শিশুর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে শিক্ষকের করণীয় :
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড—এ কথা সবাই জানি এবং মানি। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। কোনো জাতির উন্নতির পেছনে যে গোপন বীজমন্ত্রটি রয়েছে, তা হলো তার শিক্ষা ও শিক্ষাপদ্ধতির নিয়ম-রীতি। কেননা, শিক্ষা মানুষের মনুষ্য ও বিবেকের সমস্ত দরজা-জানালা খুলে দেয় এবং অন্ধত্ব দূর করে তাকে আলোর পথে ধাবিত করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষা বলতে আমরা কী বুঝি? শুধু কি বইপত্রে লিখিত কিছু সীমাবদ্ধ জ্ঞান অর্জন করাকে বোঝায়?
আমি মনে করি, শিক্ষা অর্জনটা এমন হওয়া উচিত, যা আমাদের ভেতর-বাহির দুটোরই পরিশুদ্ধ পরিবর্তন আনতে পারে। আমাদের চিন্তাচেতনা, আচার-আচরণ, বিবেক-মনুষ্যত্ব সর্বত্র যেন তার একটা প্রভাব পড়ে। শিক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছাত্র-শিক্ষক এবং বাবা-মা অর্থাৎ অভিভাবক। এই তিনের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই শিক্ষার সঠিক সফলতা অর্জন সম্ভব। আমাদের আজকের শিশু-কিশোরেরাই যেহেতু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, জাতির কর্ণধার, কাজেই তাদের সুস্থ-সবল, প্রাণবন্ত দেহ ও উন্নত জীবন গঠনে নৈতিক শিক্ষা অনুশীলন বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা অতীব জরুরি। আর এ ক্ষেত্রে একজন শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুশীলতা, সৃজনশীলতা অর্জন অনেকটাই নির্ভর করে একজন শিক্ষকের কার্যকলাপের ওপর। তিনি জাতির বিবেক, তিনি প্রাজ্ঞবান, প্রজ্বলিত আলোক শিখা, জ্ঞানের আধার, চলমান অভিধান। শিক্ষক তাঁর প্রাজ্ঞতা দিয়ে গড়ে তোলেন একটি সমৃদ্ধ ও সুন্দর সমাজ এবং যে সমাজের একজন হয়ে প্রতিনিধিত্ব করবে আজকের শিশু-কিশোরেরাই। তারাই হবে আগামীর শিক্ষক, জাতির গর্ব ও অহংকার। তারাই হবে সমাজসংস্কারক ও আলোকিত সমাজের বিবেকবান মানুষ। কাজেই শিশুদের বা শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে, যোগ্যভাবে ও আদর্শবান মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা একজন শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব।
শিশুরাই আমাদের প্রাণ। প্রাণের স্পন্দটা বোধ হয়, এখানেই বেশি অনুভূত হয়। আজকের শিশুরাই আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। ওরাই জাতির আশা-ভরসা, স্বপ্ন। এই শিশুদের সুনাগরিক, দেশপ্রেমিক ও সৎ গুণাবলিসম্পন্ন মানুষরূপে গড়ে তোলার দায়িত্ব মা-বাবা এবং শিক্ষকের। কারণ, শিশুরা মা-বাবার আদর্শেরই বেড়ে ওঠে। ঘরেই শুরু হয় শিশুর প্রথম শিক্ষা। সেই হিসাবে মা-বাবাই তার প্রথম শিক্ষক। আর শিক্ষক তাকে পরিচয় করিয়ে দেন বর্ণমালার সঙ্গে, আলোকিত পৃথিবীর সঙ্গে, ন্যায়-অন্যায় বোধের সঙ্গে আর পরিচয় করিয়ে দেন শুভ ও শুভ্রতার সঙ্গে। শিক্ষক সব সময় তাঁর ছাত্রছাত্রীদের কাছে আদর্শ রোল মডেল। একজন শিক্ষকের আচার-ব্যবহার, ব্যক্তিত্ব, সর্বোপরি অধ্যয়ন কৌশল একজন ছাত্র বা ছাত্রীর জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
শিক্ষককে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকের হাতেই তৈরি হয় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। কাজেই ছাত্র-শিক্ষকের মধ্য সম্পর্কটা হওয়া উচিত আন্তরিকতাপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ।
