১০৮ বার পড়া হয়েছে
শঙ্খ ঘোষ : অন্তরস্থিত সত্তা ও কবিতার অভিব্যঞ্জনা
( গোলাম কিবরিয়া পিনু )
এক
কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে তিন-চারবার দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে অল্প। তাঁর কবিতা পাঠ শুনেছি কাছাকাছি থেকে কলকাতার এক অনুষ্ঠানে, আমার কবিতাও তিনি শুনেছেন–সেই অনুষ্ঠানে। তাঁর সাথে দেখা হওয়া বা কথা বলার আগে থেকেই–তাঁর কবিতার সাথে আমার পরিচয়, তবে–বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-জীবন থেকে তা আরও দিনদিন গভীর হয়েছে। সেই থেকে তাঁর কবিতার বই ও অন্যান্য বই সংগ্রহ করি, কাছে রাখি, নিয়মিত পড়ি। এই তো ২০১৫ সালে কলকাতায় গিয়ে কলেজ স্ট্রিটের আনন্দ পাবলিশার্সের বিক্রয়কেন্দ্র থেকে ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ নামের কবিতা বইটি সংগ্রহ করি, বইটি আমার সংগ্রহে ছিল না, এই কবিতার বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৪ সালে, এর পর ২০১৫ তে এই বইটির একাদশ মুদ্রণ হয়। আর সেই ১৯৮২ সালের দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত ‘শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ দ্বিতীয় সংস্করণের বইটি আমার সংগ্রহে তখন থেকেই ছিল। ‘শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে, ৩৮ বছর বয়সে। শুধু কবিতার বই কেন? তাঁর সেই ছন্দ বিষয়ক বিখ্যাত বই ‘ছন্দের বারান্দা’ কাছে না থাকলে কি চলে? কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ছন্দ নিয়ে বিখ্যাত বই ‘কবিতার ক্লাস’-এর সাথে শঙ্খ ঘোষের ‘ছন্দের বারান্দা’ না থাকলে কি চলে! আরও ছন্দ বিষয়ক বই তো আমার কাছে রয়েছে। আমরা যারা কবিতা চর্চা করি, তাদের কাছে ছন্দ বিষয়ক এসব বইয়ের কদর তো থাকবেই, আমার কাছেও। শঙ্খ ঘোষের ‘ছন্দের বারান্দা’ প্রথম বের হয়েছিল ৫০ বছর আগে, ১৩৭৮ সনে, আমার কছে আছে বইটির সপ্তম মুদ্রণ ১৪০১ সনের। শঙ্খ ঘোষের আর একটি ভিন্নধারার গদ্যের বই–‘কবিতার মুহূর্ত’, যা বের হয়েছিল ১৩৯৩ সনে, ১৪০৪ সনের চতুর্থ মুদ্রণটি আমার কাছে রয়েছে। না, আর কোনো বইয়ের উদাহরণ দিচ্ছিনে, আরও উদাহরণ দেওয়া যেতে পারতো! এসবের অবতারণা করলাম এইজন্য যে, তাঁর সাথে আমার দেখা হওয়ার পরও তিনি জানেননি, আমি তাঁর একজন গুণগ্রাহী পাঠক, সেই কবে থেকে? ধারাবাহিকভাবে! আমি বিশেষত তাঁর কবিতা সেই কবে থেকে নিয়মিত কাছে রাখি, টেনে নিয়ে পড়ি, সেই পাঠ-অভ্যেস আমার এ-জীবনে থেকে যাবে। আরও ক’জন প্রিয় ও প্রয়োজনীয় কবির সাথে তিনিও সাথে আছেন, থাকবেন। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি আমার মত আরও বহু পাঠক তাঁর রয়েছেন। এইযে অদৃশ্যে, অলক্ষ্যে ও আবডালে পাঠক হিসেবে তাঁর সাথে সম্পর্ক, এই সম্পর্ক হচ্ছে নিখাদ এক অমলীন সম্পর্ক, শুধু তাঁর লেখার গুণেই এই সম্পর্কের ভিত্তিমূল তৈরি হয়েছে। এমন সম্পর্কই লেখক বেঁচে থাকেন জীবিতকালেও–মৃত্যু পরবর্তী সময়েও! একারণে লেখকের জীবন ও আয়ুষ্কাল আরও দীর্ঘ হয়।
শঙ্খ ঘোষের জন্ম ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২, বাংলাদেশের চাঁদপুরে, তৎকালীন অবিভক্ত ভারতে, মৃত্যু হলো ২১ এপ্রিল ২০২১ বিভক্ত হয়ে থাকা ভারতের কলকাতায়, মৃত্যুর সময়ে বয়স হয়েছিল ৮৯। কবির করোনা হয়েছিল। তিনি হাসপাতালে যেতে চাননি, বাড়িতেই ছিলেন। এমনিতেই তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। মুত্যুর ক’দিন আগে ১৪ এপ্রিল পরীক্ষার পর জানা যায়, তিনি করোনায় আক্রান্ত। এর পর তাঁর শরীর খারাপ হতে শুরু হয়। অক্সিজেন নিতে হয়। শরীর আরও খারাপ হলে চিকিৎসকেরা শঙ্খ ঘোষকে ভেন্টিলেটারে রাখেন। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। শেষমেশ করোনায় তাঁর মৃত্যু হলো। আশ্চর্য, তাঁর মৃত্যুর ক’দিন পরেই তাঁর দাম্পত্য সঙ্গী প্রতিমা ঘোষও ২৯এপ্রিল মৃত্যুর কাছে পরাজিত হন, প্রতিমা ঘোষের জন্ম হয়েছিল ১৯৩১ সালে। করোনায় শুধু ভারতে নয়, বাংলাদেশেও বহু বিশিষ্টজন প্রাণ হারিয়েছেন, সে তালিকাও দীর্ঘ!
