চরিত্রহীন উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত বই আলোচনা বা রিভিউ:-
বই আলোচনা: তসলিমা হাসান
বিচিত্র নারী মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, বহুমুখী প্রেম, জীবনাচরণ, সামাজিক ও ধর্মীয় নানান নিয়ম নীতি নিয়ে লিখিত “চরিত্রহীন”উপন্যাসটি। সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে শরৎ চন্দ্রের বিখ্যাত চরিত্রহীন উপন্যাস টি পড়েছি কয়েকবার, আজকে আবার অনেক আগ্রহ সহকারে উপন্যাসটি পড়ে বুঝলাম যে আসলে মানুষের আশা- আকাঙ্ক্ষা,কামনা-বাসনা, মানসিক প্রশান্তি ও সর্বোপরি ভালো থাকা এসবই অনেকটায় ভালো বোঝাপড়া ও সুস্থ জৈবিক চাহিদার উপরে নির্ভরশীল। যখন এটা ব্যহিত হয় তখন হয়ে যায় আমরা চরিত্রহীন। এটাকে ধর্মীয়, নৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে আমরা নাম দিয়েছি চরিত্রহীন।
চরিত্রহীন উপন্যাসের প্রথম অংশের নায়িকা বিধবা সাবিত্রী, তার বয়স ও জৈবিক চাহিদা আছে, কিন্তু সমাজ ও ধর্মীয় কারনে নিজেকে অবদমন করে, নায়ক সতীশ কে সে ভালোবেসেও নিজের কথা মুখ ফুটে বলতে পারে নি, অপর দিকে সতীশ তার বউ সুরবালা কেও ভালোবাসতে পারে নি, কারন তাদের ভিতরে ভালো সমঝোতা নেই,প্রেম নেয়, আছে শুধু দাম্পত্য সম্পর্ক, যাকে এক কথায় জৈবিক চাহিদা বলা চলে। উপন্যাসের শেষ অংশে আরেক বিদ্রোহী নায়িকা কিরণময়ী,যে দাম্পত্য জীবনে চির অসুখী, প্রথমে সে অসুস্থ ও অক্ষম স্বামীর চিকিৎসার জন্য ও নিজের জৈবিক ও মানসিক তৃপ্তির জন্য ডাক্তারের সাথে গোপনে সম্পর্ক করেছে, তবে এটা প্রেম নয়, নিছক জৈবিক চাহিদামাত্র , আবার মানসিক ভাবে ভালো থাকার জন্য সে নায়ক সতীশের প্রেমে পড়েছে, অক্ষম স্বামী তার নারী সত্তা কে জাগিয়ে তুলতে পারে নি, সতীশের ব্যক্তিত্ব তার মনে নতুন প্রেম জাগিয়ে তুলে নূতন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়। এক সময় সে সতীশের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে, কিন্তু সতীশ তাকে গ্রহণ করে নি। এর জন্য সতীশ যতটা দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী অপ্রচলিত ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়ম-নীতি। এই অবহেলা, এই অপ্রাপ্তি থেকে কিরণময়ী মানসিকভাবে অনেক কষ্ট পায়, একসময় সে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠে।সে সতীশের ছোট ভাই দিবাকরের সাথে আবার নতুন সম্পর্কে জরায়। দিবাকর ছিল অবিবাহিত ও বয়সের দিক থেকে কিরণময়ীর অনেক ছোট। কিরণময়ী বয়স জাত,পাত ধর্ম ও নিয়ম নীতিকে আঙ্গুল দেখিয়েছে। একসময় সে দিবাকর কে নিয়ে পালিয়ে যায় জৈবিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভের জন্য।কিন্তু দিবাকরের সাথে পালিয়ে গিয়েও কিরণময়ী সতীশকে ভুলতে পারে নি। জাহাজে করে বার্মা পালিয়ে যাওয়ার সময় কিরণময়ী দিবাকরের বুকে মাথা রেখে বলতে থাকে————
“জাহাজ যদি ডুবে যায়, আমরা যেন এমন করে দুজনে একসাথে মরি,
কত লোকে দেখিবে, ছবি তুলবে, খবরের কাগজে উঠবে,
তোমার সতীশ দাদাও নিশ্চয় এই ছবি ও খবর দেখিবে”।
সতীশ ও কিরণময়ীর প্রেমের সাথে শরৎ বাবু সুর মিলিয়ে বলেছেন-
” বড় প্রেম শুধু কাছে টানে না, দূরেও সরে দেয়”।
সমাজ ও ধর্ম এইজন্য তার নাম দিয়েছে চরিত্রহীন, কিন্তু শরৎ উপন্যাসে আত্ম সচেতন, সমাজ ও ধর্মীয় নিয়ম নীতিকে আঙুল দেখানো বিদ্রোহী, অধিকার সচেতন, নারীর আপন সত্তার প্রকাশ, নারী স্বাধীনতা, ইচ্ছা ও অনিচ্ছা প্রকাশে একমাত্র বলিষ্ঠ নায়িকা হলো কিরণময়ী, তার এমন সাহসিকতার জন্য শরৎচন্দ্রের সাহিত্যে কিরণময়ী হলো অন্যতম নারী চরিত্র।
উপস্থাপনায়
তসলিমা হাসান
কানাডা,২০-১০-২০২১
২ Comments
It’s good
প্রিয় কবি ও লেখক তাসলিমা হাসানের সুচারু পর্যবেক্ষণ ও নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ ভালো লাগলো। মহৎ বাংলা সাহিত্যকর্মগুলো নিয়ে তাঁর এরকম বিশ্লেষণ আরো চাই।