১৯২ বার পড়া হয়েছে
মন জানালা খুলে দে না …
রুমা ব্যানার্জি
কোলকাতা থেকে জলপাইগুড়ি, সেখান থেকে জুলুক থেকে নাথাঙ, ছাঙ্গু, আরিটার হয়ে আবার ফেরা কলকাতা।
যখন চার দেওয়ালের মাঝে ট্যাক্লিং, ড্রিব্লিং, আর পেনাল্টি বাঁচিয়ে হাঁফ ধরে যায়, তখন মনটা একটু বিশ্রাম নিতে চায় । বুক ভরে শ্বাস নিতে ইচ্ছে করে । তখন একটু বেড়ানোর থেকেই বেস্ট অক্সিজেন মেলে ।ভাবছিলাম সেই গল্প শোনাই ।বেড়ানোর গল্প না শোনাতে পারলে বেড়ানোর মজাটাই অসম্পূর্ণ অনেকটা ছেলেবেলায় গোল হয়ে বসে ভাগ করে টিফিন খাওয়ার মত।বেশ ব্যাপার কিন্তু ।দিব্য ব্যাপার ।শুনবেন?বেড়ানো শব্দটা শুধুমাত্র গিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে চলে আসা নয়।আমার মতে বেড়ানো শুরুটা হয় ” আর ভালো লেগেছে না।ক’দিন কোথাও ঘুরে এলে বেশ হতো ।” থেকে চেনাশোনা সবাই কে বেড়ানোর খুঁটিনাটি শোনানো অবধি ।বাঙালি চেনা যায় কিসে?খাওয়া, বেড়ানো আর রবীন্দ্রনাথে!!! শহরের কংক্রিটের জঙ্গলে প্রাণ হাঁফিয়ে ওঠে তখন এক মাত্র ভরসা… দিপদা, দিঘা-পুরী- দার্জিলিং । তবে আমার পছন্দ পাহাড়ি নির্জনতা ।যতই হোক, পাহাড় আমার প্রথম পরেম বলে কথা , একটু পক্ষপাতদুষ্ট তাই হওয়াই যায় ।পাহাড়ের জন্য আমি যে কোন বদনাম নিতে রাজি ।
বেড়াতে যেতে কত জনের কত কিছু লাগে– ভাল বড় হোটেল, শপিং, ঘরে টিভিতে বাংলা চ্যানেল, নেট কানেকশন। আমার ও কিন্তু কটা জিনিস লাগে– ছারপোকা হীন বিছানা, একটু ভদ্র গোছের বাথরুম আর সব থেকে বেশি রান্না করা খাবার। বেড়াতে গিয়ে সিদ্ধ পোড়া যা দাও তাই খাবো ।শুধু রান্না করবনা। আরে বাবা, আমার ও তো ছুটি নাকি?
এবারের যাত্রা কে বিভ্রাট যাত্রা বলেই মনে মনে নামকরণ করেছিলাম । আর তা হবে নাই বা কেন?? এমনিতেই বাঙালির হুজুগে বলে নাম ডাক প্রচুর , অতি বড় শক্র ও বাঙালি কে ঘরকুনো বলতে দ্বিধা করবে এই ব্যপারে আমি বাপু হলফ করে বলতে পারি ।জগৎ কে মুখে মারতে আর চষে ফেলতে আমাদের জুড়ি মেলা ভার।প্রায় সব মোড়ে দাঁড়িয়ে বা বসে অথবা চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে যে পরিমাণ গবেষণামূলক আলোচনা ও সমালোচনা হয় তা নিয়ে উচ্চতর স্কেলে কি হয় ভাবার মত ধূসর পদার্থ আমার খুলিতে নেই ।এই অর্বাচীন স্বজন রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট বোঝে না ।সাদা মাটা সোজা সাপ্টা কথা বোঝে ।
তবে পাহাড় শব্দটায় যে কি যাদু আছে জানি না । শব্দটি উচচারণ মাত্র বোধবুদ্ধি সব কিছু ঘেঁটে ঘ। সেটা তো আগেই বলেছি ।
যেখানে বেশির ভাগ মানুষই চার মাস আগে থেকে পরিকল্পনা করেছে সেখানে চার বিপ্লবী বাঙালি মাত্র চার দিনের সময় হাতে নিয়ে গন্তব্যের খুঁটিনাটি নিয়ে গোল টেবিল বৈঠক বসিয়ে ফোন করে, ফোন ঘেঁটে যুদ্ধ কালীন তৎপরতায় বেড়ানোর ঠিকুজি কুষ্টি তৈরি করলো। মাত্র চার জনে কি বিপ্লব জমে? শুরু হল হাঁক ডাক।
আয় আয় কে যাবি
আয় কে মন হারাবি
এক মুঠো রোদ ধরতে।
থুড়ি- –শীত ধরতে।
বিফল হলেও কুছ্ পরোয়া নহি।
হম্ চার সাথ হ্যয়।
ঠিক কিসে চড়ে পাড়ি দেব তা নিয়েও বিভ্রাট । অতি কষ্টে টিকিট যোগাড় হলো ।কিন্তু সেখানেও বিভ্রাট- – বাতানুকূল নয়।না হোক গে । চালাও পানসি বেলঘরিয়া । পাহাড় ডেকেছে বলে কথা ।
খোল দ্বার খোল।
তোল পাল তোল ।
চরম গরমেও ঘেমে নেয়ে গরমের জামা কাপড় গুছিয়ে … চলো লেট্স গো।
অনেক বছর বাদে সেই ছোট্ট মেয়েটিকে খুঁজে পেলাম ।জানালার কাঁচ তুলে রেলিং ধরে বসা।মুখের উপর ঘেমো শহরের নোনা বাতাসের ছাড়িয়ে পড়ছে ।চুলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে ওলোটপালট করে দিচ্ছে পারিপাট্য ।কিন্তু তাতে কি? এদের হাত ধরেছে আমার ছেলেবেলা(মেয়েবেলা বললে হতো কিন্তু ছেলে বেলা বলতে আমার ইগোয় লাগে না তাই বলছি না।) ।
সহযাত্রীরা কিন্তু বেশ ।ছেলেটি নিজেই যেচে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে রাখলো । দরকার মতো নামানো বা ওঠাতে ও সাহায্য করতে এগিয়ে এলো ।তার জামাইবাবু নিজের সিটের এক ধারে আমার ব্যেকপ্যেক রেখে বললেন .. আমি দেখছি, চিন্তা নট্ ।এই বলে হাসি মুখে বাঙ্কে উঠে বসলেন ।হঠাত্ মন খুশিতে ভরে উঠল । কি সহজ স্বাভাবিক আর অকিত্রিম ব্যবহার ।মুখের উপর মুখোশের অভ্যাস টা ভেঙে মন্দ লাগলো না।
