রম্য রচনাঃ রবীন্দ্রনাথের চিঠি, আজকের মোবাইল ফোন ও আমাদের কথন!
আমি আপনি যতই চিঠি, প্রেমপত্র লিখি না কেন তার দৌড় বড়জোর প্রিয়জন বা প্রেমিকার কাছে। চিঠি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের নিম্নোক্ত বক্তব্যটি প্রনিধান যোগ্য বিশেষ করে প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে। তিনি বলেছেন, “তাঁর চিঠি হল ভিড়ের আড়ালে অন্তরঙ্গ মানুষের সঙ্গে আলাপ প্রতিলাপ তা সর্বসাধারণের সাহিত্য দরবারে উপস্থাপিত করবার নয়”।
তিনি এখানে গোপনীয়তার ঘেরটোপের কথা বুঝাতে চেয়েছেন। এখনকার সময়ে পত্র লিখার রেওয়াজ যেন বিদায় নিয়ে প্রায় হারাতে বসেছে। এখন প্রেমিক-প্রেমিকা কানে কানে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা চালাচালি করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে! এই অভ্যাস আমাদের সমাজে বেশী করে দানা বাঁধতে পেরেছে গভীর রাতে রাতজাগা প্রেমিক প্রেমিকার জন্য ভ্রাম্যমান (মোবাইল) ফোনের কল-রেট সুবিধা প্রদানের বর্ধিত সুযোগের মাধ্যমে! একদিকে চলে প্রেমিক প্রেমিকার মান-অভিমানের খুনসুটি অন্যদিকে চলে ফোন কোম্পানির পকেট কাটার ডিজিটাল মহোৎসব!
শুধু কি তাই এখন পরোকীয়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ গোপন চিঠি পত্রবাহকের মাধ্যমে পাঠানোর প্রেরণের ঝুঁকি প্রেমিককে নিতে হয় না। মোবাইলে যোগাযোগ অনেক সুবিধা হাতের কাছে এনে দিয়েছে। তবে এত সুযোগের মধ্যে ভয় যে নেই তা অমূলক নয়। দেশে আঁড়িপাতার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। প্রেমেও বাদ সাধতে আঁড়ি পাতার যেমন নজির আছে তেমনি আছে বিশ্বনেতাদের টেলিফোনে আঁড়িপাতার অসংখ্য ঘটনা। মনে নেই, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে আড়িপাতার অপরাধের শিকার হয়ে ক্ষমতা হারিয়ে অসময়ে বিদায় নিতে হয়েছিল।
আর এক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন আড়িপাতায় ক্লিন বোল্ড হয়ে বিরুদ্ধবাদীদের হাতে কম নাজেহাল হন নি। মনিকার সাথে ফোন-সেক্স করে শেষ পর্যন্ত ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি হয়েছিলেন ১৯৯৮-১৯৯৯ সালে। বিল ক্লিন্টনের প্রেমিকা মনিকা লিউনেস্কী বান্ধবী লিন্ডা ট্রিপকে জানিয়েছিলেন ২০ ঘন্টার বেশী সময় ধরে ফোনালাপ ও প্রেম নিবেদনের কথা। যদিও শেষ রক্ষা হয়েছিল তবে সাদা কাপড়ের কালো দাগ তা বলে দূর হয় নি।
ডায়না প্রিন্স অব ওয়েলসও কম আঁড়িপাতার শিকার হন নি! অগাষ্ট ১৯৯২ লন্ডনের ‘সান’ পত্রিকা “Squidgygate.” শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ করে হৈ চৈ ফেলে দেয়। উল্লেখ্য এ সময়ে ডায়না ও চার্লসের সম্পর্কের গভীর টানাপোড়েন চলছিল। ডায়ানার প্রেমিকের ছদ্মনাম হিসাবে “Squidgy” ব্যবহার করতেন। ডায়ানার দেহরক্ষী Ken Wharfe ২০০৮ সালে জানান “Squidgygate.” রেকর্ডিং এর কাজটি হয়েছিল ব্রিটীশ সারভেলেন্স এজেন্সি Government Communications Headquarters (GCHQ) এর মাধ্যমে। যা পরে মিডিয়ার হাতে চলে আসে এবং বিশ্বব্যাপী চাউর হয়।
