একজন আরাধ্যার জন্ম
রেশমা আক্তার
পর্ব-৩
পাগলীটার বয়স আনুমানিক চব্বিশ কি পঁচিশ। বেশীও হতে পারে আবার কিছুটা কমও হতে পারে। ছিপছিপে কঙ্কালসার শরীর। ধবধবে ফর্সা গায়ের রং। চিবুকের মাঝ বরাবর বেশ গাঢ় একটা তিল। চিকন জোড়া ভ্রু। কোকড়ানো চুলগুলো কে বা কারা এলোমেলো ছাঁটে কেটে দিয়েছিলো কে জানে। রাওপুর বাজারে তাকে দেখা যাচ্ছে বছরখানেক হয়।
রাওপুর বাজার জমজমাট কারবারী বন্দর এলাকা। মূল বাজার এলাকাটা সবসময় কোলাহলে মুখর থাকে। পাগলীটা বেশীরভাগ সময়েই বিবস্ত্র হয়ে ঘুরে বেড়ায়। কথা তেমন বলতে পারে না। ব্যাথা, ক্ষুধা , তৃষ্ণা নিশ্চই বোঝে। কারণ ক্ষুধা লাগলে খাবারের দোকানে গিয়ে হাত পাতে। আবার পেট ভরা থাকলে সেধে খেতে দিলেও ধরে না।
অনেক সময় গায়ে কাপড় থাকে না। আজে বাজে ছেলে ছোকরাগুলো তখন আসেপাশে ছোক ছোক করতে থাকে । আবার কিছু লোকজন হাতের কাছে যার যে কাপড় থাকে ছুঁড়ে দেয়। বাজারে কাজ করা মহিলাদের কেউ দয়াপরশ হয়ে হয়তো তখন কাপড়খানা জড়িয়ে দেয় গায়ে। সেরকমই একজন হলো রাহেলা। রাহেলার মুখে জন্মের পর বুঝি মধু পড়েনি। তাই পাগলীর গায়ে কাপড়খানা জড়াতে জড়াতে মুখ থেকে তিক্ত কথার তুবড়ি চলে তার।
– হালার পুতেরা, ওই হাসোছ ক্যারে..? বেজম্মার পুতেরা..? পাগলীর পেন্দনের কাফর খুলনের সময় তগোর মনে থাহে না, এইডা পাগল? আকাম করার পর পিন্দাইয়া দেছ নাই ক্যারে, বান্দীর পুতেরা..?
আপন মনে চলতে থাকে রাহেলার কথার ছুরি। যারা এতক্ষণ ছোক ছোক করছিলো তারাই হঠাৎ খুব কাজে ব্যস্ত হয়ে এদিক সেদিক মুখ লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
রাহেলাই প্রথম আন্দাজ করে পাগলীটার পেটে বাচ্চা।
এই বাজারে পাগলীকে সবাই চেনে। সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। রাতে সেটঘরে অর্থাৎ বাজারে যে লম্বা ছাউনি ঘরে ভ্রাম্যমান দোকানপাট বসে, আবার রাত হলে গুটিয়ে ফেলা হয়, সেখানে ঘুমায় সে।
সুতরাং পাগলীর এই খবরটা শুরুতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলেও পরে সবার কাছেই স্বাভাবিক ঘটনা বলেই মনে হতে থাকে। পাগলীর যে বয়স, আর গায়ের রং, তার উপর পাগল। কথাবার্তাও ভালো করে বলতে পারে না। সারা গায়ে পুরানো গভীর সব ক্ষতচিহ্ন। কে এই মেয়ে, কোত্থেকে এসেছে, কীভাবে পাগল হলো, কীভাবেই বা বেওয়ারিশ হল কেউ জানে না।
তবে পাগলীর এই নতুন খবরে শুরুতে এলাকায় আলোচনার ঝড় উঠেছিলো। ঘাটের চায়ের দোকানে, খেলার মাঠে, আড্ডায় সবার মুখেই পাগলীর বিষয়টা ঘুরেফিরে চাউর হতে থাকলো। কেউ কেউ পরামর্শ দিলো, পাগলীকে ধরে বাসে তুলে দিয়ে অন্য কোথাও সরিয়ে দেয়া হোক। সমাজের জন্য এ দৃশ্য তো মনোরম নয় মোটেই।
অথবা হাসপাতালের ডাক্তারের শরনাপন্ন হওয়া যায়। যদি কোনো সদ্গতি হয়।
কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? এ ওকে ধাক্কা দেয়, ও একে ঠেলে দেয় সামনে। আদতে, কেউ এই মহান দায়িত্বটা নিতে চায় না। কয়েকটাদিন এমন হলো যে, পাগলীকে দেখা গেলেই সবাই তাড়া করে। এতবড় অপকর্ম, পাপাচার দেখলেও যে ঘৃণায় রি রি করে সবার গা। তবে মজার ব্যাপার হলো, সব আলোচনাই হয় একপাক্ষিক। এমন একটা অনাচারে যে দ্বিতীয় কোন পক্ষেরও সম্পৃক্ততা থাকে এবং তারা যে সমাজের সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ, অন্তত পাগল নয়, সেটা যেন বেমালুম ভুলে থাকে সবাই।
ওই দিনগুলোতে রাহেলাও ভাবতো পাগলীকে নিয়ে। আহা কী সুন্দর একটা মেয়ে? কাদের বাড়ির মেয়ে কে জানে? আহা, নসিবের দোষ সব, নইলে এমন হয়?
তবে মনুষ্যসমাজের একটা চমৎকার রীতি আছে। তীব্র উৎসাহের বিষয়টি একবার চর্বিতচর্বণ হয়ে গেলে ওতে আর আগ্রহ থাকেনা কারো। তারা আবার নতুন কোনো চমকপ্রদ ঘটনায় তাদের যাবতীয় জ্ঞান আর বিষয়বুদ্ধি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চুইংগামের রসটুকু চুষে খেয়ে বিস্বাদ পরিত্যক্ত অংশটুকু যেমন থু মেরে ফেলে দেয় ডাস্টবিনে। পাগলীর ঘটনাটাও তেমন হলো। কত আর বলা যায়। চোয়াল যেন লেগে গেলো লোকের।
এদিকে দেখতে দেখতে পাগলীর দিন গড়ালো। স্ফীত পেট নিয়ে তার বিড়ম্বনার শেষ নেই। আজকাল বাজারের অনেকেই দয়াপরশ হয়ে এটা সেটা খেতে দেয় তাকে। আবার অনেকে ঘৃণায় দূর দূর করে তাড়িয়েও দেয়।
এই যেমন রাহেলা। অভাবের সংসার তার। মিল চাতালে কাজ করে দু’পয়সা রোজগার। স্বামী পরিত্যাক্তা, দু’টা ছেলে আছে। বড়টা স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ে, আবু। ছোটটার বয়স সাত, বাবু।
রাহেলা সারাদিন পর একবেলা রান্না করে, খুব সামান্য। তাও রাতে রান্না করা খাবার কিছুটা বাঁচিয়ে সে আঁচলে ঢাকা দিয়ে নিয়ে যায় সেটঘরে। আহা সারাদিন খেতে পেলো কিনা কে জানে? হারামজাদী না খেয়ে মরুক। কিন্তু পেটের শত্তুরটার কী হবে? তারও তো একটুখানি খাবার দরকার।
পাগলীকে গভীর ঘুম থেকে টেনে উঠিয়ে বসায় রাহেলা। খাবারের থালাটা এগিয়ে দেয় সামনে। পাগলীর গায়ে বড় দুর্গন্ধ। নাকে আঁচল চাপা দিয়ে একটু দূরে বসে থাকে রাহেলা। মনে মনে ভাবে , দিনক্ষণ হবার আগে একবার পাগলীটাকে গোসল দিয়ে দিবে। মাথার চুলগুলো কামিয়ে দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। মাথা ভর্তি উকুন গিজগিজ করছে।
পাগলী, কথা বলতে পারে না। তবে অনুচ্চারিত কিছু শব্দ বের হয় মুখ দিয়ে। যেমন রাহেলাকে চেনে সে। রাহেলাকে দেখলে সে হাম্মা.. হাম্মা, এমন এক ধরণের শব্দ উচ্চারণের চেষ্টা করে। রাহেলা বোঝে, ওটা আসলে হাম্মা নয়…, ওটা আম্মা…।
দূর হারামজাদী, আমি তোর কোন জম্মের আম্মা লাগি রে..? ইস্… এক্কেরে সেয়ানা পাগল!
মুচকি হাসে রাহেলা।
খাওয়া শেষ করে পাগলী শুয়ে পড়ে। পাগলীকে ঘৃণা করে না এমন লোক কমই আছে। এমনিতেই পাগল , তার ওপর সাক্ষাত পাপাচারের প্রমান চোখের সামনে ঘোরাফেরা করলে ভদ্রসমাজে পরিবেশটা ভালো ঠেকে না। তবে এদের মধ্যেও কিছু উজবুক লোকজন আছে। তাদের মনে দয়া মায়াও আছে। তাদের কেউ কেউ দু এক ছত্র পুরানো কাপড়, বাসি রুটি বা খাবার ছুঁড়ে দেয় কখনও সখনও পাগলীর দিকে।
তাদেরকে ভদ্রলোকদের টিপ্পনীও শুনতে হয় তার জন্য।
– কিরে দরদ দেহি উৎলাইয়া পড়ে, ঘটনা কী?
সাহায্যকারী মুখ লুকাবার যায়গা পায় না। তবে রাহেলার ব্যাপার আলাদা। এ তল্লাটে তার চোপার খ্যাতি আছে। সে ছেড়ে কথা বলে না কাউকে।
– তুই কোন হারামজাদা, হারামীর পুত রে, জিগাছ আমারে? শালা শকুনের বাচ্চারা, রাইত বিরাইতে মনে থাহে না? আকামের সাধু , সবগুলানরে চিনা আছে কইলাম। হালার পুতেরা, মুখ খুলাইবি তো খবর আছে…..। গুষ্টি উদ্দার করমু এক্কেরে।
রাহেলার চোপায় প্রশ্নকারী দ্রুত নিজেকে আড়াল করে নেয়।
একটা মানবশিশু মায়ের শরীরে বড় হচ্ছে। ধীরে ধীরে তার অনুভূতি আসছে। নিশ্চই তার ক্ষুধা তৃষ্ণাও হয়। একটু একটু করে অপেক্ষার সময় পার করে পৃথিবীর আলো দেখবে বলে সে তার সমস্ত আয়োজন নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাকে কে আটকাবে? কে তাকে আয়োজন করে স্বাগত জানালো, কে চোখ রাঙালো তাতে তার কিছুই আসে যায় না। আজকাল সারাক্ষণ রাহেলার মনে এসবই চলতে থাকে। লোকজন তাকে নিয়ে হাসাহাসিও করে। বলে” ওই যে দেহো, পাগলীর মায় আইছে।”
রাহেলা পাত্তা দেয় না। সত্যিই বুঝি তাই। পাগলীর ওই ‘হাম্মা’ ডাকটাই বুঝি অবচেতনে তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ভাঙা চৌকিতে পাশ ফিরতে ফিরতে রাতে ভাবে রাহেলা। ঘুম আসে না তার। দূরে কোথাও ট্রলারের ভটভট আওয়াজ ভেসে আসে। নিশুতি রাতে চালের উপর আওয়াজ দিয়ে উড়ে যায় নিশীপক্ষী। আসমানে চাঁদ বেড়ার ফাঁক গলে জানান দেয় রাহেলার কুঁড়েঘরে। অমোঘ প্রকৃতি যেন নিরন্তর বয়ে চলে তার নিয়মে। প্রকৃতি তার নিয়ম ভাঙে না। এটুকুই যা ভরসা।
একবার কে এসে তাকে খবর দিলো, “লঞ্চঘাটের ধারে পাগলী মরতাছে। পাগলীরে কে জানি কী খাওয়াইছে।”
সর্বনাশ, এই ভয়টাই পাচ্ছিলো রাহেলা। দৌড়ে গিয়েছিলো সে। রাস্তার একধারে পাগলী শুয়ে কেমন ছটফট করছিলো। পেট চেপে ধরে বমি করার চেষ্টা ছিলো তার। আসেপাশের লোকজন কিছুক্ষণ মজা দেখলো তারপর চলে গেলো যে যার কাজে।
রাহেলা পাগলীকে ধরে হাত দিয়ে পেটের এদিক সেদিক দেখলো। বুঝলো, বেশীক্ষণ আর নয়। কে করলো এই সর্বনাশ? আহারে কী কষ্ট। পাঁচ ছ’মাসের পোয়াতির এ অবস্থা কেউ করে? রাস্তার একটা কুকুরেরওতো বাচ্চা প্রসবের অধিকার আছে।
কেউ কেউ বলল, “ভালোই হইছে, পাপের চিহ্ন মুইছ্যা যাউক।”
রাহেলা তাদের মুখের দিকে বিস্ময়ভরে তাকিয়ে থাকে। একটা পর্যায়ে সেও ভাবে যাক, এই বুঝি ভালো হলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চাতালে নিজের কাজে চলে যায় সেও। সন্ধ্যা নাগাদ কান খাড়া করে ছিলো রাহেলা। লোকের মুখে পাগলীর নতুন কোনো খবর শুনবে বলে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। যাবার পথে সেটঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো কেমন মরার মত পড়ে আছে পাগলী। সত্যিই মরলো নাকি আপদটা?