চলন্ত ট্রেনের জানালার এপাশে আমি আর ওপাশে চাঁদ তার নীরবতা ও জোছনা নিয়ে এক সঙ্গে ছুটে চলছে । উঁচু উঁচু বাড়ির ছায়ায় চুরি হয়ে যাওয়া আকাশের ফালিতে আজ খুঁজতে হলো না তাকে। থেকে থেকে জাতীয় সড়ক ধরে ছুটে চলা লরি বা ভলভো বাসের উজ্জ্বল আলো এবং অজানা আধা শহরের টিম টিমে ল্যাম্প পোস্টের আলো গুলো কতদিন ঠিক মতো খেয়াল করে দেখিনি । মাঝে মাঝে পার হয়ে যাচ্ছে নির্জন ছোটো স্টেশন ।চালশে ধরেছে অনেক দিন, তবুও পড়তে পারবোনা জেনেও, চোখ কুঁচকে স্টেশনের নাম পড়ার চেষ্টা ছাড়ি নি।অন্ধকার কামরায় উপুড় হয়ে শুয়ে জীবন্ত ভ্রমণ কাহিনী পড়তে দিব্য লাগল । মাঝে মাঝে মনটা পিছিয়ে পৌঁছিয়ে যাচ্ছিল অতীতের পাতায় ।যদিও বইটার অনেক গুলো পাতাই আঁচড় কাটা হয় নি।আনকোরা থেকে গেছে ।তাও সেটাই দেখি।নীরবতা যেখানে মুখরিত হয়,আনকোরা পাতা সেখানেই উপলব্ধির গন্ডি পেরিয়ে ছোটো গল্পের অমনিবাস । ঠান্ডা হাওয়ায় চোখ জুড়িয়ে এলে থেকে থেকে চিনি ঘুম দিয়ে নিয়েছি। খুব ভোরে মালদায় ট্রেন ঢুকলে চা চা বলে হাঁকডাক শুরু হলো ।বুঝলাম আর না ।এবার ঘুমাতে হবে। বিভ্রাটের নয় এক অনুভূতি পূর্ণ যাত্রা শুরু হলো ।শুধু একটাই আফসোস থেকে গেল। প্রতিটা মুহূর্ত কে যদি ধরে রাখতে পারতাম। কবিতা না হোক গল্প হলেও হত। এই অধম কিছুই পারে না।নাহ্ এবার ফিরেই বাকেট লিস্টে লেখক হওয়ার ইচ্ছে টা যোগ করে রাখতে হবে।যারা পারে তাদের এতদিন হিংসা করে এসেছি । তাই আপাতত সেই হিংসা টাকেই মনে মনে জড়িয়ে একটু ঘুমিয়ে নিলাম
তবে পাহাড় শব্দটায় যে কি যাদু আছে জানি না । শব্দটি উচচারণ মাত্র বোধবুদ্ধি সব কিছু ঘেঁটে ঘ। সেটা তো আগেই বলেছি ।
যেখানে বেশির ভাগ মানুষই চার মাস আগে থেকে পরিকল্পনা করেছে সেখানে চার বিপ্লবী বাঙালি মাত্র চার দিনের সময় হাতে নিয়ে গন্তব্যের খুঁটিনাটি নিয়ে গোল টেবিল বৈঠক বসিয়ে ফোন করে, ফোন ঘেঁটে যুদ্ধ কালীন তৎপরতায় বেড়ানোর ঠিকুজি কুষ্টি তৈরি করলো। মাত্র চার জনে কি বিপ্লব জমে? শুরু হল হাঁক ডাক।
আয় আয় কে যাবি
আয় কে মন হারাবি
এক মুঠো রোদ ধরতে।
থুড়ি- –শীত ধরতে।
বিফল হলেও কুছ্ পরোয়া নহি।
হম্ চার সাথ হ্যয়।
ঠিক কিসে চড়ে পাড়ি দেব তা নিয়েও বিভ্রাট । অতি কষ্টে টিকিট যোগাড় হলো ।কিন্তু সেখানেও বিভ্রাট- – বাতানুকূল নয়।না হোক গে । চালাও পানসি বেলঘরিয়া । পাহাড় ডেকেছে বলে কথা ।
খোল দ্বার খোল।
তোল পাল তোল ।
চরম গরমেও ঘেমে নেয়ে গরমের জামা কাপড় গুছিয়ে … চলো লেট্স গো।
অনেক বছর বাদে সেই ছোট্ট মেয়েটিকে খুঁজে পেলাম ।জানালার কাঁচ তুলে রেলিং ধরে বসা।মুখের উপর ঘেমো শহরের নোনা বাতাসের ছাড়িয়ে পড়ছে ।চুলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে ওলোটপালট করে দিচ্ছে পারিপাট্য ।কিন্তু তাতে কি? এদের হাত ধরেছে আমার ছেলেবেলা(মেয়েবেলা বললে হতো কিন্তু ছেলে বেলা বলতে আমার ইগোয় লাগে না তাই বলছি না।) ।
সহযাত্রীরা কিন্তু বেশ ।ছেলেটি নিজেই যেচে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে রাখলো । দরকার মতো নামানো বা ওঠাতে ও সাহায্য করতে এগিয়ে এলো ।তার জামাইবাবু নিজের সিটের এক ধারে আমার ব্যেকপ্যেক রেখে বললেন .. আমি দেখছি, চিন্তা নট্ ।এই বলে হাসি মুখে বাঙ্কে উঠে বসলেন ।হঠাত্ মন খুশিতে ভরে উঠল । কি সহজ স্বাভাবিক আর অকিত্রিম ব্যবহার ।মুখের উপর মুখোশের অভ্যাস টা ভেঙে মন্দ লাগলো না।
চলন্ত ট্রেনের জানালার এপাশে আমি আর ওপাশে চাঁদ তার নীরবতা ও জোছনা নিয়ে এক সঙ্গে ছুটে চলছে । উঁচু উঁচু বাড়ির ছায়ায় চুরি হয়ে যাওয়া আকাশের ফালিতে আজ খুঁজতে হলো না তাকে। থেকে থেকে জাতীয় সড়ক ধরে ছুটে চলা লরি বা ভলভো বাসের উজ্জ্বল আলো এবং অজানা আধা শহরের টিম টিমে ল্যাম্প পোস্টের আলো গুলো কতদিন ঠিক মতো খেয়াল করে দেখিনি । মাঝে মাঝে পার হয়ে যাচ্ছে নির্জন ছোটো স্টেশন ।চালশে ধরেছে অনেক দিন, তবুও পড়তে পারবোনা জেনেও, চোখ কুঁচকে স্টেশনের নাম পড়ার চেষ্টা ছাড়ি নি।অন্ধকার কামরায় উপুড় হয়ে শুয়ে জীবন্ত ভ্রমণ কাহিনী পড়তে দিব্য লাগল । মাঝে মাঝে মনটা পিছিয়ে পৌঁছিয়ে যাচ্ছিল অতীতের পাতায় ।যদিও বইটার অনেক গুলো পাতাই আঁচড় কাটা হয় নি।আনকোরা থেকে গেছে ।তাও সেটাই দেখি।নীরবতা যেখানে মুখরিত হয়,আনকোরা পাতা সেখানেই উপলব্ধির গন্ডি পেরিয়ে ছোটো গল্পের অমনিবাস । ঠান্ডা হাওয়ায় চোখ জুড়িয়ে এলে থেকে থেকে চিনি ঘুম দিয়ে নিয়েছি। খুব ভোরে মালদায় ট্রেন ঢুকলে চা চা বলে হাঁকডাক শুরু হলো ।বুঝলাম আর না ।এবার ঘুমাতে হবে। বিভ্রাটের নয় এক অনুভূতি পূর্ণ যাত্রা শুরু হলো ।শুধু একটাই আফসোস থেকে গেল। প্রতিটা মুহূর্ত কে যদি ধরে রাখতে পারতাম। কবিতা না হোক গল্প হলেও হত। এই অধম কিছুই পারে না।নাহ্ এবার ফিরেই বাকেট লিস্টে লেখক হওয়ার ইচ্ছে টা যোগ করে রাখতে হবে।যারা পারে তাদের এতদিন হিংসা করে এসেছি । তাই আপাতত সেই হিংসা টাকেই মনে মনে জড়িয়ে একটু ঘুমিয়ে নিলাম
