২৬৬ বার পড়া হয়েছে
রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম
কাজী নজরুল ইসলাম
১
রাতের আঁচল দীর্ণ করে আসল শুভ ওই প্রভাত,
জাগো সাকি! সকাল বেলার খোয়ারি ভাঙো আমার সাথ।
ভোলো ভোলো বিষাদ-স্মৃতি! এমনি প্রভাত আসবে ঢের,
খুঁজতে মোদের এইখানে ফের, করবে করুণ নয়নপাত।
২
আঁধার অন্তরীক্ষে বুনে যখন রুপার পাড় প্রভাত,
পাখির বিলাপ-ধ্বনি কেন শুনি তখন অকস্মাৎ?
তারা যেন দেখতে বলে উজল প্রাতের আরশিতে–
ছন্নছাড়া তোর জীবনের কাটল কেমন একটি রাত!
৩
‘ঘুমিয়ে কেন জীবন কাটাস?’ কইল ঋষি স্বপ্নে মোর,
‘আনন্দ-গুল প্রস্ফুটিত করতে পারে ঘুম কি তোর?
ঘুম মৃত্যুর যমজ-ভ্রাতা, তার সাথে ভাব করিসনে,
ঘুম দিতে ঢের পাবি সময় কবরে তোর জনম-ভোর।’
৪
আমার আজের রাতের খোরাক তোর টুকটুক শিরীন ঠোঁট
গজল শোনাও, শিরাজি দাও, তন্বী সাকি জেগে ওঠ!
লাজ-রাঙা তোর গালের মত দে গোলাপি-রং শরাব,
মনে ব্যথার বিনুনি মোর খোঁপায় যেমন তোর চুনোট।
৫
প্রভাত হল। শরাব দিয়ে করব সতেজ হৃদয়-পুর,
যশোখ্যাতির ঠুনকো এ কাচ করব ভেঙে চাখনাচুর।
অনেক দিনের সাধ আশা এক নিমেষে করব ত্যাগ,
পরব প্রিয়ার বেণি বাঁধন, ধরব বেণুর বিধুর সুর।
৬
ওঠো নাচো! আমরা প্রচুর করব তারিফ মদ-অলস
ওই নার্গিস আঁখির তোমার, ঢালবে তুমি আঙুর-রস!
এমন কী আর – যদিই তাহা পান করি দশ বিশ গেলাস,
ছয় দশে ষাট পাত্র পড়লে খানিকটা হয় দিল্ সরস!
৭
তোমার রাঙা ঠোঁটে আছে অমৃত-কূপ প্রাণ-সুধার,
ওই পিয়ালার ঠোঁট যেন গো ছোঁয় না, প্রিয়া, ঠোঁট তোমার।
ওই পিয়ালার রক্ত যদি পান না করি, শাপ দিয়ো;
তোমার অধর স্পর্শ করে এত বড়ো স্পর্ধা তার!
৮
আজকে তোমার গোলাপ-বাগে ফুটল যখন রঙিন গুল
রেখো না পান পাত্র বেকার, উপচে পড়ুক সুখ ফজুল।
পান করে নে, সময় ভীষণ অবিশ্বাসী, শত্রু ঘোর,
হয়তো এমন ফুল-মাখানো দিন পাবি না আজের তুল!
৯
শরাব আনো! বক্ষে আমার খুশির তুফান দেয় যে দোল।
স্বপ্ন-চপল ভাগ্যলক্ষ্মী জাগল জাগো ঘুম-বিভোল!
মোদের শুভদিন চলে যায় পারদ-সম ব্যস্ত পায়
যৌবনের এই বহ্নি নিভে খোঁজে নদীর শীতল কোল।
১০
আমরা পথিক ধূলির পথের, ভ্রমি শুধু একটি দিন,
লাভের অঙ্ক হিসাব করে পাই শুধু দুখ, মুখ মলিন।
খুঁজতে গিয়ে এই জীবনে রহস্যেরই কূল বৃথাই
অপূর্ণ সাধ আশা লয়ে হবই মৃত্যুর অঙ্কলীন।
১১
ধরায় প্রথম এলাম নিয়ে বিস্ময় আর কৌতূহল,
তারপর – এ জীবন দেখি কল্পনা, আঁধার অতল।
ইচ্ছা থাক কি না থাক, শেষে যেতেই হবে, তাই বলি–
এই যে জীবন আসা-যাওয়া আঁধার ধাঁধার জট কেবল!
১২
রহস্য শোন সেই সে লোকের আত্মা যথায় বিরাজে,
ওরে মানব! নিখিল সৃষ্টি লুকিয়ে আছে তোর মাঝে।
তুই-ই মানুষ, তুই-ই পশু, দেব্তা দানব স্বর্গদূত,
যখন হতে চাইবি রে যা হতে পারিস তুই তা যে।
১৩
স্রষ্টা যদি মত নিতে মোর – আসতাম না প্রাণান্তেও,
এই ধরাতে এসে আবার যাবার ইচ্ছা নেই মোটেও।
সংক্ষেপে কই, চিরতরে নাশ করতাম সমূলে
যাওয়া-আসা জন্ম আমার, সে-ও শূন্য শূন্য এ-ও!
১৪
আত্মা আমার! খুলতে যদি পারতিস এই অস্থিমাস
মুক্ত পাখায় দেব্তা-সম পালিয়ে যেতিস দূর আকাশ।
লজ্জা কি তোর হল না রে, ছেড়ে তোর ওই জ্যোতির্লোক
ভিনদেশি-প্রায় বাস করতে এলি ধরায় এই আবাস?
১৫
সকল গোপন তত্ত্ব জেনেও পার্থিব এই আবহাওয়ার
মিথ্যা ভয়ের ভয় গেল না? নিত্য ভয়ের হও শিকার?
জানি স্বাধীন ইচ্ছামতো যায় না চলা এই ধরায়,
যতটুকু সময় তবু পাও হাতে, লও সুযোগ তার।
১৬
ব্যথায় শান্তি লাভের তরে থাকত যদি কোথাও স্থান
শ্রান্ত পথের পথিক মোরা সেথায় জুড়াতাম এ প্রাণ।
শীত-জর্জর হাজার বছর পরে নবীন বসন্তে
ফুলের মতো উঠতো ফুটে মোদের জীবন-মুকুল ম্লান।
১৭
বুলবুলি এক হালকা পাখায় উড়ে যেতে গুলিস্তান
দেখল হাসিখুশি-ভরা গোলাপ লিলির ফুল-বাথান।
আনন্দে সে উঠল গাহি, ‘মিটিয়ে নে সাধ এ বেলা,
ভোগ করতে এমন দিন আর পাবিনে তুই ফিরিয়ে প্রাণ!’
১৮
রূপ-মাধুরীর মাথায় তোমার য-দিন পার, লো প্রিয়া,
তোমার প্রেমিক বধূর ব্যথা হরণ করো প্রেম দিয়া।
রূপ-লাবণির সম্ভার এই রইবে না সে চিরকাল,
ফিরবে না আর তোমার কাছে যায় যদি বিদায় নিয়া।
১৯
সাকি! আনো আমার হাতে মদ-পেয়ালা, ধরতে দাও!
