১৮৬ বার পড়া হয়েছে
শান্তির ধর্ম জানি–মানি না
(শীরীন আক্তার)
১৫/০৬/২২
মুসলমানদের দুটি প্রধান ধর্মীয় উৎসব – ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। বাংলাদেশে মুসলমানদের সংখ্যাই বেশি। তাই এ দুটি উৎসব ইসলাম ধর্মের মানুষের অতি আকর্ষণীয় ও মর্যাদার উৎসব।শব-ই বরাতের পর থেকে রমজান মাসকে সামনে রেখে যখন গোটা বিশ্বের মুসলমানেরা সওয়াব অর্জনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে, বাংলাদেশের মুসলমানেরাও তাই। কিন্তু অতীব দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, যে দেশের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যের সাথে অবিরাম যুদ্ধ করে ; সে দেশের প্রধান দুই উৎসবকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে।
তারপর একে একে সকল ভোজ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়াতে থাকে। দাম বাড়ানোর উদ্দেশ্য অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন।এর পেছনে ওদের অদম্য লোভ কাজ করে। এতে গরীব অসহায় মানুষকে অনাহারে অর্ধাহারে রেখে গুটিকয়েক মানুষ দেশবিদেশে দামী বাড়ি গাড়ি করে। বিদেশি ব্যাংকে টাকা জমায়।ঈদুল ফিতরের সময়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এই চেইন ঈদুল আজহা পর্যন্ত একনাগাড়ে বাড়তে থাকে। এইযে দরিদ্র জনগোষ্ঠী কতেক দুষ্ট নরপশুর কারণে মানবেতর জীবন যাপন করে, এতে ওই মুষ্টিমেয় সিন্ডিকেটধারীর কিছুই আসে যায় না। ওদের ভাবখানা এমন গরীব মরলে মরুক, আমাদের কী?
কিন্তু পবিত্র কুরআনের বা আমাদের মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) কোথাও কি বলেছেন — একদল লুটপাট করে টাকার পাহাড় গড়বে, অন্য দল পথের ধুলায় গড়াবে। নিশ্চয়ই সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমান একবাক্যে ‘না’ বলবেন। বরং রমজানের রোজা রাখার ক্ষেত্রে গরীব মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করতে অবস্থাপন্নদের সংযম তথা সিয়াম সাধনার কথা বলেছেন। গরীবেরা বছরের বারো মাসই হাভাতে থাকে। আর ধনীরা খাবার পঁচিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে, নষ্ট করে। তাই ওদের সাথে মিলিয়ে রমজান মাসের রোজা রাখা ফরজ করা হয়েছে। সংযম পালন এর প্রধান উদ্দেশ্য। এ সংযম শুধু দিনের বেলায় না খেয়ে থাকার জন্য নয়, এ সংযম যাপিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে করতে বলা হয়েছে। এ রমজান মাসে গরীব অসহায়কে দান করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির কথা কোথাও নেই।
এটাও কুরআন হাদিসের কোথাও উল্লেখ নেই যে, ইবাদত না করে সারাদিন ধরে মুখরোচক নানা রকমের খাবার রান্না করতে। যেখানে গরীব অসহায়েরা এক মুঠ ভাত দিয়ে ইফতার করে। আর ধনীরা ইফতারে তো ওইসব রান্না করা খাবার খেয়ে ইফতার করে। তারপর সাহরি পর্যন্ত একটানা খেতে থাকে। পবিত্র রমজান মাসে এবাদত বন্দেগি করবে ও সৎ কাজ করবে,তা না।