এর কিছুদিন পরে আবির্ভাব ঘটে কামিলাগেটের। প্রিন্স [এখন রাজা] চার্লস-কামিলা পার্কার বোলসের (বর্তমান স্ত্রী) পরকিয়া প্রেমের আড়িপাতা নিয়ে এর জন্ম।
ডিজিটাল যুগের ভ্রাম্যমান (মোবাইল) ফোনের ডামাডোলের মধ্যে কিন্তু চিঠির প্রয়োজনীয়তা যে ফুরিয়ে গিয়েছে তা বলা যাবে না। আজকাল উড়ো চিঠি-ঝড়ের তান্ডব কম নয়। উড়ো চিঠি হৃদকম্প নয় শুধু অক্কা পাওয়ার পথ পর্যন্ত খুলে দিতে পারে। তবে এহেন ক্ষেত্রে সময় মত ডাক্তারের শ্মরনাপন্ন হলে বা ল্যাব এইড, স্কয়ার, ইউনাইটেড, এপোলো পর্যন্ত পৌঁছতে পারলে যমের সাথে বাঁচা মরার টানাটানি যুদ্ধে জয়যুক্ত হয়ে হিরো বনে যেতেও পারেন বৈকি! এই যুদ্ধ মরনপন যুদ্ধ। এর মান তাই অনেক উচ্চ।
আর এক প্রকার বিশেষ চিঠির প্রকোপ মাঝে মধ্যে দেখা যায়। এটা হল ‘মুক্তিপন’ চিঠি। আপনি বন্দীদশা হতে মুক্তি পেতে চাইলে (কে না চায়?) কড়ি ফেলবেন চাহিদা মোতাবেক। তবে বারগেনের যুগে বারগেন এক্ষেত্রে হয় বলেও শোনা যায়। তবে পুলিশ, রে্বের শরনাপন্ন হয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য পেয়ে মুক্তি মিলে থাকে। ধরা পড়ে মুক্তিপন দাবী করা চিঠি প্রেরক, দল বা সিন্ডিকেট। আর এক প্রকার চিঠির সাথে জুড়ে দেওয়া হয় ‘কাফনের কাপড়’। মরনের ভয় দেখিয়ে মরার আগে মরে যাওয়ার ব্যবস্থা যেন। এটি জাগতিক মরন। সেক্সপীয়ার তাই জুলিয়াস সীজার নাটকে লিখেছেন, ‘Cowards die many times before their death’. অন্যদিকে পবিত্র ইসলাম ধর্মে মোমিনের উদ্দেশ্যে ‘মরার আগে মরে যাওয়ার’ কথা বলা হয়েছে। দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান লক্ষ যোজন। ইসলাম ধর্ম মানবের ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য অসংখ্য বন্ধন মাঝে বাস করে আত্ম-অহংকার বিসর্জন দিয়ে জাগতিক বন্ধনের মায়ার উর্ধে উঠে স্রস্টার অপার ইচ্ছার কাছে জীবদ্দশায় আত্মসমর্পনের (মৃত্যু) তাগিদ দিয়ে রূপকভাবে মরার আগে মরে যাবার কথা বলেছে। আত্মবিসর্জনের মাধ্যমে মৃত্যুহীব অনন্ত জীবন লাভের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
চিঠির মূল্য যখন ছিল অপরিসীম তখন অনেক দিন আগে যৌবনে প্রনব রায়ের লিখা, জগন্ময় মিত্রের গাওয়া ‘চিঠি’ গানের কলি,—–‘যাবার বেলায় হাত দুটি ধরে বলেছিলে চিঠি দিও মোরে/ দূর থেকে তাই গানের লিপিকা লিখে যাই গো/ লিখে যাই সুরে সুরে’ আজও পুরাণ হয় নি। সাবিনা ইয়াসমীন গেয়েছেন ‘চিঠি দিও প্রতিদিন……।