রাহেলা এগিয়ে গিয়ে পাশে বসলো। হাত দিয়ে ধাক্কাতেই কাহিল চোখে তাকালো পাগলী। মুখ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে তার। রাহেলা তার পেটের নানান জায়গায় হাত দিলো। মুখে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। বাচ্চাটা মরেনিতো? কোনো নড়াচড়া নেই কেন?
সে রাতে খাবার নিয়ে এসে পাগলীটাকে খাওয়াতে পারলো না রাহেলা। সারাদিন যন্ত্রণা আর ছটফটানির পর পাগলী মরার মত নিস্তেজ হয়ে পড়ে ছিলো। কী জানি কে কী খাওয়ালো। উদ্দেশ্য পেটের পাপটা দূর করা, সেতো বোঝাই যায়। তা, সে হলে হোক। যদি হয় আজ রাতের মধ্যেই হবে হয়তো। কি জানি, পাগলীটাও মরবে বুঝি এবার। তা মরুক না, মরতে পারলেই হবে ওর সত্যিকারের বেঁচে যাওয়া। মরে অন্তত বাঁচুক আপদটা।
বিক্ষিপ্ত মনে ফিরেছিলো ঘরে রাহেলা। সারারাত কেমন ভাঙা ভাঙা ঘুমে সেও ছটফট করলো বিছানায়। সকালে দু’গ্রাস পান্তা মুখে দিয়ে ছেলেদের রেখে কাজে ছুটলো আবার।
আজ সারাদিন, পাগলীর মরার খবর কেউ দেয়নি তাকে। কাজের চাপে ফুসরতও ছিলো না ওসব জানার। বিকেলবেলা ফেরার পথে দেখলো রাহেলা, একটা দোকানের টুলে বসে পাওরুটি ছিড়ে মুখে দিচ্ছে পাগলী। ঠোঁটে হাসি ফুটলো রাহেলার। মরা বুঝি এত সহজে মরে না এ জগতে।
সেদিন রাতে রাক্ষুসে ক্ষিধে নিয়ে রাহেলার আনা খাবার গিলছিলো পাগলী। রাহেলা তার পেটে হাত দিয়ে পরীক্ষা করলো। তার ঠোঁটে হাসি ফুটলো এবার।
ফেরার পথে ভাবছিলো সে, সবাইতো চায় পাগলীর পেটের সন্তানটা মরুক। তাহলে রাহেলা কেন ভাবতে পারে না? সে কেন বাচ্চাটার ভালোমন্দ চিন্তা করে? এই বাচ্চা ভুমিষ্ট হলে এর দায় কে নেবে? ভাগাড়ে মরে পড়ে থাকবে বৈ তো নয়? মরলে মরুক, তার কী?