প্রিয়ার মতন ও মদ-মদির সুরত-ওয়ালি ধরতে দাও!
জ্ঞানী এবং অজ্ঞানীরে বেঁধে যা দেয় গাঁট-ছড়ায়,
সেই শরাবের শিকল, সাকি, আমায় খালি পরতে দাও।
২০
নীল আকাশের নয়ন ছেপে বাদল-অশ্রুজল ঝরে,
না পেলে আজ এই পানীয় ফুটত না ফুল বন ভরে।
চোখ জুড়াল আমার যেমন আজ এ ফোটা ফুলগুলি,
মোর কবরে ফুটবে যে ফুল – কে জানে হায় কার তরে!
২১
করব এতই শিরাজি পান পাত্র এবং পরান ভোর
তীব্র-মিঠে খোশবো তাহার উঠবে আমার ছাপিয়ে গোর।
থমকে যাবে চলতে পথিক আমার গোরের পাশ দিয়ে,
ঝিমিয়ে শেষে পড়বে নেশায় মাতাল-করা গন্ধে ওর।
২২
দেখতে পাবে যেথায় তুমি গোলাপ লালা ফুলের ভিড়,
জেনো, সেথায় ঝরেছিল কোনো শাহানশা-র রুধির।
নার্গিস আর গুল-বনোসার দেখবে যেথায় সুনীল দল,
ঘুমিয়ে আছে সেথায় – গালে তিল ছিল যে সুন্দরীর।
২৩
নিদ্রা যেতে হবে গোরে অনন্তকাল, মদ পিয়ো।
থাকবে নাকো সাথি সেথায় বন্ধু প্রিয় আত্মীয়।
আবার বলতে আসব না ভাই, বলছি যা তা রাখ শুনে–
ধরেছে যে ফুলের মুকুল, ফুটতে পারে আর কি ও?
২৪
বিদায় নিয়ে আগে যারা গেছে চলে, হে সাকি,
চির-ঘুমে ঘুমায় তারা মাটির তলে, হে সাকি!
শরাব আনো, আসল সত্য আমার কাছে যাও শুনে,
তাদের যত তথ্য গেল হাওয়ায় গলে, হে সাকি!
২৫
তুমি আমি জন্মিনিকো – যখন শুধু বিরামহীন
নিশীথিনীর গলা ধরে ফিরত হেথায় উজল দিন;
বন্ধু ধীরে চরণ ফেলো! কাজল-আঁখি সুন্দরীর
আঁখির তারা আছে হেথায় হয়তো ধূলির অঙ্কলীন!
২৬
প্রথম থেকেই আছে লেখা অদৃষ্টে তোর যা হবার,
তাঁর সে কলম দিয়ে – যিনি দুঃখে সুখে নির্বিকার।
স্রেফ বোকামি, কান্নাকাটি লড়তে যাওয়া তাঁর সাথে,
বিধির লিখন ললাট-লিপি টলবে না যা জন্মে আর!
২৭
ভালো করেই জানি আমি, আছে এক রহস্য-লোক,
যায় না বলা সকলকে তা ভালোই হোক কি মন্দ হোক।
আমার কথা ধোঁয়ায় ভরা, ভাঙতে তবু পারব না –
থাকি সে কোন গোপন-লোকে, দেখতে যাহা পায় না চোখ।
২৮
চলবে নাকো মেকি টাকার কারবার আর, মোল্লাজি!
মোদের আবাস সাফ করে নেয় সেয়ান-ঝাড়ুর কারসাজি।
বেরিয়ে ভাঁটি-খানার থেকে বলল হেঁকে বৃদ্ধ পির –
‘অনন্ত ঘুম ঘুমাবি কাল পান করে নে মদ আজি!’
২৯
সবকে পারি ফাঁকি দিতে মনকে নারি ঠারতে চোখ,
খোদার উপর খোদাকারিতে ব্যর্থ হয় এ মিছে স্তোক।
তীক্ষ্ণ সূক্ষ্ম বুদ্ধি দিয়ে জাল বুনিলাম চাতুর্যের,
মুহূর্তে তা দিল ছিঁড়ে হিংস্র নিয়তির সে নোখ!
৩০
মৃত্তিকা-লীন হবার আগে নিয়তির নিঠুর করে
বেঁচে নে তুই, মৃত্যু-পাত্র আসছে রে ওই তোর তরে!
হেথায় কিছু জোগাড় করে নে রে, হোথায় কেউ সে নাই
তাদের তরে – শূন্য হাতে যায় যাহারা সেই ঘরে।
৩১
বলতে পার, অসার-শূন্য ভবের হাটের এই ঘরে
জ্ঞান-বিলাসী সুধীজনের হৃদয় কেন রয় পড়ে?
যেই তাহারা শ্রান্ত হয়ে এই সে ঘরের শান্তি চায়,
‘সময় হল, চল ওরে’, কয় অমনি মরণ হাত ধরে!
৩২
খাজা! তোমার দরবারে মোর একটি শুধু আর্জি এই–
থামাও উপদেশের ঘটা, মুক্তি আমার এই পথেই।
দৃষ্টি-দোষে দেখছ বাঁকা আমার সোজা সরল পথ,
আমায় ছেড়ে ভালো করো ঝাপসা তোমার চক্ষুকেই।
৩৩
কাল কী হবে কেউ জানে না, দেখছ তো হায়, বন্ধু মোর!
নগদ মধু লুঠ করে লও, মোছো মোছো অশ্রু-লোর।
চাঁদনি-তরল শরাব পিয়ো, হায়, সুন্দর এই সে চাঁদ
দীপ জ্বালিয়ে খুঁজবে বৃথাই কাল এ শূন্য ধরার ক্রোড়।
৩৪
প্রেমিকরা সব আমার মতো মাতুক প্রেমের মত্ততায়,
দ্রাক্ষা-রসের দীক্ষা নিয়ে আচার-নীতি দলুক পায়।
থাকি যখন সাদা চোখে, সব কথাতে রুষ্ট হই,
শরাব পিয়ে দিল-দরিয়া উড়িয়ে দি ভয়-ভাবনায়।
৩৫
মানব দেহ – রঙে-রূপে এই অপরূপ ঘরখানি–
স্বর্গের সে শিল্পী কেন করল সৃজন কী জানি,
এই ‘লাল-রুখ’ বল্লি-তনু ফুল-কপোল তন্বীদের
সাজাতে হায় ভঙ্গুর এই মাটির ধরার ফুলদানি!
