স্মৃতিময় মিশর
শারমীন ইয়াসমিন
“আমার মন চলে যায় মনের কাছে
বলতে মনের কথা, দেহ পরে থাকেরে
মনের যত কথা থাকে
রাখি তারে গোপন করে
বুকের মাঝে নিত্য তুমি
খেলো কত খেলারে।
আসলে প্রতিটি মানুষের মাঝেই লুকিয়ে আছে একটা কবি মন, একটা প্রেমিক হ্নদয়। আর থাকে আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন। যা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, তাকে আনন্দ দেয়, তাকে পুলকিত করে, আত্নাবিশ্বাসী করে তোলে। তেমনি একটি মন সেদিন পুলকিত হয়েছিল, বিমোহিত হয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়ার ভূমধ্যসাগরের নীলাভ নয়নাভিরাম জলের সৌন্দর্যে। বড় চমৎকার মনোরম ছিল সেই আনন্দময় মুহুর্তগুলো। যা ইচ্ছে করলেও কখনও স্মৃতির পাতা থেকে মুছে ফেলা যাবে না।আসলে প্রকৃতি বড় বৈচিত্র্যময়, বড়ই রহস্যময় ও কাব্যময়। তার চেয়েও বড় রহস্য ও কাব্যময় আমাদের এই মন। বড় বিচিএ এ ভাবনা, বড় বিচিএ এ অনুভূতি। তাই প্রকৃতি প্রেমে মানুয আকুল হয়ে ছুটে চলে দেশ হতে দেশান্তরে। ভ্রমণ পিপাসু মানুষের চোখে- মুখে ভেসে ওঠে অজানাকে দেখার ও জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। প্রকৃতি ও সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনে সে খুঁজে পায় অনাবিল আনন্দ ও সুখ। কেননা পৃথিবীর পরতে পরতে রয়েছে সুন্দরের এক একটা বাগান।
বলছিলাম ২০১০ সালের কথা। আমার স্বামী কুয়েত মিশনে থাকাকালীন সময়ে আমার মিশরে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল । নীলনদ, পিরামিড আর মমি দেখার ইচ্ছেটা অনেক আগে থেকেই মনের মধ্যে ছিল। তবে ইচ্ছেটা যে একদিন সত্যি হবে সেটাও ছিল একটা স্বপ্ন।
মিশরে যাওয়ার সুযোগ যখন পেয়েছি , তখন আর সময় নষ্ট করিনি। সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম। আমাদের সাথে আরও একটি পরিবার যেতে রাজি হয়ে গেল। আর তার পর থেকেই শুরু হয়ে গেলো মিশর যাওয়ার প্রস্তুতি। সেই সাথে চোখের সামনে ভেসে উঠছিল পিরামিড, কায়রো মিউজিয়াম, মমি, নীলনদ, আলেকজান্দ্রিয়া পৃথিবী বিখ্যাত লাইব্রেরি, বাতিঘর, রাতের কায়রো শহর ইত্যাদি। যা এতোদিন বই- পুস্তকে পড়েছিলাম। আর এখন তা বাস্তবে দেখতে যাবো, তা ভেবেই পুলকিত হচ্ছিলাম।
অপেক্ষার পালা শেষে একদিন এলো সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ। মহাখুশিতে আমরা যাএা শুরু করলাম কুয়েত থেক মিশরের উদ্দেশ্য। কুয়েত থেকে আকাশ পথে আমরা প্রথমে গেলাম আলেকজান্দ্রিয়া বিমান বন্দরে। সেখান থেকে টেক্সি নিয়ে চলে এলাম আলেকজান্ড়িয়ার পর্যটন শহরে। যেন এক অভূতপূর্ব সৌন্দর্যের মাঝে উপস্থিত হলাম। দেহ- মন উদাস হয়ে গেলো।