‘ চিঠির সেই যুগে ‘রানারের’ কদর ছিল। পোষ্ট অফিস ছিল দূর থেকে কথা আদান প্রদানের মাধ্যম। ডাকহরকরা বয়ে নিয়ে আসত চিঠি। সুকান্ত লিখেছেন বিখ্যাত ‘রানার’ কবিতাটি। তরুন বয়সে ‘রানার’ কবিতাটি কার মনে না শিহরন জাগায়? পোষ্ট অফিস, রানার সবই যেন হারাতে বসেছে ডিজিটাল যুগে। পোষ্ট অফিসের মাধ্যমে পাওয়া টেলিগ্রামের কথা ‘কাম শার্প মাদার/ ওয়াইফ সিরিয়াস’ আজ আর কোন সিরিয়াস ব্যাপার নয়। টরেটক্কা ইতোমধ্যে যেন নীরবে অক্কা পেয়ে হারিয়ে গিয়েছে। ক’জনা আমরা আজ মনে রেখেছি এক সময়ের বান্ধব টেলিগ্রাম বা টরেটক্কাকে? অথচ কিছুকাল আগেও টরেটক্কার মেইল অর্থাৎ টেলিগ্রাম সুসংবাদ বা দূঃসংবাদের বাহন আমাদের সকলের কাছে ছিল কত না পরিচিত। সময়ের সাথে বদলে গিয়েছে অনেক কিছু। আমাদের মনোভঙ্গীও! এখন দূর পরবাসে গিয়ে চিঠি লিখার দিন শেষ হয়েছে। এখন ভ্রাম্যমান মোবাইল ফোন চিঠি লিখার কাজ হাতে তুলে নিয়েছে। শেষ হয়েছে লেখালেখির দিন! এখন মানুষ নগদ-নারায়নে বিশ্বাসী। দূরের বাদ্য শুনে লাভ কি? বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল জেলে গিয়ে করেছিলেন অনশন। রবীন্দ্রনাথ টেলিগ্রাম করে লিখেছিলেন, ‘‘Give up hunger strike. Our literature claims you’’ টেলিগ্রামটি নজরুলের হাতে পৌঁছে নি অর্থাৎ দেওয়া হয় নি। টেলিগ্রামটি ভারতবর্ষে ‘সুসভ্য’ ইংরেজের এক ‘অসভ্যতার কিংবদন্তি নজির’ হয়ে আছে। আজও আলোচিত হচ্ছেন প্রেরক রবীন্দ্রনাথ আর প্রাপক কাজী নজরুল। টেলিগ্রামটি আজও সাহিত্যে সমানতালে আলোচিত হয়ে চলেছে। আমাদের স্মরণ ও সাহিত্য থেকে তা কোনদিন উবে যাবে না।
রবীন্দ্রনাথের কথায় যখন এসে পড়েছি তখন দেখা যাক রবি জীবনে, রবির হাতে ও মনে চিঠির প্রভাব কিরূপ ছাপ ফেলেছিল। চিঠির জন্য কবির ব্যাকুলতার তীব্রতা প্রকাশ পেয়েছে মানসীর’ ‘পত্রের প্রত্যাশা’ কবিতায়। এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বারবার বলছেন, চিঠি কই,চিঠি কই, কই চিঠি। একই ভাবে চিঠির জন্য ব্যাকুলতা লক্ষ্য করা যায় শিশু কাব্যগ্রন্থের ‘ব্যাকুল’ কবিতায়। চিঠি নামে কবিতাটি আছে পূরবীতে। পত্র শিরোনামে তাঁর কয়েকটি কবিতা আছে। ‘কড়ি ও কোমল’, মানসী, পুনশ্চ, বীথিকা ও প্রহসিনীতে। মাত্র চার বছর বয়স থেকে প্রায় আশী বছর পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ অজস্র চিঠি লিখেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম চিঠি লিখেছিলেন পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। আর শেষ চিঠি লিখেছিলেন পুত্রবধু প্রতিমা দেবীকে। প্রথম চিঠি লিখেছিলেন ১৮৬৫ সালের দিকে। শেষ চিঠি লিখেন ১৯৪১ সালের ৩০ জুলাই অর্থাৎ প্রথম চিঠির ৭৬ বছর পরে মৃত্যুর আট দিন আগে। বাল্যের চিঠিগুলি জমিদারী সেরেস্তার কর্মচারী মহানন্দ বাবু’র কাছ থেকে টুকরো কাগজ চেয়ে নিয়ে শিশু রবীন্দ্রনাথ পিতাকে লিখতেন। প্রথম প্রথম দু’একটি চিঠি বাবার হাতে পৌছলেও অনেক চিঠি সেরেস্তার কর্মচারীদের কাছে মূল্যহীন বলে