৩৬
তিন ভাগ জল এক ভাগ থল এই পৃথিবীর এও মায়া,
এই ধরাতে দেখছ যা তার সকল-কিছু সব মায়া,
এই যে তুমি বলছ যা সব, শুনছ কলরব – মায়া।
গোপন প্রকাশ সত্য মিথ্যা এ সব অবাস্তব মায়া।
৩৭
দোষ দেয় আর ভর্ৎসে সবাই আমার পাপের নাম নিয়া,
আমার দেবী-প্রতিমারে পূজি তবু প্রাণ দিয়া।
মরতে যদি হয় গো আমায় শরাব-পানের মজলিশে–
স্বর্গ-নরক সমান, পাশে থাকবে শরাব আর প্রিয়া।
৩৮
মুসাফিরের এক রাত্রির পান্থ-বাস এ পৃথ্বীতল–
রাত্রি-দিবার চিত্র-লেখা চন্দ্রাতপ আঁধার-উজল।
বসল হাজার জামশেদ ওই উৎসবেরই আঙিনায়
লাখ বাহ্রাম এই আসনে বসে হল বেদখল।
৩৯
কারুর প্রাণে দুখ দিয়ো না, করো বরং হাজার পাপ,
পরের মনে শান্তি নাশি বাড়িয়ো না তার মনস্তাপ।
অমর-আশিস লাভের আশা রয় যদি, হে বন্ধু মোর,
আপনি সয়ে ব্যথা, মুছো পরের বুকের ব্যথার ছাপ।
৪০
ছেড়ে দে তুই নীরস বাজে দর্শন আর শাস্ত্রপাঠ,
তার চেয়ে তুই দর্শন কর প্রিয়ার বিনোদ বেণির ঠাট;
ওই সোরাহির হৃদয়-রুধির নিষ্কাশিয়া পাত্রে ঢাল,
কে জানে তোর রুধির পিয়ে কখন মৃত্যু হয় লোপাট।
৪১
অজ্ঞানেরই তিমির-তলের মানুষ ওরে বে খবর!
শূন্য তোরা, বুনিয়াদ তোর গাঁথা শূন্য হাওয়ার পর।
ঘুরিস অতল অগাধ খাদে, শূন্য মায়ার শূন্যতায়,
পশ্চাতে তোর অতল শূন্য, অগ্রে শূন্য অসীম চর।
৪২
লয়ে শরাব-পাত্র হাতে পিই যবে তা মস্ত হয়ে
জ্ঞানহারা হই সেই পুলকের তীব্র-ঘোর বেদন সয়ে,
কী যেন এক মন্ত্রবলে যায় ঘটে কী অলৌকিক,
প্রোজ্জ্বল মোর জ্ঞান গলে, যায় ঝরনাসম গান বয়ে।
৪৩
‘শরাব ভীষণ খারাপ জিনিস মদ্যপায়ীর নেইকো ত্রাণ।’
ডাইনে বাঁয়ে দোষদর্শী সমালোচক ভয় দেখান –
সত্য কথাই! যে আঙুরে নষ্ট করে ধর্মমত,
সবার উচিত – নিঙড়ে ওরে করে উহার রক্ত পান!
৪৪
আমার কাছে শোন উপদেশ – কাউকে কভু বলিসনে–
মিথ্যা ধরায় কাউকে প্রাণের বন্ধু মেনে চলিসনে!
দুঃখ ব্যথায় টলিসনে তুই, খুঁজিসনে তার প্রতিষেধ,
চাসনে ব্যথার সমব্যথী, শির উঁচু রাখ ঢলিসনে!
৪৫
মউজ চলুক! লেখার যা তা লিখল ভাগ্য কালকে তোর,
ভুলেও কেহ পুঁছল নাকি থাকতে পারে তোর ওজর !
ভদ্রতারও অনুমতি কেউ নিল না অমনি ব্যস
ঠিক ঠাক সব হয়ে গেল ভুগবি কেমন জীবন-ভোর!
৪৬
আমি চাহি স্রষ্টা আবার সৃজন করুন শ্রেষ্ঠতর
আমি চাহি স্রষ্টা আবার সৃজন করুন শ্রেষ্ঠতর
সেই সাথে চাই – সৃষ্টি-খাতায় দিক কেটে সে আমার নাম,
কিংবা আমার যা প্রয়োজন তা মিটাবার দিক সে বর।
৪৭
নাস্তিক আর কাফের বলো তোমরা লয়ে আমার নাম,
কুৎসা গ্লানির পঙ্কিল স্রোত বহাও হেথা অবিশ্রাম।
অস্বীকার তা করব না যা ভুল করে যাই, কিন্তু ভাই,
কুৎসিত এই গালি দিয়েই তোমরা যাবে স্বর্গধাম?
৪৮
বদখশানী রক্ত-চুনির মতন সুরা চুঁইয়ে আন
তপ্তহিয়ার আনন্দ যা, শান্ত যাহে দগ্ধ প্রাণ।
মুসলমানের তরে শরাব হারাম নাকি, সবাই কয়,
বলতে পারে তাদের কেহ – আছে কি আর মুসলমান?
৪৯
মসজিদ মন্দির গির্জায় ইহুদ-খানায় মাদ্রাসায়
রাত্রি-দিবস নরক-ভীতি স্বর্গ সুখের লোভ দেখায়।
ভেদ জানে আর খোঁজ রাখে ভাই খোদার যারা রহস্যের
ভোলে না এই খোশ-গল্পের ঘুম-পাড়ানো কল্পনায়।
৫০
এক হাতে মোর তসবি খোদার, আর-হাতে মোর লাল গেলাস,
অর্ধেক মোর পুণ্য-স্নাত, আধেক পাপে করল গ্রাস।
পুরোপুরি কাফের নহি, নহি খাঁটি মুসলমানও–
করুণ চোখে হেরে আমায় তাই ফিরোজা নীল আকাশ।
৫১
একমনি ওই মদের জালা গিলব, যদি পাই তাকে,
যে জালাতে প্রাণের জ্বালা নেভাবার ওষুধ থাকে!
পুরানো ওই যুক্তি তর্কে দিয়ে আমি তিন তালাক,
নতুন করে করব নিকাহ্ আঙুর-লতার কন্যাকে।
৫২
বিষাদের ওই সওদা নিয়ে বেড়িয়ো না ভাই শিরোপরি,
আঙুর-কন্যা সুরার সাথে প্রেম করে যাও প্রাণ ভরি!
নিষিদ্ধা ওই কন্যা, তবু হোক সে যতই অ-সতী,
তাহার সতী মায়ের চেয়ে ঢের বেশি সে সুন্দরী!
৫৩
স্বর্গে পাব শরাব-সুধা, এ যে কড়ার খোদ খোদার,
ধরায় তাহা পান করলে পাপ হয়, এ কোন বিচার?
‘হামজা’ সাথে বেয়াদবি করল মাতাল এক আরব–
তুচ্ছ কারণ – শরাব হারাম তাই হুকুমে ‘মোস্তফার’।
৫৪
‘রজব শাবান পবিত্র মাস’ বলে গোঁড়া মুসলমান,
‘সাবধান, এই দু-মাস ভাই কেউ করো না শারাব পান।’
খোদা এবং তার রসুলের ‘রজব’ ‘শাবান’ এই দু-মাস
পান-পিয়াসীর তরে তবে সৃষ্ট বুঝি এ ‘রমজান’?
