নারীর ভূষণ
রুমা পারভীনারা
কথায় আছে ‘লজ্জাই নারীর ভূষণ’। যে নারী যত বেশি লজ্জাবতী সে নারী ততই সুলক্ষণা। নারীর এই লজ্জাই তার সম্ভ্রমকে সংযত রাখে। লজ্জাশীলা নারীই সংসারের রমণীয়তায় এক অলংকারে মুড়ে যায়। এমনকি তার সমস্ত সংসার – পৃথিবী হয়ে ওঠে এক সুনীবিড় -সুশীতল ছায়াঘন শীতল আশ্রয়।
এসব কথা নাকি প্রাচীন যুগ থেকে প্রবাহমান হয়ে আসছে। তাই বর্তমান দিনের নারীর সঙ্গে প্রাচীন যুগের নারীর এক বিচিত্র বৈপরীত্য তৈরি করতে সদা তৎপর হয়ে উঠেছে মানুষ। বেশিরভাগ প্রবীণ মানুষের গলার স্বর যেন একই ধারায় বইতে চায়। প্রবীণ মানুষই যেন যুগ বিভাজনের রীতির মাপকাঠিতে বেশি গণক হয়ে উঠেছে।বেশি দক্ষ হয়ে ওঠে নারীর সমস্ত অধিকার নিয়েও আঙুল তুলতে।
বর্তমান যুগের আবহাওয়ায় এসে আমরা নারীগণ কি দুঃসহনীয় হয়ে পড়েছি,নাকি বড়ই বেপরোয়া হয়ে পড়েছি?জানতে খুবই মন চায় বয়স্ক প্রবীন দাদুদের কাছে। যাঁরা আধুনিক ও প্রাচীনের মধ্যে এক যুগের বলিরেখা হিসেবে দণ্ডায়মান।
যুগ পাল্টিয়েছে সঙ্গে বলা যেতেও তো পারে যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণ দাদুদের মনের মতিভ্রমও ঘটেছে।আর সে কারণেই না প্রাচীন যুগের নারীর অর্ধলগ্ন ভাবকে বর্তমান যুগের যুগের নগ্ন ভাবের মধ্যে একাকার করে ফেলে দুইয়ের সংঘাতে জর্জরিত করে ফেলছে নিজেদের মননকে।
কিন্তু তবুও নারীর ভূষণ যে লজ্জা এটা অবিশ্বাস্য নয়ই কোনওভাবে।কারণ নগ্নতাই হোক আর অর্ধনগ্নতাই হোক তারই মধ্যে তার গোপন সম্ভ্রম কাজ করে তা বুঝিয়ে দেয় তাদের চলন বলনে।নারীর সৌন্দর্যও তাই টিকে থাকে অলঙ্কারে সজ্জিত করে নিজেকে আভরণে আভরিত করে।তবু তারও মধ্যে লজ্জাশীলতার আভাকে স্মরণ করেই মানানসই হিসাবেই পরিহিত করে অলঙ্কার।এভাবেই যে নারী এক দুই পর্দার সংমিশ্রিত মোড়কে মুড়িয়ে নিজেকে লজ্জাশীল রূপসী,সুন্দরী হিসাবে গড়ে তোলায় সদাই পরিব্যস্ত।
এসব তো গেল অলঙ্কার আর লজ্জার দুই মেরুবিন্দুর মিলিত আকর্ষণ। কিন্তু পশ্ন জাগতেই থাকে মনের কোণে তাহলেও নারী এখনও কেন অপমানিত অবহেলিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখে। একজন নারী যদি তারই পরিবারে সমস্ত বাধা বিপত্তিকে তুচ্ছ করে নিজের চেষ্টায় মাথা তুলে দাঁড়াতে সক্ষম হয় তবুও তার নিন্দার অভাব হয় না নিন্দুকদের মুখের বাণীতে।নিজের পরিবারও কখনও কখনও ভুলে যায় নিজের পরিবারেই গড়ে ওঠা,বেড়ে ওঠা সদস্যা একজন শিক্ষিতা নারী।তারও যে মাথা তুলে,নিজের দাম্ভিকতায়,নিজের স্বসম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকার আছে এটাও ভুলে যায় পরিবার। এই পরিবারও কখনও কখনও মরিয়া হয়ে ওঠে নারী পুরুষের ভেদাভেদের মন্তব্যে তাকে বারংবার খোঁচা মারতে।মরিয়া হয়ে ওঠে তার শিক্ষিতা হয়ে ওঠার সুন্দর তকমাকে কলঙ্কিত করে দিতে।আর তাই তো জোর পূর্বক সেই নারীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয়।কেড়ে নেওয়া হয় বইয়ের স্তূপ।কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয় তার শক্ত মেরুদণ্ডের ঋজুতাকে।ভেঙে দিতে তৎপর হয় তার স্ব স্ব নারী ভূষণকে।আর সেভাবেইতো নারীকে কখনও ভাঙা হচ্ছে, কখনও গড়া হচ্ছে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষালী অস্ত্র দিয়ে।
নারীর শিক্ষাও যে নারীর ভূষণ হতে পারে একথাটাও যেন মানতে নারাজ হয়ে ওঠে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ।পুরুষতান্ত্রিক পরিবার। একজন নারী যে কতটা বিপন্ন হয়ে দূর্গম রাস্তাকে পাড়ি দিয়ে, দূর্ভেদ্য প্রাচীরকে ভেদ করে তার শিক্ষিতা স্বাবলম্বিতার তকমা অর্জন করে তা কখনও কখনও ভাবতেও ভুলে যায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষালী পরিবার। তাই সেই পরিবার শিক্ষিতই হোক আর অশিক্ষিতই হোক সেই শিক্ষিতা নারীর যোগ্য সম্মান দিতে ভুলে যায়। ভুলে যায় না কটু কথার বাণে বিদ্ধ করতে,অপমানের বাণে ভাসিয়ে দিতে।
একজন নারী শিক্ষিতা হয়ে ওঠা মানেই বলা যেতে পারে পুরো সমাজটাই তার কাছে একটা বিরাট ভূষণ হয়ে ওঠে। এককথায় পুরো লজ্জা -সম্ভ্রম,মান-মর্যাদা, ইজ্জত সবই তার ভূষণ,অলঙ্কার হয়ে ওঠে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যদি তার পুরুষালী চোখেও নারীর শিক্ষিতা হয়ে ওঠাটাকেও একটা ভূষণ হিসাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতো তাহলেই হয়তো সমাজটা পরিবর্তন হতে পারতো।পরিবর্তন হয়ে যেত শিক্ষিতা নারীই সমাজের ভূষণ, সমাজের অলঙ্কারের আড়ালে এক মহিয়সিনী।আর নারীর পুরো অলঙ্কার, ভূষণও হতো পুরো সমাজটাই। নারী পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদের বাইরে মননও মানসিকতা যদি শিক্ষিত ও অশিক্ষিত দুই বৈপরীত্যের মধ্যে সংমিশ্রণ করত তাহলেই উভয়ের মিলিত সংমিশ্রণে গড়ে উঠত সুন্দর শালীনতায় মোড়া এক ভূষণ, অলঙ্কারের আভরণে প্রকৃষ্ট শালীনতা সমৃদ্ধ সমাজ।
রুমা পারভীনারা (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)
১ Comment
দূর্দান্ত রচনাশৈলী। সময়োপযোগী আলোচনা।