মোহাম্মদ হাশেম এঁর গানে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বদেশ চেতনা
অধ্যাপক শীরীন আক্তার
বাংলাদেশের অন্যতম জেলা নোয়াখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চল সদর উপজেলার অন্তর্গত চরমটুয়া ইউনিয়নের শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান মোহাম্মদ হাশেম। তাঁর পিতা ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর পিতার পেশাগত কারণে গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে লেখা পড়ার জন্যে বাবার সাথে ঢাকা চলে যান।ঢাকার পুরানা পল্টন লাইন স্কুল থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তবে অতি শৈশব থেকেই তিনি ভীষণ সঙ্গীতানুরাগী ছিলেন। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সঙ্গীতের উচ্চতর শাস্ত্রীয় বিদ্যাও লাভ করেন। গ্রামের জনজীবনের মাটি ও মানুষের জীবনাচরণ ও জীবনচিত্র অতি শৈশব থেকেই তিনি অন্তর দিয়ে অবলোকন ও হৃদয়ে লালন করেছেন। ১৯৭১ এর মুক্তি যুদ্ধের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছেন। গ্রামের সহজ সরল মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি নিয়ে তিনি ভাবতেন। তাই রাজধানী ঢাকায় সরকারি চাকরি শুরু করলেও শৈশবের ফেলে যাওয়া গ্রাম তাঁকে আকর্ষণ করতো প্রবল ভাবে। তিনি প্রথমে কিছুদিন ঢাকা সঙ্গীত কলেজে চাকরি করেছেন। পরে রেডিওতে সরকারি চাকরি করাকালীন সময়ে সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে নাড়ীর টানে একসময় গ্রামের এক কলেজে চাকরি নিয়ে চলে আসেন নিজ জন্মস্থান নোয়াখালীতে।
স্বভূমি নোয়াখালীর জন্য তিনি অন্তরে গভীর মায়া অনুভব করতেন। তাঁর ছিলো সুতীব্র স্বদেশপ্রেম। পিতা মুক্তি যুদ্ধে যাওয়াতে পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে তাঁকে থেকে যেতে হয় দেশে। তাঁর মা ভাই বোন স্ত্রী সন্তানের দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি ইচ্ছের বিরুদ্ধেই গ্রামে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। কিন্তু যাঁর অন্তরে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা ছিলো তিনি তা খুব উপলব্ধি করতেন। তাই স্বদেশের বিপদের কথা চিন্তা করে মনে মনে কষ্ট পেয়েছেন, মানুষের কষ্ট দেখে কেঁদেছেন। যার প্রতিফলন পরবর্তীতে তাঁর গানে ফুটে উঠেছে। এ ছাড়াও নিজের এলাকার প্রান্তিক মানুষের দৈনন্দিন জীবনচিত্র খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে দেখতে তিনি মাঝে মধ্যে গ্রামের হাঁটে-মাঠে- বাটে ঘুরে বেড়িয়েছেন। দেখেছেন একদম নিকট থেকে চরের অধিবাসী ও ছিন্নমূল মানুষের মানবেতর জীবনযাপনের নিষ্করুণ চিত্র। যা দেখে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে যেতেন। তাদের দারিদ্র্যজীর্ণ জীবনের জলছবি চাক্ষুষ দেখে এসে রচনা করেছেন নোয়াখালীর মৃত্তিকা সংলগ্ন সন্তানদের মুখের জবানীতে গান। শুধু গান রচনা করেই তিনি ক্ষান্ত থাকেননি। রাতের মধুর ঘুম বিসর্জন দিয়ে গুনগুন করে মনের মধ্যে সুর তুলেছেন। তারপর তাঁর জ্ঞানলব্ধ সঙ্গীত কলার অভিজ্ঞতা দিয়ে তাল লয় মিশিয়ে অত্যন্ত দরদী কণ্ঠে সে গান নিজেই গেয়েছেন। আর সে গানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে নোয়াখালীর আঞ্চলিক গানের সম্রাট ও জনক বলা হয়।
যেহেতু তিনি পূর্বেই রেডিওতে চাকরি করেছেন সেই সুবাদে অচিরেই রেডিওতে গান গাওয়ার সুযোগ এসে যায়। তিনি তখনই একাধারে নোয়াখালীর আঞ্চলিক গানের গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেন। নিজের মাতৃভাষা, প্রাণের আঞ্চলিক ভাষায় শ্রোতারা সে গান শুনে বিমুগ্ধ হয়ে ধন্য ধন্য করলো। রাতারাতি তিনি চট্টগ্রাম রেডিওতে ও গেয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের তথা সারা দেশের জনপ্রিয় শিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর অনেক গানের মধ্যে এখানে আলোচিত হবে তাঁর মুক্তিযুদ্ধ ও স্বদেশ চেতনামূলক গান।