৫৫
শুক্রবার আজ, বলে সবাই পবিত্র নাম জুম্মা যার,
হাত যেন ভাই খালি না যায়, শরাব চলুক আজ দেদার।
এক পেয়ালি শরাব যদি পান করো ভাই অন্যদিন,
দু-পেয়ালি পান করো আজ বারের বাদশা জুম্মা বার!
৫৬
মসজিদের অযোগ্য আমি, গির্জার আমি শত্রু-প্রায়,
ওগো প্রভু, কোন মাটিতে করলে সৃজন এই আমায়?
সংশয়াত্মা সাধু কিংবা ঘৃণ্য নগর-নারীর তুল
নাই স্বর্গের আশা আমার, শান্তি নাহি এই ধরায়।
৫৭
মুগ্ধ করো নিখিল-হৃদয় প্রেম-নিবেদন কৌশলে
হৃদয়জয়ী হে বীর, উড়াও নিশান প্রিয়ার অঞ্চলে।
এক হৃদয়ের সমান নহে লক্ষ ম-জিদ আর ‘কাবা’;
কী হবে তোর তীর্থে ‘কাবা’র শান্তি খোঁজ হৃদয় তলে।
৫৮
বিধর্মীদের ধর্মপথে আসতে লাগে এক নিমেষ,
সন্দেহেরই বিপথ-ফেরত বিবেক জাগে এক নিমেষ।
দুর্লভ এই নিমেষটুকু ভোগ করে নাও প্রাণ ভরে,
এই ক্ষণিকের আয়েস দিয়ে জীবন ভাসে এক নিমেষ।
৫৯
হৃদয় যাদের অমর প্রেমের জ্যোতির্ধারায় দীপ্তিমান,
মসজিদ মন্দির গির্জা, যথাই করুক অর্ঘ্য দান–
প্রেমের খাতায় থাকে লেখা অমর হয়ে তাদের নাম,
স্বর্গের লোভ ও নরক-ভীতির ঊর্ধ্বে তারা মুক্ত-প্রাণ।
৬০
মদ পিয়ো আর ফুর্তি করো – আমার সত্য আইন এই!
পাপ পুণ্যের খোঁজ রাখি না – স্বতন্ত্র মোর ধর্ম সেই।
ভাগ্য সাথে বিয়ের দিনে কইনু, ‘দিবি কি যৌতুক?’
কইল বধূ, ‘খুশি থাকো, তার বড়ো যৌতুক সে নেই!’
৬১
এক সোরাহি সুরা দিয়ো, একটু রুটির ছিলকে আর
প্রিয়া সাকি, তাহার সাথে একখানি বই কবিতার,
জীর্ণ আমার জীবন জুড়ে রইবে প্রিয়া আমার সাথ,
এই যদি পাই চাইব নাকো তখ্ত আমি শাহানশার!
৬২
হুরি বলে থাকলে কিছু – একটি হুরি, মদ খানিক,
ঘাস-বিছানো ঝরনাতীরে, অল্প-বয়েস বৈতালিক–
এই যদি পাস, স্বর্গ নামক পুরনো সেই নরকটায়
চাসনে যেতে, স্বর্গ ইহাই স্বর্গ যদি থাকেই ঠিক।
৬৩
যতক্ষণ এ হাতের কাছে আছে অঢেল লাল শরাব
গেহুঁর রুটি, গরম কোরমা, কালিয়া আর শিক-কাবাব,
আর লাল-রুখ প্রিয়া আমার কুটির-শয়ন-সঙ্গিনী, –
কোথায় লাগে শাহানশাহের দৌলত ওই বে-হিসাব!
৬৪
দোষ দিয়ো না মদ্যপায়ীর তোমরা, যারা খাও না মদ;
ভালো করার থাকলে কিছু, মদ খাওয়া মোর হত রদ।
মদ না পিয়েও, হে নীতিবিদ, তোমরা যেসব কর পাপ,
তাহার কাছে আমরাও শিশু, হই না যতই মাতাল-বদ!
৬৫
খুশি-মাখা পেয়ালাতে ওই গোলাপ-রক্ত মদ-মধুর!
মধুরতর পাখির গীতি, বেণুর ধ্বনি, বীণার সুর।
কিন্তু ওই যে ধর্মগোঁড়া – বুঝল না যে মদের স্বাদ,
মধুরতম – রয় সে যখন অন্তত পাঁচ যোজন দূর!
৬৬
চৈতি-রাতে খুঁজে নিলাম তৃণাস্তৃত ঝরনা-তীর,
সুন্দরী এক হুরি নিলাম, পেয়ালা নিলাম লাল পানির।
আমার নামে বইল হাজার কুৎসা গ্লানির ঝড় তুফান,
ভুলেও মনে হল না মোর স্বর্গ নরকের নজির।
৬৭
সাকি-হীন ও শরাব-হীনের জীবনে হায় সুখ কী বলো?
নাই ইরাকি-বেণুর ধ্বনির জমজমাটি সুর-উছল
সুখ নাই ভাই সেথায় থেকে, এই জগতের তত্ত্ব শোনো,
আনন্দহীন জীবন-বাগে ফলে শুধু তিক্ত ফল।
৬৮
মরুর বুকে বসাও মেলা, উপনিবেশ আনন্দের,
একটি হৃদয় খুশি করা তাহার চেয়ে মহৎ ঢের।
প্রেমের শিকল পরিয়ে যদি বাঁধতে পার একটি প্রাণ–
হাজার বন্দি মুক্ত করার চেয়েও অধিক পুণ্য এর।
৬৯
শরাব এবং প্রিয়ায় নিয়ে, সাকি, হেথায় এলাম ফের!
তৌবা করেও পাইনে রেহাই হাত হতে ভাই এই পাপের।
‘নূহ’ আর তাঁর প্লাবন-কথা শুনিয়ো নাকো আর, সাকি,
তার চেয়ে মদ-প্লাবন এনে ডুবাও ব্যথা মোর বুকের!
৭০
নৃত্য-পাগল ঝরনাতীরে সবুজ ঘাসের ওই ঝালর
উন্মুখ কার চুমো যেন দেবকুমারের ঠোঁটের পর –
হেলায় পায়ে দলো না কেউ – এই যে সবুজ তৃণের ভিড়
হয়তো কোনো গুল-বদনীর কবর-ঢাকা নীল চাদর।
৭১
আমার ক্ষণিক জীবন হেথায় যায় চলে ওই ত্রস্ত পায়
খরস্রোতা স্রোতস্বতী কিংবা মরুঝঞ্ঝা-প্রায়।
তারই মাঝে এই দু-দিনের খোঁজ রাখি না – ভাবনা নাই,
যে গতকাল গত, আর যে আগামীকাল আসতে চায়।
৭২
আর কতদিন সাগরবেলায় খামকা বসে তুলব ইঁট!
