে প্রমাণসরূপ পুলিশের হাতে তুলে দিতে। ওকে নিঃশ্ব করে ভিক্ষীরির মতো পথে বসিয়ে দিতে। কিন্তু লিলি তা পারেনি। পারিনি চুরি-ডাকাতি করে রাতারাতি ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে। উল্টে নিজের ভাগ্যকে বাজী রেখে ঘরের আলো নিভিয়ে, টেলিফোনের সমস্ত কানেকশান্ অফ্ করে, দরজায় খিল দিয়ে সারারাত অন্ধকার ঘরের কোণে চুপটি করে বসেছিল, ধূর্ত সন্দীপ আগরওয়ালের হৃদয় কম্পিত ভয়াবহ দূর্ধর্ষ্য রহস্যের জ্বাল উন্মোচন করার জন্য। সত্য উদ্ঘাটনের জন্য। অথচ নিজে প্রতারিত, অপমানিত এবং নিগৃহীত হয়েও সর্বনাশা ভালোবাসাই ওর পলায়নের পথ অবরোধ করে রাখে। অন্যদিকে নিজেও ভয়ানক বিপদ হোতে মুক্তি পেলো বৈকি। শুধু তাই নয়, নারীজাতির কলঙ্ক থেকেও মুক্ত হোলো, রক্ষা পেলো।
লিলির হৃদয় বড়ই কোমল, উদার। ওযে নিয়তির কাছে আত্ম সমর্পিত, নিমোজ্জিত এবং বিসর্জিত। লিলি সিদ্ধান্ত নেয়, নারীর পূর্ণ সত্ত¡া দিয়ে, ওর হৃদয় নিংড়ানো অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়ে, প্রেমের পরশ দিয়ে, সঙ্গ দিয়ে, সেবা-যতেœ এ্যন্থনিকে, ওরফে সন্দীপকে এই ভয়ঙ্কর নরক থেকে ফিরিয়ে আনবে, ওকে মুক্ত করবে। ওকে সুশীলসমাজে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত করবে।
ভাবতে ভাবতে আপনমনে স্বগতোক্তি করে ওঠে লিলি,-তোমায় যে মনে-প্রাণে ভালোবেসেছি দ্বীপ। তোমায় একান্ত আপন করে কখনো কাছে না পেলেও আমাদের প্রথম দেখার সেই বর্ণনাতীত ভালোলাগার অ¤øান স্মৃতিটুকুই যে জড়িয়ে আছে আমার অদৃশ্য অনুভূতিতে। যা তোমার কাছে নিন্ততাই অর্থহীন, মূল্যহীন। কী করে বোঝাই, তুমি যে আমার হৃদয়ের পুরোটাই দখল করে নিয়েছ। আমায় ভালোবাসো না জেনেও, গ্রহণ করবে না জেনেও তোমায় একেলা ছেড়ে পারিনি চলে যেতে। পারিনি তোমায় হাজতে রেখে সাজা দিতে। আমরা নাইবা হলাম বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী। নাইবা পেলাম স্ত্রীর পূর্ণ মান-মর্যাদা, পূর্ণ আধিপত্য। তবু আমার হৃদয় মন-প্রাণ শরীরের সমস্ত অনুভূতি দিয়েই একান্তে নিঃভৃতে গহীনভাবে অনুভব করবো, তোমার উপস্থিতি। তোমার আবেগাপ্লুত প্রেমস্পর্শ। অচীরেই নিমজ্জিত হয়ে ডুবে যাবো সুখের অতল গহবরে। কিন্তু এত বড় অসম্ভবকে সম্ভব করা কল্পনায় যতটা সহজ, বাস্তব ততটাই কঠিন।
চার
রাত পোহাতেই সন্দীপ আগরওয়াল টের পায়, ওকে ফাঁকি দিয়ে খাঁচার পাখী উড়ে পালিয়েছে। ধারণা করেছিল, ওর বিষয় সম্পত্তির দলিলপত্র, টাকা-পয়সা সব লুট করে রাতের অন্ধকারেই ওর শিকার উধাও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু গতকাল রাতে লিলিকে প্রেমালিঙ্গনে বেঁধে নিতেই সোহাগ করে লিলি ওকে একগ্লাস শরবত পান করতে দিয়েছিল। তারপর কিছু আর মনে নেই। এখন লিলিও বেপাত্তা। তিনতলা ফ্ল্যাটে ওকে কোথাও নজরে পড়ছে না। কিন্তু এমন ঘুটঘুটে রাতের অন্ধকারে লিলি গেল কোথায়?