মোহাম্মদ হাশেম এঁর মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গানগুলো সবিস্তারে আলোচনা অন্যত্র হবে। এখানে স্বল্প পরিসরে তাঁর দু’একটা্ গানের আলোচনা করা হলো —
তিনি যখন বলেন —
আঙ্গো উত্তর বাড়ির তারা
আঁডি আঁডি বড়লোকের বান্দে খালি বারা
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাপ গেছে তার মারা।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পিতার চরম অসহায়ত্বের করুণ চিত্র এখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দেশের জন্য অকাতরে জীবন দেওয়া লক্ষ লক্ষ পরিবারের নিদারুণ ও নিষ্ঠুর বাস্তবতা এক তারা চরিত্রের মাধ্যমে শিল্পী মোহাম্মদ হাশেম উপস্থাপন করেছেন। এ ছাড়াও তিনি প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তি হিসেবে তাঁর গানে যখন ভৌগোলিক ভাবে নিয়ে আসেন অত্র এলাকার কিছু বাস্তব চিত্র তখন বিস্মিতই হতে হয়। যেমন —
নোয়াখালীর দক্ষিণেদি উইঠছে নোয়া চর
হেই চরে বানাইছে মাইনষে নোয়া বাড়িঘর
আরেক কানা দয়িনে দি বঙ্গোপসাগর।
তখন শ্রোতামাত্রেরই চোখে ভেসে ওঠে বাংলাদেশের দক্ষিণের উত্তাল বঙ্গোপসাগরের চিত্র।
তাঁর অন্য একটি গানে মুক্তিযুদ্ধে বীর বাঙালির বীরত্বের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে —
এই বাঙালি হেই বাঙালি
দ্যাশ কইচ্ছে স্বাধীন
হাইঞ্জাবিরে এমন হিডা
দিছিল একদিন
একাত্তরে বাঙালিয়ে
মুক্তিযুদ্ধ করে
কতবড়া কতবড়া ছাগী
বাড়বালে ভাই মারে।
এখানে শিল্পী মোহাম্মদ হাশেম নিরস্ত্র বাঙালি পাকসেনাদের কীভাবে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে কূপোকাত করেছিলো সে কথা বলেছেন।
ঠিক তেমনি তাঁর অনেক গানে অত্যন্ত নিখুঁত ভাবে স্বদেশ চেতনা চিত্রিত হয়েছে। যেমন —
আঁই যাইতান্ন ডুবাই
দ্যাশের বদিল্লা খুবাই
দরকার অইলে না চালামু
ডাইলের হানি খাই।
এ গান ও যে শুনবে সে-ই দেশে থেকে পরিশ্রম করে এবং দেশেই নিজের মেধা খাটিয়ে উপার্জন করতে উজ্জীবিত হবে।
অধ্যাপক শিল্পী মোহাম্মদ হাশেম তাঁর বিখ্যাত নীচের উল্লেখিত এ গানে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ যে নোয়াখালীর গৌরব সার্জেন্ট জহুরুল হক তা তুলে ধরেছেন। ভাষা আন্দোলনে ও নোয়াখালীর বীর সন্তান সালামের কথা বলেছেন —
উড়ের হদ্দার নোয়াখাইল্যা
কোন মিছিলে নাই
বায়ান্নতে গুলি খাইছে
ঢাকা শহর যাই
নাম অইসে সালাম
কইচ্ছে কামের মতো এক্কান কাম
জীবন দি ও রাইকছে হেদিন
নোয়খাইল্লার নাম।
আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলা তুলি নিল
একে একে আসামিরা খালাস ও তো হাইল
সার্জেন্ট জহুরুল হক মরি
তুঙ্গে নেয় সংগ্রাম।
তিনি তাঁর মেধা মনন ও মগজে স্বদেশ প্রেম ও মুক্তি যুদ্ধকে যে গভীর ভাবে লালন করতেন তাঁর মৃত্যুর পরেও তা শোনার ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছেন এ গানে —-
মাইজদী বড় দীঘির হাড়ে একদিন কবর দিও আঁরে,
———— —— ———
হুতি হুতি বিজয় মঞ্চের গানগুন হুনুম ভাই রে
কোর্ট মসজিদে আযান দিব ভায়রো রাগের হরে,
হুনুম মুক্তিযুদ্ধের আলোচনা
গান আর গল্প ভাইরে।
মোহাম্মদ হাশেম তাঁর গানে যেমন মুক্তিযুদ্ধ ও স্বদেশ চেতনাকে এনেছেন তেমনি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে প্রত্যাশা করেছেন ; তারা বিজয় মঞ্চে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ও পল্লী গীতি গাইবে, মুক্তি যুদ্ধের ও দেশপ্রেমের কবিতা, গান নিয়ে আলোচনা করবে। তা তিনি কবরে শুয়ে শুয়ে শুনবেন, তাঁর বিদেহী আত্মা তাতে সুখী হবে। এভাবে তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে অনন্ত কাল অমর হয়ে থাকবেন। আমরাও আন্তরিক ভাবে আশাবাদী মোহাম্মদ হাশেম চিরকাল তার সৃষ্টির জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকবেন।