বল বীর –
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
১৯২১ সালের ডিসেম্বর, ক্রিসমাসের রাত। কলকাতার ৩/৪সি, তালতলা লেনের একটি বাড়িতে বসে কাঠ পেন্সিলে এই কালজয়ী কবিতা লিখতে শুরু করেন সদ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধফেরত বাইশ বছরের যুবক কাজী নজরুল ইসলাম।
বিশ্লেষকদের ভাষায়, রবীন্দ্র জমানার সাহিত্য থেকে বেরিয়ে সেটি নতুন এক সাহিত্য ধারার সূচনা হলো।
একশো বছর পরেও সেই কবিতার আবেদন ফুরায়নি, রয়ে গেছে আগের মতোই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”ঔপনিবেশিক ভারতের সেই সময় যখন নজরুল আবির্ভূত হলেন, তখন তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঔপনিবেশিক বিরোধিতা বড় করে তুলছেন। বল বীর, চির উন্নত মম শির, এই বীর তিনি বলছেন সমস্ত বাঙ্গালিকে, যে বীরের মতো তোমরা উঠে দাঁড়াও। ভীরু বাঙ্গালিকে উদ্দীপ্ত করে তুলতে চেয়েছেন, তাদের জাগ্রত করতে অসংখ্য শব্দের ঝংকারে কবিতাটি যেন পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে!”
কলকাতায় ডিসেম্বরের সেই রাতে কবিতা লেখার পরের দিন সকালে প্রথম পড়ে শুনিয়েছিলেন তার সঙ্গে থাকা বন্ধু কমরেড মুজফফর আহমেদকে।
কমরেড মুজফফর আহমদ তাঁর ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ বইয়ে লিখেছেন, ”আসলে বিদ্রোহী কবিতা রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। (যদিও তিনি এর আগে একটি বইয়ে দুর্গাপূজার সময় এই কবিতাটি লেখা হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন, তবে এই বইয়ে সেটার সংশোধনী দিয়েছেন।) বিদ্রোহী কবিতাটি প্রথম ছাপা হয়েছিল ‘বিজলী’ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায়।
যেভাবে লেখা হয়েছিল বিদ্রোহী কবিতাটি
মুজফফর আহমদ লিখেছেন, ”তখন নজরুল আর আমি নীচের তলার পূব দিকের, অর্থাৎ বাড়ীর নিচেকার দক্ষিণ-পূর্ব কোনের ঘরটি নিয়ে থাকি। এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম তার ”বিদ্রোহী” কবিতাটি লিখেছিল। সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রির কোন সময়ে তা আমি জানিনে। রাত দশটার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে।”
”পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল। ”বিদ্রোহী” কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।”
কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ বইয়ে মুজফফর আহমদ এরপর বর্ণনা দিয়েছেন, যেহেতু তিনি সামনাসামনি কারো প্রশংসা করতে পারেন না, তাই কবিতা শোনার পরেও তিনি উচ্ছ্বসিত হতে পারেননি। তাতে মনে মনে কাজী নজরুল ইসলাম আহত হয়েছিলেন বলেও তার মনে হয়েছে।
”আমার মনে হয়, নজরুল শেষ রাত্রে কবিতাটি লিখেছিল, তা না হলে এত সকালে সে আমায় কবিতা পড়ে শোনাতে পারত না।….এখন থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে নজরুলের কিংবা আমার ফাউন্টেন পেন ছিল না। দোয়াতে বারে বারে কলম ডোবাতে গিয়ে তার মাথার সঙ্গে তাল রাখতে পারবে না, এই ভেবেই সম্ভবত সে কবিতাটি প্রথমে পেন্সিলে লিখেছিল।” লিখেছেন মি. আহমদ।
সেদিন বেলা হওয়ার পর ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার আফজালুল হক সেই বাড়িতে আসেন। তাকেও কবিতাটি পড়ে শোনান কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি সেটা শুনে একটি কপি সঙ্গে নিয়ে যান।
মুজফফর আহমদ লিখেছেন, ”আমিও বাইরে চলে যাই। তারপরে বাড়িতে ফিরে আসি বারোটার কিছু আগে। আসা মাত্রই নজরুল আমায় জানাল যে, ‘অবিনাশদা (বারীন ঘোষেদের বোমার মামলার সহবন্দী শ্রীঅবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য) এসেছিলেন। তিনি কবিতাটি শুনে বললেন, তুমি পাগল হয়েছ নজরুল, আফজালের কাগজ কখন বার হবে তার স্থিরতা নেই, কপি করে দাও, বিজলীতে ছেপে দেই আগে। তাকেও নজরুল সেই পেন্সিলের লেখা হতেই কবিতাটি কপি করে দিয়েছিল।”