উদ্ভ্রান্ত হয়ে তিনতলার উপরে নিচে, এঘর ওঘর, ঘরের প্রতিটি জায়গায় কোণায় কোণায় তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে সন্দীপ। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ সিঁড়ির গোঁড়ায় ষ্ট্যাচুর মতো লিলিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। তবু বুঝতে দিলো না। নিজের ইমেজ বজায় রেখে বলল,-‘সারারাত কোথায় ছিলে?’
লিলি কটাক্ষ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। ওর চোখদু’টোতে যেন আগুন জ্বলছে। এ্যন্থনির আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে তীব্র কন্ঠে বলে ওঠে,-‘ছিঃ সন্দীপ ছিঃ, তুমি এতো নিচে নেমে যাবে, কভি সোচা নেহি। ইতনি বড়ি সাজিশ? ম্যায় আন্ধী থি, নাদান থি, জো তুমহারি বাতোসে ব্যাহেক গয়ি। দূর হো যাও মেরি নজরোসে।’
সন্দীপ তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। চোখমুখ রাঙিয়ে তেড়ে এসে বলে,-‘ছোড়ি, হামার এত বড় লুকসান হয়ে গেল, তুই ল্যাকচার দিচ্ছিস।’
উত্তেজনায় কর্কশ কণ্ঠে গর্জে ওঠে লিলি।-‘চিল্লাও মত্। ধোকেবাজ হো তুম। স্মাগলার হো, ফ্রড্ হো, না জানে অউর ক্যায়া ক্যায়া হো তুম! মুঝে সব মালুম হ্যায়।’
বড় বড় চোখ পাকিয়ে তাকায় সন্দীপ। কিছুক্ষণ থেমে একটা ঢোক গিলে সামান্য নরম হয়ে ফ্যাস্ ফ্যাস্ শব্দে বলে,-‘কী মালুম করেছিস তুই?’
-‘মুখ সামলে বাত করো এ্যন্থনি, আই মিন সন্দীপ। বিবি না সই, কমসে কম এ্যাক অউরতকে নাতে কুছতো শরম করো, ইজ্জত করো। আপনে বারেমে শোচো। বতাও, ওলোগ কৌন থি? কিঁউ আনেওয়ালে থে এঁহা? এ্যাঁ, বতাও মুঝে!’
তো তো স্বরে সন্দীপ বলল,-‘দ্যাট্’স মাই বিজিনেস্। হু আর ইউ? নো রাইট্ টু ইন্টারফেয়ার ইন মাই বিজিনেস।’
-‘আচ্ছা, তো এহিই হ্যায় আপক্ াবিজনেস্। অউর হামারি সাধী কা ক্যায়া? মুঝে ইতনি বড়ি ধোকা? ইতনি বড়ি সাজিশ! হ্যায় কোই জবাব?’
অট্টহাসি সন্দীপের। বলে,-‘হুঁম্, ছন্নছাড়া জীবন আমার। ধান্দা করে খাই। মেয়েছেলে নিয়ে ব্যবসা করি। সংসার করবো ভাবলি কি করে! প্যায়ার বেয়ার সব বেকার কি বাত। ওতে রুপিয়া আসবে না, বুঝলি? দফা হয়ে যা মেরে সামনে সে।’
নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফ্যালে লিলি। ক্ষোভে দুঃখে অপমানে ক্রোধ সম্বরণ করতে পারেনি। সন্দীপের গায়ের ওপর আঁছড়ে পড়ে শক্তহাতে ওর জামা খিঁচে ধরে বলে,-‘তাহলে কেন ভালোবাসার নাটক করেছিলে? কেন মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আমায় নিয়ে এসেছিলে? বলো সন্দীপ বলো! তোমার কি ক্ষতি করেছিলাম?’
