রম্যগল্প ‘অবাক সঙ্গীত’
শাহেদ ইকবাল
কথা ছিল দীপালি আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমি সন্ধ্যায় দীপালির কাছে যাবো। আমার কাছে থাকবে একটি আংটি। সারপ্রাইজ গিফট। আমি সেই আংটি দীপালির আঙুলে পরিয়ে দেব। এখন আমি আংটি পরিয়ে দিচ্ছি ঠিকই। ঘড়িতে সময়টাও ঠিক আছে। কিন্তু দীপালিকে নয়, আংটি পরাচ্ছি গোঁফওয়ালা এক দারোয়ানকে। যার হাতে প্রমাণ সাইজের একটি লাঠি। কারণ কি?
আমার অফিস দিলকুশায়। দুপুরবেলায় হঠাৎ একটি আমন্ত্রণপত্র পেলাম। আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছে রিয়াজ। রিয়াজ আমার বন্ধু। পেশায় শিল্পপতি। সেই বন্ধুর ভাতিজার একক সঙ্গীত সন্ধ্যা। সেই ভাতিজা কখন গান শিখল, কার কাছে গান শিখল কিছুই জানতাম না। আজ হঠাৎ এই আমন্ত্রণপত্র। সেই সাথে জরুরি ফোন। না গিয়ে আর উপায় আছে?
অনুষ্ঠান শুরু হবে পাঁচটায়। ভাবলাম কিছুক্ষণ গান শুনে বেরিয়ে যাবো। বন্ধুর দাওয়াতও রক্ষা হবে, দীপালির সাথে ডেটিংও ঠিক থাকবে। দুই কুলই রক্ষা হবে। আমি যথাসময়ে কেতাদূরস্ত পোশাকে অনুষ্ঠানে গিয়ে হাজির হলাম।
শিল্পপতিরা শৌখিন মেজাজের হয়। ভাবলাম জমজমাট একটা অনুষ্ঠান হবে। পরিচিত আরও অনেকের সাথে দেখা হবে। কিন্তু অনুষ্ঠানে গিয়ে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম। সব মিলিয়ে জনা পঞ্চাশেক দর্শক। তার উপর ভ্যাপসা গরম। কি একটা কারণে যেন এসি কাজ করছে না।
গান শুরু হওয়ার কথা বিকাল পাঁচটায়। এখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। গান শুরু হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। গানের বদল চলছে বক্তৃতা। বন্ধুর নিজের জীবনের স্মৃতিচারণ। শৈশবে পাগলা কুকুরের কামড় খেয়ে কিভাবে গান গেয়ে উঠেছিল, সেই গান শুনে কুকুর পালিয়ে গিয়েছিল তার ফিরিস্তি। জীবনে কত কষ্ট করে গান শিখেছে তার বিবরণ। পাড়াপড়শী কেউ নাকি গাইতে দিতো না। যে বাড়িতে ভাড়া থাকতো সেই বাড়িও ছাড়তে হলো। চাপাবাজি। নিশ্চয়ই চাপাবাজি। কুকুরের কামড় খেয়ে কেউ গান গাইতে যায়?
অবশেষে ছ’টার দিকে গান শুরু হলো। সে এমনই গান-একটা গান শুনেই আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। আমাদের গ্রামের বাড়িতে জঙ্গল ছিল। সেই জঙ্গলে শিয়াল ছিল। সন্ধ্যা হলেই শিয়াল ডাকতো। রিয়াজের ভাতিজার গান শুনে আমার কেন যেন সেই শিয়ালের কথা মনে পড়তে লাগল।
দুই তিনটা গান শোনার পর বুঝতে পারলাম এখানে আর থাকা যাবে না। থাকলে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাব। শার্টের ইস্ত্রি ঠিক করতে করতে উঠে দাঁড়ালাম। গেটের কাছে গিয়ে দেখলাম দৈত্যাকৃতির একজন দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। মুখে পাকানো গোঁফ। হাতে প্রমাণ সাইজের লাঠি।
দারোয়ান জানতে চাইল, ‘কোথায় যাবেন?’
