২০২ বার পড়া হয়েছে
কবি ও প্রাবন্ধিক মনজুরে মওলা’র মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি
অন্তরস্থ দৃষ্টি ও সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধ আকুলতা
গোলাম কিবরিয়া পিনু
————————————
কবি ও প্রাবন্ধিক মনজুরে মওলা হারিয়ে গেলেন, ২০শে ডিসেম্বর ২০২০, করোনাকালের এক অংশী হয়ে। কী এক বাস্তবতা আমরা অতিবাহিত করছি, আমাদের অনেক বিশিষ্টজনকে হারালাম ইতোমধ্যে, যাঁরা আমাদের মননশীল অবস্থানকে উজ্জ্বল করেছেন, তাঁদেরই অন্যতম তিনিও ছিলেন। আর কতদিন এমন বেদনার স্ফিতি হবে? আমরা তাতে ডুবতে থাকবো! এমন অন্তরস্থিত কষ্টবোধ জেগে উঠছে–আমাদের! এর মাঝে বসবাস করে–স্মরণ করি–শ্রদ্ধা জানাই মনজুরে মওলাকে। গত ১লা অক্টোবর ছিল, তাঁর ৮০তম জন্মবার্ষিকী কিন্তু করোনাকালের কারণে, আনুষ্ঠানিকতা রহিত হয়, তেমনি অনেক প্রিয়জনও সেদিন তাঁর সান্নিধ্য থেকে দূরবর্তী থাকতে বাধ্য হন।
আমাদের পর্যবেক্ষণে মনে হয়েছে–এই মানুষটি, এমন এক মানুষের প্রতিকৃতি, যা এক সক্রিয় ও সৃজনশীল মানুষেরই প্রতিকৃতি! জীবনের শেষ দিনগুলোতেও তিনি সমান তালে কর্মক্ষম ছিলেন, হাঁপিয়ে পড়েননি, স্বাস্থ্যের দুবর্লতা নিয়েও! একেবারে শেষ বয়সে এসে তিনি টিএস এলিয়ট নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেছেন, তা আমরা অনেকে জানতাম না, মৃত্যুর পর তা জেনেছি! কী এক অদম্য ইচ্ছেশক্তির ভেতর বসসাব করে ধীশক্তির পরিচয় তুলে ধরলেন, তা এক বিরল উদাহরণ হয়ে থাকল! অন্য কোনো সুবিধে নেওয়ার লক্ষ্য থেকে তিনি পিএইচ.ডি. কাজে নিজেকে যুক্ত করেননি, টিএস এলিয়েেটর মুগ্ধ পাঠক হিসেবে তা করেছেন বলে–তিনি অনুভূতি প্রকাশ করলেও–তা গবেষণার পরিমণ্ডলে এক অনন্য কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। তারপরও আমরা বলবো–বয়স কোনোভাবে বিদ্যানুরাগের কাছে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না, তা এমন মানুষের মনস্তত্ত্বের প্রতি দৃষ্টি রাখলে আমরা বুঝতে পারি!