-‘আঃ, প্যান্ প্যান করিস না! জাহান্নামে যা। ছোড়, ছোড় মুঝে।’
বলে লিলিকে এক ধাক্কা। লিলিও নাছোরবান্দা। শুরু হয় হাতাহাতি, ধস্তাধস্তি। সন্দীপ পা তুলে লাথি মারতেই লিলি ছিটকে পড়ে যায় মাটিতে। উঠে দাঁড়িয়ে বলে,-‘তুমি রেহাই পাবে ভেবেছ! কভি নেহি। মুঝে সবকুছ মালুম হ্যায়। তুমি একটা লম্পট, ধোকেবাজ, ক্যারেক্টারলেস্্ হো তুম। তোমার মুখোশ আমি খুলে দেবো। আব যো করনা হ্যায় করো, মুঝে কোই পরোওয়া নেহি।’
বলে উত্তপ্ত মেজাজে তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে দোতলার ঘরে উঠে গেল লিলি।
সন্দীপ বিমূঢ় হয়ে পড়ে। বেকায়দায় নিজেই নিজের জ্বালে ফেঁসে গিয়ে বিপাকে পড়ে যায়। এখন ওর উভয়
সংকট। আগে-পিছে দুদিকেই রাস্তা বন্ধ। মুক্তি পাবার কোনো উপায় নেই। চেয়েছিল এক ঢিলে দুইপাখী শিকার করবে। কিন্তু সেটা আর হোলো না। দীর্ঘ সাত বছরের রমরমা মেয়ে মানুষের ব্যবসা লাটে উঠে যাবার আশক্সক্ষায় আফসেট হয়ে পড়ে। চেহারা সুরত বিবর্ণ হয়ে যায়। খেল খতম সন্দীপের। ওর মতো একজন ধূর্ত নির্দয় নিষ্ঠুর মানুষকে বিনা অস্ত্রে কথার তীর ছুঁড়ে বেমালুম ঘায়েল করে ফেললো লিলি।
অগত্যা, নিজের অপরাগতার কারণে লিলির কাছে পরাস্ত হয়ে শামূকের মতো নিজেকে গুটিয়ে ন্যায় সন্দীপ। মুখে একটা রা নেই। কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ নেই। কলহ নেই। বিবাদ নেই। অভিযোগ নেই। একেবারে অভাবনীয় পরিবর্তন সন্দীপের। হতেই পারে! কারণ মানুষ পরিবর্তনশীল। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অসম্ভব সম্ভব হওয়া বিরল নয়।
কিন্তু একজন স্মাগলার, ধোকেবাজ, ধান্দাবাজ মানুষ এতো সাহসায় হার মেনে যাবে, ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছে না লিলির। এ যেন ভূতের মুখে রাম নাম। ভাবাই যায় না। অবিশ্বাস্য হলেও মনে মনে খুব খুশী হয়। কিন্তু কারো মুখে আর কথা নেই। দুজনেই মৌনব্রত ধারণ করে। এদিকে সন্দীপের মতিগতিও ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। এভাবেই কেটে যায় কয়েকটা দিন। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
লিলি সাদা মনের মেয়ে। সন্দীপের অভাবনীয় পরিবর্তন লক্ষ করে ভাবলো, সত্যিই বদলে গিয়েছে সন্দীপ। ওকে নিয়েই ঘর বাঁধবে। সংসার করবে। এইভেবে সন্দিপের নৈকট্য লাভের আশায় কারণে অকারণে প্রায় প্রতিদিনই সন্দীপের পছন্দের ডিস তৈরী করে সাজিয়ে রাখে। কোনো কোনোদিন একসাথেই ডিনার করে। মাঝেমধ্যে দু-চারটে কথাবার্তাও হয়। এভাবে চলতে চলতে নতুন করে দুজনের বন্ধুত্ব হয়। হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। অনিবার্য কারণেই আবার ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। সন্দীপ ডিপার্টমেন্ট ষ্টোরে ম্যানেজার পদে নিযুক্ত হলে লিলিকে ওর এ্যাসিষ্টেন্ট করে আবার আগের মতোই হাসি কলোতানে দিন কাটতে থাকে। পরিশেষে জীবন সঙ্গিনী করবার প্রতিশ্রæতি দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মতোই বসবাস করতে থাকে। সন্দীপ অনায়াসে ছিনিয়ে নেয়, স্বামীত্বের পূর্ণ অধিকার। লিলিও সামাজিক ও পারিবারিক রীতি নীতি অনুসারে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ না হয়েও পবিত্র ভালোবাসাকে সাক্ষী রেখে কর্তব্যপরায়ণ স্ত্রীর মতো নিজেকে সর্বান্তকরণে সঁপে দেয় স্বার্থাণে¦ষী সন্দীপের একান্ত কামনার অগ্নিকুন্ডে। স্বাভাবিক কারণে লিলি সন্তানসম্ভবা হলে বেঁকে বসে সন্দীপ। অস্বীকার করে লিলির গর্ভে লালিত ওর ভালোবাসার ফসলকে। অনাগত নিস্পাপ সন্তানকে। বলে,-’গিরা দে, মার ডার উসে।’
লিলির হাতে হাজার ডলারের একটা নোটা গুঁজে দিয়ে বলে,-‘প্যাসা চাইয়ে? লে প্যাসা লে। মেরা পিছা ছোড়।’
লিলি নাছোড়বান্দা। করজোড়ে মিনতি করে। অনুনয় বিনয় করে বলে,-‘এ্যাসী বাত কেন বলছ দ্বীপ? ম্যায় তো তুমহারি হু। ইয়ে বাচ্চা ভি তুমহারি হ্যায়। হামারি প্যায়ার কি নিশানি!’
-‘আঃ, তং করিস না! ভাগ এহাসে। আই সেইড্ গেট্ আউট!’
গর্জে ওঠে সন্দীপ। পাষান হৃদয় ওর। কোনভাবেই গলে যাবার নয়। ওকে যে কোন্ ধাতূ দিয়ে বিধাতা গড়ে ছিলেন, এতটুকু করুণা, দয়া-মায়া, আবেগ-অনুভূতি কিছুই নেই ওর শরীরে। সবই কচুপাতার জলাবদ্ধের মতো ক্ষণস্থায়ী। ওর মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়াই ঘটতে দেখা যায় না।
লিলিও হার মানার পাত্রী নয়। বড্ড শক্ত মেয়ে। এসেছিল একটা বিহীত করতে, সমাধান করতে, সন্দীপের সাথে একটা বোঝা পোড়া করতে, সমঝোতা করতে। অথচ গ্রাহ্যই করলো না সন্দীপ। উল্টে দিনে-দূপুরে ষ্টোরের এতগুলি মানুষের সম্মুখে, ওদের উপস্থিতিতে অমানবিক ও কান্ডজ্ঞানহীনভাবে ওকে বেইজ্জত করে. মিথ্যে অপবাদে গলা ধাক্কা দিয়ে ওকে অফিস ঘর থেকে বের করে দিলো। কিন্তু অবহেলিত, প্রবঞ্চিত, নিগৃহীত লিলির চোখে যে আগুন জ্বলতে দেখেছিল, সন্দীপ তাতেই বুঝতে পেরেছিল, এর কিমত ও’কে পাই পাই করে চুকাতে হবে। ঐ আগুনে একদিন ও’ও জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে হবে।
পাঁচ
লিলি সুশিক্ষিতা, রুচীশীল, বুদ্ধিমতী, ধৈর্য্য ও সহনশীলা মেয়ে। মাতা-পিতার মুখে চূণকালী ঘসে দিয়ে যেদিন অন্ধ ভালবাসার মোহে সন্দীপের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল, সেদিন থেকে পিছন ফিরে আর তাকায় নি। হার সে মানতে শেখেনি। কিছুতেই হার মানবে না। একবার যা আঁকড়ে ধরে তা কখনোই ছেড়ে দেবার মেয়ে নয় লিলি। ওকে ভালো করেই চেনে। ও’ যদি মুখ খোলে সন্দীপের নির্ঘাৎ হাজত বাস। হতবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড। কিন্তু ওতো অনেক আগেই পারতো সন্দীপকে ধরিয়ে দিতে। ওর সমস্ত বৈষয়িক সম্পত্তি আত্মসাৎ করে ওকে ভিক্ষারী করে একেবারে পথে বসিয়ে দিতে পারতো। কুৎসা রটিয়ে ওর উঁচু মাথাটাকে একেবারে হেট্ করে দিতে পারতো। অথচ লিলি তা করেনি। কিন্তু কেন? কেন এতকিছু জানবার পরও এতোবড় একটা আঘাত নীরবে নির্বিঘেœ সহ্য করছে লিলি?