সারা রাত ট্রেনের ধকল কাটিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছাতেই নিমেষে উধাও হয়ে গেছে সারা রাতের ক্লান্তি।হবে নাই বা কেন? এই শহর আর পাহাড় আমার কাছে হাত ধরাধরি করে আসে। সেই ছোট্ট বেলার- –” আমরা দুটি ভাই ,শিবের গাজন গাই ” স্টাইলে।একজন এলেই অন্য জনও বলবে” ইয়েস মিস্ , প্রেজেন্ট প্লিজ্”।
শিলিগুড়ি ও সেবক ছাড়িয়ে গাড়ি চললো পাহাড়ি চড়াই উতরাই পেরিয়ে ।পাশাপাশি নেচে নেচে, গানে গানে কখনও বাঁদিকে কখনও ডান দিকে লাফিয়ে লাফিয়ে চললো তিস্তা সুন্দরী । কখনও বা অষ্টাদশীর চাঞ্চল্য কখনও বা প্রখরতা হারিয়ে প্রৌঢ়তার শিথিলতায় সল্থ। কখনো সে সবুজ শ্যামল জীবনের প্রতীক । কখনও সে ধূসর ছাই রঙের নুড়ির উপর বয়ে যায় জীবন যুদ্ধে বিধ্বস্ত শরীরে শুধুমাত্র জীবনের নিয়মে । কখনও এক্কা দোক্কা খেলতে খেলতে ।কখনও পাহাড়ি সূর্যের ওম্ মেখে এলো চুল পিঠে ছড়িয়ে আলস্যে মাখামাখি হয়ে ।শুরু হলো যাত্রা । ডেস্টিনেশন জুলুক ।গাড়ি চললো পাহাড়ি চড়াই উতরাই পেরিয়ে ।অনেকটা পথ ।প্রায় 160 কি .মি যেতে হবে। রংপো তে গাড়ি বিভ্রাট । আগত্যা গাড়ি বদল । সেখানে দেখি আমাদের নতুন সারথি কাজি , তার সঙ্গে মিষ্টি একটি নেপালি মেয়ে পার্বতী, কাজির বৌ। জরুরী সওদা নিতে এসেছিল শহরের বাজারে।বেশ মিশুকে মেয়ে পার্বতী, টুক টুকে রং, গাল দুটো গোলাপি,ছিপছিপে গড়নে আধুনিক পোষাক বেশ মানিয়েছে। অনেক শহুরে আধুনিকা কে টেক্কা দিতে পারে এই সরল প্রানবন্ত মেয়েটি। কল কলিয়ে কথা বলছে, খিল খিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ছে, কিশোরীর মতো খাবো খাবো বলে বায়না করছে, টুক্ করে ঘুমিয়ে পড়ছে , আবার গাড়ি বাঁক নিতেই চোখ কচলে উঠে বসছে। আমি দুচোখ ভরে দেখছি আর ভাবছি কোথায় যেন দেখেছি ।হঠাৎ উপলব্ধি করলাম …এ যে আমার তিস্তা!!! তিস্তার মানবী রূপ নিশ্চই ঠিক এইরকম । ইসস্ এতক্ষণ এই সহজ সাদৃশ্যটা বুঝিনি? বুঝলাম শহুরে আদব কায়দায় মনের চোখে ছানি পড়েছে ।এত দিনে মনটা কিছুটা বিবর্ণ, বিষাদের ধূসর রঙে চাপা পড়ে যাচ্ছে ।
ভাবতে ভাবতে এসে পড়ল রঙলি, এই পথের শেষ জনপদ ।এর পরে কদিন থাকবো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সীমানার বাইরে । হাওয়ায় একটা শীতল আমেজ ।ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মুঠো ফোনে যোগাযোগ করতে তৎপর হলাম । বাড়িতে ছেলে আছে যে ।যদিও সে পূর্ণ যুবক কিন্তু মায়ের মন, একই কথা বার দশেক না বললেই নয়। তাই যতক্ষণ পারলাম বকবক করে উলু বনে মুক্ত ছড়ালাম ।
ততক্ষণে কাজী কাজের কাজটা সেরে ফেলেছে, মানে এই অঞ্চলে ঢুকতে যে বিশেষ অনুমতি পত্র (permit) লাগে তা যোগাড় করে ফেলেছে । তিব্বত ও চীনের সীমান্তবর্তী এলাকায় যাচ্ছি একটু নিয়মের বেড়াজাল থাকবে এটাই স্বাভাবিক ।
পথের ধারে কোন এক অচেনা ঝরনা দেখে ঠেলাঠেলি করে নেবে পড়লাম ।কর্তা চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে বুঝেও কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা জলের ধারে ।কর্তা রে রে করে করে আঙুল নেড়ে তেড়ে এল… খবরদার বুবলি আর এক পা এগোবেনা। অতীতের ” বুবলি গিরা ” মনে করে রণে ভঙ্গ দিলাম ।বাধ্য, গোবেচারা, ভালো মানুষের মত সুর সুর করে গাড়ি তে উঠে বসলাম ।
এদিকে মেঘ ঘনিয়ে আসছে ।জুলুক পৌঁছাতে না পৌঁছাতে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। দেখলাম কারেন্ট নেই। ঝড়ে পোস্ট ভেঙে পড়েছে ।সুতরাং মোমবাতি ও টর্চই ভরসা ।
বাইরে উথাল পাতাল বৃষ্টিি , মোমের নিভু নিভু আলো, গায়ের শালটা মুড়িয়ে বসলাম । হঠাৎ মনটা উদাস হয়ে গেল … বন্যা কি অমিতের সঙ্গে এমন বর্ষা মুখর পরিবেশে মুখোমুখি বসেছিল .. কে জানে?
