টান
রহিমা আক্তার লিলি
আমাদের এ তিলোত্তমা ঢাকা শহরের শব্দ দূষণে অভ্যস্থ হয়ে যাওয়া লাবণ্যের শ্রবণ ইন্দ্রিয় দুটি অনেক দিন পর গ্রামের শুনসান পরিবেশে এসে ভাবছে-হায়! কী হলো আমার! বিকল হলাম নাকি! খুব যে শান্তি শান্তি লাগছে! এক্ষুনি মাথায় উপর দিয়ে যে পাখিটা উড়ে গেল লাবণ্য যেন তার বুকের ভেতরর শব্দটাও শুনতে পেল।ধান ক্ষেতের ভেতর যে পোকাটা ডেকে উঠলো একটু খেয়াল করলে হয়তো কী বলছে তাও শুনতে পেত।রিকশার হর্ণ বেলের আওয়াজটাও খুব একটা কুৎসিত মনে হচ্ছে না, বাতাসে ভেসে ভেসে কেমন মোলায়েম হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু লাবণ্যের বুকের ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কেন যে সুমনের সাথে রাগ করে আসতে গেল। খুব মন খারাপ হচ্ছে। এটা ঠিক হয়নি। কিন্তু সুমনওতো কিছু বললো না আসার সময়। একবার তো বলতে পারতো -“লাবণ্য যেয়ো না”। সেওতো রাগ করে ছিল। কিন্তু লাবণ্য জানে সুমনের এই রাগ বেশিক্ষণ থাকবে না।কালই ছুটতে ছুটতে আসবে লাবণ্যকে নিতে।
ঠাকুর বাড়ি পার হয়ে বানিয়া বাড়ির তেঁতুল গাছটার কাছাকাছি আসতেই লাবণ্যের মনে হলো কে যেন কাঁদছে, বিলাপ করে, মরাকান্না। রিকশাওয়ালাকে বললো- ভাই একটু দাঁড়াওতো, মনে হলো কে যেন কাঁদছে!
রিকশাওয়ালা বললো-হ আফা মনে অয় কেউ মরছে।
মরছে কথাটা এমনভাবে বললো যেন এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা, মরতেই পারে; কোনো ব্যাপার না।
রিকশা থেকে মুখ বের করে লাবণ্য দেখার চেষ্টা করলো। কে যেন হন হন করে এদিকেই আসছে।লাবণ্য দেখলো হারু কাকা।পরনে ময়লা ধুতি,গায়ে গেঞ্জি, গামছা কাঁধে ফোঁস ফোঁস করতে করতে পূর্ব পাড়ার দিকে যাচ্ছে।
: পাজি! নচ্ছার! কুটনি বুড়ি!
তোর বাপের দেশে জায়গায় অইলো না?
খুব তো ড্যাং ড্যাং কইরা হিন্দুস্থান গেছিলিগা!
এই দেশে আইয়া মরলি কে?
মরছস দুই দিন আগে মরতি!
এই দেশে আইছস আমার পিন্ডি চটকাইতে?
লাবণ্য একটু এগিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
হারু কাকা ও..হারু কাকা।কী হয়েছে গো।এভাবে হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছ?
হারু বণিক লাবণ্যের দিকে এক মুহূর্ত চেয়ে থেকে কী যেন ভাবলো।তারপর বললোঃ
: আর কইসনা মা, যাইতাছি পুবপাড়া, তোর বাবার কাছে।হুগনা চেলাকাঠ আনতে।
: চেলাকাঠ দিয়ে কী হবে কাকা?
: আর কইস না মা আমার কফালের দোষ!
আমার জম্মের শত্তুর সুধাংশুর মা! আমার খুড়িগো খুড়ি! আইছে ইন্ডিয়া থেইক্কা কাইল রাইতে।আইতে না আইতেই আইজ বেইন্না বেলা পটল তুলছে।
: শয়তান বুড়ির এই দেশে আইয়া মরার শখ অইছে!
আমার হাড় জ্বালাইতে আইছে! বদের আড্ডি!
মেঘ বাদলের দিনে শুকনা কাঠ পাই কই কছাইন? বুড়িরে শ্মশানে তুলতে অইবো না? দেহি তোর বাপের কাছে কিছু শুকনা কাঠ পাই কিনা।
ধপাস ধপাস পা ফেলে যত রাগ সর্বংসহা মাটিতে ঢেলে দিতে দিতে লাবণ্যের বাড়ির দিকে চললো হারু বণিক।
চলবে….