গ্রন্থ আলোচনা:
গ্রন্থের নাম: ক্রীতদাসের হাসি
বইয়ের ধরন: উপন্যাস
বইয়ের লেখক: শওকত ওসমানের
আলোচনায়: তসলিমা হাসান (কবি ও কথা সাহিত্যিক)
প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। নাটকের ন্যায় সংলাপ সদৃশ উপন্যাসটির মূল উপজীব্য বাদশাই শাসনামলে মানুষের পরাধীনতা। যেখানে প্রচুর ধনের মালিক হলেও ধন মানুষের মনে সুখ আনে না।
বাগদাদের মুসলিম খলিফা হারুন অর রশিদ। প্রচুর ধন সম্পদ আর ক্ষমতার কতৃত্বধারী এই খলিফার মনে কোন সুখ ছিলনা, সদা অস্থিরতায় নিমজ্জিত থাকতেন। তারই দরবারের দাসী মেহেরজান ও ক্রীতদাস তাতরী প্রেমে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। খলিফা হারুনর রশীদ এর বেগম জুবায়দা, দাসী মেহেরজানকে অনেক ভালোবাসতেন। বেগম জুবায়দার তত্বাবধানে প্রাসাদের নিয়ম ভঙ্গ করে খলিফা হারুনুর রশীদের অজান্তেই গোপনে তাদের বিয়ে দেন। তারা দুজন প্রতিদিন ই গভীর নিশিতে দাসদের বসবাসের জীর্ণ বস্তিতে মিলিত হন। আর নবযৌবন উপভোগের নিমিত্তে প্রাণখোলা হাসিতে মেতে উঠেন।
খলিফা ও তার জল্লাদ মাশরুর দাসদাসীর বস্তির পাশের বাগানে রাত্রি নিশিথে হাঁটার সময় নবদম্পতির প্রাণখোলা হাসি শুনতে পান এবং মুগ্ধতার সাথে সে হাসি অনুভব করেন। এবং সাথে সাথে গোলাম মাশরুরকে এ হাসির উৎস আবিষ্কারে হুকুম প্রদান করেন। পরদিন একই সময়ে খলিফা ও তার জল্লাদ নবদম্পতির প্রেমলীলা প্রত্যক্ষ করেন।
আশ্চর্যজনকভাবে তারপরদিন ই খলিফা এই দাসযোগল কে দাসত্ব হতে মুক্ত করে দেন। রাজদরবারের বাগানবাড়ি ও দাসদাসী সহ নানান সুবিধা দেয়া হয় তাতারী কে। তবে এই ক্রীতদাসের সকল সুবিধা ভোগের আয়োজন করা হলেও তার থেকে আলাদা করে নেয়া হয় তার প্রিয়াকে (মেহেরজান), তাকে দরবারের বাইরে বের হতে দেয়া হয়না। এসবের উদ্দেশ্য ছিল খলিফা তার থেকে প্রাণখোলা হাসি শুনবেন।
কিছুদিন পর খলিফা তার দরবারের কবি আতাহিয়া ও নওয়াসকে তাতরীর প্রাণখোলা হাসি শুনাতে নিয়ে যান। কিন্তু তাতরী তার প্রিয়জন হারানোর বেদনায় হাসি ভুলে যায়, সে আর হাসেনা। বন্ধুবর কবিদের সম্মুখে খলিফা হারুনর রশীদ অপমানিত হন, তবুও তিনি আশাহত হননি। তাতারীকে ৩ দিন সময় দেন এবং তার মনে আনন্দের জোগাড়ের নিমিত্তে বাগদাদ শহরের সুন্দরী রূপবতী রমণী ( নর্তকী) কে তার কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু সে তার আবেদন গ্রাহ্য করাট পাশাপাশি তাকে এই অন্ধকার জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনেন তাতারী। তবে সুন্দরী নর্তকী তাতারীর মনে আনন্দ না আনতে পারলে পরদিন সকালে তার গর্দান যাবে এই ভয়ে সে রাতেই নর্তকী আত্মহত্যা করে।
এই আত্মহত্যা কে খুন বলে চালিয়ে দেয়া হয় এবং দোষী সাব্যস্ত করা হয় তাতারীকে। তার বিচার করা হয়, এই বিচারের তীব্র বিরোধিতা করেন কবি নাওয়াস। যার ফলে তাকে দরবার হতে বিতাড়িত করা হয়। খলিফা দাস তাতারীকে তিনবছরের সময় দেন যাতে করে সে তাকে মনভুলানো হাসি শুনায়। কিন্তু এই তিনবছর নানান অমানবিক নির্যাতন সহ্য করে পাথর সদৃশ হয়ে যায় তাতারী তবও এক ফোঁটা হাসি তো দূরে থাক কথা পর্যন্ত বলেনি।
শেষপর্যন্ত, খলিফা তার স্ত্রী মেহেরজান কে নিয়ে আসেন রাজদরবারে এই আশায় যে, যদি তার প্রিয়াকে দেখে সে একটু হাসে-একটু কথা বলে। কিন্তু না, তাতে কোন ফল হলোনা। মেহেরজানকে দেখেও সে এক ফোঁটা হাসি বা কথা বললোনা। তাতারীর জীবনের এই শেষ ক্ষনে খলিফা ঘোষণা দেন হাসি নয় শুধু তার মুখ থেকে যদি কথাও বের হয় তবে তাকে মুক্ত করে দিবেন। তাতেও মুখ ফোটেনি তাতারীর।
মেহেরজান চলে যাওয়া শুরু করলে ক্রীতদাস তাতারি মুখ খোলে। মেহেরজানকে পিছু ডাক দেন। তারপরই খলিফাকে বলেন, ‘শোন হারুন রশিদ’! খলিফাকে সম্মান না করায় সবাই তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে আঘাত করতে থাকে। ক্রীতদাস তাতারী বলতে থাকেনঃ
শোন, হারুনর রশীদ! দীরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে। বান্দী কেনা সম্ভব –। কিন্তু – কিন্তু—ক্রীতদাসের হাসি – না – না—না—না। এরপরই তার মৃত্যু হয়।
এবং শেষে দরবারে কবি নওয়াসিস প্রবেশ করেন এবং বলেনঃ খলিফা! হাসি মানুষের অন্তরে প্রতিধ্বনি।
শুধু ধন দৌলত, অর্থ সম্পদ দিয়ে সব কিনতে পারলেও মানুষের মনকে কিনা যায়না, সুখ কিনা যায়না, হাসি কিনা যায়না, মনে সুখ আনে না।
তসলিমা হাসান
কানাডা, ২৫-০৮-২০২১