“মেয়ে”
রুমানা মকবুল
একটি মেয়ে তার বাবাকে প্রশ্ন করল, বাবা আমাদের উঠোনে যে গাছটা আছে সেটা পাশের বাগানে লাগানো যায় না?
বাবা- “মা, ওটা চার বছরের পুরোনো গাছ, নতুন মাটিতে মানিয়ে নিতে পারবে না!
মেয়ে- (চেখে জল) তোমার আঙিনায় ও তো একটা চারাগাছ এখন ২২ বছরের পুরোনো হয়ে হয়ে গেছে, সে কিভাবে নতুন জায়গায় বাঁচবে?
বাবা- (কিছুক্ষন ভেবে)” এই শক্তি পৃথিবীতে একমাত্র মেয়েদের’ই আছে, তাইতো তারা কল্পবৃক্ষের সমান!যে নিজের নতুন জায়গা মানিয়ে সারাজীবন অন্যের জন্য বাঁচে!”
“কর্মক্ষেত্রে ফিরিবার পূর্বে আমার শ্বশুর আমাকে ডাকিয়া বলিলেন,’বাবা’,আমার মেয়েটিকে আমি সতেরো বছর ধরিয়া জানি,আর তোমাকে এই ক’টি দিনমাত্র জানিলাম,তবু তোমার হাতেই রহিল। যে ধন দিলাম,তাহার মূল্য যেন বুঝিতে পার,ইহার বেশি আশীর্বাদ আর নাই। “( হৈমন্তী) ”
আগে ও এটা পড়েছি; তবে আজকের মতো উপলব্ধি হয়নি। মানুষ কখনো শতভাগ শুদ্ধ হয় না,যদিও হয় সে থাকে মানুষের উর্ধে। কাউকে বিচার করার বিচারিক ক্ষমতা বলেন যোগ্যতা বলেন কোনটাই দেখাবার দূঃ সাহস আমার নেই। তবু্ও আমার নিজস্ব চিন্তা,চেতনায়, ভাবনা,ভালোবাসায় কিছু মানুষ আমার হৃদয়ের আঙিনায় সবসময় বিচরন করেন।
আজ যার কথা বিশেষ ভাবে মনে পড়ছে,উনি হচ্ছেন আমার বাবার খালু।আমাদের দাদা যখন মারা যান, আমার ফুফুর বয়স কত ছিল সেটা আমার জানা হয়নি তবে শুনেছি বাবার বয়স তখন এক বছর। সুতরাং দাদা কেমন হয় সেটা আমরা ভাই-বোনরা কেউ উপলব্ধি করতে পারিনি। পরবর্তীকালে দাদা বলে যাকে দেখেছি, চিনেছি সে হচ্ছে আমার বাবার খালু। দাদা তখন সরকারি চাকরি থেকে রিটায়ার্ড করে দুলামিয়া কটন মিলে এডভাইজার পদে কর্মরত।বাবা তখন বেঁচে নেই। আম্মাকে দেখতাম ভাল-মন্দ রান্না হলে কিংবা কঠিন কোন পরিস্থিতির সমাধান খুঁজে না পেলে দাদাকে চিঠি লিখে পাঠাতেন।কটন মিল বাড়ির কাছে হওয়াতে, যে কোন একজন লোকের হাতে নাম লিখে পাঠিয়ে গেইট ম্যানের হাতে দিলেই জায়গা মতো পৌঁছে যেতো।
দাদাও চিঠি পেয়ে ছুটে আসতেন। দাদাকে দেখতে পেলে আম্মার মনের মেঘ যে অনেক খানি কেটে যেতো তা আমমার চেহারা দেখলে অনুমান করা যেত। আমার দাদী তখনও বেঁচে ছিলেন। সম্পর্কে আমার দাদী বড় ছিলেন।দাদা আমার দাদিকে বসে পা’ ধরে সালাম করতেন।এত সম্মান ভাবা যায় না!! একজন বয়স্ক মানুষ যখন অন্য একজন মানুষকে বসে পা ধরে সালাম করে,সত্যিই এটা দেখলে ভালোলাগার অন্য রকম অনুভূতি কাজ করে।
খাওয়া -দাওয়া শেষ হলে আম্মা দাদার সাথে নিরিবিলি ভালো -মন্দ সব বলতেন।দাদা সব শুনে হয়তো মনে সাহস যোগাতেন। এমন ঘটনা প্রায় ঘটতো। দাদা আমাদের চার ভাই-বোনকে অনেক ভালোবাসতেন।দাদাকে দেখলে যে কি পরিমান আনন্দিত আমরা হতাম তাতেই বোঝা যেত ভালবাসার আদান-প্রদান ছিল কতটা নির্মল।
পরবর্তীতে আমার বিয়ের সকল বন্দোবস্ত দাদা করেন।দাদা যখন হাসপাতালে ভর্তি বার বার আমাদের খবর পাঠাচ্ছিলেন। আমি আর আমার স্বামী গেলাম রাজধানীর ধানমন্ডিতে অবস্থিত সালাউদ্দিন হাসপাতালে। আমাদেরকে দেখে দাদার চেহারায় আনন্দের আভা ফুটে উঠলো। আমার স্বামীর সাথে আলাদা করে কি যেন বললেন। দাদা মারা গেলেন। দাদা মারা যাওয়ার কয়েক বছর পর আমার স্বামী কার সাথে যেন দাদার কথা বলতে বলতে মুখ ফসকে সেদিনের দাদার বলা গোপন কথাটি মনের অজান্তে বলে ফেলেন।দাদা নাকি আমার ব্যাপারে বলেছিলেন, ” এখন বুঝবে না আমি তোমাকে কি দিলাম,একদিন ঠিক বুঝবে।তার অমর্যাদা করোনা।”
আজ হৈমন্তী পড়তে যেয়ে ওখানেই আটকে গেলাম।দাদার মিষ্টি চেহারা,ভুবনমোহিনী হাসি, অপরিসীম ধৈর্য, আচার-ব্যবহার শতভাগ শুদ্ধ মানুষের কাছাকাছি। কলেজ ছুটির পর কতদিন দেখতাম,দাদাকে অফিসে বহন করা গাড়িটি কলেজের গেটের সামনে। অবাক হতাম দাদা যখন বলতো,” আসেন, বাড়ি যাবেন না!! ”
দাদা মারা যাবার পর আম্মা খুব দূঃখ পেয়ে কান্না করতে করতে বলেছিলেন, ” আমার ছেলেমেয়েদের জন্য কথা বলার আর কেউ রইল না।” সেদিন সে কথার অর্থ না বুঝলেও আজ বুঝি। আজ বেঁচে থাকলে দাদাকেও আমার অনেক বলার ছিল…
জানি, এমন মানুষগুলো ওপারেও ভালো থাকবেন।
৪ Comments
congratulations
চোখে জল এসে গেলো। আসলেই দাদারা এমনি হন।
আত্মকেন্দ্রীক এই সমাজে বর্তমানের ছেলে-মেয়েরা দাদা-দাদীর আদর/কদর কি জিনিস, সেটা যেমন জানে না। আবার দাদা-দাদীর সাথে থেকে বেড়ে ওঠা ছেলে-মেয়েদের মেধা ও বুদ্ধিমত্তা এবং সামাজিক মূল্যবোধ অনেক বেশি থাকে।
চমৎকার লেখনী,খুবই সুন্দর
এত সাবলীলভাবে খুব কম লেখকই মনের কথা ফুটিয়ে তুলতে পারে, অভিনন্দন ।