পৌষ মাসের শেষের দিকে, পাগলীর টালমাটাল অবস্থা। ইদানিং রাহেলা প্রতিদিন সকাল বিকেল খোঁজ নেয় পাগলীর। কিন্তুু আজ সকাল থেকে সে তাকে দেখেনি কোথাও। চাতালে কাজ করতে করতেও মনে হয়েছিলো কয়েকবার। কিন্তু কাজের চাঁপে ফুসরত মেলেনি তার। পড়ন্ত বিকেলে পরিশ্রান্ত রাহেলা। হাতে একটা খুঁদের পোটলা। বাড়ি ফিরে রাঁধলে পরে ছেলে দুটি সারাদিন পর খেতে পাবে। মায়ের পথ চেয়ে বসে আছে হয়তো।
রাহেলা সবাইকে জিজ্ঞেস করতে করতে লঞ্চ টারমিনালের এক কোনায় খুঁজে পায় পাগলীকে। তার অবস্থা ভালো নয়। একটু পর পর গোঙ্গাচ্ছে। রাহেলা চিন্তিত মুখে দুই হাত দিয়ে পাগলীর পেটের নানান জায়গা পরীক্ষা করলো। তারপর ওর একটা হাত কাঁধের উপর তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিলো। পাগলী উঠে দাঁড়ালো। এক পা ,দুই পা করে তাকে সেট ঘরের এক ধারে এনে শুইয়ে দিলো রাহেলা।
রাহেলা আজ বাসায় এসে তাড়াতাড়ি রান্না খাওয়া শেষ করলো। কিছু পুরানো ছেড়া কাপড় চোপড় জড়ো করে , বাটিতে একটু খাবার নিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ আবার গেলো পাগলীর কাছে। পাগলীর গোঙানী তখন বেড়ে গেছে অনেক । চারপাশে উৎসুক মানুষের ভীড়। নানান জনে নানান পরামর্শ দিচ্ছে।
রাহেলা মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবলো। তারপর উঠে গিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানো এক পরিচিত ভ্যান ওয়ালার সাথে পরামর্শ করে ফিরে আসলো।
একটু পরে ভ্যান ওয়ালার সহযোগিতায় পাগলীকে ভ্যানে তোলা হলো, তারপর সোজা উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে।
হাসপাতালের বারান্দায় একটা পলিথিন বিছিয়ে রাহেলা পাগলীকে শুইয়ে দিলো। কিন্তুু ব্যাথার যন্ত্রনায় পাগলী তখন ছটফট করতে শুরু করেছে, কখনও উঠে দাঁড়ায়, কখনও হাঁটা দেয়। আর তার অনিয়ন্ত্রিত চিৎকারে লোকজন জড়ো হয়ে গেলো। আসেপাশে সবাই রাহেলার এই নির্বোধ আচরণে তিরষ্কার করতে থাকলো।
হাসপাতালের এক লোক এসে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলো
– আরে আরে, এইটারে এইখানে কে আনছে? কী আপদ, কে….. কে আনছে?
রাহেলা দোনোমনা করে এগিয়ে আসলো, গলার স্বর যথাসম্ভব নরম করে বলল
– ভাই….আমি আনছি। পাগল ছাগল মানুষ, কিছুই কইতে পারে না, ভাবলাম এইহানে একটু চিকিতসা পাইবো…..তাই….
– তোমাগো কী কোন আক্কেল নাই? বাইরে কোন চিপাচাপায় বাচ্চা খালাস কইরা ফালাইতা। এইখানে কত রুগী, তারমধ্যে একটা পাগল আইনা উপস্থিত করছ? অক্ষুনি সরাও কইলাম। বড় স্যার রাউন্ডে আসার আগে বিদায় হও।
রাহেলার মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে গেল। সে জানে, নরমের জায়গা নাই দুনিয়াতে।
গলার স্বরে আরও গাম্ভীর্য এনে সে বলল।
– ভাইজান, আফনে কী চিকিতসক? আফনে কী বড় ডাক্তর…?
– না,
– তাইলে এহানথন ফুডেন। পাগলীর ডেলিভারি এইহানেই অইবো। কোনো হারামীর পুতে আটকাইতে পারবো না। সরকারী চিকিতসা পাগলে পাইবোনা, এমন কোনো আইন আছে দেশে? পাগলের লইগ্যা কী আমি কোনো বেড, বিছনা চাইছি? এই হানের সক্কল বান্দীর পুতেরা মায়ের পেট থেইক্কা বাইর হইছে, দেহি কেডা আটকায়।
একজন নার্স এসে ধমক দিলো
– এই এইখানে এত চেঁচামেচি কিসের? এইটা কী মাছের বাজার? তোমাগো সমস্যা কী?