দুই
তাঁর বিষয়ে জানা তথ্যগুলো এখানেও চকিত টেনে আনছি, এইকারণে যে–তিনি লেখায় ছিলেন বহুপ্রজ, তালিকাটা সেকারণেও যে–সৃজনশীল স্পর্ধায় তিনি জীবনের সময়কে লেখায় কীভাবে নিবেদিত করেছেন–তা আমরা বিবেচনা করতে পারি, তাঁর সৃজনশীলতার বিচিত্রমুখী গভীরতাও আমরা উপলব্ধি করতে পারি, সুলুকসন্ধান করে বুঝতে পারি–আমরা বিস্ময়াভিভূত হই–এমন লেখক হওয়ার দম কতটুকু লাগে! কী অলোকসামান্যতা নিয়ে তাঁর অভিনবত্ব ও রিয়ালিটি! এইসব ইশারা পাওয়ার জন্য, তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা এখানে উপস্থাপন করলাম। এখন এসব গ্রন্থ নিয়ে তাঁকে আবিষ্কার করতে পারি আরও গভীরভাবে। সেই বাজিয়ে-দেখাটা এখন অনুসন্ধানের বিষয়।
তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলো : দিনগুলি রাতগুলি (১৯৫৬), এখন সময় নয় (১৯৬৭), নিহিত পাতালছায়া (১৯৬৭), শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৭০), আদিম লতাগুল্মময় (১৯৭২), মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয় (১৯৭৪), বাবরের প্রার্থনা (১৯৭৬), মিনিবুক (১৯৭৮), তুমি তো তেমন গৌরী নও (১৯৭৮), পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ (১৯৮০), কবিতাসংগ্রহ -১ (১৯৮০), প্রহরজোড়া ত্রিতাল (১৯৮২), মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে (১৯৮৪), বন্ধুরা মাতি তরজায় (১৯৮৪), ধুম লেগেছে হৃদকমলে (১৯৮৪), কবিতাসংগ্রহ -২ (১৯৯১), লাইনেই ছিলাম বাবা (১৯৯৩), গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ (১৯৯৪), শঙ্খ ঘোষের নির্বাচিত প্রেমের কবিতা (১৯৯৪), মিনি কবিতার বই (১৯৯৪), শবের উপরে শামিয়ানা (১৯৯৬), ছন্দের ভিতরে এত অন্ধকার (১৯৯৯), জলই পাষাণ হয়ে আছে (২০০৪), সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি (২০০৭), মাটিখোঁড়া পুরোনো করোটি (২০০৯), গোটা দেশ জউঘর (২০১০), হাসি খুশি মুখে সর্বনাশ (২০১১), প্রতি প্রশ্নে জেগে ওঠে ভিটে (২০১২), প্রিয় ২৫ : কবিতা সংকলন (২০১২), বহুস্বর স্তব্ধ পড়ে আছে (২০১৪), প্রেমের কবিতা (২০১৪), শঙ্খ ঘোষের কবিতাসংগ্রহ (২০১৫), শুনি নীরব চিৎকার (২০১৫), এও এক ব্যথা উপশম (২০১৭)।
গদ্যগ্রন্থ : কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক (১৯৬৯), নিঃশব্দের তর্জনী (১৯৭১), ছন্দের বারান্দা (১৯৭২), এ আমির আবরণ (১৯৮০), উর্বশীর হাসি (১৯৮১), শব্দ আর সত্য (১৯৮২), নির্মাণ আর সৃষ্টি (১৯৮২), কল্পনার হিস্টোরিয়া (১৯৮৪), জার্নাল (১৯৮৫), ঘুমিয়ে পড়া এলবাম (১৯৮৬), কবিতার মুহূর্ত (১৯৮৭), কবিতালেখা কবিতাপড়া (১৯৮৮), ঐতিহ্যের বিস্তার (১৯৮৯), ছন্দময় জীবন (১৯৯৩), কবির অভিপ্রায় (১৯৯৪), এখন সব অলীক (১৯৯৪), বইয়ের ঘর (১৯৯৬), সময়ের জলছবি (১৯৯৮), কবির মর্ম (১৯৯৮), ইশারা অবিরত (১৯৯৯), এই শহর রাখাল (২০০০), ইচ্ছামতির মশা : ভ্রমণ (২০০২), দামিনির গান (২০০২), গদ্যসংগ্রহ ১-৬ (২০০২), অবিশ্বাসের বাস্তব (২০০৩), গদ্যসংগ্রহ – ৭ (২০০৩), সামান্য অসামান্য (২০০৬), প্রেম পদাবলী (২০০৬), ছেঁড়া ক্যামবিসের ব্যাগ (২০০৭), সময়পটে শঙ্খ ঘোষ : কবিতা সংকলন (২০০৮), ভিন্ন রুচির অন্ধকার (২০০৯), আরোপ আর উদ্ভাবন (২০১১), বট পাকুড়ের ফেনা (২০১১), গদ্যসংগ্রহ – ৮ (২০১৩) দেখার দৃষ্টি (২০১৪), আওয়ার ডায়েরি (২০১৪), নির্বাচিত প্রবন্ধ : রবীন্দ্রনাথ (২০১৪), নির্বাচিত প্রবন্ধ : নানা প্রসঙ্গ (২০১৪), নির্বাচিত গদ্যলেখা (২০১৫), গদ্যসংগ্রহ – ৯ (২০১৫), হে মহাজীবন : রবীন্দ্র প্রসঙ্গ (২০১৬), বেড়াতে যাবার সিঁড়ি (২০১৬), অল্প স্বল্প কথা (২০১৬), নিরহংকার শিল্পী (২০১৭), গদ্যসংগ্রহ-১০ (২০১৮), লেখা যখন হয় না (২০১৯), পরম বন্ধু প্রদ্যুমন (২০১৯), সন্ধ্যানদীর জলে : সংকলন (২০১৯)।
