উৎসব আনন্দে
– দেবাশীষ দাস
– অক্টোবর ১২, ২০২১
শারদীয় দুর্গোৎসবে সবাই যখন আনন্দে মেতে ওঠে আমি তখন বরাবরই একটা দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকি। কার সাথে পুজোয় ঘুরতে যাব সেটাই আমার দুশ্চিন্তার কারণ। ছোটবেলায় মায়ের সাথে বা দিদিদের সাথেই পুজোয় ঠাকুর দেখতে যেতাম। বড় হবার পর মায়ের সাথে বা দিদিদের সাথে পুজো দেখতে গেলে পাড়ার লোকেরা ব্যঙ্গ করে বলে ‘ছেলেটা এখনও বাচ্চাই রয়ে গেল।’ বন্ধুদের সাথে পুজো দেখতেও সমস্যা। একাংশ বন্ধু আছে যাদের সাথে বান্ধবী থাকে। ওদের মাঝে আমি বেমানান। অনেকটা ওই ‘কাবাব মে হাড্ডি’ এর মত। আর কিছু বন্ধু আছে যারা উৎসবের দিনগুলোতে সুরা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করে একটু অন্যরকম মেজাজে থাকে। আমার এটা মোটেই পছন্দ নয়, তাই ওদের সাথেও পুজো দেখা হয় না। একা একা পুজো দেখতে কি ভাল লাগে! আবার পুজোয় ঘুরতে না গেলেও সমস্যা। পাড়ার লোকজন ভাবে হয়তো প্রেমে ধোঁকা খেয়ে মন খারাপ, তাই বাড়িতে বসে আছে। একা একা ঘরে বসে না জানি কি কুকর্ম করছে! বাড়ির লোকজন ভাবে হয়তো নতুন ড্রেসটা পছন্দ হয়নি, তাই ঘুরতে যাচ্ছে না। এক কথায় বলতে গেলে পুজোয় ঘুরতে গেলেও সমস্যা আবার না গেলেও সমস্যা, মানে উভয়সংকট।
সে বছর আমি একাদশ শ্রেণিতে পাঠরত, সালটা ২০০৫। পুজোর প্রথম দিনে সন্ধ্যা বেলায় সাহস করে একা একা বেরিয়ে পড়েছিলাম, কাউকে না কাউকে পেয়ে যাব ভেবে। ছৈলেংটা বাজারে গিয়ে পেয়ে গেলাম আমার সহপাঠী অঞ্জনকে। অঞ্জনের সাথে ছিল ওর প্রতিবেশী বিধুর। আমাকে দেখেই অঞ্জন বলল, ‘চল বন্ধু ওদিকে পুজোটা দেখে আসি।’ অঞ্জনের কথা শুনে আমি কতটুকু স্বস্তি পেয়েছিলাম তা বলে বুঝতে পারব না। আমি অঞ্জনের সাথে চললাম। কিছুদূর গিয়ে পেয়ে গেলাম আরও চার সহপাঠী প্লাবন সুমিত জয়ন্ত ও বিশ্বজিতকে। তারপর আমরা সবাই মিলে একসাথে পুজো দেখলাম। খুব মজা হয়েছিল, সতীর্থরা একত্রিত হলে যা হয়। আমরা সবাই ছিলাম একই রকম। আমরা সবাই ছিলাম নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত ও ভদ্র ছেলে। আমাদের কারোর মেয়ে বন্ধু ছিল না। কোনও প্রকার নেশা দ্রব্যে আমাদের আসক্তি ছিল না।
আমরা সেদিন প্রাণ ভরে উৎসব আনন্দ উপভোগ করেছিলাম। যেখানেই মখরোচক খাবার দেখেছি সবাই মিলে খেয়েছি। নির্জনে সবাই মিলে মনের আনন্দে এক সুরে গান ধরেছি। পুজোয় অন্যান্য সহপাঠী বন্ধু বান্ধবীদের সাথেও দেখা হয়েছে। সবার সাথে হাসি মজা হয়েছে, কিন্তু কারও সাথে অশালীন আচরণ করিনি। মধ্য রাত্রি পর্যন্ত আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি। যাবার সময় সবাই বলল কাল আবার দেখা হবে সন্ধ্যা ৭টায় ছৈলেংটা বাজারে। পরের দিন ঠিক সময়মত সবাই ঐ নির্দিষ্ট জায়গায় উপস্থিত। সেদিন মনু ছৈলেংটা ময়নামাতে ঘুরেছি। খুব মজা হয়েছিল। নবমীর দিনেও একই ঘটনা। বিজয়ার দিনে আর ঘোরাঘুরি নয়। বিজয়ার দিনে সবাই নিজের নিজের পাড়ায় প্রতিমা বিসর্জনে ব্যস্ত ছিলাম। ২০০৬ সালে আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ওই দুবছর-ই শারদীয় দুর্গোৎসব আমার জন্য সবচেয়ে আনন্দময় ছিল। ২০০৭ এ আর হল না। দ্বাদশ পাশ করে প্লাবন সুমিত কৈলাশহর কলেজে, জয়ন্ত আগরতলা কলেজে, অঞ্জন ধর্মনগর কলেজে চলে গেল। আমি রহস্যজনক ভাবে দ্বাদশ শ্রেণির টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করে ছৈলেংটায় থেকে গেলাম। বন্ধুরা যে যেখানে কলেজে ভর্তি হয়েছিল ওরা সেখানেই পুজো দেখেছে। এখানে এটাই প্রথা ছিল, এখানকার ছেলে মেয়েরা শহরের কলেজে পড়তে গেলে ওখানেই পুজো দেখে। আমি আবার একা হয়ে গেলাম। আবার কার সাথে পুজো দেখতে যাব সেই দুশ্চিন্তা…
শারদ স্মৃতি | পর্ব- ০১
দেবাশীষ দাস
ত্রিপুরা, ভারত