বিদ্রোহী কবিতাটি ১৩৯-পঙক্তির।
১৯২২ সালের ৬ই জানুয়ারি শুক্রবার সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় প্রথম ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ছাপা হয়। বৃষ্টি হওয়ার পরেও কাগজের চাহিদা এতো হয়েছিল যে, সেই সপ্তাহে ওই কাগজটি দুইবার মুদ্রণ করতে হয়েছিল।
তার ধারণা, মোসলেম ভারতের কার্তিক সংখ্যায় পরবর্তীতে সেটা ছাপা হলেও সেই সংখ্যাটি বের হয়েছিল ফাল্গুন মাসে।
মুজফফর আহমদ লিখেছেন, ”বিদ্রোহী ছাপা হওয়ার পরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎকারের কথাও শ্রী অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন এবং নজরুলের মুখে শুনেই লিখেছেন। তাতে আছে, কবিতাটি রবীন্দ্রনাথকে পড়ে শোনানোর পরে তিনি নজরুলকে বুকে চেপে ধরেছিলেন।”
‘বিদ্রোহী’ কবিতা নিয়ে মোহিতলালের ‘ভাব চুরির’ দাবি
মুজফফর আহমদ তার বইতে উল্লেখ করেছেন, ‘বিদ্রোহী’ ছাপা হওয়ার পর কবি মোহিতলাল মজুমদার দাবী করেছিলেন যে, তার ‘আমি’ শীর্ষক একটি লেখার ভাব নিয়ে কবিতাটি লিখেছে, কিন্তু কোন ঋণ স্বীকার করেনি। এই প্রচারটি তিনি মৌখিকভাবে করেছিলেন।
কারণ এর বছরখানেক আগে একটি সাহিত্য আসরে মানসী পত্রিকা থেকে ‘আমি’ নামের নিজের লেখা একটি গদ্য পড়ে শুনিয়েছিলেন মোহিতলাল মজুমদার, যে আসরে মুজফফর আহমদ ও কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেকেই ছিলেন।
কিন্তু সেই দাবি নাকচ করে দিয়েছেন মি. আহমদ। তবে তিনি এও উল্লেখ করেছেন, ”……একবার মাত্র শুনে এত দীর্ঘকাল পরে সে ‘আমি’র ভাবসম্পদ নিয়ে বা চুরি করে যে বিদ্রোহী রচনা করেছিল, আমি তা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনে।……এটা আমি মানতে রাজী আছি, মোহিতলালকে লেখাটি পড়তে শুনে তার মনে হয়তো একথাটা আসতে পারে যে, এই ধরনের একটা কবিতা লেখা যায়।”
এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ গুপ্ত ‘বিংশ শতাব্দী’-তে লিখেছেন, মোহিতলাল মজুমদারের ‘আমি’ প্রবন্ধের ভাববস্তুর সঙ্গে নজরুলের বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির সাদৃশ্য অত্যন্ত স্পষ্ট। কবিতার রচনার বেশ কয়েক বছর আগে মোহিতলালের প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। মোহিতলাল মনে করেন, “তার রচনাকেই নজরুল আত্মসাৎ করেছেন, অথচ কোথাও তার উল্লেখ মাত্র নেই। বলা বাহুল্য, আমি প্রবন্ধের বীজ ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে গ্রন্থটি থেকে গৃহীত, আধ্যাত্মিক রূপকার্থের মূল্যেই সেটি উল্লেখ্য, সাহিত্যগুণে নয়। পরন্তু নজরুলের কবিতাটি যে একান্ত আত্মগত প্রেরণার ফল, তা কাব্যরসিক মাত্রেই স্বীকার করবেন। নতুবা রবীন্দ্র-প্রতিভা যখন মধ্যাহ্ন দীপ্তিতে বিরাজমান, তখনই নজরুলের আকস্মিক আবির্ভাব দলগোষ্ঠী নির্বিশেষে এমন সম্বর্ধিত হত না।”
বিদ্রোহী কবিতার ব্যাঙ্গ করে সজনীকান্ত দাস ‘ব্যাঙ’ নামে একটি কবিতাও লিখেছিলে, যা শনিবারের চিঠি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেখানে তিনি প্যারোডি করে লিখেছিলেন, ‘আমি ব্যাঙ/ লম্বা আমার ঠ্যাং/ আমি ব্যাঙ/ আমি সাপ, আমি ব্যাঙেরে গিলিয়া খাই/ আমি বুক দিয়ে হাঁটি ইঁদুর ছুঁচোর গর্তে ঢুকিয়া যাই।”
বিশ্বের পালাবদলের প্রভাব নজরুলের কবিতায়
পৃথিবীর ভাবজগতে বিভিন্ন দেশে সেই সময় একটা পরিবর্তন চলছিল। বিশেষ করে এই অঞ্চলের শিল্প সাহিত্যের মধ্যে যে রোমান্টিক ধারা চলছিল, তাতেও পরিবর্তন আনে। সেই সঙ্গে বলশেভিক বিপ্লব সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের প্রচলিত ধ্যানধারণার, চিন্তা চেতনার পরিবর্তন এনে দিয়েছিল।