পেশাজীবনে বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন, তা আমরা জানি, সে বিষয়ে তাঁর আরও বিভিন্ন দক্ষতা ও কর্মপরিধির পরিচয় রয়েছে। এমন পেশার দায়িত্ব ছাপিয়ে–কবি, প্রবন্ধকার, অনুবাদক, গবেষক, সম্পাদক ও গ্রন্থ পরিকল্পক হিসেবে তাঁর সৃজনশীলতায় যে সিলমোহর তিনি রেখেছেন, তার সুলুকসন্ধান করলে–আমরা বিস্ময়াভুত হই! এক জীবনে–একটি মানুষের এতগুলো পরিচয়ের ভিত্তিমূল–সৃজনশীল ভূমিতে; তাতে আমরা শুধু চমকে যাই না, আমাদের গভীর শ্রদ্ধাও জাগে–এমন সম্মাননীয় পূর্বসূরির প্রতি, যাঁরা তাঁদের সৃজনশীল স্পর্ধায় আমাদের মননশীলতা ও সংস্কৃতিমানকে উজ্জ্বল করেছেন।
মনজুরে মওলা, আশির দশকে প্রায় তিন বছর তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, এই তিন বছরে কী এক যাদু স্পর্শে–বাংলা একাডেমির কার্যক্রমে নিয়ে এসেছিলেন অসামান্য সংযোজন, পরিবর্তন ও নতুনবিন্যাস। কর্মচঞ্চলতায় জেগে উঠেছিল বাংলা একাডেমি, বাংলা একাডেমিও খুঁজে পেয়েছিল–পথচলার দিশা, যার ফলে একুশে বইমেলার হলো নতুন বিন্যাস, গোড়াপত্তন হলো একুশে বক্তৃতা, রচিত হলো–‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’, ‘ছোটদের অভিধান’; শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি প্রদর্শনী আয়োজন হলো, শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ-স্মারকগ্রন্থেরও উদ্যোগ নেওয়া হলো। প্রথম জাতীয় ফোকলোর কর্মশালার আয়োজন হলো, আরজ আলী মাতুব্বর ও খোদা বক্স সাঁইয়ের মতো মানুষকে ফেলোশিপ প্রদান করা হলো, ‘ডেভিডসনের চিকিৎসাবিজ্ঞান’ কিংবা আনিসুজ্জামানের ‘পুরোনো বাংলা গদ্য’-এর মতো বই প্রকাশিত হলো। ঐতিহাসিক বর্ধমান ভবন সংস্কারের সাথে সাথে বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকুবিধিরও সংস্কার হলো। ‘ভাষাশহীদ গ্রন্থমালা’–শিরোনামের ১০১টি ব্যতিক্রমী বই প্রকাশিত হলো–যা ইতিহাস, ভাষা, সাহিত্য, সাহিত্যতত্ত্ব ও সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রচিত হলো, বিভিন্ন ধরনের পাঠকের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল! বহু লেখককেও আমরা পেলাম। শুধু কি তাই? না, মনে হলো–বাঙালির মনীষার এক সম্মিলন হলো–অগ্রজ্ঞান নিয়ে, যারফলে মনে হলো মননশীলতার একটি পাটাতন তৈরি হলো, এইসব বইয়ের ঐকসূত্রে। এসব হয়েছে–মনজুরে মওলার অন্তরস্থ দৃষ্টি, স্বদেশানুরাগ ও সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধ আকুলতা থেকে। মনে হয়েছে–তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন বাংলা একাডেমিকে, স্বপ্নের পর, বাস্তবতার এক রূপকল্পে।
মনজুরে মওলা লিখেছেন দুটো কাব্যনাট্য ‘আমি নই’ ও ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘দশমী’ বইটিকে কেন্দ্র করে লিখেছেন ‘নষ্ট নীড়’। অনুবাদ করেছেন ইবসেনের নাটক ‘ব্র্যান্ড’, এলিয়টের ‘সুইনি’ ও ‘দ্য রক’, ‘গির্জায় খুন’। অনেকটা বেশি বয়সে ‘নিমগ্ন, কী করে পারো’–নামের প্রথম কবিতার বই প্রকাশ হয়। ২০২০ সালে ‘জোরে শ্বাস নাও’–নামের কবিতার বইটি বের হয়। আমরা সাহিত্যের ইতিহাসে দেখি–অনেকে তাঁদের শেষ বয়সে এসে সৃজনশীলতার বিশেষ স্বাক্ষর রাখেন। মনজুরে মওলাও সেইদিক থেকে এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
‘মূর্ধন্য’ প্রকাশনার উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ১৫১টি বইয়ের প্রকাশনার সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন। ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’–নামের একটি গ্রন্থও তিনি সম্পাদনা করেন, এই প্রকাশনা থেকে। ২০১৮ সালে মনজুরে মওলা সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের কবিতা ১৯৪৭-২০১৭’ বইটি উল্লেখযোগ্য সংকলন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা ‘মূর্ধন্য’ থেকেই প্রকাশিত হয়েছে। ৯৫০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ, যা ইতিপূর্বে প্রকাশিত কাব্য-সংকলনের মধ্যে অন্যতম। এই সংকলনে–‘সত্তর বছরের কবিতা’ শিরোনামের ৭৭ পৃষ্ঠার ভুমিকা লিখেছেন তিনি। এই লেখাটায়, কবিতা সংকলনটি কেন–সে সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রায় হারিয়ে যাওয়া কবিদের নেওয়া হলো কেন, তা-ও বলেছেন, পুর্বের উল্লেখযোগ্য সংকলন নিয়েও আলোচনা এসেছে। কোনো কবির দুটি কবিতা, কোনো কবির দুয়ের অধিক, কোনো কোনো কবির সাতটি কবিতাও নেওয়া হয়েছে। আশ্চর্য হতে হলো–মনজুরে মওলা তাঁর নিজের একটি মাত্র কবিতাকে স্থান দিয়েছেন–এই সংকলনে। এমন পরিমিত হয়ে সম্পাদনা করেছেন–এই সংকলনটি, যা এর আগে দেখা যায়নি–্এমনটি ।
তিনি উল্লিখিত বইয়ের ভূমিকার একাংশে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা তুলে ধরেছেন–‘‘যে-কবিতা আধুনিক মানুষের জীবন আধুনিক ভাষায় তুলে ধরে তা-ই আধুনিক কবিতা। আধুনিক মানুষ কে? সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে জীবন পাল্টে যায় : (১) যিনি এই পাল্টে-যাওয়ার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন; (২) এ পাল্টে-যাওয়াকে নিজের সুবিধে ও অন্যের কল্যাণের জন্য কাজে লাগাতে পারেন; এবং, (৩) একই সঙ্গে, যে-মূল্যবোধ বহুদিন ধরে একটু-একটু করে নানা দেশে বহু মানুষের মধ্যে গড়ে উঠেছে, তা সমুন্নত রাখতে ও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, তাঁকেই আমি আধুনিক মানুষ বলে মনে করি। এইসব মূল্যবোধের মধ্যে আছে : (১) মিথ্যাকে প্রতিরোধ করা ; সত্যকে সমর্থন করা ; (২) শঠতাকে প্রত্যাখান করা ; সততাকে গ্রহণ করা ; এবং (৩) মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ; মানুষকে ভালোবাসা।’’ কী গভীর উপলব্ধিজাত বিবেচনা, কী দার্শনিক অভিব্যক্তি–এই সুচিন্তা নিয়ে আমাদের চৈতন্য জাগ্রত রাখা সমীচীন–কবি ও মানুষ হিসেবে।
আমার সাথে তাঁর দু’একটি ব্যক্তিগত স্মৃতি ও যোগাযোগের ঘটনা তো আছেই, এ বছরের প্রথমদিকে ফোন করেছিলেন, আমার কবিতা পড়ে, সে সম্পর্কে বলেছিলেন, আন্তরিকতায় ও একজন কবিতার অভিভাবক হিসেবে; তা এখনো অনুরণিত হচ্ছে–আমার ভেতরে! কিন্তু তাঁর কর্ম, অভিজ্ঞান, লেখা ও কবিতার পঙক্তি গভীরভাবে আজ আমাকে স্পর্শ করছে। তাঁকে খানিকটা আবিষ্কার করা মানেই–একজন আধুনিক মানুষের সান্নিধ্যে যাওয়া, এই রকম সান্নিধ্যের মানুষ পরম্পরায় যত থাকবেন–ততই আমাদের মঙ্গল। শেষে তাঁর কবিতার উচ্চারণ করি–‘কবির তো পালাাবার কোনো পথ নেই।/ দেখা দেন ভিভিয়েন পালাতে গেলেই।’’