শিশু ও কিশোরদের জন্যে লেখা : বিদ্যাসাগর (১৯৫৬), সকালবেলার আলো (১৯৭২) শব্দ নিয়ে খেলা : বানান বিষয়ক বই {কুন্তক ছদ্মনামে লেখা } (১৯৮০), রাগ করো না রাগুনী (১৯৮৩), সব কিছুতেই খেলনা হয় (১৯৮৭), সুপারিবনের সারি (১৯৯০), আমন ধানের ছড়া (১৯৯১), কথা নিয়ে খেলা (১৯৯৩), সেরা ছড়া (১৯৯৪), আমন যাবে লাট্টু পাহাড় (১৯৯৬), ছোট্ট একটা স্কুল (১৯৯৮) বড় হওয়া খুব ভুল (২০০২),ওরে ও বায়নাবতী (২০০৩), বল তো দেখি কেমন হত (২০০৫), অল্পবয়স কল্পবয়স (২০০৭), আমায় তুমি লক্ষ্মী বল (২০০৭), শহরপথের ধুলো (২০১০), সুর সোহাগী (২০১০), ছড়া সংগ্রহ (২০১০), ছোটদের ছড়া কবিতা (২০১১), ইচ্ছে প্রদীপ (২০১৪), ছোটদের গদ্য (২০১৭), আজকে আমার পরীক্ষা নেই (২০১৮)।
বক্তৃতা-সাক্ষাৎকার ভিত্তিক সংকলন : অন্ধের স্পর্শের মতো (২০০৭), এক বক্তার বৈঠক : শম্ভু মিত্র (২০০৮),
কথার পিঠে কথা (২০১১), জানার বোধ (২০১৩), হওয়ার দুঃখ (২০১৪)।
শঙ্খ ঘোষের সৃজনশীলতার ব্যাপ্তি ও বৈজয়ন্তীতে–বেশ কিছু পুরস্কারও যুক্ত হয়েছে–সেগুলো উল্লেখ করি, তিনি জীবিতকালে অনুমোদিত হয়েছিলেন বিভিন্ন পুরস্কারের মর্যাদায়, যা অনেকে হন না, তা তাঁর জন্য তা ছিল এক পার্থিবতা। উল্লেখযোগ্য কিছু পুরস্কার : ‘মূর্খ বড়, সামাজিক নয়’ গ্রন্থের জন্য নরসিংহ দাস পুরস্কার (১৯৭৭), ‘বাবরের প্রার্থনা’ গ্রন্থের জন্য সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার (১৯৭৭ ), ‘ধুম লেগেছে হৃদকমলে’ গ্রন্থের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৮৯). ‘রক্তকল্যাণ’ অনুবাদের জন্য সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার (১৯৯৯), বিশ্বভারতীর দ্বারা দেশিকোত্তম পুরস্কার (১৯৯৯), ভারত সরকারের পদ্মভূষণ পুরস্কার (২০১১) ও জ্ঞানপীঠ পুরস্কার (২০১৬)।
তিন
শঙ্খ ঘোষের ভাষ্য অনুযায়ী জেনে নিই তাঁর কৈশোর–
‘সকলেই একদিন খেলাচ্ছলে শুরু করে কৈশোরে। তার মধ্য থেকে কখন জেগে ওঠে শরীর, তার নিজেরও অগোচরে। না-শহর না-গ্রাম আমাদের সেই পদ্মাপারের ছোট্ট জনভূমি, একদিকে নদী একদিকে বন, তার মাঝখানে বারো বছর বয়সে আমারও একদিন শুরু হয়েছিল ছন্দমেলানোর খেলা, একেবারে দায়হীন, প্রগল্ভ। বিষয়ের কোনো ভাবনা ছিল না তখন, যে-কোনো উপলক্ষেই ছিল রচনার উপলক্ষ। এ-রচনার যে সঙ্গী ছিল না কেউ, এক হিসেবে সেই ছিল ভালো। খাতার পর খাতা ভরে উঠেছিল কেবল তুচ্ছ আনন্দে। আর তারপর, প্রায় একসঙ্গেই পৌঁছল আমাদের যৌবন আর স্বাধীনতা। আর সেই আমার কলকাতায় সত্যিকারের পা দেওয়া।’ (কবিতার মুহূর্ত, পৃষ্ঠা-১৩)।
কলকাতার থিতু হওয়ার পর তাঁর অনুভূতি খুঁজে পাই–
‘বহিরাগতের ভীরুতা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগল অনেক। কেবল কলকাতাই যে নতুন ছিল তা নয়, আমাদের সামনে তখন খুলে যাচ্ছে নতুন এক আধুনিক জীবন আর কবিতার জগৎ, যার কোনো চিহ্ন জানতাম না আগে। … আর কলকাতা, কলকাতা খুলে দিল সাম্প্রতিকের দরজা। একদিনে নয়, দিনে দিনে। সেখানেও ছিল বহিরাগতের ভীরুতা, জানা ছিল না কোনদিকে আছে পথ।’(কবিতার মুহূর্ত, পৃষ্ঠা-১৩-১৪)।
১৯৪৭ সালে, যখন ভারতবর্ষ ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের পোশাকে বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। কীভাবে ভারত বিভাগের পর ভারতের বিভিন্ন অংশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মানুষেরা পূর্ববাংলায় এসে এখানে বসসাস শুরু করে, কীভাবে এখানকার পুরনো হিন্দু বাসিন্দারা ঘরবাড়ি ছেড়ে পূর্ববাংলা থেকে চলে যায়, আছে আরও রক্তাক্ত দাঙ্গার ইতিহাস। এই ইতিহাসের কণ্ঠলগ্ন হয়েই–শঙ্খ ঘোষের বেদনামথিত উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে কলকাতার জীবনের বর্ণনা আমরা তাঁর বিভিন্ন লেখায় খুঁজে পাই!