গড় করি পায়, দিক লেগেছে গড়ে গড়ে মূর্তি পীঠ।
ভেবো নাকো – খৈয়াম ওই জাহান্নমের বাসিন্দা,
ভিতরে সে স্বর্গ-চারী, বাহিরে সে নরক-কীট।
৭৩
মধুর, গোলাপ-বালার গালে দখিন হাওয়ার মদির শ্বাস,
মধুর তোমার রূপের কুহক মাতায় যে এই পুষ্প-বাস।
যে গেছে কাল গেছে চলে এল না তার ম্লান স্মৃতি,
মধুর আজের কথা বলো, ভোগ করে নাও এই বিলাস।
৭৪
শীত ঋতু ওই হল গত বইছে বায় বসন্তেরই,
জীবন-পুথির পাতাগুলি পড়বে ঝরে, নাই দেরি।
ঠিক বলেছেন দরবেশ এক, ‘দূষিত বিষ এই জীবন,
দ্রাক্ষার রস বিনা ইহার প্রতিষেধক নাই, হেরি।’
৭৫
‘সরো’র মতন সরল-তনু টাটকা-তোলা গোলাপ-তুল,
কুমারীদের সঙ্গে নিয়ে আনন্দে তুই হ মশগুল!
মৃত্যুর ঝড় উঠবে কখন, আয়ুর পিরান ছিঁড়বে তোর–
পড়ে আছে ধুলায় যেমন ওই বিদীর্ণ-দল মুকুল!
৭৬
পল্লবিত তরুলতা কতই আছে কাননময়,
দেওদার আর থলকমলে, জান কেন মুক্ত কয়?
দেবদারু তরুর শত কর, তবু কিছু চায় না সে
থলকমলীর দশ রসনা তবু সদা নীরব রয়।
৭৭
আমার সাথি সাকি জানে মানুষ আমি কোন জাতের ;
চাবি আছে তার আঁচলে আমার বুকের সুখ দুখের।
যেমনি মেজাজ মিইয়ে আসে গেলাস ভরে দেয় সে মদ,
এক লহমায় বদলে গিয়ে দূত হয়ে যাই দেবলোকের।
৭৮
আরাম করে ছিলাম শুয়ে নদীর তীরে কাল রাতে,
পার্শ্বে ছিল কুমারী এক, শরাব ছিল পিয়ালাতে ;
স্বচ্ছ তাহার দীপ্তি হেরি শুক্তি-বুকে মুক্তাপ্রায়
উঠল হেঁকে প্রাসাদরক্ষী, ‘ভোর হল কি আধ-রাতে?’
৭৯
মন কহে, আজ ফুটল যখন এন্তার ওই গোলাপ গুল
শরিয়তের আজ খেলাফ করে বেদম আমি করব ভুল।
গুল-লালা-রুখ কুমারীদের প্রস্ফুটিত যৌবনে
উঠল রেঙে কানন-ভূমি লালা ফুলের কেয়ারি-তুল।
৮০
হায় রে, আজি জীর্ণ আমার কাব্য পুথি যৌবনের!
ধুলায় লুটায় ছিন্ন ফুলের পাপড়িগুলি বসন্তের।
কখন এসে গেলি উড়ে, রে যৌবনের বিহঙ্গম!
জানতে পেরে কাঁদছি যখন হয়ে গেছে অনেক দের!
৮১
আজ আছে তোর হাতের কাছে, আগামী কাল হাতের বার,
কালের কথা হিসাব করে বাড়াসনে তুই দুঃখ আর।
স্বর্গ-ক্ষরা ক্ষণিক জীবন – করিসনে তার অপব্যয়,
বিশ্বাস কি – নিশ্বাস-ভর জীবন যে কাল পাবি ধার!
৮২
হায় রে হৃদয়, ব্যথায় যে তোর ঝরছে নিতুই রক্তধার,
অন্ত যে নেই তোর এ ভাগ্য-বিপর্যয়ের, যন্ত্রণার!
মায়ায় ভুলে এই সে কায়ায় আসলি কেন, রে অবোধ!
আখেরে যে ছেড়ে যেতে হবে এ আশ্রয় আবার!
৮৩
অর্থ বিভব যায় উড়ে সব রিক্ত করে মোদের কর,
হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে মোদের মৃত্যুর নিষ্ঠুর নখর,–
মৃত্যুলোকের চোখ এড়িয়ে ফেরত কেহ আসল না,
যেসব পথিক গেল সেথায় নিয়ে তাদের খোশখবর।
৮৪
পান করে যাই মদিরা তাই, শুনছি প্রাণের বেণুর রব,
শুনছি আমার তনুর তীরে যৌবনেরই মদির স্তব,
তিক্ত স্বাদের তরে সুরার করো না কেউ তিরস্কার,
ত্যক্ত মানব-জীবন সাথে মানায় ভালো তিক্তাসব।
৮৫
ব্যথার দারু শরাব পিয়ো, ইহাই জীবন চিরন্তন,
জরায় স্বর্গ-অমৃত এ, যৌবনের এ সুখ-স্বপন।
গোলাপ, শরাব, বন্ধু লাভের মরশুম এই আনন্দের–
যদিন বাঁচ শরাব পিয়ো, সত্যিকারের এই জীবন।
৮৬
সুরা দ্রবীভূত চুনি, সোরাহি সে খনি তার,
এই পিয়ালা কায়া যেন, প্রাণ তার এই দ্রাক্ষাসার।
বেলোয়ারির এই পিয়ালা-ভরা তরল হাসির রক্তিমা,
কিংবা ওরা ব্যথায়-ক্ষত হিয়ার যেন রক্তাধার।
৮৭
সুরার সোরাহি এই মানুষ, আত্মা শরাব তার ভিতর,
দেহ তাহার বাঁশির আর তেজ যেন সেই বাঁশির স্বর।
খৈয়াম! তুই জানিস কি এই মাটির মানুষ কোন জিনিস?
খেয়াল-খুশির ফানুস এ ভাই, ভিতরে তার প্রদীপ-কর।
৮৮
ব্যর্থ মোদের জীবনঘেরা কুগ্রহ সব মেঘলা প্রায়,
‘জিহূন’ সম স্রোত বয়ে যায় অশ্রুসিক্ত চক্ষে হায়!
বুকের কুণ্ডে দুখের দাহ – তারেই আমি নরক কই,
মুহূর্তের যে মনের শান্তি – আমি বলি স্বর্গ তায়।
৮৯
মদের নেশার গোলাম আমি সদাই থাকি নুইয়ে শির,
জীবন আমি পণ রাখি ভাই প্রসাদ পেতে তার হাসির।
শরাব-ভরা কুঁজোর টুটি জাপটে সাকি হস্তে তার
পাত্রে ঢালে, নিঠুর হাতে নিঙড়ে তাহার লাল রুধির!