ছাত্রছাত্রীর অহেতুক ভুলত্রুটিগুলো না ধরে, অপদস্থ না করে আন্তরিকতা ও স্নেহের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। শিক্ষার্থীরা তো ভুল করতেই পারে। আর সেই ভুলগুলো সংশোধন করার জন্যই রয়েছে শিক্ষক। আমি মনে করি, শিক্ষকের আন্তরিকতা ও ভালোবাসা থাকলে যেকোনো ধরনের শিক্ষার্থীকে সঠিক পথে পরিচালনা করা সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মনোযোগী হতে হবে এবং শিক্ষকের কথামতো কাজ করতে হবে। একজন শিক্ষক সব সময় চান তাঁর ছাত্রছাত্রীরা ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক, পড়াশোনায় মনোযোগী হোক এবং ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক।
শিক্ষার লক্ষ্যই হলো ভালো মানুষ তৈরি করা। শিক্ষকতা কোনো পেশা নয়। এটা একটা ব্রত। এটা একটা মহৎ কাজ। একজন শিক্ষককে শুধু তার ছাত্রছাত্রীরাই শ্রদ্ধা-সম্মান করে না; সমাজের সবাই তাকে শ্রদ্ধা-সম্মান করে, তাঁকে আদর্শ মনে করে। কাজেই আমরা বুঝতে পারছি যে শিক্ষকেরও অনেক কিছু করণীয় আছে।
আমি মনে করি, শিক্ষক হবেন ছাত্রের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ও শ্রদ্ধার পাত্র। এ ক্ষেত্রে শিক্ষককেই আগে এগিয়ে আসতে হবে এবং ছাত্রের ভয়ভীতি দূর করে তার সঙ্গে সহজ-স্বাভাবিক হবেন। তাহলেই জানা যাবে কোথায় কী সমস্যা আছে বা কী সমস্যা হচ্ছে। ছাত্রের সমস্যা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে এবং আন্তরিকতার সঙ্গে তার সমাধান দিত হবে। কেননা, শাসন দিয়ে যা সম্ভব নয়, ভালো ব্যবহার ও স্নেহ দিয়ে তা সহজেই সম্ভব। শিক্ষককে হতে হবে অনেক ধৈর্যশীল, সহানুভূতিশীল মহানুভব ও ক্ষমাশীল।
শিক্ষকের উচিত শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের আগেই পাঠ-পরিকল্পনা করে যাওয়া এবং যে ছাত্রছাত্রীরা তুলনামূলকভাবে কিছুটা পিছিয়ে আছে, তাদের প্রতি একটু বেশি যত্নবান হওয়া। তাদের সঙ্গে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা। প্রায় প্রতিদিন তাদের কুশলাদি জানা, পড়াশোনার খোঁজখবর নেওয়া, তাদের শ্রেণিকক্ষে সামনের দিকে বসতে দেওয়া এবং সম্ভব হলে প্রতিদিন পড়া জিজ্ঞেস করতে হবে। তাহলে হয়তোবা কিছুটা হলেও উন্নতি হবে।
শ্রেণিকক্ষে নিজেকে অবশ্যই আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। শিক্ষক যেহেতু মানুষ গড়ার কারিগর, তাই তাঁকে সর্বদাই সচেতন থাকতে হবে যেন তার কোনো ভুলের কারণে শিক্ষার্থীরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। শিক্ষার্থী অপেক্ষা শিক্ষককে অনেক বেশি পড়তে হবে, জানতে হবে এবং জানাতে হবে। কারণ, এখানে আপনিই কান্ডারি। শিক্ষকের বাচনভঙ্গি হবে সুন্দর, উপস্থাপন কৌশল হবে আকর্ষণীয়, সুনির্দিষ্ট বিষয়ে থাকতে হবে জ্ঞানের গভীরতা এবং তিনি হবেন বিনয়ী ও বন্ধুবৎসল।
ক্ষমার ওপর কোনো কিছু নেই। ক্ষমা মহত্ত্বের লক্ষণ। ক্ষমাশীল মানুষ সবার কাছে পূজনীয়। ক্ষমা মানুষকে সহজ-সরল ও সহানুভূতিশীল হতে শেখায়। যিনি শিক্ষক হবেন, তাঁকে অবশ্যই ক্ষমাশীল ও সহানুভূতিশীল হতে হবে। শিক্ষকতা যেহেতু একটা সেবামূলক কাজ, তাই অর্থের সঙ্গে এর তুলনা না করাই শ্রেয়। সর্বোপরি শিক্ষকের তাঁর কাজের প্রতি থাকতে হবে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠা। আর তাহলেই দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধিত হবে।