শঙ্খ ঘোষ আরও অনুভব করলেন–
‘এমনিভাবে একদিন কবিতার দিকে এগোনো গেল ঠিক, কিন্তু এগোনো গেল না কবিতার সমাজের দিকে। আমাদের চেয়ে বড়ো যাঁরা, তাঁদের দিকে তাকিয়ে মনে হলো কোথায় যেন এক নিয়মবৃত্ত আছে, যেন না-লেখা এক কানুন মেনে চলেন অনেকে, কবিতা যেন ভাগ হয়ে আছে মুখ না-দেখা দুই ভিন্ন শিবিরে। কী নিয়ে লেখা হবে কবিতা? আমার বাইরের পৃথিবী নিয়ে? না কি আমার ব্যক্তিগত জগৎ নিয়ে? এই ছিল তর্ক, দেশবিদেশের বহুকালের পুরোনো তর্ক। কিন্তু এই দুই কি ভিন্ন না কি? এই দুইয়ের মধ্যে নিরন্তর যাওয়া-আসা করেই কি বেঁচে নেই মানুষ?’ (কবিতার মুহূর্ত, পৃষ্ঠা-১৫)।
এমন কৌতুহলোদ্দীপক জিজ্ঞাসা এখনো, এখনকার কবির চৈতন্যেও অনুরণিত হয়, নতুন নতুন বিবেচনাবোধও জেগে তোলে। কাব্যপ্রসিদ্ধির ধীশক্তিতে তা আগ্রহ নিয়ে সবসময়ে প্রশ্ন তোলে।
শঙ্খ ঘোষের ‘কবিতার মুহূর্ত’–বইটির লেখাগুলো থেকে পেয়ে যাই তাঁর কবি হয়ে ওঠার দৃশ্য ও খ- খ- বর্ণনা, তা থেকে কবির কবিতা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিও। আমরা যারা কবিতা লিখি, কবিতাচর্চা করি–তারাও তাঁর এসব ভাষ্যের মধ্যে দিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবো নিঃসন্দেহে। তিনি আরও আমাদের জানালেন, কীভাবে একটি পত্রিকা তাঁর প্রশ্রয়ের স্থল হয়ে ওঠে–
‘এমন সময়ে পৌঁছল এসে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা, তরুণতম কবিদের মুখপত্র হিসেবে ঘোষণা করা হলো তার নাম । ‘কৃত্তিবাস’-এর যে কালাপাহাড়ি চরিত্রের কথা বলা হয়, সূচনায় ঠিক তেমন ছিল না তার পরিচয়। তখনো দেখা দেয়নি কোনো তেজী বিদ্রোহ, তখনো সে আকর্ষণ করে আনেনি সুসামাজিকদের কোলাহলময় নিন্দে, কিন্তু তখন থেকেই এর ছিল ভবিষ্যতের দিকে এক নিশ্চিত পদক্ষেপ, ছিল তারুণ্যের আভিজাত্যে ভরা পত্রিকার গৌরব। হিসেববন্ধন বা দলীয়তার বাইরে থেকে ‘কৃত্তিবাস’ তখন ডাক দিয়েছিল সমস্ত তরুণকে, আমারও জুটল ডাক। এর পর অতিদীর্ঘকাল জুড়ে এই পত্রিকার অবাধ প্রশ্রয় পেয়েছি আমি, এতটাই, যা পাবার অধিকার ছিল না আমার। আর এরই মধ্য দিয়ে ভীরুতা একদিন পৌঁছল এসে ভালোবাসায়।’ (কবিতার মুহূর্ত, পৃষ্ঠা-১৬)।
শঙ্খ ঘোষের কবিতাও আক্রান্ত হয়েছে, কোনো কবির পথযাত্রা একেবারে বাধা-বিপত্তিহীন থাকে না, কতরকমের যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হতে হয়, রক্তক্ষরণ হয়, অবহেলা-অপমান সহ্য করতে হয়, এর অনেকটা মূর্ত হয়, অনেকটা বিমূর্ত থেকে যায়। এসব সামলিয়ে, প্রতিরোধমুখী ভূমিকায় সৃজনশীল-স্পর্ধার মাধ্যমে নিজের একটা অবস্থান তৈরি করে নিতে হয়, কবিকে তার সম্মুখযাত্রাকে সংহত করতে হয়। আত্মসমর্পণ ও পরাজিত হওয়ার পরিবেদনাকে ঘেরাটোপে রেখে কবিকে চলতে হয়। কবি টনটনানি অনুভব করবেন, বেদনাক্লিষ্ট হবেন কিন্তু নিজের স্বভাবপ্রকৃতি নিয়ে স্বাধীন ও অনুধ্যায়ী হয়ে পথ চলবেন, যে-পথে তিনি একা, একক পথযাত্রী।
শঙ্খ ঘোষের বোধভাষ্যি থেকে আমরা আরও জানতে পারি–
