টুকরো খামে নিলর্জ্জ জোছনা
নদীতে জাগা নতুন চর দখলের বেপরোয়া লেঠেলের মতো হুংকার ছেড়ে রমজান তেড়ে যায় মাজেদার দিকে। তার রক্ত জবার মতো লাল চোখ দুটো যে কারো হাড়ে হাড়ে কাঁপন ধরাবে। মাজেদার জায়গায় অন্য যে কোনো মেয়ে মানুষ হলেই সে হুংকারে চারাগাছে বাতাস লাগার মতই থর থর করে কাঁপতো। কিন্তু মাজেদা একেবারে স্বাভাবিক। সে একমনে সর্বশক্তি দিয়ে ধানের তুষ ঝেরেই চলছে।
তার কাছে এই তুষই স্বর্ণখনি যা থেকে সে একটি একটি করে আলাদা করছে চালের খুদ। গত তিনদিন তার সন্তানেরা শুধু পানি আর কলমি শাক খেয়ে আছে। বৃদ্ধ শ্বশুর পেটের ব্যথায় কাতরাচ্ছে। খাবারের অভাবে পেটের সন্তান নির্জীব। তাই বেচারির স্তব্ধ মুখে আঁধার জমে আছে আর ভিতরে জমেছে ক্ষোভ। সন্তানদের জন্য এই ভরা পেটেও সে অন্যের বাড়ি কাজে গিয়েছিল। দুই ধামা ধান ভেনে এই তুষগুলো নিয়ে এসেছে সে। এক মুঠো ভাত চাই, বেলি ফুলের মত ধবধবে সাদা ভাত। তাই রমজানের চোয়াল শক্ত মুখের পাঁচালী, তরমুজের বিচির মতো দাঁত কড়মড় আর নিষ্প্রাণ বাতাসে ঘুষি বগানো আস্ফালনে কিছুই যায় আসে না তার। মাজেদার এই নির্লিপ্ত ভঙ্গি রমজানের চোখে- মুখে আগুন ধরিয়ে দেয়। মরিচ লাগার মতো জ্বলতে থাকে সারা গা। একবার ভাবে কষে এক লাথি মারবে কিন্তু সাহস হয় না। কেবল নিজের অক্ষমতার জন্য রক্তে বান ডাকে, বুকে বড় বড় শ্বাস ওঠা-নামা করে।
এক সময় হেলে পড়া সূর্যের মতো তেজ কমে আসে রমজানের। তক্তপোষে শুয়ে এপাশ-ওপাশ করে। দুপুরের কড়া রোদ ফুটো চাল আর বেড়ার ফাঁক গলে গায়ে লাগে ওর। গত রাতের কথা মনে পড়তেই মাথাটা ভনভন করে, মাজেদার উপর ঘৃণায় মুখ কুঁচকে আসে। রাগে দুঃখে থুথু ছিটায় সে। মাজেদা তাকে পুরুষত্ব নষ্ট করতে বলে কোন সাহসে? অভাবের ঘরে চার সন্তান থাকার পরও আল্লায় আবার সন্তান দিলে সে দোষ কি রমজানের?
কিন্তু ক্লান্ত,বিরক্ত হয়ে মাজেদা কেবল তাকেই দোষ দেয়। তার সাপের ফনার মতো জিহ্বার তীক্ষ্ণ বানং রমজানকে ফালাফালা করে। অথচ বিয়ের সময় মাজেদা ছিল কলমি লতার মতো থকথকে আর কোমল।
অভাবের সূর্য শুষে নিয়েছে তার ঢলো ঢলো লাবনী। কারণ রমজানের সাথে বিয়ে হয়ে সে কেবল অভাবই দেখেছে কিন্তু রমজান তো ইচ্ছা করে অভাব ডেকে আনে নাই। অভাব বুকে নিয়েই তার জন্ম, জমি-জিরাত বলতে কিছুই নেই। সরকারি খাস জমিতে ঘর তুলে কোন মতে মাথা গুঁজে আছে। কাজে অলসতা তার কখনোই ছিল না। পাথুরে মাটিতে কোদাল চালাতে চালাতে হাতে ফোস্কা পড়লেও মন ছিল তার টনটনে। লাঙ্গলের ফলায় জমিকে ক্ষতবিক্ষত করা থেকে রাস্তায় বসে জুতো সেলাই কোন কিছুতেই তার লজ্জা নাই। এতদিন তবু কোন মতে সংসার চালিয়ে নিচ্ছিল সে কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে এলো অদৃশ্য শত্রু, শুরু হলো লকডাউন। অন্যদিকে প্রকৃতিরও মেজাজ খিটিয়ে উঠেছে- বৃষ্টি নেই, জমিতে ফসল নয়, কোন কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই, চারিদিকে কেবল নেই নেই আর নেই।
সন্তানগুলো না খেয়ে হাড়ে হাড়ে বাড়ি খায়। বৃদ্ধ বাপ মানুষের কাছে হাত পাতে কিন্তু শূন্য হাত আবার তার কাছেই ফিরে আসে।
এসব ভাবতে ভাবতে রমজানের পেটের খিদে লকলকিয়ে ওঠে। পেটের নাড়িভুড়ির ভিতরে জংলি খিদের দাবানল পুড়িয়ে ছাই করে রমজানকে। সে ঘরের বাইরে বের হয়ে অপেক্ষা করে ডুবন্ত সূর্যের।
একটু পরেই সন্ধ্যার আকাশে সূর্যের রক্তিম আভা মিলিয়ে যায়, সেই সঙ্গে সঙ্গে রমজানের বিবেকও শোলার পুতুলের মতো ভেসে যায়। সে গুটিগুটি পায়ে ঢোকে ব্যাপারি বাড়ির রান্না ঘরে। পাতিল ভর্তি গরম ভাতের গন্ধ তার নাকে সুড়সুড়ি দেয়।