৯০
পেতে যে চায় সুন্দরীদের ফুল্ল-কপোল গোলাপ ফুল
কাঁটার সাথে সইতে হবে তায় নিয়তির তীক্ষ্ণ হুল।
নিঠুর করাত চিরুনিরে কেটে কেটে তুলল দাঁত
তাই সে ছুঁয়ে ধন্য হল আমার প্রিয়ার কেশ আকুল।
৯১
শরাব নিয়ে বসো, ইহাই মহ্মুদেরই সুলতানৎ,
‘দাউদ’ নবির শিরীন-স্বর ওই বেণু-বীণার মধুর গত।
লুট করে নে আজের মধু, পূর্ণ হবে মনস্কাম,
আজকে পেয়ে ভুলে যা তুই অতীত আর ভবিষ্যৎ।
৯২
ওগো সাকি! তত্ত্বকথা চার ও পাঁচের তর্ক থাক,
উত্তর ওই সমস্যার গো এক হোক কী একশো লাখ!
আমরা মাটির, সত্য ইহাই, বেণু আনো, শোনাও সুর!
আমরা হাওয়া, শরাব আনো! বাকি যা সব চুলোয় যাক।
৯৩
এক নিশ্বাস প্রশ্বাসের এই দুনিয়া রে ভাই, মদ চালাও!
কালকে তুমি দেখবে না আর আজ যে জীবন দেখতে পাও।
খামখেয়ালির সৃষ্টি এ ভাই কালের হাতে লুঠের মাল,
তুমিও তোমার আপনাকে এই মদের নামে লুটিয়ে দাও!
৯৪
কায়কোবাদের সিংহাসন আর কায়কাউসের রাজমুকুট,
তুসের রাজ্য একছিটে এই মদের কাছে সব যে ঝুট!
ধর্ম-গোঁড়ার উপাসনার কর্কশ যে প্রভাত-স্তব
তাহার চেয়ে অনেক মধুর প্রেমিক-জনের শ্বাস অফুট।
৯৫
এই যে প্রমোদ-ভবন যেথায় জলসা ছিল বাহরামের,
হরিণ সেথায় বিহার করে, আরাম করে ঘুমায় শের!
চিরজীবন করল শিকার রাজশিকারি যে বাহ্রাম,
মৃত্যু-শিকারির হাতে সে শিকার হল হায় আখের।
৯৬
ঘরে যদি বসিস গিয়ে ‘জমহুর’ আর ‘আরাস্তু’র,
কিংবা রুমের সিংহাসনে কায়সর হস শক্তি-শূর–
জামশেদিয়া জামবাটি ওই যে শুষে রে, সময় নাই,
বাহ্রামও তুই হস যদি, তোর শেষ তো গোর আঁধারপুর!
৯৭
প্রেমের চোখে সুন্দর সেই হোক কালো কি গৌর-বরন,
পরুক ওড়না রেশমি কিংবা পরুক জীর্ণ দীন বসন।
থাকুক শুয়ে ধুলোয় সে কি থাকুক সোনার পালঙ্কে,
নরকে সে গেলেও প্রেমিক করবে সেথায় অন্বেষণ।
৯৮
খৈয়াম – যে জ্ঞানের তাঁবু করল সেলাই আজীবন,
অগ্নিকুণ্ডে পড়ে সে আজ সইছে দহন অসহন।
তার জীবনে সূত্রগুলি মৃত্যু-কাঁচি কাটল, হায়!
ঘৃণার সাথে বিকায় তারে তাই নিয়তির দালালগণ!
৯৯
সাত-ভাঁজ ওই আকাশ এবং চার উপাদান-সৃষ্ট জীব!
ওই এগারোর মারপ্যাঁচে সব ধোয়াস গলিস, বদ-নসিব।
যে যায় সে যায় চিরতরে, ফেরত সে আর আসবে না,
পান করে নে বলব কত, বলে বলে ক্লান্ত জিভ!
১০০
খরাব হওয়ার শরাব-খানায় ছুটছি আমি আবার আজ,
রোজ পাঁচবার আজান শুনি, পড়তে নাহি যাই নামাজ!
যেমনি দেখি উদগ্রীব ওই মদের কুঁজো, অমনি ভাই–
কুঁজোর মতোই উদগ্রীব হই, কন্ঠ সটান হয় দরাজ।
১০১
এই কুঁজো – যা আমার মতো ভোগ করেছে প্রেম-দাহন,
সুন্দরীদের মাথায় থাকি পেল খোঁপার পরশন।
এই সোরাহির পার্শ্বদেশ এই যে হাতল দেখতে পাও,
পেল কতই তন্বঙ্গীর ক্ষীণ কাঁকালের আলিঙ্গন!
১০২
দ্রাক্ষা সাথে ঢলাঢলির এই তো কাঁচা বয়স তোর,
বৎস, শরাব-পাত্র নিয়ে ঠায় বসে দাও আড্ডা জোর।
একবার তো নূহের বন্যা ভাসিয়েছিল জগৎখান,
তুইও না হয় ভাসিয়ে দিলি মদের স্রোতে জীবন তোর!
১০৩
সাবধান! তুই বসবি যখন শরাব পানের জলসাতে,
মদ খাসনে বদমেজাজি নীচ কুৎসিত লোক সাথে।
রাত্তির ভর করবে সে নীচ চিৎকার আর গণ্ডগোল,
ইতর সম চেঁচিয়ে কারণ দর্শাবে ফের সে প্রাতে।
১০৪
যদিও মদ নিষিদ্ধ ভাই, যত পার মদ চালাও,
তিনটি কথা স্মরণে রেখে ; কাহার সাথে মদ্য খাও?
মদ-পানের কি যোগ্য তুমি? কী মদই বা করছ পান?
জ্ঞান পেকে না ঝুনো হলে মদ খেয়ো না এক ফোঁটাও!
১০৫
তোমরা – যারা পান কর মদ আর সব দিন, কিন্তু যা
পান কর না শুক্রবারে, ছোঁও না শরাবের কুঁজা–
তাদের বলি – আমার মতো সব বারকে সমান জান,
খোদার তোরা পূজারি হ, করিস নাকো বার পূজা।
১০৬
করছে ওরা প্রচার – পাবি স্বর্গে গিয়ে হুরপরি,
আমার স্বর্গ এই মদিরা, হাতের কাছের সুন্দরী।
নগদা যা পাস তাই ধরে থাক, ধারের পণ্য করিসনে,
দূরের বাদ্য মধুর শোনায় শূন্য হাওয়ায় সঞ্চরি।
১০৭
এই যে আঁধার প্রহেলিকা পারবিনে তুই পড়তে মন!
তুই কি সফল হবি যথায় হার মেনেছে বিজ্ঞজন?
শরাব এবং পেয়ালা নিয়ে খুশির স্বর্গ রচ হেথাই–
পাবি কি না পাবি বেহেশত, বলতে পারে কেউ কখন?
১০৮
দোহাই! ঘৃণায় ফিরিয়ো না মুখ দেখে শরাব-খোর গোঁয়ার
যদিও সাধু সজ্জনেরই সঙ্গে কাটে কাল তোমার।
শরাব পিয়ো, কারণ শরাব পান কর আর না-ই কর,
ভাগ্যে ধার্য থাকলে নরক যায় না পাওয়া স্বর্গ আর।
১০৯
জীবন যখন কন্ঠাগত – সমান বলখ নিশাপুর,
পেয়ালা যখন পূর্ণ হল – তিক্ত হোক কি হোক মধুর!