‘পাঁচ বছরের কবিতা নিয়ে তখন প্রবন্ধ পড়ছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। শেষ হবার মুখে, অন্য আরো কবিতাংশের সঙ্গে, পড়ে শোনাচ্ছেন ‘যমুনাবতী’-রও কয়েকটি লাইন, হয়তো ¯েœহভরেই। কিন্তু তাঁর কথা শেষ হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঝাঁপ দিয়ে উঠলেন বুদ্ধদেব। একটু আগেই যে বলবেন না বলে ঘোষণা হয়েছিল, ভুলে গেলেন তার কথা। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা-রুচির, তাঁর কবিতাবিচারের প্রখর প্রতিবাদ করে বলতে হলো বুদ্ধদেবকে : যে-কোনো হাহাকারকেই কবিতা বলা চলে না। …আমার লেখাটাও যে এতে আক্রান্ত হলো, সেজন্য আমার ক্ষোভ হয়নি সেদিন।’ (কবিতার মুহূর্ত, পৃষ্ঠা-২২)।
শঙ্খ ঘোষ এমন অনুভবের পরও থেমে যাননি, বুদ্ধদেব বসু সেই সময়ের সাহিত্য-জগতকে এককভাবে বিভিন্নভাবে শাসন করতেন, তাঁর অনুমোদনকে কবি ও লেখক হয়ে ওঠার স্বীকৃতি বলে অনেকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু যাঁরা বুদ্ধদেব বসুর কাছ থেকে অনুমোদন, স্বীকৃতি ও সাড়া পাননি, তাঁরাও কিন্তু অকম্পিত ও অদমনীয় থেকে পরবর্তীতে নিজেদের কবি ও লেখক হিসেবে পরিজ্ঞাত করিয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত পত্রিকা ছিল–‘কবিতা’, পঁচিশ বছরের অধিককাল পত্রিকাটির ১০৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বেশকিছু কবিতা পাঠিয়েছিলেন কিন্তু তা ছাপা হয়নি। যে-কোনো সম্পাদক তাঁর বিবেচনায় কারো কবিতা ছাপতে পারেন, নাও পারেন, তা হয়তো দোষের নয়। কিন্তু সে-সেময়ে ‘দেশ’ পত্রিকার বিখ্যাত সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তাঁকে উৎসাহ শুধু দেননি, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবতীর কবিতা ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপিয়েছেনও। শঙ্খ ঘোষের কবিতাও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত পত্রিকা–‘কবিতা’ থেকে দূরবর্তী ছিল বলে জানা যায়। এমন উদাহরণ এই কারণে দিলাম, যেকোনো কবি লেখার শুরুতে বিভিন্নভাবে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার পরও–তার অগ্রসূচনাকে দৃঢ়চিত্তে ও অনুধ্যানে টলতে দেন না, সম্মুখযাত্রায় অবিচল থাকেন।
শঙ্খ ঘোষ লেখা থামিয়ে দেননি–
‘কৈশোর থেকে সেদিন পর্যন্ত, হঠাৎ হঠাৎ লিখতে ইচ্ছে করেছে কয়েকটি কথা, যে-কোনো কারণে, আর লিখে গিয়েছি তখন। সে-লেখাকে তো হতে হবে আমারই বোধ মতো, আমারই জানা সত্যে। সেটা যদি শেষ পর্যন্ত না পৌঁছয় কোথাও, তাহলে সে তো আমার অক্ষমতা শুধু। সেই অক্ষমতাকে মেনে নিয়ে, জীবনটাকে সেদিন ছুঁতে চেয়েছি আমারই মতো।’ (কবিতার মুহূর্ত, পৃষ্ঠা-২২-২৩)।
চার
শঙ্খ ঘোষের প্রথম কবিতার বই দিনগুলি রাতগুলি বের হয় ১৯৫৬ সালে। তার পর এক এক করে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অন্যান্য গ্রন্থ ছাড়াই ৩৫ (২৬টি স্বতন্ত্র কবিতার বইসহ) এর অধিক কবিতার বই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। প্রায় ৯০ বছরের জীবনে কবিতা লেখা থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন থাকেননি। তাঁর সময়কালের কবি, যাঁরা ৮০ বছরের উপর বেঁচেছিলেন–কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, তাঁরাও জীবনব্যাপী কবিতার সাধনা করে গেছেন, কবিতা লেখা থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হননি।
কবিতায় তিনি নৈঃশব্দ আর আড়ালের মধ্যে দিয়েও সমাজ ও পরিপাশর্^কে তুলে টেনে নিয়ে কবিতায় জাগিয়ে তুলতেন। তাই তো শঙ্খ ঘোষ বলেন–