আমি বললাম, ‘চলে যাবো। আমার কাজ আছে।’
দারোয়ান বললো, ‘এখন তো যাওয়া যাবে না।’
আমি আঁতকে উঠলাম। আমার কয়েকটা হার্টবিট মিস হয়ে গেল। ‘যাওয়া যাবে না মানে?’
‘যাওয়া যাবে না মানে যাওয়া যাবে না। খাঁটি বাংলাও বোঝেন না?’
‘যাওয়া যাবে না কেন?’
‘সাহেবের নিষেধ আছে।’
‘সাহেব মানে রিয়াজ?’
‘হ্যাঁ’
‘রিয়াজ কোথায়?’
‘একটু বাইরে গেছেন।’
আমি কাঁপাকাঁপা হাতে মোবাইল কানে লাগিয়ে দেখলাম। ডেড। স্ক্রিনে দেখলাম নো সার্ভিস। বুঝলাম ইচ্ছে করেই এমন করে রেখেছে।
এতক্ষণে বুঝলাম দর্শক কেন ধৈর্য ধরে এই গান শুনছে। তারাও আসলে স্বেচ্ছায় শুনছে না। বের হতে পারছে না বলেই শুনছে। আমার যে অবস্থা ওদেরও সেই অবস্থা। এখন উপায়?
সন্ধ্যা সাতটায় দীপালির সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। দীপালি আজ আমাকে মনের কথা বলবে। ছয়মাস ঘোরাঘুরির পর মন গলেছে। আজ দুপুরে ফোনে বলেছে সন্ধ্যায় হাতিরঝিলে আসতে। ঘড়িতে বাজে সাড়ে ছ’টা। দীপালিকে যে ফোনে জানাবো আমার দেরি হবে। সে উপায়ও নেই।
রাগে-দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। ভেবেছিলাম পাঁচটার প্রোগ্রাম ছয়টায় শেষ হবে। তারপর মনের সুখে হাতিরঝিল যাওয়া যাবে। এখন সে গুড়েবালি। টিকেটের দামও নিয়েছে প্রচুর-ছয়শত টাকা। ভেবেছিলাম হাজার হোক বন্ধুর প্রোগ্রাম। নাহয় খসলো কিছু টাকা। বেরুতে গিয়েও ভেবেছিলাম টাকাটা জলে গেল। এখন দেখা যাচ্ছে, আমও গেছে ছালাও গেছে। টাকা তো গেছেই, এখন বেরুনোও যাচ্ছে না।
আড়চোখে গেটের দিকে তাকালাম। ঝেড়ে দৌড় দিলে কেমন হয়? পরমুহূর্তে সেই চিন্তা বাদ দিলাম। দৈত্যাকৃতির দারোয়ান গোঁফে তা দিচ্ছে। এই পাহাড় ডিঙিয়ে দৌড় মারা আমার কর্ম নয়। রিয়াজের সাথে কথা বলাও সম্ভব নয়। এখন উপায়?
ভাবতে ভাবতেই চার নম্বর গান শুরু হলো। এই গানের কাছে আগের তিনটা কিছুই না। যেমন বিকট গলা, তেমনই বিকট সুর। আমার কাছে দিনের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল কেন এই শিল্পীর গান শুনে কুকুর পালিয়ে গিয়েছিল। আরও পরিষ্কার হলো কেন তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। শুরুতে যাকে চাপাবাজি বলে মনে হয়েছিল এখন তাকে আর চাপাবাজি বলে মনে হচ্ছে না।
হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো একটা বুদ্ধি মাথায় এলো। পৃথিবীতে ফ্রি লাঞ্চ বলে কিছু নেই। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। দীপালির জন্য যে আংটি নিয়ে যাচ্ছিলাম, সেই আংটি এই দারোয়ানকে দিয়ে দিলে কেমন হয়? যত পাকানো গোঁফই হোক না কেন, দামি আংটি দেখলে হয়তো গলেও যেতে পারে।
বাস্তবে হলোও তাই। পকেট থেকে আংটি বের করতেই দারোয়ানের চোখ চকচক করে উঠল। গোঁফে তা দিতে দিতে বললো, ‘দামি মাল মনে হচ্ছে।’
কাতর কণ্ঠে বললাম, ‘বেশ দামি জিনিস। নেবেন?’