তবে কি সত্যিই সন্দীপকে মনে-প্রাণে ভালোবেসেছিল লিলি? সত্যিই কি নিঃভৃতে নিবিড় করে একান্ত আপন করে ওকে পেতে চেয়েছিল লিলি? দিনের পর দিন প্রতারিত, প্রবঞ্চিত হয়েও কেন সন্দীপের মতো একজন হিংস্র ব্যভিচারি পুরুষমানুষের কাছে আত্ম সমর্পণ করেছিল লিলি? যাকে হাজার হাজার ডলার আর পাউন্ডের বিনিময়ে অত্যাচারী পাষন্ডের হাতে সন্দীপ নিজেই তুলে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আজ এতোসব ঘটনা ঘটে যাবার পরেও কি ওকে নিয়ে ঘর বাঁধবার স্বপ্ন দেখবে লিলি? সত্যিই ওর সুকোমল হৃদয়ে সন্দীপকে ঠাঁই দিতে পারবে লিলি? কিন্তু ঠাঁই দেবে কোন্ অধিকারে? কিসের জোরে? কোন্ সূত্রে? ওতো বিয়েই করেনি লিলিকে! তা’হলে!
এতোকিছুর পরেও আজ মনের মধ্যে একটা অনুতাপবোধ সৃষ্টি হয় সন্দীপের। নিজেকেই ছোট মনে হয়। অপরাধী মনে হয়। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ নতুন করে এক অভিনব মুগ্ধ ভালোলাগা আর ভালোবাসার আবেশ ছড়িয়ে পড়ে ওর দেহে-মনে। স্পর্শ করে ওর পাষাণ হৃদয়কে। সিক্ত হয়ে ওঠে। ভিজিয়ে ওর অন্তরাত্মাকে একেবারে নরম করে দেয়। নড়ে ওঠে ওর হৃদস্পন্দন। আবেগের প্রবণতায় হৃদয়-মন-প্রাণ মুহূর্তে সজীব হয়ে ওঠে। মনকে বিকশিত করে। টের পায়, এক অভিনব আনন্দানুভূতির তীব্র জাগরণ। এর নামই বুঝি পিওর ভালোবাসা! সচ্চা ভালোবাসায় এত সুখ! এত আনন্দ!
জাগ্রত হয় লিলির প্রতি ওর দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ। হঠাৎ অব্যক্ত খুশীর প্লাবনে হৃদয়ের দুকূল ভরে ওঠে। সংম্বরণ করতে পারেনা। একসময় নিজেই আবিস্কার করে, লিলিকে সত্যি সত্যিই সেও ভালোবাসতে শুরু করেছে। আজ যেন লিলিই ওর জীবনের সব। ওর সুখ, শান্তি, আশা-ভরসা সব। লিলিকে বাদ দিয়ে আজ আর কিছুই ভাবতে পারছে না। মনে মনে অবাক হয় সন্দীপ। ওর এই আবেগ-ইচ্ছানুভূতিগুলি এতকাল কোথায় লুকিয়ে ছিল!
হঠাৎ অপরাধবোধ ও মানবিক মূল্যবোধ উদয় হয়ে অনুতাপ অনুশোচনায় মনকে প্রচন্ডভাবে আন্দোলিত করে। ক্ষণপূর্বের বেদনানুভূতি এবং বিবেকের তীব্র দংশণে ওকে পীড়া দেয়। বিচলিত করে তোলে। মনে মনে ভাবে, স্বেচ্ছায় নিজের গুনা কবুল করলে পাপ মুক্ত হয়। ভগবানও মাপ করে দেয়। লিলিতো রক্তে মাংসে গড়া একজন সহজ সরল মহিলা, ওকি কোনদিন পারবে না ওকে ক্ষমা করতে! ওকি পারবে না, ওর অন্তরের নিঃসৃত ভালোবাসা দিয়ে সন্দীপের জীবনকে নতুন করে সাজাতে! একটি সুখের রাজপ্রাসাদ গড়ে তুলতে!
