পাহাড়ের সাথে, একান্তে
রুমা ব্যানার্জী (Kolkata)
শহুরে একঘেঁয়েমিতে ক্লান্তজীবন যখন প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে চায় তখন মন ছুটে যায় নীল সবুজ হিমালয়ের কোলে কোন অজানা গ্রামে। সেখানকার সোঁদা মাটির গন্ধ, ঝোপে ঝাড়ে ঝিঁঝি পোকার ডাক, হোমস্টের রান্না ঘর থেকে নেপালি সুরে গুনগুন, দূরে পাহাড়ের গায়ে জ্বলে থাকা টিমটিমে আলো সব যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। কিছুটা নিমরাজি কর্তা কে বাগে পেয়ে বলেই ফেললাম, চলো কদিন পাহাড়ে ঘুরে আসি। হাতে বেশি দিন ছুটি নেই, বড়জোর চার পাঁচদিন। তাই বা মন্দ কি?কর্তা রাজি শুধু শর্ত একটাই দার্জিলিঙে থাকা চলবে না।অগত্যা তাতেই রাজি।
আগে থেকে তেমন প্ল্যান ছিলনা তাই বন্ধুর স্মরনাপন্ন হলাম। সে’ই ফোন করে একটা মনের মত হোমস্টেও খুঁজে দিল, শহর থেকে দূরে, যেমনটি চাইছিলাম ।বারমিক, কালিম্পং এর কাছে একটা নির্জন গ্রামে।গাড়িও ঠিক হল। এন জি পি থেকে তুলে নেবে। চালাও পানসি বেলঘরিয়া!!!!
ভোর বেলায় দার্জিলিং মেল থেকে নেমে বাক্স পেঁটরা নিয়ে চড়ে বসলাম নির্দিষ্ট গাড়িতে। শহর ছাড়িয়ে একটু প্রাতরাশ তার পর সেভোক রোড ধরে সোজা বেঙ্গল সাফারি। আমার বন্য জীবজন্তু দেখার দৌড় চিড়িয়াখানা অবধি ।খোলা পরিবেশে, সতর্ক পাহারায় দক্ষিণ রায় কে দেখা এই প্রথম, তাও একহাত দূরত্বে।বানর, হাতি, হরিণ, ভাল্লুক, ময়ূর সব দেখার পরে দর্শন দিলেন স্বয়ং দক্ষিণ রায়। অলস পায়ে, ঘাড় ঘুড়িয়ে, তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে হেঁটে চলে গেলেন সামনে দিয়ে । মন বলল, মহারাজা তোমাকে সেলাম।
সন্ধ্যা নামার মুখে পৌঁছে গেলাম বারমিক, পাহাড়ের ঢালে একটা ছোট্ট গ্রাম। ছড়ানো-ছিটানো কিছু বাড়ি।কালিম্পং থেকে রংপো যাওয়ার যে পাকা রাস্তা গ্রাম চিরে চলে গেছে তার ধারে গোটা চার-পাঁচ দোকান। নিচে, অনেকটা নিচে খানিকটা সমানমতো জায়গায় একটা খেলার মাঠ।পাশে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় আরেকটা ঝরনা আছে গ্রামের গা-ঘেঁষে। অনেকখানি পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে একটা চওড়া পাথরের ওপর পড়ছে। সেখান থেকে প্লাস্টিকের বোতলে বা জারিকেনে ভরে জল আনে গ্রামের লোকেরা। সেটাই বলতে গেলে বারমিকের খাওয়ার জল বাকিটা বৃষ্টির জল ধরে রেখে।পর্যটক এলে জলের গাড়ি বুক করতে হয়। পথচলতি ড্রাইভাররা অনেক সময় গাড়ি দাঁড় করিয়ে ঝরনা থেকে তাদের বোতলে জল ভরে নেয়।এসব নিয়েই এই গ্রাম। মালিক ভীষণ আন্তরিক ভাবে হাসি মুখে আমাদের স্বাগত জানালো। ছোট্ট ছিম ছাম অথচ আধুনিক ব্যবস্থা যুক্ত বাড়ি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে যতদূরে চোখ যায় শুধু সবুজ।মালকিনের হাতের রান্না সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দিল। সেদিন তাড়াতাড়ি শুলাম কারণ পরের দিন কালিম্পং যাব।
কালিম্পং তিস্তা নদীর ধারে একটি শৈলশিরার উপর অবস্থিত।সেই জেলার কালিম্পংয়ে দর্শনীয় স্থান অনেক। শহরের কাছেই অবস্থান করছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত গৌরীপুর হাউজ। কালিম্পংয়ের আরেক দ্রষ্টব্য লেপচা মিউজিয়াম। এই শহরে বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ মঠ, চার্চ অতিমারির কারনে বন্ধ। বিখ্যাত মর্গ্যান সাহেবের বাংলো সেটাও বন্ধ । ক্যাকটাসের মনোমুগ্ধকর সংগ্রহ দেখতে গেলাম, পাইন ভিউ নার্সারিতে। এছাড়া হনুমান পার্ক, দুর্গামন্দির, কালীমাতা মন্দির প্রভৃতি জায়গা দেখার মতো। তিস্তা বাজারে মংপুর রেস্টুরেন্টে খেয়ে পেট মন দুটোই ভরল। এখনো মোমোর সুবাস পাচ্ছি যেন।