আমরা একটা সুন্দর পরিপাটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলাম। দুই পরিবারের জন্য যা ছিল খুবই চমৎকার। ফ্ল্যাটটি ছিল ভূমধ্যসাগরের অতি সন্নিকটে। রুমে ঢুকেই মনটা ভরে গেলো। অনেক সুন্দর করে সবকিছু গুছিয়ে রেখেছিল। যেহেতু ফ্ল্যাটে উঠেছি সেহেতু মনে হচ্ছিল যেন বাসাতেই আছি।
ভূমধ্যসাগরের পাশেই ছিল আমাদের ফ্ল্যাটটি। ভূমধ্যসাগরের নীলাভ নয়নভিরাম জলের সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছিল,বিমোহিত করেছিল।আমি যেন এক অন্য আমি হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মাঝে যেন সেই মুহুর্তে অন্য এক আমিকে খঁজে পেলাম।যে আমিটা এতোদিন এক অন্ধকার গলিতে, নিভূতে ঘুমরে কেঁদে ছিল।আজ যেন তা পূর্ণতা পেল। আমার চেতনা যেন একটি সাদা সত্যিকার পালকের মতো উড়তে শুরু করল।
আমার মন যেন ডুবে যাচ্ছিল, হারিয়ে যাচ্ছিলাম অন্য এক আমিতে।আমার আমিতে যেন আমি আর নেই। আবিষ্কার করলাম নিজেকে এক নতুন আমিতে। টাইটানিকের নায়িকার মতো দ’হাত বাড়িয়ে ইচ্ছে করছিল পৃথিবীকে আলিঙ্গন করতে, তাকে সাধুবাদ জানাতে। বারান্দায় বসে চা- বিস্কুট খেতে খেতে ভাবছিলাম আকাশ- পাতাল কত কিচ্ছু। মিষ্টি বাতাসের পরশ এসে লাগছিল দেহ- মন- প্রাণে।মনে হচ্ছিল বাসনার নদীতে অবগাহন করছিলাম।ভূমধ্যসাগরের আকাশ ছোঁয়া ঐ জলে মনে হচ্ছিল কিচ্ছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছলা। রুম থেকেই দেখতে পাচ্ছলামসৃষ্টিী অপার রহস্যের সৌন্দর্য। পৃথিবীর এত সুন্দর, সৃষ্টি এত রহস্যময়, প্রকৃতি এত উদার ভেবে ভেবে অবাক হচ্ছিলাম। হঠাৎ আম্মু আম্মু ডাক শুনে চৈতন্য ফিরে এলো।
তারপরের দিন সকালে আমরা দু’ই পরিবার মিলে দেখতে গেলাম পৃথিবী বিখ্যাত ঐতিহাসিক আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি। যাচ্ছিলাম ঘোড়ার গাড়িতে করে। আর যেতে যেতে মনে পড়ছিল বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিচ্ছু লেখা-“মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে,সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত।”
এই লাইব্রেরিটি সংস্কৃতি, জ্ঞান- বিজ্ঞান ও সভ্যার প্রতীক। লাইব্রেরি দর্শন শেষে রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে দুপুরবেলার খাবার খেয়ে, কিচ্ছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে দেখতে গেলাম আলেকজান্দ্রিয়া বিখ্যাত সেই বাতিঘরটি। সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজগুলো যেন রাতের অন্ধকারে দিক না হারিয়ে ফেলে সেইজন্য সমুদ্রের তীরে বা পাহাড়ে প্রাচীনকালে নির্মাণ করা হতো বাতিঘর। প্রাচীন সময়ের সবথেকে উঁচু বাতিঘরটি হল এই আলেকজান্ড়িয়ার বাতিঘরটি। বিস্ময়কর এই বাতিঘরটি ভূমধ্যসাগরের উপকূলে মিশরের ফায়োস নামের এক দ্বীপে অবস্হিত।