নজরুল গবেষক জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”বাংলা কবিতায় একটা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের মতো কবিতা লেখা। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের মতো কেউ কেউ সেই বলয়ের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পুরোপুরি বাইরে যেতে পারেননি। প্রমথ চৌধুরী চলতি ভাষা চালু করলেন।”
”প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব, ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন, তুরস্কে কামাল পাশার আবির্ভাব, বাংলা সাহিত্যের এসব পটভূমি নজরুলকে বিদ্রোহীর মতো কবিতা লেখার জন্য প্রভাবিত করেছে।”
”তাই বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, বাংলা সাহিত্য বিশ শতকে রবীন্দ্র প্রভাব এতো সর্বগ্রাসী হয়েছিল, মনে হচ্ছিল, এর বাইরে যাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না বিদ্রোহী কবিতার নিশান উড়িয়ে হইহই করে নজরুল এসে হাজির হলেন।” বলছেন অধ্যাপক ইসলাম।
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলছেন, ”আধুনিক বাংলা কবিতার যে জন্ম হলো, রবীন্দ্র ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে তাতে আরও সময় লেগে যেতো। বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে আধুনিক বাংলা কবিতার সূচনা হলো।”
তিনি বলছেন, বিদ্রোহী কবিতাটি বাংলা সমাজ জীবনে, বাংলা রাজনৈতিক জীবনে, বিভিন্ন আন্দোলনে অত্যন্ত প্রভাব বিস্তার করেছে।
এই কবিতা সেই সময় নিষিদ্ধ করা হবে কিনা, সেটা নিয়ে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের মধ্যে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল।
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলছেন, ”আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করলেও যেখানেই এসব পত্রিকা পেতো, সেগুলো জব্দ করতো। আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে একপ্রকার নিষিদ্ধ ছিল। আমার মনে হয় না, বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী ছাড়া আর কোন কবিতা এতোটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। একশো বছর পরেও সেই আবেদন কমেনি।”
বিদ্রোহী কবিতা শুনলেই উদ্বেলিত হয়ে উঠতেন বাকরুদ্ধ কবি
কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৪২ সালে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। এরপর তার তিনি কবিতা বা গান লিখেননি।
কবির নাতনি খিলখিল কাজী বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ”সেই সময় আমার বাবার তো অল্পবয়স ছিল। আমরা যখন জন্মালাম, দাদুর অনেকটা বয়স হয়ে গেছে। আমার বাবা কাজী সব্যসাচী দাদুর সামনে বিদ্রোহী কবিতা প্রায়ই আবৃত্তি করতেন।”
”তখন দেখেছি দাদুকে ভীষণভাবে উদ্বেলিত হতে, বিদ্রোহী শুনলেই উনি চোখটা যেমন কেমন করতেন, মাথায় হাত বুলাতেন। বার বার যেমন মনে হচ্ছিল যে, এখনো পৃথিবীতে অন্যায় অবিচার হচ্ছে, দাদু যদি কথা বলতে পারতেন, তাহলে কোথাও গিয়ে যেন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলবেন, প্রতিবাদ করবেন, এই অনুভবটা আমরা দাদুর চোখেমুখে দেখতে পেতাম।” বলছেন খিলখিল কাজী।
কোন কবিতার বর্ষপূর্তি পালনের মতো অনন্য ঘটনা ঘটে ২০১১ সালে। সেই বছর বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ৯০ বছর পূর্তি উদযাপন করা হয়। এখন চলছে এই কবিতার শতবর্ষপূর্তি উদযাপনের আয়োজন। বিবিসি বাংলা
১ Comment
তথ্য ভিত্তিক লেখা