হঠাৎ রোমান্টিক মুড পরিবর্তন হলো । ঝুলুক্ (zuluk/Dzuluk) নামের এই ছোটো পাহাড়ি গ্রামে কত ঐতিহাসিক রোমাঞ্চ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । একসময় এই পথ বেয়ে চলতো তিব্বত বা চীনের ব্যাবসায়ীরা।সঙ্গে থাকতো মাখনের মতো নরম রেশমি কাপড় । লাসা থেকে জে -লেপ -লা বেয়ে কালিংপং হয়ে ভারতের মাটিতে । এই পথেই এসেছিলেন বিখ্যাত হিয়ুঙ স্যেং। হয়তো এমনি কোন পথের ধারে কোন এক অচেনা অজানা জায়গায় রাতের অন্ধকারে আশ্রয় নিয়েছিলেন কোনো গাছের তলায় ।ভাবতে অবাক লাগে আমি ও সেই একই জায়গায় । তার থেকেও অবাক করে হাজির হলো গরম চা সঙ্গে মুচমুচে পিঁয়াজী। সুতরাং সব চিন্তা ভাবনা ঝেড়ে ফেলে ডুব দিলাম পিঁয়াজীর বোলে।সঙ্গে নির্ভেজাল আড্ডা । ডেডলি কম্বিনেশন ।এমনিতেই একটু সকাল সকাল ওঠা অভ্যাস, তার ওপর কানে আসছিল বেশ কয়েকটি নাম না জানা পাখির ডাক ।প্রচন্ড উৎসাহে গায়ের মোটা কম্বলটা সরিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসলাম বিছানায় ।জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে মনে হলো মেঘ বাড়িতে আছি । সবে একটু আলো ফুটে উঠেছে । ইতিমধ্যে একবার গম্ভীর হুঁশিয়ারি- -‘ বেরুবে না’ । বাধ্য সুবোধ বৌ এর মত এক হাত জিভ কেটে ” ননা না.. একদম না” বলে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিলাম ।
গতকালের প্রবল বৃষ্টিতে সুটকেসটা কিছুটা ভিজেছিল, ভিতরে রাখা জামা কাপড় ও হাল্কা ভেজায় সেগুলো সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । ঘরটা এখন অনেকটা পার্সনালাইজ্ড ওয়েটিং রুমে পরিবর্তিত হয়েছে ।তার মধ্যেই এটা সরিয়ে, ওটা সরিয়ে কিছুটা জায়গায় করে জানলার গা ঘেঁষে বসে পড়লাম ।নিশ্বাসে বার বার কাঁচ টা ঝাপসা হয়ে আসছে ।ঘরটা তখনো আধো আধো অন্ধকারে । কারেন্ট আসে নি তাই ব্যাগটা টেনে নিয়ে মোবাইল খোঁজা শুরু করলাম ।উদ্দেশ্য অতি মহান ,মেঘেদের বন্দি করবো । অন্তত মিনিট দশেক কুস্তি করে অবশেষে তিনি হস্তগত হলেন।কিন্তু বিধি বাম । কারেন্টের অভাবে একটা লক্ষ্মণের লাল রেখা টেনে তিনি একবার সতর্ক বার্তা দিয়ে দেহ ত্যাগ করলেন আর সেই সাথে আমার সব উৎসাহে ভাঁটা পড়ল ।
কিন্তু আমার কাছে উৎসাহের ” ওয়াটার ওফ্ ইন্ডিয়া ” আছে ।তাই একটু ঝিমিয়েই আবার স্বমহিমায় ফিরে যেতে সময় লাগে অল্পই। ইতিমধ্যে দুটো পাখি এসে হাজির । ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তদন্তকারী অফিসারদের মত সরোজামিনে তদন্ত শুরু করেছে ।” হাইলি সাস্পিসিয়াস” চরিত্রটির পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টে দিতেই বোধহয় উড়ে গেল ।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল দলবদ্ধ মেঘ আর কুয়াশা ঢাকা পাহাড়ের কুমির ডাঙা খেলা দেখে।পাহাড় একটু উঁকি মারলেই মেঘেরা দল বেঁধে ছুটে যায় ।ওমনি পাহাড় টুক্ করে লুকিয়ে পড়ে ।দেখতে দেখতে চোখ বুজে গেছে কখন বুঝতে পারিনি । চটকা ভেঙ্গে গেল একটা মিষ্টি গানের সুরে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১১১০০ ফিট ওপরে ভাটিয়ালি সুর!!! মন ভরে গেলো। তার সঙ্গে মিষ্টি হাসির রোল।উড়ো কথাও কানে আসছিল।সেদিক থেকে মন সরতে চোখে পড়লো হোম স্টের দিদি সেজেগুজে তৈরি ।একটু চা জলখাবারের পর্ব মিটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম থাম্বি পয়েন্টের উদ্দেশ্যে।
মাত্র ১৪ কি মি পথ।কিন্তু বেশ চড়াই । পাকদন্ডীর ঘুর পথ বেয়ে ওপরে উঠে এলাম ।ঘন মেঘ থাকায় ইয়েতিপয়েন্টে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করে সোজাসুজি চলে এলাম থাম্বিপয়েন্টে। কথিত আছে যে এখানে নাকি ইয়েতি দেখা গেছে ।নানান স্থানীয় উপকথাও আছে সে নিয়ে ।
বিখ্যাত জিগ জাগ (zig zag ) পথ টাই প্রধান আকর্ষণ । অন্তত এক ডজন বাঁক পেরিয়ে পৌঁছালাম ১২২০০ ফিট ওপরে ।কনকনে ঠান্ডা হাওয়া ।মেঘে ঢাকা চারিদিকে শুধুই প্রশান্তি। মাঝেমধ্যে একটুকরো ছেঁড়া মেঘের টুকরো সরে গিয়ে বেরিয়ে পড়ছে বিখ্যাত তিন চার থাকের জিগ জাগ্ রোড। সঙ্গে সঙ্গে সবার মোবাইল আর ক্যেমেরা ঝলসে উঠেছে । আমারটি দেহ ত্যাগ করেছে তাই বান্ধবীর তোলা ছবিতেই ভাগ বসাবো কাড়ার করে নিলাম । অদূরে পুরোনো সিল্ক রুটের অবশিষ্ট অংশ বিশেষ ও দেখলাম।ঘন কুয়াশা ও মেঘ নেমে এসেছে দেখে বৃষ্টির আশঙ্কায় বাড়ি ফিরতে হল।গরম গরম খাবার খেয়ে কাছের মন্দির টা ঘুরে আসব ঠিক হলো। ছোট্ট পরিস্কার পরিচ্ছন্ন মন্দির । যাওয়ার পথটাও সুন্দর করে বাঁধিয়ে রেখেছে । দুধারে বুনো ফুলের গন্ধ ।
গ্রামটা ছোট্ট, খুব বেশি হলে শ’খানেক পরিবারের বাস।চাষ বাস খুব একটা হয় না ।শুধু আলু । বাকি সবকিছু হয় রংলী থেকে অথবা ভারতীয় সেনাবাহিনীর দাক্ষিন্যে চলে।মহিলা শাসিত সমাজে মহিলারা অসম্ভব পরিশ্রমী ।
মেঘের ঘনঘটা অব্যাহত রয়েছে। তাই বারান্দায় আমি আর মিতু মেতে উঠলাম আড্ডায়। বিষয়ের ব্যেপ্তি বিশাল ।অনেক দিনের গল্পের ঝুলি খুলে বসলে যা হয় ।আমাদের ও তেমনি সময় জ্ঞান ছিল না । ইতিমধ্যে দিনের আলো নিভে আসছে দেখে চা চা করছে মন।কারেন্ট বার কয়েক ঝিলিক দেখিয়ে গেছে ।বিধি মোতাবেক স্বাস্থ্য বিষয়ক সতর্কতামূলক সব বাধা নিষেধ অতিক্রম করে নিমেষে উড়ে গেল পকোড়া ও মোমো । কারেন্ট কিশোরীর মত লাফ দড়ি খেলছে ।মোবাইলে চার্জ হচ্ছে দেখে ধড়ে যেন প্রাণ এল ।” বুঝিলাম স্নেহ থুড়ি, মোবাইল একটি বিষম বস্তু ।”গাজরের হালুয়া দেখেছেন? ঘি চপচপে,ইতি উতি ছড়ানো কাজুবাদাম আর কিসমিস, দু চারটে সরু লম্বা তেজ পাতা।ওপরে হাল্কা রূপোর তবক। কাঁচের পাত্রের মধ্য স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত ।দূর থেকেও সেই প্রাণ আকূল করা গন্ধ পাগল করে । মনটা দোটানায়- –” To eat or not to eat is the question”.. (মহান লেখকের লেখায় কলম চালানোর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।নিজ গুণে মাফ করবেন ।)
জুলুকে দুই রাত কাটিয়ে আজ আবার পথ চলা ।
ঘরের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জামা কাপড়, টুকটাক জিনিস পত্র যথাসম্ভব বাক্স বন্দী করে ফেলেছিলাম রাতেই ।আজ্ঞে না ।আমি মটেই খুব গুছিয়ে রাখতে পারি না । বরং ভীষণ অগোছালো । রেগুলার বেসিসে ভুলভাল করি ।সেটা যে অনিচ্ছাকৃত সেটা আমার অফিসের বড়কর্তা মানেন না। “বস ইজ অলওয়েজ রাইট” সুতরাং এইবার আমি খুব সতর্ক আছি ।রাতেই ব্যাগ গোছানো সেরে ফেলেছি, তাই সকালটা নিশ্চিন্তে জুলুককে শেষ বার একটু খুঁটিয়ে দেখতে বসলাম ।আর তখনই ওই গাজরের হালুয়ার কথা মনে পড়লো। তফাত একটাই রংটা শুধু উজ্বল গৈরিক নয়, শ্যামল সবুজ।তেজ পাতার মতো পথ, তার আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ঘুমন্ত গ্রামের টিনের চাল দেওয়া বাড়ি, কারুর অবস্থাই খুব স্বচ্ছল নয়। বেশির ভাগই দিন মজুরের কাজ করে কিন্তু সবাই বেশ সৌখিন। সবার বাড়ির সামনে, বারান্দায় ফুলের গাছ, দরজা জানালায় সৌখিন পর্দা ।প্রায় সব ঘরেই আছে কুকুর, বিড়াল ও মুরগি । পাতলা কুয়াশা আর মেঘের আস্তরণের চাপা রয়েছে এলাকাবাসীরা। বৃষ্টির জলে ভিজে গোটা এলাকাটা যেন সুস্বাদু হালুয়া । নাক সিঁটকে বলতেই পারেন …শেষে গাজরের হালুয়া!!! আমি বাপু খাঁটি ভোজন রসিক, সুতরাং একে রবিবারের সকাল তার ওপর ঠান্ডা আবহাওয়া উপরি পাওনা লুচি আর আলুর তরকারি । বাঙালি মনটা একটু হালুয়া চাইতেই পারে ।তাই না?
আর একটা জিনিস নজরে পড়ল, এরা সকাল সাতটার আগে ওঠে না যদিও নির্জন বলেই নজর বোলাতে সুবিধা হলো ।ইতিমধ্যে কাল যারা শিলিগুড়ি থেকে রওনা হয়েছিলেন তাঁরা অনেকেই শিলারীগাঁও তে রাতে কাটিয়ে আজ সকালে জুলুক পৌঁছাবেন। দু চারটে গাড়ি আসতে শুরু করেছে দেখে আমরাও রেডি হয়ে রওনা দিলাম নাথাঙ ভ্যালির দিকে ।
থাম্বি পয়েন্ট ছাড়িয়ে উঠে আসতেই শেষ হলো চড়াই উতরাই ।এবার শুরু হলো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চলা।অদ্ভুত ভাবে মেঘের দল বিদায় নিয়েছে ।নীল আকাশটা কেমন ন্যাড়া লাগল, অনেকটা স্কুলে ক্লাসের ঘন্টা পড়ার শব্দে যেমন হঠাৎ ভর্তি মাঠটা যেমন নিমেষে শান্ত হয়ে যায় তেমন। চার দিকে দেওয়াল তুলে আকাশেটাও এই সুযোগে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে ।
এই অঞ্চলের আর একটা জিনিস ভীষণ ভাবে নাড়া দিল । বড় বড় পাইন জাতীয় গাছ আর চোখে পড়ছে না। ঘনসবুজ যুবক পাহাড় হঠাৎ যেন হৃত যৌবন প্রৌঢ়।ঠিক যেন মহাভারতের যুবরাজ পুরু, অকালে হৃত যৌবন ।প্রকৃতি রূপী যযাতির খামখেয়ালিপনায় ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ।এই রূপ ও কিন্তু বাক্য হারা করে দিল।রুক্ষ পাহাড়ের প্রেমে পড়লাম আবার ।
৪কি, মি পথ পেরিয়ে এলাম লুংথুং, ১৩০০০ ফিট ওপরে ছোট্ট একটা তিব্বতি অধ্যুষিত অঞ্চল । চীনের আক্রমণে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসে এঁদের পূর্ব পুরুষ ।এর থেকে অল্প দূরে টুকলা।এইখানে ১৯০৩ সনে ইংরেজ ও তিব্বত সৈন্যদের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়ে ।দু হাজার তিব্বতি সৈন্য মারা যান।মৃত ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য এখানে একটা সৌধ আজও রয়েছে । এখান থেকে দুটো পথ দুদিকে বেঁকে যাচ্ছে ।একটা যাচ্ছে সোজা নাথাঙ, অন্যটি বাবা মন্দির হয়ে নাথাঙ।
সেটা ১৯৬৮ সাল, অক্টোবরের শেষ ।এক তরুণ শিখ সৈনিক হরভজন সিং ,ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্লাটুনের সঙ্গে সীমান্তবর্তী এলাকায় অতন্দ্র পাহারায় ছিল । একদিন নাথুলা অঞ্চলে টহল দিতে গিয়ে সে আর ফিরে আসেনি । এটা ওই অঞ্চলে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা । মৃত সৈনিকের দেহ খুঁজে না পাওয়াও ছিল স্বাভাবিক ঘটনা ।কিন্তু এর পর শুরু হল আসল চমক । মৃত হরভজন সিং তার সঙ্গী কে স্বপনে জানান তার দেহ ঠিক কোথায় পড়ে আছে ।উদ্ধার করা হয় দেহ।কিছু দিন পর আবার স্বপনে এসে শক্রর আক্রমণের কথা জানিয়ে জান। বেঁচে যায় অনেক গুলো তাজা প্রাণ ।
ক্রমেই এমন হুঁশিয়ারি বাড়তে লাগল ।আসতে আসতে সবার মনে হরভজন সিং এর অশরীরী উপস্থিতি ঐশ্বরীয় রূপ নিল । এমনকি চীনের সীমান্তবর্তী সৈনিকরাও নাকি এই ঐশ্বরীয় ক্ষমতাসীন সৈনিক কে বিশ্বাস করে। ততদিনে হরভজন সিং “বাবা হরভজন সিং” হয়ে গেছেন। তার সম্মানে গড়ে উঠেছে বাবা মন্দির ।সেনাবাহিনীর কাছে এটি একটি পবিত্র তীর্থ স্থান । বাবা হরভজন সিং এর ব্যবহারের সমস্ত জিনিস এখানে সংরিক্ষত । জুতো, জামা, খাট, বিছানা এমনকি বাঙ্কার অবধি । বিশ্বাস এতটাই প্রবল যে সৈন্যবাহিনীর সমস্ত নিয়ম তাঁর জন্য মানা হয়।এমনকি ছুটিতে বাড়ি যাবার টিকিট অবধি সংরিক্ষত হয়।এহেন বাবার মন্দির না দেখে ফিরে গেলে বাবার রোষানলে কি হবে জানা নেই তাই চান্স না নিয়ে ঠকাঠক্ পেন্নাম ঠুকে দিলাম । বেরিয়ে প্রসাদ হিসেবে এক মুঠো কিসমিস পেয়ে মহানন্দে চিবুতে চিবুতে গাড়িতে উঠলাম । ফেরার রাস্তার দুধারে সেনা ছাউনি ।সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্লাটুন, বাঙ্কার পেরিয়ে পৌঁছালাম নাথাঙ ।একদিন ঝড় থেমে যাবে ।
পৃথিবী আবার শান্ত হবে।
কথাটা সত্যি করে তিন দিনের ঝড় বৃষ্টি কাটিয়ে উঠল নাথাঙ ।আমিও যথারীতি আলো ফুটতেই তিন লাফে বারান্দায়।দেখি সারাটা গ্রাম লেপ,কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে ।সামনেই দেখা যাচ্ছে আমাদের ড্রাইভারের বাড়ির খাড়কির দরজা ।দূর থেকে দেখে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মনে হলো ।নজর পড়ল পোষ্যের জন্য তৈরি ছোট্ট ঘরটার দিকে ।আপাত দৃষ্টিতে কোন বৈশিষ্ট্য চোখে পড়বে না ।আর পাঁচটা সাধারণ মুরগি বা কুকুরের ঘর যেমন হয়ে থাকে তেমনি ।কিন্তু যা দেখলাম তাতে অভিভূত হয়ে গেলাম। ঘর থেকে বের হয়ে আসছে লোমশ কুকুরটি আর তার চারটি ছানা আর সঙ্গে ক’টা মুরগির ছানাও।আরো অবাক করে হাজির হলো এইয়া বড় হাই তুলতে তুলতে মিনি রাণী ।সত্যি বলতে কি এত অবাক বোধহয় অনেক দিন হই নি।একই ঘরে কুকুর বিড়াল আর মুরগি তাদের ছানা পোনা নিয়ে থাকে ।অথচ আমরা বিবর্তনের শীর্ষ পর্যায়ের অধিকারী হয়েও নিজেদের মধ্যে মারামারি করে সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে রক্ত গঙ্গা বওয়াচ্ছি। একটা কুকুর ছানা নিয়ে গেলে বেশ হতো ।এক বন্ধু বলেছিল নিয়ে যেতে ।কিন্তু এই গরমে কষ্ট পাবে ।তার ওপর আবার …. না বাবা থাক্।গোল বাঁধিয়ে কাজ নেই।