প্রতিভাত হয়েছিল। ফলে পিতার কাছে শিশু পুত্রের চিঠি আর পৌছে নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবন-স্মৃতিতে পিতাকে প্রথম চিঠি লেখার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে লিখেছেন, “বেশ মনে আছে, আমাদের ছেলেবেলায় কোনো এক সময় গভরমেন্টের চিরন্তন জুজু রাশিয়া কর্তৃক ভারত আক্রমনের আশঙ্কা লোকের মুখে আলোচিত হইতেছিল। ….. এইজন্য মার মনে অত্যন্ত উদ্বেগ উপস্থিত হইয়াছিল। বাড়ির লোকেরা নিশ্চয়ই কেহ তাঁহার এই উৎকন্ঠার সমর্থন করেন নাই। মা সেই কারণে পরিণত বয়স্ক দলের সহায়তা লাভের চেষ্টায় হতাশ হইয়া শেষকালে এই বালকের আশ্রয় করিলেন। আমাকে বলিলেন, ‘রাশিয়ানদের খবর দিয়া কর্তাকে একখানা চিঠি লেখো তো’। মাতার উদ্বেগ বহন করিয়া পিতার কাছে সেই আমার প্রথম চিঠি। কেমন করিয়া পাঠ লিখিতে হয়, কী করিতে হয় কিছুই জানি না। দফতর খানায় মহানন্দ মুনশির শরনাপন্ন হইলাম। ………. এই চিঠির উত্তর পাইয়াছিলাম। তাহাতে পিতা লিখিয়াছেন, ‘ভয় করিবার কোন কারণ নাই, রাশিয়ানকে তিনি স্বয়ং তাড়াইয়া দিবেন।‘’
পিতার দুর্জয় সাহস শিশু পুত্রের মনে কি ভাবের উদয় ঘটিয়েছিল তা আমাদের জানা নেই তবে মনে হয়, রাশিয়া শিশু কবির মনে বিশেষ প্রভাব বোধ করি বাল্যেই ফেলেছিল। রাশিয়া ভ্রমন, ‘রাশিয়ার চিঠি’ কি মাতার মনের ভীতি আর পিতার অমিত সাহস প্রদর্শনের ফল কিনা কে জানে! শেষ চিঠিতে প্রতিমা দেবীকে ১২ টি শব্দের চিঠিতেরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেন, ’’তোমাকে নিজের হাতে কিছু লিখতে পারিনে বলে কিছুতে লিখতে রুচি হয় না।’ এখন দেখা যাক কাব্যে উপেক্ষিতা স্ত্রী মৃণালিনীর কাছে কবি চিঠি দিয়ে কি বলেছেন। তিনি কি লিখেছেন?
স্ত্রী মৃনালিনী দেবীকে তিনি লিখেন, “ভাই ছুটি বড় হোক ছোট হোক মন্দ হোক একটা করে চিঠি আমাকে রোজ লেখ না কেন? ডাকের সময় চিঠি না পেলে ভারি খালি ঠেকে।” প্রতিদিন চিঠি পাবার আশায় তিনি ডাক হরকরার আগমন প্রতীক্ষায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। চিঠি, ডাকঘর এবং ডাক হরকরা নিয়ে কবির লেখা বাংলা সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ। কাব্য-কবিতা, নাটক, কথাসাহিত্যে এসবের কথা বারেবারে উঠে এসেছে। ‘পোষ্টমাষ্টার’ বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প। কুষ্টিয়ার শিলাইদহের গগন হরকরার গান অবলম্বনে তাঁর লিখা হয়ে উঠেছে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত।