শুধু ভাত না, পাশেই ড্রাম ভর্তি চাল। রমজান গামছায় মুঠো মুঠো চাল ঢালে। আহা, সোনারঙা চকচকে চাল। চালগুলো পুটলি করে কাঁধে রাখতে গিয়ে বিবেক গর্জে ওঠে তার কিন্তু স্রোতের মুখে কুটো যেমন হারিয়ে যায় তেমনি বিবেকও ছ্যাছরিয়ে যায় ভাতের পাতিল এর দিকে। পাতিল হাতে ঘর থেকে বের হতেই গিয়েই চোখা-চোখি হয় ব্যাপারী গিন্নির সাথে।
কিছুক্ষণের মধ্যে পিলপিল করে কালো পিঁপড়ের মতো বিভিন্ন বাড়ি থেকে ঘাম ঝরা মানুষের ঝাঁক বেরিয়ে আসে।
এক ধরনের মানুষ আছে যারা কাঁদতে পারেনা বলেই শান্ত থাকে। রমজানও তাদের দলের একজন। অজস্র কিল-ঘুসির ওজন সইতে না পেরে ফুলে ফুলে ওঠে রমজানের শরীর। মনে হয় শরীরটা যেন জোড়া জোড়া থেকে খুলে পড়ছে। আঘাতের জায়গাগুলো থেকে রক্তের বদলে কষ ঝরতে থাকে। শারীরিক কসরত করতে করতে ক্লান্ত পাষাণ জনগণের মন অবশেষে গলতে শুরু করে। প্রথমবারের অপরাধের ক্ষমা হিসাবে মুক্তি পায় রমজান।
পা টানতে টানতে কোন মতে বাড়ির পথ ধরে সে। তার শরীরের ভেতর সাইক্লোন প্রবাহিত হচ্ছে, বুকের ভিতর চায়ের ফুটন্ত কেতলির মতো ঘড়ঘড় আওয়াজ হচ্ছে। একসময় পরাজিত সৈনিকের মতো মাথা নিঁচু করে ঘরে ঢোকে সে।
ভাঙা ঘরে এখনো মাটির পিদিম ধুঁকে ধুঁকে জ্বলছে। চেরাগের মৃদু আলোয় রমজান মাজেদার দিকে তাকায়। মাজেদা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, কাপড় এলোমেলো। হয়তো প্রসব বেদনায় ছটফট করেছে নয়ত খিদের চোটে তড়পায়ছে তার বৌটা। মাজেদা বেঁচে আছে কি মরে গেছে সেটা ভাবতে সাহস হয় না রমজানের।
মাজেদার পাশে সন্তানরা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে। তাদের তেল চিটচিটে ধুলোবালি মাখা মুখে এখনো অশ্রুর দাগ লেগে রয়েছে। খিদের জ্বালায় কান্না করতে করতে হয়ত ঘুমিয়ে গেছে ওরা।
ঘরের এক কোণে ইঁদুর আর তেলাপোকার সাথে রমজানের বৃদ্ধ বাপের সংসার। তার দিকে এগিয়ে যেতেই নড়ে উঠল মানুষটা। যদিও রমজানের কাছে তাকে মানুষ বলে মনে হয় না। কঙ্কালের উপর ঝুলে পড়া কুঁচকানো চামড়া লাগালে যেমন উদ্ভট মনে হয় রমজানের কাছে তার বাপকেও তেমনি লাগে। গরিব হয়ে জন্মানোর জন্য এই মানুষটার উপর তার আজন্ম আক্রশ কিন্তু আজ কেন জানি বড্ড মায়া হয় বুড়োটার জন্য। রমজান পরম মমতায় বাপের বুকের হাড়গুলো মালিশ করে, মুখের চারপাশে লেগে থাকা থুথু পরিস্কার করে। বৃদ্ধ আধ বোজা চোখে রমজানের দিকে তাকায়। করুণ সুরে বলে “এক থাল ভাত দিবি বাপ!”
রমজান মাথা নিঁচু করে থাকে,তার চোখে বাষ্পের তাপ।
বাপ তার ক্ষীণ স্বরে বলে সকালে সে মাইল তিনেক পথ লাঠি ভর দিয়ে হেঁটে সরকারি হাসপাতালে গিয়েছিল পেটের পীড়ার ওষুধ আনতে। ডাক্তার অনেকগুলো বড়ি দিয়েছে সাথে মধুর মত মিষ্টি এক শিশি ওষুধ। বাড়ি ফিরে খিদের জ্বালায় ওষুধগুলো চিবিয়ে সব খেয়ে ফেলেছে সে। এখন তার খুব ঘুম পাচ্ছে। মাজেদ ভেজা তুলোর মত নরম চোখে তাকিয়ে থাকে বাপের দিকে। অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করে তার কিন্তু পোড়া কাঠের মতো শক্ত হয়ে থাকে তার জিহ্বা। নির্বাক। উলঙ্গ অভাব যখন জীবনীশক্তি কেড়ে নিচ্ছে তখনও মধ্যরাতে নির্লজ্জ জোছনার বান ডেকেছে। মাজেদের খুব জোছনা দেখতে ইচ্ছে করে। দাওয়ায় বসে সে জোছনা দেখে। এক সময় জোছনাগুলো ভাত হয়ে গলে গলে পড়ে। মাজেদ কোচর ভর্তী করে ভাত কুড়ায়। তার গপাগপ ভাত খেতে মন চায় অথচ গভীর ঘুমে তার চোখ বুজে আসে। নিশ্চিন্ত ঘুমে ঢলে পড়ে মাজেদ।