ফুর্তি চালাও, নিভে যাবে হাজার তপন লক্ষ চাঁদ,
আমরা ফিরে আসব না আর এই ধরণির পথ সুদূর!
১১০
আয় ব্যয় তোর পরীক্ষা কর ঠিক সে হিসাব করতে পেশ,
আসার বেলায় আনলি কী আর নিয়েই বা কী যাস সে দেশ।
‘আনব নাকো বিপদ ডেকে শরাব পিয়ে’ কস যে তুই,
মদ খাও আর না খাও তবু মরতে তোমায় হবেই শেষ।
১১১
হঠাৎ সেদিন দেখলাম, এক কর্মরত কুম্ভকার,
করছে চূর্ণ মাটির ঢেলা, ঘট তৈরির মাল দেদার।
দিব্য দৃষ্টি দিয়ে এসব যেই দেখলাম, কইল মন,
নূতন ঘট এ করছে সৃজন মাটিতে মোর বাপ দাদার।
১১২
একী আজব করছ সৃষ্টি, কুম্ভকার হে, হাত থামাও!
চূর্ণ নরের মাটি নিয়ে করছ কী তা দেখতে পাও?
কায়খসরুর হৃদয় এবং ফরীদুনের অঙ্গুলি
বে-পরোয়া হয়ে তোমার নিঠুর চাকায় মিশিয়ে যাও!
১১৩
চূর্ণ করে তোমায় আমায় গড়বে কুঁজো কুম্ভকার,
ওগো প্রিয়া! পার হবার সে আগেই মৃত্যু-খিড়কি-দ্বার–
পাত্রে ব্যথার শান্তি ঢালো – এই সোরাহির লাল সুরা,
এক পেয়ালা তুমি পিয়ো, আমায় দিয়ো পেয়ালা আর।
১১৪
এই যে রঙিন পেয়ালাগুলি নিজ হাতে যে গড়ল সে
ফেলবে ভেঙে খেয়াল-খুশির লীলায় এদের বিন-দোষে?
এতগুলি সুষ্ঠু শোভন চটুল আঁখি চন্দ্রমুখ
প্রীতির ভরে সৃষ্টি করে করবে ধ্বংস ক্রোধবশে?
১১৫
পিয়ালাগুলি তুলে ধরো চৈত্রী লালা ফুলের প্রায়
ফুরসুত তোর থাকলে, নিয়ে বস লালা-রুখদিল প্রিয়ায়।
মউজ করে শরাব পিয়ো, গ্রহের ফেরে হয়তো ভাই
উলটে দেবে পেয়ালা সুখের হঠাৎ-আসা ঝঞ্ঝাবায়।
১১৬
মসজিদ আর নামাজ রোজার থামাও থামাও গুণ গাওয়া,
যাও, গিয়ে খুব শরাব পিয়ো, যেমন করেই যাক পাওয়া!
খৈয়াম, তুই পান করে যা, তোর ধূলিতে কোন একদিন
তৈরি হবে পিয়ালা, কুঁজো, গাগরি, গেলাস মদ-খাওয়া।
১১৭
মৃত্যু যেদিন নিঠুর পায়ে দলবে আমার এই পরান,
আয়ুর পালক ছিন্ন করি করবে হৃদয়-রক্ত পান,
আমায় মাটির ছাঁচে ঢেলে পেয়ালা করে ঢালবে মদ,
হয়তো গন্ধে সেই শরাবের আবার হব আয়ুষ্মান!
১১৮
রে নির্বোধ! এ ছাঁচে-ঢালা মাটির ধরা শূন্য সব,
রং-বেরং-এর খিলান-করা এই যে আকাশ – অবাস্তব।
এই যে মোদের আসা-যাওয়া জীবন-মৃত্যু-পথ দিয়ে,
একটি নিশাস ইহার আয়ু, আকাশ-কুসুমের এ টব।
১১৯
তিরস্কার আর করবে কত জ্ঞান-দাম্ভিক অর্বাচীন?
লম্পট নই, পান যদিও করি শরাব রাত্রিদিন!
তোমার কাছে তসবি দাড়ি, তাপস সাজার নানান মাল,
আমার পুঁজি দিল্-প্রিয়া আর লাল পেয়ালি মদ-রঙিন!
১২০
মসজিদের ওই পথে ছুটি প্রায়ই আমি ব্যাকুল প্রাণ,
নামাজ পড়তে নয় তা বলে, খোদার কসম! সত্যি মান
নামাজ পড়ার ভান করে যাই করতে চুরি জায়নামাজ ,
যেই ছিঁড়ে যায় সেখানা, যাই করতে চুরি আরেকখান।
১২১
নিত্য দিনে শপথ করি – করব তৌবা আজ রাতে,
যাব না আর পানশালাতে, ছোঁব না আর মদ হাতে।
অমনি আঁখির আগে দাঁড়ায়ে গোলাপ-ব্যাকুল বসন্ত
সকল শপথ ভুল হয়ে যায়, কুলোয় না আর তৌবাতে।
১২২
আগে যে সব সুখ ছিল, আজ শুনি তাদের নাম কেবল,
মদ ছাড়া সব গেছে ছেড়ে আগের ইয়ার বন্ধুদল।
কেমন করে ছাড়ব – যে মদ আমায় কভু ছাড়ল না,
এক পেয়ালা আনন্দ, তাও ছাড়লে কীসে বাঁচব বল!
১২৩
আমরা শরাব পান করি তাই শ্রীবৃদ্ধি ওই পানশালার,
এই পাপীদের পিঠ আছে তাই স্থান হয়েছে পাপ রাখার।
আমরা যদি পাপ না করি ব্যর্থ হবে তাঁর দয়া,
পাপ করি তাই ক্ষমা করে করুণাময় নাম খোদার!
১২৪
তোমার দয়ার পিয়ালা প্রভু উপচে পড়ুক আমার পর,
নিত্য ক্ষুধার অন্ন পেতে না যেন হয় পাততে কর।
তোমরা মদে মস্ত করো আমার ‘আমি’র পাই সীমা,
দুঃখে যেন শির না দুখায়, হে দুখ-হর অতঃপর!
১২৫
আমায় সৃজন করার দিনে জানত খোদা বেশ করেই,
ভাবীকালের কর্ম আমার, বলতে পারত মুহূর্তেই।
আমি যেসব পাপ করি – তা ললাট-লেখা, তাঁর নির্দেশ,
সেই সে পাপের শাস্তি নরক – কে বলবে ন্যায় বিচার এই!
১২৬
দুঃখে আমি মগ্ন প্রভু, দুয়ার খোলো করুণার!
আমায় করো তোমার জ্যোতি, অন্তর মোর অন্ধকার।
স্বর্গ যদি অর্জিতে হয় এতই পরিশ্রম করে –
সে তো আমার পারিশ্রমিক, নয় সে দয়ার দান তোমার।
১২৭
দয়ার তরেই দয়া যদি, করুণাময় স্রষ্টা হন,
আদমেরে স্বর্গ হতে দিলেন কেন নির্বাসন?
পাপীর তরে করুণা যে – করুণা সে-ই সত্যিকার,
তারে আবার প্রসাদ কে কয় পুণ্য করে যা অর্জন!
১২৮
আড্ডা আমার এই যে গুহা, মদ চোলাই-এর এই দোকান,
বাঁধা রেখে আত্মা-হৃদয় করি হেথায় শরাব পান।
আরাম-সুখের কাঙাল নহি, ভয় করি না দুর্দশায়,
এই ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুতের ঊর্ধ্বে ফিরি মুক্ত-প্রাণ।
১২৯
দেখে দেখে ভণ্ডামি সব হৃদয় বড়ো ক্লান্ত ভাই!
তুরন্ত শরাব আনো সাকি, ভণ্ডের মুখ ভুলতে চাই!
শরাব আনো বাঁধা রেখে এই টুপি এই জায়নামাজ,
হব বক-ধার্মিক কাল, আজ তো এখন মদ চালাই।
১৩০
স্যাঙাৎ ওগো, আজ যে হঠাৎ মোল্লা হয়ে সাজলে সং!
ছাড়ো কপট তপের এ ভান, সাধুর মুখোশ এই ভড়ং।
দেবেন ‘আলী-মুর্তজা’ যা সাকি হয়ে বেহেশতে
পান কর সে শরাব হেথাও হুরি নিয়ে রঙ-বেরঙ।
১৩১
পানোন্মত্ত বারাঙ্গনায় দেখে সে এক শেখজি কন –
‘দুরাচার আর সুরার করো দাসীপনা সর্বক্ষণ!’
‘আমায় দেখে যা মনে হয়, তাই আমি’ – কয় বারনারী,
‘কিন্তু শেখজি, তুমি কি তাই, তোমায় দেখে কয় যা মন?’
১৩২
হাতে নিয়ে পান-পিয়ালা নামাজ পড়ার মাদুরখান –
দেখতে পেলাম ভাঁটি-খানার পথ ধরে শেখ সাহেব যান!
কইনু দেখে, ‘ব্যাপার কী এ, এ-পথে যে শেখ সাহেব!’
কইলেন পির, ‘ফক্কিকার এ-দুনিয়া, করো শরাব পান!’
১৩৩
কালকে রাতে ফিরছি যখন ভাঁটিখানার পাঁড় মাতাল,
পির সাহেবে দেখতে পেলাম, হাতে বোতল-ভরা মাল।
কইনু, ‘হে পির, শরম তোমার নেই কি?’ হেসে কইল পির,
‘খোদার দয়ার ভাণ্ডার সে অফুরন্ত, রে বাচাল!’
১৩৪
হে শহরের মুফতি! তুমি বিপথ-গামী কম তো নও,
পানোন্মত্ত আমার চেয়ে তুমিই বেশি বেহুঁশ হও।
মানব-রক্ত শোষ তুমি, আমি শুষি আঙুর-খুন,
রক্ত-পিপাসু কে বেশি এই দু-জনের, তুমিই কও!
১৩৫
ভন্ত যত ভড়ং করে দেখিয়ে বেড়ায় জায়নামাজ,
চায় না খোদায় – লোকের তারা প্রশংসা চায় ধাপ্পাবাজ!
দিব্যি আছে মুখোশ পরে সাধু ফকির ধার্মিকের,
ভিতরে সব কাফের ওরা, বাইরে মুসলমানের সাজ!
১৩৬
ধূলি-ম্লান এ উপত্যকায় এলি, এসেই হলি গুম,
করল তোরে জরদ্গব এই সে যাওয়া আসার ধুম।
নখগুলো তোর পুরু হয়ে হয়েছে আজ ঘোড়ার খুর,
দাড়ির বোঝা জড়িয়ে গিয়ে হল যেন গাধার দুম।
১৩৭
সুন্দরীদের তনুর তীর্থে এই যে ভ্রমণ, শরাব পান,
ভণ্ডদের ওই বুজরুকি কি হয় কখনও তার সমান?
প্রেমিক এবং পান-পিয়াসি এরাই যদি যায় নরক,
স্বর্গ হবে মোল্লা পাদরি আচার্যদের ‘দাড়ি-স্থান’!
১৩৮
এই মূঢ়দল – স্থূল তাহাদের অজ্ঞানতার ঘোর মায়ায়,
ভাবে – মানবজাতির নেতা তারাই জ্ঞান ও গরিমায়।
ফতোয়া দিয়ে কাফের করে তাদের তারা এক কথায়
শুভ্র-মুক্ত বুদ্ধি যারা, নয় গর্দভ তাদের ন্যায়।
১৩৯
মার্কা-মারা রইস যত – ঈষৎ দুখের বোঝার ভার
বইতে যাঁরা পড়েন ভেঙে, বিস্ময়ের নাই অন্ত আর,
তাঁরাই যখন দীন দরিদ্রে দেখেন দ্বারে পাততে হাত
তাদের তখন চিনতে নারেন মানুষ বলে এই ধরার।
১৪০
দরিদ্রেরে যদি তুমি প্রাপ্য তাহার অংশ দাও,
প্রাণে কারুর না দাও ব্যথা, মন্দ কারুর নাহি চাও
তখন তুমি শাস্ত্র মেনে না-ই চললে তায় বা কি!
আমি তোমায় স্বর্গ দিব, আপাতত শরাব নাও!
১৪১
জ্ঞান যদি তোর থাকে কিছু–জ্ঞানহারা হ সত্যিকার,
পান করে নে শাশ্বতী সে সাকির পাত্রে সুরার সার!
সেয়ান-জ্ঞানী! ?
রুবাইয়াৎ:
পারস্য কবি ওমর খৈয়াম প্রায় ৯৬০ বছর পূর্বে অনধিক ১২০০ রুবাইয়াৎ,অর্থাৎ চার লাইনবিশিষ্ট অনুকবিতা লিখেছিলেন, যেখান থেকে বাছাইকৃত উপরোক্ত রুবাইয়াৎগুলো নজরুল বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন।
মূল পার্সী রুবাইয়াৎ-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো চার লাইনে পূর্ণাঙ্গ ভাবাবেগ প্রকাশ করা এবং ১ম/২য়/৪র্থ লাইনে অন্ত্যমিল রেখে ৩য় লাইনে অন্ত্যমিল না রাখা।
পারস্য কবি ওমর খৈয়াম প্রায় ৯৬০ বছর পূর্বে অনধিক ১২০০ রুবাইয়াৎ,অর্থাৎ চার লাইনবিশিষ্ট অনুকবিতা লিখেছিলেন, যেখান থেকে বাছাইকৃত উপরোক্ত রুবাইয়াৎগুলো নজরুল বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন।
মূল পার্সী রুবাইয়াৎ-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো চার লাইনে পূর্ণাঙ্গ ভাবাবেগ প্রকাশ করা এবং ১ম/২য়/৪র্থ লাইনে অন্ত্যমিল রেখে ৩য় লাইনে অন্ত্যমিল না রাখা।