ভাবতেই বিদ্যুতের শখের মতো শরীরের সমন্ত শিরা-উপশিরায় এক অনবদ্য মধুর ভালোলাগা আর ভালোবাসার একটা কোমল নিদারুণ অভিনব অনুভূতি সঞ্চালন হতে থাকে সন্দীপের। সবুর সয় না ওর। হঠাৎ নতুন উদ্যাম-উদ্দীপণায় একরাশ স্বপ্ন নিয়ে অফিস ঘর থেকে ঝড়ের বেগে উর্দ্ধঃশ্বাসে ছুটে বেরিয়ে আসে বাইরে।
ততক্ষণে ধূয়োর মতো ঘন কূয়াশায় ছেয়ে গিয়েছে চারদিক। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা কিছু। আবছা ক্ষীণ আলো অন্ধকারে হঠাৎ ম্যানেজার সন্দীপকে (এ্যন্থনি) দেখে আমরা দুজনেই চমকে উঠি। ভাবলাম, এক্ষণিই আবার চেঁচামিচি শুরু হবে। গালিগালাজ করবে। কিন্তু না, তা আর হলো না। হলো তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
ধীর পায়ে লিলির সন্নিকটে এগিয়ে আসে সন্দীপ। গলার স্বর মোলায়েম করে মৃদুস্বরে বললো,-‘ঠান্ডার মধ্যে কী করছো লিলি? অনবরত শিশির পড়ছে। ভুখার হবে। মানতা হু, মুঝসে গলতি হোগয়া। মাপ কর দো। আও উঠো, ঘর চলো!’
বলে অপরাধির মতো ক্ষমা প্রার্থীর চোখে লিলির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কী স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর ওর। যেন কিছুই ঘটেনি। ইত্যবসরে ওখান থেকে নৈঃশব্দে সড়ে গেলাম আমি। লিলি তক্ষুণি সাপের ফণার মতো তীব্র কন্ঠে ফোঁস করে ওঠে,-‘আবার কী মতলবে! জরুর কোই নয়া সাজিশ কিয়া, হ্যায় না! আব জান বুঝকর দোবারা ধোকা নেহি খাউঙ্গী। চলে যাও। মুঝে একেলা ছোড় দো।’
সামান্য সড়ে এসে লিলির গা-ঘেষে দাঁড়ায় সন্দীপ। লিলির কথায় এতটুকু রাগ হোলো না, উত্তেজিত হোলো না। সেই প্রথম দেখার উজ্জ্বল দ্বীপ্তিময় চেহারা নিয়ে কিছু বলার ব্যকুলতায় উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে অগ্নিসংযোগ করে প্রসন্ন মেজাজে টানতে থাকে। হঠাৎ সচ্চা প্রেমিকের মতো আবেগে আপ্লুত হয়ে অত্যন্ত সাবলীলভাবে বলে ওঠে,-‘মুঝসে সাধী করোগী?’
লিলি নিরুত্তর, নির্বিকার। রক্তরাঙা নয়নে চোখ মেলে একপলক তাকায়। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় মনে মনে। কী প্রশান্ত দেখাচ্ছে সন্দীপকে। ক্রোধের লেশমাত্র নেই। কন্ঠে জড়তা নেই। বিশ্বাসই করা যায না। এ যেন অচেনা অজানা এক নতুন মানুষ। কোনো এক অজ্ঞাত কূলশীল ব্যক্তি। আগে কোনোদিন দ্যাখেনি।
অপ্রত্যাশিত সন্দীপের আগমন, ওর উপস্থিতি প্রেমিকসুলভ আচরণ, লিলিকে বেশ কিছুক্ষণ বুদ করে রাখে। মুহূর্ত্যের জন্য হারিয়ে যায় অন্য এক জগতে। কিন্তু ওর অন্তর্নিহীত কোনো তাৎপর্য বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছিল না। হঠাৎ সন্দীপের উষ্ণস্পর্শে চমকে ওঠে। স্পর্শকাতরতায় চোখের পাতাদু’টো ওর নূয়ে পড়ে। ক্ষোভে, দুঃখে, অপমানে, অভিমানে মুক্তোর মতো বিন্দু বিন্দু অশ্রæকণায় চোখদু’টো চিক্চিক্ করে ওঠে।
ইতিপূর্বে ওর মসৃণ পৃষ্ঠদেশে আলতো স্পর্শে হস্ত সঞ্চালন করে সন্দীপ বলল,-‘আমিই প্রকৃত অপরাধী! জানি এর কোনো ক্ষমা নেই। কারণে অকারণে তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, আঘাত করেছি। আজ তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। আমায় ফিরিয়ে দিও না।’
পকেট থেকে একটা ব্যাঙ্ক চেক্ বের করে বলে,-‘নও, তোমার যত ইচ্ছে টাকার সংখ্যা ভরে নাও। বাধা দেবো না। আমার স্থাবর অস্থাবর বৈষয়িক সম্পত্তি যা কিছু আছে, আমি সন্দীপ আগরওয়াল, স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে সব তোমাকেই সঁপে দিলাম। জীবনের বাকীদিনগুলি যদি তোমায় নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারি, নিজেকে ধন্য ও ভাগ্যবান মনে করবো। আর যাই হোক, অন্তত একবার আমায় প্রায়শ্চিত্ত করবার সুযোগ দাও। প্রমিস করছি, শীঘ্রই এ পথ আমি বর্জন করবো। তোমার মনের মতো করেই নিজেকে গড়ে তুলবো, কথা দিলাম!’