পরেরদিন দার্জিলিং, আমার স্বপ্নের শহর, দার্জিলিং। নীল আকাশের নীচে পাহাড়ের গায়ে ধূসর মেঘেদের আনাগোনা, সবুজ উপত্যকার গায়ে ছোট ছোট কাঠের বড়ি , আর পাইন, দেবদারুর সাথে রডোড্রেনড্রন, ক্যমেলিয়ার মেলবন্ধন ভ্রমনপ্রেমীদের বার বার টেনে নিয়ে যায় দার্জিলিং।মেঘ-কুয়াশার লুকোচুরিতে ব্যস্ত শহরের পাশ দিয়ে চলে যায় টয় ট্রেন।পাইনের অন্ধকার মাখা পিস প্যাগোডা যাওয়ার রাস্তা আমাকে বড্ড আর্কষন করে।ভিউ পয়েন্টের রেলিংএ দাড়িয়ে বার বার হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে কুয়াসায়, মেঘেদের ভিড়ে। গ্লেনারিজ্ আর ম্যাল ঘুরে তীর্থ করার আনন্দ নিয়ে রওনা হলাম। শর্ত অনুযায়ী দার্জিলিং এ থাকা হবেনা।সুতরাং ঠিক হলো থাকবো কিছুটা দূরে জোর পোখরিতে।
জোর পোখরী, হিমালয়ের কোলে পাইন আর ধুপি গাছের জঙ্গলে ঘেরা, কুয়াশা মাখা একটা ছোট্ট জায়গা প্রায় 7600 ফিট ওপরে সেঞ্চল অভয়ারণ্যের একটা অংশ। এখন একদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে এমন। অন্যদিকে কারশিয়ং আর দার্জিলিং ।দার্জিলিং ঘুরে রওনা হলাম জোর পোখরির উদেশ্যে। চড়াই উৎরাই পেরিয়ে মাত্র 19কিমি রাস্তা। সন্দাকফু যাওয়ার জন্য মানেভঞ্জন বা চিত্রের দিকে না গিয়ে ধরলাম সুখিয়া পোখরির পথ। সুনসান রাস্তা, পাইন গাছের পাতা ঘেঁসে হওয়ায় বাজছে এক নৈসর্গিক সুর, দিনের শেষ তাই পাখির কূজনে পাহাড় থেকে পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ছে মায়াবী সুরের ঝর্না, পথে রয়েছে কংক্রিটের তৈরি বেঞ্চ যেখানে বসে এই আনন্দ উপভোগ করা যায়।
সন্ধ্যা নামছিল পাইনের পাতা বেয়ে।কুয়াশা আার মেঘ চপল কিশোরীর মত পথের আঁকে বাঁকে খেলা করছে দলবেঁধে।
কান পাতলে শোনা যায় গাছ থেকে টুপ টাপ করে ঝরছে জলের ফোঁটা। আমাদের ড্রাইভার জানালো সামনেই একটা গোরস্থান, সব মিলিয়ে একটা গা শিরশিরে অনুভূতি ঘিরে ধরলো।
যতক্ষণে আমরা হোমস্টেতে পৌঁছালাম ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে যদিও ঘড়িতে সময় সাড়ে পাঁচটা।দূরে কারশিয়ং শহর জুড়ে আলো জ্বলছে। এমনকি বাগডোগরার আলো অবধি দেখা গেল।হাতে গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম স্বপ্নের রূপকথার রাজ্যে। সব যেন ঘুমিয়ে আছে রুপোর কাঠির ছোঁয়ায়। যদিও ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমি নেই তবে শুনলাম ওখানে হিমালয়ের স্যালামান্ডার দেখা যায় যার আঞ্চলিক নাম গোড়া এবং বেশ কিছু বছর আগে ভাল্লুক দেখা গেলেও এখন আর তেমন বন্য প্রাণী দেখা যায় না। নিশ্চিন্তে ঘরে ঢুকে পড়লাম।
সুন্দর সাজানো গোছানো ঘর, বড় বড় জানালার পর্দা সরালেই সামনেই দুটো পুকুর, এই জোড়া হ্রদের জন্যই জায়গার নাম জোর পোখরি। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ায় এতটাই ঠান্ডা লাগছিল যে রুম-হিটার নিতে হলো। গরম গরম খাবার খেয়ে আমরা সে দিনের মত যে যার ঘরে লেপ কম্বলের মধ্যে সিঁধিয়ে গেলাম।
খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো । ঝক ঝকে আকাশ আর সামনে অপরূপা কাঞ্চনজঙ্ঘা তার মোহিনী রূপে মাথায় সোনার মুকুট পরে উপস্থিত। সে দৃশ্য বর্ণনা করার ক্ষমতা ঈশ্বর আমাকে দেন নি, শুধুই মুগ্ধতায় ঈশ্বরের এই অসীম দান প্রাণ ভরে গ্রহণ করলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ না যেতেই নেমে এলো মেঘমালা, ঢেকে দিল আশপাশ। একটু আগের রূপের সঙ্গে কোনো মিল নেই এই কুয়াশা ভরা সকালের। দিন যত বাড়লো কুয়াশা ততই ঘন হতে লাগলো। সামনের শান বাঁধানো পুকুর একটা বিরাট সাপের মূর্তি যেন এই কুয়াশায় কেমন জীবন্ত মনে হচ্ছিল। জলে সাঁতার কাটছে বেশ কিছু হাঁস, দূরের বাগানটায় চড়ে বেড়াচ্ছে আরো কতগুলো।পুকুর দুটি ঘিরে যত্নে লালিত মরশুমে ফুলের সারি আর তারপর সীমানা প্রাচীরের মত পাইন গাছের সারি, এক অসামান্য মেল বন্ধনে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। মিরিক এর পথ ধরে নিলে ফিরতে সময় লাগার কথা সাড়ে তিন ঘন্টা তাই সকালটা ঘুরলাম চারিদিকে । আমি তখনও আমার চাতক মনটা কে ভিজিয়ে নিচ্ছিলাম এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে।ফেরার সময় নেপাল বোর্ডের এর কাছে পশুপতি মার্কেটে ঘোরা হলো না কারণ আতিমারীর কারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ । কিন্তু তাতে দুঃখও নেই যে দৃশ্য মন ভরে দেখেছি সেটা ফিরে অনেক দিন অক্সিজেন দেবে, বেড়ানোর এটাও একটা সুখ যে ঘুরে এসে সেই সুখ স্মৃতি কে মনে করে ঘটনার জাবর কেটে প্রতি টা মুহূর্ত আবার করে স্মৃতি পটে ফুটিয়ে তোলার আনন্দই আলাদা..
১২ Comments
Thsnk you for painting such a vivid picture with your words. While reading i was transported to this magical realm and visuslise what you saw. The wordplay was simply excellent.
Thank you so much for your eulogistic comment, I am in cloud nine, Thank you once again for you support and love, stay blessed
চমৎকার লেখা আর ছবি। পড়তে আর দেখতে দেখতে ঠিক মনে হচ্ছিল যেন আমি নিজেই দেখছি, ঘুরছি আর পরে লিখছি। লেখিকাকে কুর্নিশ জানাই।
প্রাপ্তি!! অসংখ্য ধন্যবাদ বন্ধু, মতামত পেয়ে আপ্লুত হলাম।
ভীষন ভালো লাগলো
আপনাকে বিশেষ ধন্যবাদ জানাই বাকিটা অপেক্ষায় রইলাম।
যোগরাজ চৌধুরী সম্পাদক বাংলার সিঞ্চন হালিশহর
অসাধারণ। ঘরে বসেই মানস ভ্রমণ হয়ে গেলো। কি অনবদ্য প্রাঞ্জল লেখনী। একবার শুরু করলে এক টানে শেষ করতেই হবে।
প্রসঙ্গত বলি পাহাড় আমাকে পাগলের মতো টানে। সেই হিসাবে কয়েকবার ট্রেকিং ও করেছি। সেই পাহাড়ি অঞ্চলের মাদকতা রুমা ব্যানার্জির উপস্থাপনায় ভীষণ সুন্দর ভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
শ্রীমতি ব্যানার্জীর কাছে আরো এইরকম মনোজ্ঞ লেখার আবদার রাখছি।
@যোগরাজ চৌধুরী, মতামত দিয়ে উৎসাহিত করার জন্য জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। লেখার মাধ্যমে আবার দেখা হবে নিশ্চয়। শুভেচ্ছা নিরন্তর
@কুশল ভাস্কর, এই অতিমারির কারণে বেড়াতে যাওয়ায় ভাটা পড়েছে। তাই এখন মানস ভ্রমন একমাত্র হাতিয়ার। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জানাই, আমি যে আপনার সেই সাধ অল্প হলেও মেটাতে সক্ষম হয়েছি এটা আমার লেখনীর প্রাপ্তি।পাশে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
খুউব খুব ভালো লাগলো। ভ্রমণের এত ভালো বর্ণনা মনে হলে আমরাও ঘুরে এলাম।
wow! nice
@papri, I am deeply honoured
Thank you so much
@ Gopal Dey, ভ্রমণ কাহিনী উদ্দেশ্যই হল মানস ভ্রমণ, সেটা সম্ভব হয়েছে জেনে অনুপ্রাণিত হলাম। অসংখ্য ধন্যবাদ।