নাথাঙ ভ্যালিতে এলে সূর্যোদয় দেখতে যাওয়া যায় ঈগলস্ নেস্ট বাঙ্কার পয়েন্ট (Eagle’s Nest Bunker point ) থেকে ।খুব বেশি হলে ডের কিলোমিটার দূরে, একটু চড়াই উতরাই পেরিয়ে যাওয়া যায় অনায়াসেই।এক সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর বাঙ্কার ছিল এটা ।এখন প্রযোটকদের প্রধান আকর্ষণ । এখানে বাঙ্কারটির গায়ে আজও খুঁজে পাওয়া যাবে শক্রপক্ষের গুলির ক্ষত । এখান থেকে 360′ তে কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ হিমালয়ের পর্বত শ্রেণী দেখা যায় ।ভুটান ও চীনের দিগন্তরেখা ছুঁয়ে সূর্যোদয় হয়।নিমেষে তার সোনার কাঠির ছোঁয়ায় ব্রহ্মপুত্র কে নববধূর রাঙা সীমন্তিণীর মত রাঙিয়ে ছোঁয় কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া ।নিমেষে ঘটে ঐশ্বরীয় বিস্ফোরণ।গলানো সোনার ছোঁয়া লেগে কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ হিমালয়ের পর্বত শ্রেণী যেন স্বালংকারা গৌরী। দেখে চক্ষু সার্থক । এই ঐশ্বরীয় দৃশ্য দেখে জীবন সার্থক করতে তিন বন্ধু পাড়ি দিয়েছিল।কিন্তু বৃষ্টি না হলেও মেঘলা আকাশের কারণে সে দৃশ্য দেখা যায়নি ।যাবে না সেটা অবশ্য কাল রাতেই আমরা জেনে গিয়েছিলাম এলাকাবাসীদের থেকে ।
আজ সকালে আরো কিছু জানলাম নাথাঙবাসীদের জীবন যাপন সম্পর্কে।এখানে জীবন পুরোপুরি ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর নির্ভরশীল ।মে থেকে সেপ্টেম্বর ঠান্ডা থাকলেও সেটাই গ্রীষ্মকাল,এবংএই সময় পর্যটক বেশি আসে, বিয়েথাও এই সময় হয়। বেশির ভাগ ছেলেরাই নেপালি মেয়ে বিয়ে করে । বিয়ের সময় কন্যা পণ দিতে হয়। টাকা পয়সা, বাড়ি জমি সব যৌতুক দেওয়া রীতি ।নেপালি বিয়ে করলে যৌতুক হিসাবে শুধু দারু ।তার ওপর বাপের বাড়িতে যাওয়া আসার পাট নেই। সুতরাং নেপালি মেয়ের কদর বেশি ।যা বলছিলাম, এদের অঞ্চলে বরফের পুরু আস্তরণ বাকি সারা বছর, তখন জল মানে আশে পাশে থেকে কুড়িয়ে আনা বরফ কাঠের আঁচে গলানো , খাদ্য বলতে চালে ডালে সেটাও রেশন করে দেয় সৈন্যবাহিনী। তবে সুখ একটাই, বাড়ির পুরুষরা বাড়ি আসে ।এই সময়ে সৈন্যবাহিনীর জন্য যে রসদ হেলিকপ্টার করে পৌঁছানো হয় তা বয়ে আনতে মোটা অঙ্কের টাকা দেয় সরকার ।তাই সারা বছরের খরচের আর চিন্তা থাকে না ।শুনে বুকের ওপর যেন পাথর চেপে বসল।শুধু চোখের কোণে জলটা আর বাধা মানলো না যখন মেয়েটি হাত ধরে বললো” জেনারেটর চলা নহি ।আপকো তকলিফ্ হুয়া মেডামজী, মাফ কিজিয়ে।”
রিমঝিম বৃষ্টি শুরু হল দেখে আমরা ধরাচুরো পরে ছাতা টুপি নিয়ে বেরুলাম। বাবা মন্দির পার হয়ে এলাম কুপূপ। এখানে ও সবাই আসে সূর্যোদয় দেখতে ।তবে আমরা দুচোখ ভরে রোডোডেনড্রন দেখলাম ।লাল আর গোলাপি রঙের আগেই দেখেছি, এবার দেখলাম হলুদ ও নীল রঙের । ধূসর পাহাড়ে যেন রঙের ঝরনা নেবছে। ছোটো ছোটো ঝোপ, ফুলের সাজে যেন যত্ন করে সাজানো গোছানো ড্রয়িংরুমে সাজানো ফুলের তোড়া । কিছু টা এগিয়ে আবার গাড়ি থামলো । কিছুটা দূরে একটা ঝিল।খেয়াল করলে দেখা যাবে যেন অবিকল হাতির অবায়েব । ডানদিকে শুঁড় আর বাঁ দিকে লেজ। তাই এর নাম এলিফ্যান্ট লেক ( Elephant Lake) বা বিতানচু, ১৩০৬৬ফিট ওপরে এই ঝিল এক পবিত্র তীর্থ স্থান ।
আর একটু এগোলেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর তৈরি ১৮ হোল যুক্ত য়াক্ গল্ফ কোর্স, পৃথিবীর মানচিত্রে দ্বিতীয় উচ্চতম( ১৩০৫০ ফিট) । ভাবলেই গর্বে বুক ভরে ওঠে।অজন্তেই হাত উঠে আসে স্যেলুটের ভঙ্গিতে।
এর পর সোজা সামঙ্গো বা ছাঙ্গো লেকের (tsomngo )দিকে । ডানদিকে নাথুলার রাস্তা ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে বাঁ দিকে দেখলাম মেনমেচো(menmecho) লেক। এটাই হলো তিস্তার উপনদী রংপোচু র উৎস । এখানে ট্রাউট মাছ পাওয়া যায় ।এই লেকের পাশে সরকারি গেস্ট হাউজে থাকা যায়, কিন্তু তার জন্য অনুমতি নিতে হবে গ্যংটক থেকে ।