হ্যাঁ না ভালো-মন্দ কোনো মন্তব্য করলো না লিলি। গালে হাত দিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে মুখ ঘুরিয়ে বসেছিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে দ্বিধা আর দ্বন্ধের টানাপোড়ণে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে না পারলেও অনুভব করে, সন্দীপের প্রতি ওর ভালোবাসার টান. দায়িত্ববোধ এতটুকুও কমেনি। অন্তর্কলহে ক্ষণপূর্বে যে হিংস্র মনোবৃত্তি সন্দীপের প্রতি পোষণ করেছিল, তা এখন ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অনুভব করে, অদৃশ্য এক মায়াজ্বালে ক্রমশ জড়িয়ে পড়ছে। মনকে ওর দুর্বল করে দিচ্ছে।
বয়ে যায় কিছুটা সময়। অপেক্ষারত সন্দীপ উৎসুক্য নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। লিলির নীরবতা লক্ষ করে বিষন্ন হয়ে বলল,-‘ওঠো লিলি, লক্ষিটি ঘর চলো। রাত বাড়ছে। কমসেকম নিজেকে সুধরে নেবার মৌকা তো দো। দেখো, এক্ষুণি লোকজন সব ভীড় করবে এসে। বিশ্রি একটা কান্ড ঘটে যাবে। সেটা কি ভালো হবে! লিলি, এ্যাই লিলি! শুন রাহি হো না তুম? মুঝসে বাত নেহি করোগে? তো ঠিক হ্যায়, ম্যায় হামেশাকে লিয়ে যা রাহা হুঁ। কক্ষনো আর তোমার সামনে আসবো না। পারো তো ক্ষমা করে দিও।’
বলে বø্যাঙ্ক চেকটা লিলির হাতে গুঁজে দিয়ে পিছন ফিরতেই লিলি ওর পশমাবৃত বুকের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অপ্রস্তুত সন্দীপ সজোরে ওর উষ্ণ বক্ষপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতেই ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে লিলির হৃদয়-মন-প্রাণ সারাশরীর। ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস্ ফিস্ করে সন্দীপ বলল,-‘আই লাভ ইউ লিলি, মাই সুইট্ হার্ট। মুঝে মাপ কর দো!’
সন্দীপের পিঠে আলতোভাবে একটা চিমটি কেটে লিলি বলল,-‘হুঁমঃ, ঝুটে, বেশরম, লফঙ্গে কাঁহিকা। তুমনে মুঝে বহত দুঃখ দিয়া!’
সহাস্যে মান-অভিমানের ইতি টেনে পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে ক্ষীণ আলো অন্ধকারের ঘন কূয়াশার মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল দু’জনে।
সমাপ্ত
যুথিকা জ্যোতি : কানাডার টরন্টো প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।
২ Comments
Excellent story but could not finish yet ! It was very difficult to stop reading as early morning as sleeping mood and i will read it sure. Congratulations and best wishes.
Thank you so much Mr.Yousuf Ali for your valuable comment to read my story.
Take care and stay well.