‘একটা কবিতার চারপাশে অনেক না-বলা কথা থাকে, সেই সঙ্গে এও বলা যায়, গোটা কবিতার নয়, তার প্রতিটি লাইনের চারপাশেরই একটা না-বলা বলয় থাকে। আবার এও বলা যায়, প্রতিটি শব্দ বা চারপাশে যুক্তিক্রমহীন একটা দূরত্বের ব্যবধান থাকে। তখনই রহস্যময় হয়ে ওঠে কবিতা।’
কবি-লেখক-শিল্পীরা সংগঠন সক্রিয়ভাবে করতে পারেন, না-ও করতে পারেন। তবে শিল্প-সাহিত্যের মাধ্যমে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবাদর্শের লড়াইটা কখনো মোটা দাগে বা কখনো সূক্ষ্মভাবে থেকে যায়, চলতে থাকে–শঙ্খ ঘোষের মধ্যেও বিভিন্ন পরিধিতে তা আমরা লক্ষ করি–তিনি কখনো মিছিলে থেকে প্রতিবাদী হয়েছেন, কখনো বা বিভিন্ন লেখায় উচ্চকিত হয়েছেন। শঙ্খ ঘোষ একজর আধুনিক মানুষ হিসেবেই ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করেেেছন–স্বাধীনভাবে।
আমরা জানি–শিল্প ও সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিভিœনমুখী মতামত আছে। ভাবুক ও লেখক-সমালোচকের মধ্যে বোঝাপড়ার পার্থক্যও আছে। কোন্টা ভালো সাহিত্য বা শিল্প-তা নিয়েও তর্ক আছে। কিন্তু তারপরও বলি–দেশ ও মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কি কবি-লেখক ও শিল্পীদের কোনো ভূমিকা থাকবে না? তাঁরা কি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও অগ্রগতি চাইবেন না? নিশ্চয় চাইবেন। পূর্বেও তাঁরা নিজেদের বিবেক-তাড়িত ভূমিকা রেখেছেন, বর্তমানেও তাঁরা সেই ভূমিকা শাণিত রাখবেন, সেটা অনেকেরই আকাক্সক্ষা। জীবনের প্রাত্যহিকতায় সাহিত্য-শিল্পের যোগ ঘটিয়ে মানুষের আত্মবীক্ষণের মধ্যে দিয়ে উপলব্ধির জগতকে সমৃদ্ধ করা যায়, রুচিকে নির্মাণ করা যায়, ফিরে আনা যায় বিকার ও অসুস্থতা থেকে মানুষের মানবিক-সুস্থতা। শঙ্খ ঘোষের সাহিত্য-ভূমিকা কখনো মোটা দাগে, কখনো বা সূক্ষ্মভাবে আমরা এমন পটভূমিতে উপলব্ধি করতে পারি।
শঙ্খ ঘোষ জীবিতকালেই ছিলেন পাঠকপ্রিয় ও বিভিন্ন পরিধিতে গ্রহণযোগ্য কবি। তরুণ কবিদেরও তিনি আগ্রহের ভূমিতল ছিলেন। তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ পঞ্চাশ বছরে তেইশটি সংস্করণ হয়ে প্রকাশিত হয়েছে–এমন একটি উদাহরণ আমাদের বুঝিয়ে দেয়–তাঁর কবিতা পাঠকের কাছে কতটা সমাদৃত হয়েছে।
কবিতার বইয়ের চেয়ে শঙ্খ ঘোষের বিভিন্ন ধরনের গদ্যের বইয়ের সংখ্যা কম নয়। সেগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, সাহিত্য বিচারে সেগুলোও বিশেষভাবে বিবেচিত হয়, হবে। এখানে ওসবের আলোচনার দিকে না গিয়ে–তাঁর কবিতার অভিমুখে আমার কিছু বিবেচনাবোধ তুলে ধরছি। তাঁর কবিতা অনেকের মত আমার কাছেও বহুদিন হলো কিছুটা হলেও–পরিজ্ঞাত ও অনতিদূর।
চল্লিশের ঐতিহ্যকে বহন করেও পঞ্চাশের দশকে যাঁরা নতুনভাবে কবিতা লেখা শুরু করেন–তাঁদের মধ্যে অন্যতম শঙ্খ ঘোষ । তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দিনগুলি রাতগুলি’র পর দীর্ঘকাল, ছয় বছর তিনি লেখেননি। শঙ্খ ঘোষ ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে মিলিয়ে কবিতায় ঐতিহ্যলগ্ন ছন্দ ব্যবহার করে কবিতায় স্পন্দন ও বিন্যাসকে আরও গভীর প্রাণ দিয়েছেন–এমন উদাহরণ :
‘ আমার জন্য একটুখানি কবর খোঁড়ো সর্বসহা
লজ্জা লুকাই কাঁচা মাটির তলে-
গোপন রক্ত যা-কিছুটুক আছে আমার শরীরে, তার
সবটুকুতে শস্য যেন ফলে।’
(কবর, দিনগুলি রাতগুলি, প্রকাশ ১৯৫৬)
‘মাগো, আমার মা-
তুমি আমার দৃষ্টি ছেড়ে কোথাও যেয়ো না।
….
তুমি, আমার মা-
শান্তি তোমার ঘট ভরেছে, দুঃখ তোমার পল্লবে কি গাঁথা?
তুমি আমার চক্ষু ছেড়ে কোথাও যেয়ো না।’
(বলো তারে, ‘শান্তি শান্তি’, দিনগুলি রাতগুলি, প্রকাশ ১৯৫৬)
‘নিভন্ত এই চুল্লীতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে।
নোটন নোটন পায়রাগুলি
খাঁচাতে বন্দী
দু’এক মুটো ভাত পেলে তা
ওড়াতে মন দি’।’
(যমুনাবতী, দিনগুলি রাতগুলি, প্রকাশ ১৯৫৬)
লৌকিক ছড়ার আদলে–উল্লিখিত ‘যমুনাবতী’ কবিতাটি সার্থকভাবে নির্মাণ করেছেন তিনি। পাঠককে ঐতিহ্যের ছন্দোবদ্ধ কবিতার স্বাদের ভেতর রেখেই–ভিন্নমাত্রায় বোধ জাগ্রত করার সম্মোহন ও বিস্ময়ঘোর তৈরিতে শঙ্ঘ ঘোষ
সার্থক হয়ে–বিচ্ছুরণ ঘটান।
‘আমাদের শেষ কথাগুলি গড়িয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের দিকে
আমাদের শেষ কথাগুলি
মৃত মানুষদের চোখে ভরে গেছে অর্ধেক আকাশ
আমাদের শব্দের ওপারে’
(আমাদের শেষ কথাগুলি, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, প্রকাশ ১৯৮৪)
‘আকণ্ঠ ভিক্ষুক, তুমি কথা বলো গৃহস্থের কানে
ভাঙো তার সব স্থবিরতা
ঝরাও প্রপাত তার সাবেক কার্নিশগুলি থেকে
পাঁজরে বাজাও বাঁশিগুলি’
(আকণ্ঠ ভিক্ষুক, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, প্রকাশ ১৯৮৪)
‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ নামক কাব্যগ্রন্থের দুটি কবিতার উদাহরণে আমরা দেখি–কবি চৈতন্যের বহু স্তর টেনে নিয়ে পাঠককে সংবেদী করে তোলেন, সামান্য বিষয়ের মধ্যে কী-এক সূক্ষ্ম ইংগিত বাজিয়ে এক জাগতিকতায় উদ্বুদ্ধ করেন। স্বগোক্তির মত তাঁর উচ্চারণ হলেও গভীরতায় অসামান্য অন্তর্দৃষ্টি ও উপলব্ধিতে ক্রমে ক্রমে পাঠককে নিমজ্জিত করেন।
‘কী হতভাগ্য সেই দিন যখন শিশুরাও জেনে গেছে গাছ কখনো কথা বলেেত পারে
না আর সাতভাই চম্পাকে ডাকতেও পাওে না কোনো পারুলবোনের
রূপকথা
কী হতভাগ্য সেই দিন যখন বুকের ভিতর দিকে ছুটে যায় বাঁধভাঙা জল কিন্তু চোখ
তাকে ফিরেও ডাকে না শুধু অযুত আতশবাজি শোভা হতে হতে শূন্যের
গহ্বরে ভেঙে অন্ধ হয়ে দেখে
পাথরের মুখচ্ছবি নেই কিন্তু মুখের পাথরছবি আছে’
(শিশুরাও জেনে গেছে, ধুম লেগেছে হৃদকমলে, প্রকাশ ১৯৮৭)
‘ধুম লেগেছে হৃদকমলে’ কাব্যগ্রন্থের উল্লিখিত কবিতার আঙ্গিকের মত আরও ক’টি কবিতা রয়েছে–এই কাব্যগ্রন্থে, আরও ভিন্ন আঙ্গিকের কবিতাও রয়েছে। শঙ্খ ঘোষ বহু ধরনের আঙ্গিকের নীরিক্ষা করেছেন, যারফলে এক ধরনের আঙ্গিকের কবিতা দেখেই শঙ্খ ঘোষের কবিতাকে চিহ্নিত করা যায় না, বলা যায় না সহজভাবে–এ-ধরনের, ও-ধরনের কবিতা–শঙ্খ ঘোষের কবিতা। বিচিত্রপথে তাঁর আঙ্গিকের নিরীক্ষা, যা আমাদের ইন্দ্রিয়গোচর হয়। যেমন–তিনি বেশি কবিতা লিখেছেন, তেমনি আঙ্গিকেরও বিভিন্ন উদ্ভাবন দেখিয়েছেন।
১
‘লক্ষ্মীছাড়া দুঃখ এল আরো একবার এজীবনে
বড়োই বিহ্বল আছি তোমাদের কা-কারখানায়।
২
সমস্ত ধন্দের থেকে মীমাংসা পেয়েছ বাচ্চা ছেলে
গোঁফদাড়ি উঠেছে বটে, বাল্যশিক্ষা এখনো মেটেনি।’
(দ্বিপদীমালা ২, ধুম লেগেছে হৃদকমলে, প্রকাশ ১৯৮৭)