চিঠি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “তাঁর চিঠি হল ভিড়ের আড়ালে অন্তরঙ্গ মানুষের সঙ্গে আলাপ প্রতিলাপ তা সর্বসাধারণের সাহিত্য দরবারে উপস্থাপিত করবার নয়”। রবীন্দ্রনাথঠাকুর ১৯১৫ সালের ১৮ জুলাই শিলাইদহ থেকে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে জানান,‘‘ রথী, শিলাইদহে এসেছি ……..। অনেকদিন পরে জলের ধারা ও সবুজ মাঠের সংশ্রব ও নির্জন পেয়ে আমি যেন নিজের সত্যকে আবার ফিরে পেয়েছি। এখানেই সুদীর্ঘকাল থাকতে ইচ্ছা করছে। নিভৃত প্রকৃতির হাতে সুশ্রষা আমার পক্ষে একান্ত দরকার – সে জন্যই জীবনের ও সংসারের সমস্ত জঞ্জাল ছিন্ন করে ফেলে সুদুরে পালাবার জন্যে আমার মন এত ছট্ফট্ করছিল—–।‘’
কোলকাতা হতে শিলাইদহের শচীন্দ্রনাথ অধিকারীকে লিখা কবির চিঠিতে বাংলাদেশ প্রীতি ও ভালবাসা বাঙময় হয়ে ফুটে উঠেছে। তিনি লিখেন, ‘‘মনে পড়ছে সেই শিলাইদহের কুঠি, তেতলার নিভৃত ঘরটি আমের বোলের গন্ধ আসছে বাতাসে–পশ্চিমের মাঠ পেরিয়ে বহুদূর দেখা যাচ্ছে বালুচরে রেখা আর গুনটানা মাস্তুল। দিনগুলো অবকাশে ভরা– সেই আবকাশের উপর প্রজাপতির ঝাঁকের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে রঙিন পাখাওয়ালা কত ভাবনা এবং কত বানী। কর্মের দায়ও ছিল তার সঙ্গে আর হয়তো মনের গভীরে ছিল অনন্ত আকাঙ্খা পরিচয়হীন বেদনা। সব নিয়ে ছিল যে আমার নিভৃত বিশ্ব সে আজ চলে গিয়েছে বহুদুরে। ……. আমার শিলাইদহের কুঠি পদ্মার চর সেখানকার দিগন্তবিস্তৃত ফসলখেত ও ছায়ানিবিড় গ্রাম ছিল সেই অভাবনিয়কে নিয়ে যার মধ্যে আমার কল্পনার ডানা বাধা পায়নি।‘’
চিঠি নিয়ে বিশ্ব সাহিত্য যে হতে পারে তার প্রমান মেলে কন্যা ইন্দিরাকে লিখা পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর অসংখ্য চিঠি। জেলে থেকে চিঠির মাধ্যমে নেহেরু সাহিত্য সাধনা করেছেন। বিশ্ব ইতিহাসকে করেছেন সমৃদ্ধ। Glimpse of World History চিঠি সাহিত্যের সার্থকতা ও বিজয় ঘোষণা করে চলেছে। এখন আর্ল অব চেষ্টারফিল্ডের (১৬৯৪-১৭৭৩) লিখা ‘Letter to His Son’ এর উল্লেখ করব। ছাত্রাবস্থায় চেষ্টারফিল্ডের লিখা ‘Letter to His Son’ আমাদের পাঠ্য ছিল। চেষ্টারফিল্ড প্রায় তিনশতের মত চিঠি পুত্রকে লিখেছেন যার সাহিত্য মূল্য অপরিসীম। আজ ক’জন পিতা চেষ্টারফিল্ডের মত পুত্রের তরে চিঠি লিখতে তাড়িত হন জানি নে। তাঁর চিঠিগুলি আজও পড়ুয়া পাঠককে কাছে টেনে নেয়। লন্ডনের ‘দি ওয়াল্টার স্কট পাবলিশিং কোম্পানি লিমিটেড’ কতৃক প্রকাশিত চিঠিগুলির কদর আজও এতটুকুও কমে নি।
হালের মোবাইল ফোনের আগমনে আত্মীয় পরিজন, প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝে চিঠি লিখার প্রবণতা যে অনেক কমে গিয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারপরও বলা চলে কথা দুদিন পরে যেভাবে হারিয়ে যায় চিঠির ক্ষেত্রে সেটি হবার নয়। এর স্থায়িত্ব অনেক বেশী। কয়েকটি বিশ্ববিখ্যাত প্রেমের চিঠির উল্লেখ করছি। এই বিখ্যাত চিঠিটি ১৭৯৬ সালে নেপোলিয়ান বোনাপার্ট লিখেছেন প্রেমিক-স্ত্রী জোসেফাইনকে। তিনি লিখেন,–‘‘The charms of the incomparable Josephine kindle continually a burning and a glowing flame in my heart.’’ নেপোলিয়ানের এই হৃদয়ানুভূতি আমরা কভু কি পেতাম চিঠি ছাড়া? রোমান্টিক কবি জন কীটস ১৮১৯ সালে প্রতিবেশী নারী ফ্যানী ব্রাউনিকে প্রেম নিবেদন করে লিখেছিলেন এই প্রেমপত্রঃ ‘‘My love has made me selfish. I cannot exist without you – I am forgetful of every thing but seeing you again.’’ এই চিঠি কি তাদের কম স্মরণীয় করে রেখেছে? অন্যদিকে ১৯৩৫ সালে স্যার উইষ্টন চার্চিল লিখেছিলেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী ক্লিমেন্টাইনকে,– ‘‘Time passes swiftly, but is it not joyous to see how great and growing is the treasure we have gathered together, amid the storms and stresses of so many eventful and, to millions, tragic and terrible years?’’ চার্চিলের চিঠি পড়ে বুঝে নেওয়া যায় প্রেম চার্চিলকে কঠিন সময় অতিক্রম করতে কত না শক্তি যুগিয়েছে। যে চার্চিলকে আমরা চিনি তার বাহিরে আর এক চার্চিলকে কি আমরা পেতাম এই চিঠি বিনা? সেই যুগে যদি মোবাইল ফোন থাকত তাহলে এই দুই সময়ের দুই ক্ষণজন্মা পুরুষ কি লিখতেন এ রকমের চিঠি না কি বলতেন ‘ডার্লিং আই লাভ ইউ মোর দ্যান মি। উইথাউট ইউ আই ষ্ট্যান্ড নো হয়ার। উইথ ইউ আই ক্যান ড্যু এন্ড আনড্যু এভরিথিং। ইভেন আই ক্যান জাম্প ফ্রম দি আল্পস ফর ইউ’’। আজকের মোবাইল ফোনের জন্ম ১৯৭৩ সালে। নাম দেওয়া হয় DynaTAC 8000X. ১৯৭৩ সালে মটরোলার কর্মকর্তা ড. মার্টিন কুপার এবং বেল ল্যাবসের ড. জিল এঙ্গেলের সাথে প্রথম মোবাইল ফোনে কথা বলেন। এই দুইজনকে মোবাইল ফোনের পুরধা ধরা হয়। এখন বুঝুন মাত্র ৪৯ বছরে কথা চালাচালির কি বিপুল পরিবর্তন না সারা বিশ্বে এসেছে। বাংলাদেশ মোবাইল ব্যবহারে বিশ্বের উন্নত দেশের গা ঘেসে অবস্থান করছে। এটা কম কথা নয়!
সিরজদ্দৌলার কথা (নাটকে) ‘বাঙালি জানে শুধু কাঁদতে…’ সেই যুগের অবসান ঘটিয়ে এখন এসেছেঃ ‘বাঙালি জানে শুধু কথা বলতে’। কথা বলা দোষের কিছু নয়। যদি কথার থাকে দাম। বাহুল্য কথা নিজেকে যেমন ছোট করে তেমনি ঘটাতে পারে সমূহ বিপত্তি। বাহুল্যের বিপত্তি বা উৎপত্তি আমাদের কখনোই কাম্য নয়। এ থেকে সাবধানতা অবলম্বন কি অপরিহার্য্য নয়? হউক না তা মোবাইল (ভ্রাম্যমান’) ফোনে বা মিডিয়ার সামনে, ঘটনাকে কেন্দ্র করে অথবা কোন সভা-সমাবেশে।
পরিশেষে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কথা আমাদের মনে রাখা ভাল,– ‘নিজেরে করিতে গৌরবদান/ নিজেরে কেবলি করি অপমান’। নিজেকে গৌরবদান অবশ্যই আমরা করব। কিন্তু কথার ঘনঘটা বা বাড়তি কথা দিয়ে নয়। নিজেকে অপমান করেও নয়। আমাদের কথন প্রয়োজনীয়, জীবনধর্মী ও মূল্যবান হওয়া বাঞ্ছনীয় অথবা হতে পারেঃ “অনেক কথা যাও যে বলি কোন কথা না বলি” এরূপ কিছু।
লেখক: মালিক খসরু, এআইজি (সাবেক), বাংলাদেশ পুলিশ।
১ Comment
congratulations