রাহেলা এবার গলার স্বর নিচু করলো। যথাসম্ভব বিনীতভাবে খুলে বলল বৃত্তান্ত। একটু পরে রাহেলার মুখে সমস্যার কথা শুনে নার্স বলল,
– তোমার পেশেন্টরে কী চিকিৎসা দিব? ওতো স্থির থাকতেছে না। আমরা কী ওর পিছন পিছন দৌড়াবো?
উপস্থিত সবাই হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে ঢলে পড়তে লাগলো।
রাহেলা এবারও মাথা ঠান্ডা রাখলো, নার্সের কাছে এসে বলল
– আফাগো, আমি যথাসাধ্য অরে থামানোর চেষ্টা করতেছি, আফনে একটু দ্যাহেন। মাইয়া মাইনষের ব্যাপার আফা। রাস্তা ঘাডে বে আব্রু ডেলিভারি হইব, এইডা কেমুন কতা? এক মেয়ের ইজ্জত গেলে সব মেয়েলোকের সরম গো আফা……
বিরক্ত মুখে নার্স তাকে থামিয়ে দিলো।
– হইছে হইছে থামো, কথা তো তুমি বেশিই বুঝ। কোন বুদ্ধিতে এই পাগলের দায়িত্ব নিছ? আর এখন হাসপাতালে নিয়া আসলা কোন আক্কেলে? এইখানকার একটা নিয়ম কানুনতো আছে। দুইটা ট্যাবলেট দিতাছি ব্যাথা ওঠার। ওরে নিয়ে বাইরে কোথাও রাইখ্যা আসো। বাচ্চা হইলে এমনিই হইবো। এগুলান বাঁচে না। বহুত দেখছি।
রাহেলার মুখটা থমথম করছে। হেরে যাওয়া দিশেহারা মুখ। কী করবে এখন সে? আর বুঝি কিছু করার নাই। কেন যেন মনে হচ্ছে, বাইরে নিলে বাচ্চাটা স্বাভাবিকভাবে ভূমিষ্ট হবে না।
নার্স ঘুরে দাড়িয়েছে। চলে যেতে উদ্যত হতেই রাহেলা দৌড়ে এসে তার পা জড়িয়ে ধরলো।
– আফা আফনের পায়ে ধরি, যাইয়েন না। ওরে খেদাইয়েন না। বাচ্চাডারে বাঁচান আফা। বাইরে নিলে বাচ্চাডা বাঁচবো না মনে হয়। দয়া করেন আফা…
নার্স বিরক্ত হয়ে কিছু বলতে গেলো, কিন্তু বলতে পারলো না। হয়তো সত্যিই তার কিছুটা দয়া হচ্ছে এখন। সে চিৎকার করলো
– রহিমা…. এই রহিমা….এইদিকে আয় তো,
একজন আয়া টাইপের কেউ দৌড়ে এলো, লোকজন সরিয়ে দেয়া হল। নার্স, দু’জনার সহযোগিতায় পাগলীকে চেকআপ করল।
নার্সের মুখ গম্ভীর
– ব্যথা উঠছে কোন সময় , জানো কিছু? অবস্থাতো জটিল মনে হয়।
– সঠিক জানি না আফা। তয় কাল রাইত থেইকা ছটফট করতাছে।
– ঔষধ যা আছে দিতেছি, দুই একটা কিনতে পারবা?
– সস্তার মইধ্যে দিয়েন আফা।
ঔষধপত্র দেবার পর পাগলীর চিৎকার আরও বেড়ে গেলো। হাসপাতালের লোকজন অতি বিরক্ত। কিন্তুু আবার উৎসাহেরও অভাব নেই। সারাক্ষণ পাগলীর কী হল , কী হল, কৌতূহল।
যাক, রাহেলার চোপা আর সিনিয়র নার্সটির ধমক ধামকে কাজ হলো। পগলী হাসপাতালে টিকে গেল। তার জায়গা হলো সিঁড়ির নিচে।
রাত তিনটার দিকে পাগলী একটা কন্যা সন্তান জন্ম দিল।
( চলবে)
১ Comment
nice story, congratulations