‘ধুম লেগেছে হৃদকমলে’ কাব্যগ্রন্থে কয়েকটি দ্বিপদী লিখেছেন–‘দ্বিপদীমালা’ শিরোনামে। বাংলা কবিতার পরিব্যাপ্তিতে কত ধরনের কবিতা লেখা হয়েছে, ‘দ্বিপদী’–যা বাংলা কবিতার রক্তরেণুতে রয়েছে, শঙ্খ ঘোষ তা পরম্পরায় স্বীকার করে নিয়ে ভিন্ন অনুভবে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন।
‘গন্ধর্ব, উন্মাদ, তুমি অর্থহীন হাতে উঠে এসে
জলমগুলের ছায়া মাখিয়ে গিয়েছ এই মুখে
তবু আজও বৃষ্টিহারা হয়ে আছে সমস্ত প্রদেশ
আমারাও পায়ের কাছে চাপ চাপ রক্ত লেগে আছে।’
(১, গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ, প্রকাশ ১৯৯৪)
‘সব চোখ মেলে দিয়ে এ বাতাসে জড়িয়ে ধরেছ
তুমিই আগুন তুমি জল তুমি আকাশ বা মাটি
শরীরে শিহর তুমি মনে আমরণ আরাধনা
অমৃত পাহাড় থেকে সাগরের তরল গরল।
(৩৬, গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ, প্রকাশ ১৯৯৪)
শঙ্খ ঘোষের ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’-এর দুটি কবিতার ক’টি লাইন উপরে উল্লেখ করা হলো। এই কাব্যগ্রন্থে রয়েছে মোট ৩৬টি কবিতা, কবিতাগুলো অক্ষরবৃত্তে লেখা, একটি মাত্র ছন্দকে কী-এক ধ্যানমগ্নতার ভেতর দিয়ে শব্দস্ফুরণে করেছেন শিল্পজাত। কবিতাগুলোতে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান ও অনুসঙ্গ মিলেমিশে একাকার এক নিঃশব্দের শিল্প হয়ে উঠেছে, জীবনের গভীর বোধের ব্যঞ্জনা নিয়ে হয়ে উঠেছে-মূর্ত ও বিমূর্ত।
শঙ্খ ঘোষ ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’-এর সূচনাকথয় বলেন–
‘কয়েক বছর আগে, বেশ কয়েকটা মাস কেটেছিল শিমলার এক পাহাড়-চূড়োয়। মেঘকুয়াশার চরাচর-ঢেকে-দেওয়া সেখানকার এক সকালবেলায় অনেকদিন পর একেবারে একঝোঁকে লেখা হয়ে গেল কয়েকটি কবিতা। পরে মনে হলো, হয়তো ঠিক ‘কয়েকটি’ নয় তারা, একটিই মাত্র লেখা, কেবল স্তরে স্তরে খোলা। (সূচনাকথা, গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ, প্রকাশ ১৯৯৪)
‘এই দুর্দিনের কাছে রয়ে গেল অধিকন্তÍু ্ঋণ
প্রত্যেক মুহূর্ত তুমি ইতিহাসে করেছ রঙিন।
আমি যার কথা বলি সে কখনো বোঝেনি একথা
ক্ষীণ হয়ে যেতে যেতে এখনও পালক আছে কটা।’
(কিনারা, ছন্দের ভিতরে এত অন্ধকার, প্রকাশ ১৯৯৯)
‘আমি এই শতাব্দীর শেষ প্রান্ত থেকে কথা বলি
আমি এই শালপ্রাংশু মধ্যরাত্রি থেকে কথা বলি
আমার মায়ের রক্ত হাতে নিয়ে কথা বলি
হোলি খেলেছিল যারা আমার মেয়ের রক্ত নিয়ে
আগুন জ¦ালিয়ে যারা শবের উপরে নেচেছিল
এই শেষ অন্ধকারে তাদের সবার কথা বলি’
(শহিদ শিখর, ছন্দের ভিতরে এত অন্ধকার, প্রকাশ ১৯৯৯)
‘ছন্দের ভিতরে এত অন্ধকার’ বইয়ের দুটি কবিতার অংশ টেনে নিয়ে–কবিতার উদাহরণ শেষ করি, এই লেখাটায়। শঙ্খ ঘোষের কবিতার যে মূল প্রবণতা–আত্মমগ্œতা ও সমাজলগ্নতা, তারই অংশী উল্লিখিত দুটি কবিতার অংশ। ব্যক্তিবিশ^ ও সমাজ-বিশে^র বিভিন্ন দিক উন্মোচিত হতে দেখি–তাঁর কবিতায়। আধুনিক কবিরা অরণ্যচারী ও দূরালোকের বাসিন্দা নন। শঙ্খ ঘোষকে অন্তর্মুখী মনে হলেও–তাঁর অন্তরস্থিত সত্তায় জনসংলগ্ন ও দেশসংলগ্ন অভিব্যঞ্জনা অন্তঃসলিলা হয়ে থেকে যায়। বাংলা কবিতার সুলুকসন্ধান ও কূলকিনারা জানতে শুধু নয়, একজন শক্তিশালী কবির কবিতার কাছে যেভাবে বিস্ময়াভিভূত হয়ে যেতে হয়–সেইভাবে তাঁর কবিতার সান্নিধ্যে আমাদেরও যেতে হবে সবসময়ে।
২ Comments
Congratulations
অসাধারণ।