সবাই যার যার সামর্থ অনুযায়ী দান সদকা করবে। ধনীরা ওসব কথায় পাত্তাও দেয়না। মধ্যবিত্তরাও কোনো অংশে কম নয়। নারীদের রমজান মাসে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হয়। তারা সাহরির পর থেকে পরদিন ইফতার পর্যন্ত অমানুষিক খাটুনি খাটে। ফলে তারা সময় মতো ইবাদত পালন করতে পারে না। ইবাদত তো নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই ফরজ। এ ক্ষেত্রেও পুরুষদেরই আধিপত্য। নারীকে সন্তান, স্বামী, শ্বশুর শাশুড়ী, মা বাবা ও বাড়ির আরও মুরুব্বি থাকলে তাদের সেবাযত্ন ইত্যাদির ফাঁকে ফাঁকে নামাজ ও কুরআন তেলাওয়াত করতে হয়। আর পুরুষেরা ইফতার শেষে নামাজ পড়তে মসজিদে যায় । কেউ কেউ বাড়িতে পড়ে রাতের খাবার খেয়েই শুয়ে পড়ে। নারীদের সেই সুযোগ নেই। ইবাদতের বেলায়ও বৈষম্যের শিকার হয় নারী। সময়মতো ইফতার ও খাবার তৈরি না হলে নির্যাতনের শিকারও হয় নারী। এতে পরিবারে অশান্তি লেগে থাকে।
ইসলামকে শান্তির ধর্ম বলা হয়। শান্তিরই যদি হবে তবে নারীর সঙ্গে অসদাচরণ, বাজারে যার যার আয় অনুসারে জিনিসপত্র কিনতে না পারাও অশান্তির কারণ। একজন দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা, সিএনজি অটোরিকশা চালক, গার্মেন্টস কর্মী ও কলকারখানার শ্রমিক তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যদি তার রুজি অনুযায়ী কিনতে না পারে। তখনই তার মনে অশান্তি শুরু হয়। এর প্রভাব পড়ে তার পরিবারে।গুটিকয়েক মানুষের দুর্নীতির কারণে রমজানের বাজার সাধারণ জনগণের সামর্থের বাইরে চলে যায়। তাই শব-ই বরাতের বা শাবান মাসের চাঁদ ওঠার সাথে সাথেই সিন্ডিকেট যাতে না করতে পারে সেদিকে তদারকি করা আবশ্যক। সমাজের জোঁক সদৃশ শোষক তথা বিষধর সাপের মতো লোলুপ জিহ্বা ওয়ালাদের লাগাম টেনে ধরতে হবে শক্ত হাতে। সরকারই ওইসব নরকের কীটদের কঠোর শাস্তি দিতে পারে।
কোরবানি ও রমজান দুটোরই উদ্দেশ্য ভোগ নয় – ত্যাগ।আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কোরবান সম্পর্কে বলেছেন —
তোরা ভোগের পাত্র ফেলরে ছুঁড়ে
ত্যাগের তরে হৃদয় বাঁধ।
ক’জন মুসলমান কোরবানির শর্ত মেনে চলে? যুগে যুগেই সমাজে ধনী গরীব ছিল। সেই জন্য ধর্মীয় বিধানও সেই রকমই হয়েছে। পবিত্র কুরআনে কুরবানির বদলে ‘কুরবান’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। হাদিসেও কুরবানির স্থলে ‘ উযহিয়াহ’ ও ‘যাহিয়া’ এই শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ জন্যই কুরবানির ঈদকে ঈদুল আজহা বলা হয়।আরবি ‘কুরবান ‘ শব্দটি ফারসি বা উর্দুতে ‘কুরবানি’ রূপে পরিচিত। কুরবান অর্থ নৈকট্য। মানে আল্লাহর নৈকট্য লাভ। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন — আমার সৃষ্টিকে ভালোবাসলেই আমাকে ভালোবাসা হবে। এভাবেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হয়।ঈদুল আজহার দিন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু জবাই করা হয় তাকে কুরবানি বলা হয়। এই কুরবানির পশুর গোস্তের সিংহভাগ গরীব অসহায়ের মধ্যে বিলিয়ে দিলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়।
ঈদুল আজহার মূল আহ্বান মহান স্রষ্টা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রকাশ করা। কুরবানির মানে চিত্তশুদ্ধি এবং পবিত্র হওয়া। অথচ বর্তমান কালে এটি হয়ে গেছে একটি ভোগবাদী অনুষ্ঠান। এ কুরবানি শুধু পশু কুরবানি নয়। মানুষের ভেতরের পশুত্ব,নীচতা, হীনতা, ক্ষুদ্রতা, স্বার্থপরতা, হিংসা ও অহংকারকে ত্যাগ বা কুরবানি করা। এ জন্যই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘কোরবানী’ কবিতায় বলেছেন —
ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ
শক্তির উদ্বোধন
ঐ খুনের খুঁটিতে কল্যাণকেতু
লক্ষ্য ঐ তোরণ।
আজি আল্লাহর নামে
জান কোরবানে
ঈদের পূত বোধন।
কিছু কিছু নব্য ধনী যারা মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসে থেকে হজ্জ করে নিজেকে হাজি পরিচয় দেন। আবার যারা হঠাৎ ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ ‘ হয়ে বহুতল বাড়ি ও গাড়ির মালিক হয়েছে। তাদের কুরবানির অবস্থা দেখে তারা আল্লাহর কোনো নির্দেশই যে পালন করে না তা যে কোন বিবেকবান মানুষকেই প্রশ্নের সম্মুখীন করে। ওরা ঈদের দিন হুজুর পশু জবাই করে যাওয়ার পর পরই বাড়ির প্রধান গেইট বন্ধ করে দেয়। যতক্ষণ পর্যন্ত গোসত কাটাকাটি হয় এবং সব ঘরে নিয়ে জবাই করার ও কাটাকাটি করার জায়গা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে তবে গেইট খোলে। এর মধ্যে কোনো গরীব গোসত চাইলে ধমকে তাড়িয়ে দেয়।যদি কুরবানির গোস্তের সিংহভাগ গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে না দেওয়া হয় তবে তাদের সেই কুরবানি কি আল্লাহর নামে দেওয়া হয়! তা যে কোনো ধর্মপ্রাণ খাঁটি মুমিন ভালো ভাবে জানেন।
ধর্মের নামে অধর্মের কাজ ওই টাকার কুমিরেরা হর হামেশাই করছে। ত্যাগের মাহাত্ম্য ওসব ধনকুবেররা জানে কিন্তু মানেনা। ওরা নামেই মুসলমান, কার্যত রাক্ষস, শোষক। ওদের কারণেই বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির আগুন জ্বলতেই থাকে। ওরা আবার মাথায় টুপি, মুখে লম্বা দাড়ি ও লম্বা পাঞ্জাবি পরে। মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে পড়ে কপালে কালো দাগ ফেলে। আর অকপটে বিরামহীন মিথ্যা বুলি আওড়ায়!মানুষকে ঠকানোর জন্যেই তারা এই ছদ্মবেশ ধরে। এই গুটিকয়েক অমানুষ পুরো সমাজ ও দেশের অশান্তির কারণ। প্রকৃত ধার্মিকও এখনো আছে, তবে তাঁরা সংখ্যায় কম।
ভোক্তা অধিকার আইন, দুর্নীতি দমন আইন, বিএসটিআই ইত্যাদি যতই থাকুক। ওসব হলো –” কেতাবে আছে গোয়ালে নেই” টাইপের আইন। ঘুষখোর, সুদখোরদের দৌরাত্ম্যে সকল আইন ভেস্তে যায়। তাই সরকার বেছে বেছে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের ধরা উচিত। সরকারকে সুশীলসমাজের প্রতিনিধিগণও সহায়তা করতে পারে। ওদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে। শুধু জরিমানা আদায় করে ওসব ঠকবাজ, শোষক জোঁকদের ঠেকানো যাবে না। ওরা একদিকে জরিমানা দেবে, অপরদিকে ক্রেতাদের ঠকিয়ে তা উসূল করবে। এই অধর্ম থেকে বাঁচানোর জন্য দরকার শুদ্ধ ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষা। তবেই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষেরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে।শান্তিতে থাকবে। সেই সাথে ধান্দাবাজ, বক ধার্মিকেরা সত্য ও ন্যায়ের পথে আসবে। তখন ইসলাম শান্তির ধর্ম এ কথা ও সত্যি হয়ে উঠবে।
স্বত্ব সংরক্ষিত
গন্ধরাজ, মাইজদী, নোয়াখালী।
১ Comment
congratulations