তারপর দিন সকালে রওনা হলাম মিশরের রাজধানী কায়রোর উদ্দেশ্য। কায়রো এসে পৌঁছািলাম সন্ধ্যারাতে।এখানে আমরা একটা হোটেলে উঠেছিলাম। তারপর দিন দেখতে গেলাম কায়রো মিউজিয়াম। সারা পৃথিবীর পর্যটকদের যেন মিলনমেলা বসেছে। টিকেট কেটে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আমরাও ঘুরে ঘুরে দেখলাম প্রাচীন নির্দশনসমূহ।আর দেখলাম বিশ্ববিখ্যাত মমি।যা দেখে শিহরিত ও বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম।
কায়রোকে বলা হয় রাতের শহর। আমরা দুই পরিবার একসাথে ঘুরে ঘুরে কায়রোর রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। রাতের কায়রো বড় চমৎকার। দোকানিরা তাদের দোকানগুলোকে মনোরমভাবে সাজিয়ে রেখেছে। যা দেখলে সবারই কেনাকাটা করতে ইচ্ছে করবে, আমরাও অনেক কিচ্ছু কিনেছিলাম। মিশরের খাবার আমাদের খাবারের মতো নয়। মিশরীয়রা নরম নরম আঠালো ভাত খেতে পছন্দ করে।তার চেয়েও বেশি পছন্দ করে খবুজ বা রুটি। তবে পর্যটকদের খাবারের জন্য রয়েছে নানা রকম খাবারের দোকান। তবে আমরা বেশির ভাগ সময়েই রুমে রাইস কুকারে রান্না করে খেয়েছিলাম।
তারপর দেখতে গেলাম বড় কাঙ্খিত সেই পিরামিড। সভ্যতার আদি ভূমি মিশর। মানব ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূণ আবিষ্কার এই মিশরেই হয়েছে। মিশর বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পিরামিডের ছবি। এটি পৃথিবীর প্রাচীন সপ্তম আশ্চর্যের একটি। পিরামিড হলো এক প্রকার জ্যামিতিক আকৃতি বা গঠন, যার বাইরের স্তরগুলো এিভূজাকার এবং যারা শীর্ষে একটি বিন্দুতে মিলিত হয়। মিশরে রয়েছে ছোট বড় প্রায় ৭৫ টি পিরামিড। সবচেয়ে বড় এবং আকর্ষণীয় হচ্ছে গিজার পিরামিড যা খুফুর পিরামিড হিসেবেই বেশি পরিচিত। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য পিরামিড দেখে মুগ্ধ ও অভিভূত হলাম।
ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস বলেছিলেন মিশর নীলনদের দান। সেই নীলনদে রাতের মনোমুগ্ধকর পরিবেশে জাহাজে করে ঘুরে বেড়িয়েছি আর সেই সাথে উপভোগ করেছি তাদের সংস্কৃতি ও আতিথিয়তা। যতক্ষণ জাহাজে ছিলাম সম্পূর্ণ সময়টা নাচে গানে ও আপ্যায়নে ভরপুর ছিল এবং স্মৃতিপটে থেকে গেল কত স্মৃতিময় ঘটনা।
আবার ভোর হলো কায়রো শহরকে চিরকালের মতো বিদায় জানিয়ে ছুটলাম মিশরের আরেক প্রান্তে। গেলাম লুক্সের, ফেরাউনের প্রাসাদে এবং গেলাম মিশরের আধুনিক ও পর্যটন নগর হুরগাদায়।যতদূর সম্ভব এভাবে ঘুরে ঘুরে দেখলাম মিশরকে।আর স্মৃতির ভান্ডারে যতন করে রেখেছি সেই আনন্দঘন স্মৃতিময় মুহুর্তগুলো। যা এখনো মনের কোণে নিজের অজান্তেই উঁকি মারে। আমাকে আজও আবেগ আপ্লুত করে তোলে। সবকিচ্ছু মিলিয়ে আসাধারণ ভ্রমনের একটি দেশ মিশর।
২ Comments
সুন্দর উপস্থাপন ।
congratulations; very good response.