দারোয়ানের পাথুরে মুখে এক চিলতে হাসি ফুটলো। বললো, ‘তা আপনি সাধলে কি আর না নিয়ে পারি?’
‘তাহলে আমাকে এবার যেতে দিন।’
দারোয়ান হাত বাড়িয়ে দিল। ‘দিন। আমার আঙুলে পরিয়ে দিন।’
আংটিটা দারোয়ানের আঙুলে পরিয়ে দিলাম।
আমাকে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দারোয়ান বললো, ‘মুখ ব্যাজার কেন স্যার?’
বললাম, ‘এই আংটি নিয়ে প্রেমিকার কাছে যাবার কথা ছিল। এখন খালি হাতে যেতে হবে।’
‘তাঁকে ঘটনা খুলে বলবেন। তাহলে আর রাগ করবেন না।’ দারোয়ান বুদ্ধি দিল।
‘যদি বিশ্বাস না করে?’
‘সঙ্গে করে প্রমাণ নিয়ে যাবেন।’
‘প্রমাণ? কিসের প্রমাণ?’ আমি অবাক হলাম।
দারোয়ান এবার তার লাঠিটা নিয়ে এল। ভাবলাম এই কাজটাই বোধহয় এতক্ষণ বাকি ছিল। এবার বোধহয় আমাকে লাঠিপেটা করা হবে। আমি ঝেড়ে দৌড় দেবার জন্য প্রস্তুত হলাম।
কিন্তু না। দারোয়ান আমাকে বিস্মিত করে লাঠিটা এগিয়ে দিল আমার দিকে। বললো, ‘এটা নিয়ে যান। আপনার প্রেমিকাকে দেখান। এটা দেখলে তিনি বুঝবেন কেন আংটি রেখে গেছেন।’
প্রস্তাবটা আমার মনে ধরলো। প্রস্তাব মন্দ না। দীপালি যদি জানতে চায় তাহলে এই লাঠি দেখানো যাবে। বলা যাবে এই লাঠি দিয়েই আমার আংটি ছিনতাই করা হয়েছে। তারপর লাঠিটা রাস্তায় ফেলে গেছে।
আমি খুশিমনে লাঠি হাতে রওনা হলাম। রাস্তার লোকজন সন্দেহের দৃষ্টিতে আমাকে দেখতে লাগলো। এই সময় মোবাইলে দীপালির ফোন পেলাম। দীপালিকে বললাম, ‘সোনা, দশমিনিট অপেক্ষা করো। আমি কাছাকাছিই আছি।’
হাতিরঝিলে গিয়ে দেখলাম দীপালি সুবোধ বালিকার মতো অপেক্ষা করছে। আমি দু’হাতে লাঠিটা আড়াল করে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। দীপালির চোখ আনন্দে চকচক করতে লাগলো। নিশ্চয়ই বড়সড় কোনো চমক হবে। উত্তেজনায় ওর যেন তর সইছে না।
‘তোমার হাতে কি?’
‘তেমন কিছু না।’ আমি বিরস মুখে বললাম।
দীপালি হুড়োহুড়ি করে আমার লুকিয়ে রাখা লাঠিটা সামনে নিয়ে এলো। তারপর সেই লাঠি দেখে চোখমুখ উল্টে অজ্ঞান হয়ে গেল।
লেখক: ড.শাহেদ ইকবাল, শিশুসাহিত্যিক ও যুগ্মসচিব (স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়)
২ Comments
very good job; very good response. Congratulations sir.
দারুন