যেহেতু আসল বাবা হরভজন সিং মন্দির অনেকটা দূরে তাই নাথুলা আর সামঙ্গো র মাঝামাঝি তৈরি হয়েছে নতুন বাবা মন্দির ।অন্যটির মত এটিকেও পরিচালনা করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর যোয়ানরা। মন্দির কে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি দোকান পাট ও গড়ে উঠেছে ।তবে সব কিছুতেই শৃঙ্খলার ছাপ স্পষ্ট ।
যদিও নাথাঙ ভ্যালি থেকে বেশ কিছু টা নেবে এসেছি তাও পথের ধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বরফের স্তুপ।এবং সেই দেখতে সবাই গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে নেবে পড়েছে ।ঝুরঝুরে বরফ রঙিন সিরাপে ডুবিয়ে খেতে অভ্যস্ত আমি ।খুব বেশি হলে লম্বা কাঁচের গ্লাসে মার্গারেটা আকারে খাওয়া।সেই বরফ স্তুপাকৃত দেখে মন নেচে ওঠে, এটাই স্বাভাবিক।সুতরাং হৈ হৈ করে নেবে পড়লাম ।বরফের ওপর লুটোপুটি খেতে খুবই ইচ্ছা কিন্তু একজোড়া সতর্ক চোখ এড়িয়ে যেতে পারলাম না। আমাকে নিয়ে আগে এত ভুগেছে যে ইদানিং আমার গতিবিধির ওপর কঠিনতম নিয়ন্ত্রণ চলছে । ম্যনেজ করা গেলনা কিছুতেই ।অগত্যা ভাজা মাছ কি করে খেতে হবে বুঝতে না পারার মুখে চেষ্টা ত্যাগ করলাম ।খানিক ছবি তুলে ,ভালো কানা মামার কথা ভেবে উঠে বসলাম, আবার গাড়ি ছাড়ল।
পথ বাঁক নিতেই চোখে পড়ল ছাঙগো বা সংমো বা সংগো (tsongmo)লেক। কি বিশাল জলাশয়!!! ২৭৪৩ ফিট লম্বা, ১৪০১ ফিট চওড়া এই লেক ১২৩১৩ফিট উচচতায় অবস্থিত । গুরু পূর্ণিমায় এখানে উৎসব হয়।সেই সময় ধর্মীয় গুরুরা জলের রং দেখে ভবিষ্যত বাণী করেন। এখানে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলে এই বিশালাকার হৃদ মনে অদ্ভূত একটা অনুভূতি জাগায় ।এখানে দাঁড়িয়ে, ছাঙ্গোর বিশালত্ব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে নিজের ক্ষুদ্র ,দৈন্য , অতি সামান্য অস্তিত্বকে।আমি ছোটো বলেই এত অহং, সে বৃহৎ বলেই শান্ত মৌনী জলাধার নিজেকে চিনতে এমন বিশালত্বের মুখোমুখি দাঁড়ানো প্রয়োজন। এই ঐশ্বরীয় অনুভূতিতে জীবন সার্থক । স্বর্গে গেলে হয়তো এমনি অনুভূতি হয়( যদিও আমার সেখানে প্রবেশ নিষেধ) । তাই হয়তো স্বর্গের অন্য নাম নাথাঙ ।
মনে এক আশ্চর্য প্রশান্তি নিয়ে ফেরার পথে নতুন বাবামন্দির পার হয়ে সেনা বাহিনীর এক মিউজিয়ামে নেবে কিছুটা সেখানকারই যুদ্ধের ইতিহাস শিখে, বুঝে নিলাম ।
ফিরে সন্ধ্যাটা কাটলো জমাটি আড্ডা দিয়ে ।কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে ।হাতে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপ, সামনে সেই ডেডলি কম্বিনেশন!!! মোগাম্বো ফুলটু খুশ হো গয়া!!!কটা দিন ঠান্ডায় কাটিয়ে মনটা বেশ ফুরফুরে ।বেড়ানোর দিন শেষ হয়ে আসছে । মনটাও একটু বাড়ি বাড়ি করছে।বিশেষ করে ছাদ ভর্তি ছানাপোনা গুলোর জন্য ।কলকাতার গরমে ঝলসে যে কি অবস্থা কে জানে । পরক্ষণেই ভেবে দেখলাম, আবার তো সেই কংক্রিটের জঙ্গলে থাকা,মন খারাপের দুপুর বেলা••• সেগুলোতো রইলোই।বরং আশপাশের সবকিছু কে মনের ক্যেনভাসে এঁকে নিয়ে যাই।এগুলোকেই ফ্লুরিনের মত ব্যাবহার করবো ভালো না লাগা গুলোকে অক্সিডাইজ করতে ।প্রতিটা দুঃখ ইলেকট্রনের মতো খসে পড়ে রোজ উঠে আসবে নতুন ফিনিক্স পাখি। তাই বাক্স প্যেঁটরা গোছা রে মন , চলো বৃন্দাবন থুড়ি … আরিটার।
আরিটার নামে এই ছোট্ট জনপদ সৌন্দর্যের মোড়কে সাজানো একটুকরো সদ্য ওভেন ফ্রেস মোলটেন লাভা কেক। প্লিজ হাসবেন না। কি করবো বলুন, জীবনের অনেকটা সময় রান্নাঘর আর ডাইনিং টেবিলের মধ্যে স্প্রিন্ট করে কাটে তার ওপর খাদ্য রসিক ( পেটুক শব্দে আমার তীব্র আপত্তি) তাই এমন তুলনাই মনে আসে । যা বলছিলাম,চকো লাভা কেক ••• নরম তুলতুলে, সামনে রাখলেই মিষ্টি গন্ধে প্রাণ উথাল পাতাল, ওপরে ছড়ানো গুঁড়ো চিনির আস্তরণের মাঝে উঁকি মারছে ব্রাউন কেক, ভিতরে টলটলে গলে পড়া চকোলেটের হৃদপিন্ড।আরিটার ও ঠিক তেমন ,নরম সবুজের ঘন জঙ্গলের আস্তরণে মোড়া, নিশ্বাস নিলে বুনো ফুলের সোঁদা গন্ধ পাওয়া যায় । বিভিন্ন রংয়ের বাহারি ফুল ফুটে আছে পাহাড়ের গায়ে আর প্রতিটি বাড়ির চারপাশে, কিছু লাগিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা কিছু প্রকৃতির আপন খেয়ালে ফুটেছে । সবুজ শ্যেওলা ধরা, বাঁধানো পাহাড়ের আনাচে কানাচে সাদামাটা ছোটো ফুলগুলো যেন কেকের উপর আইসিং সুগারের মত ফুটে আছে । মধ্যিখানে আরিটারের হৃদপিন্ড, লাম্পোখারির , টলটলে স্বচ্ছ জল পরিস্কার করে বাঁধানো পথ ঘিরে রেখেছে হৃদটাকে।পথের একদিকে জল, অন্য দিকে আকাশ ছোঁয়া উঁচুউঁচু সবুজ গাছে ঘেরা ঘন জঙ্গল। দেখেও প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
আমরা যথারীতি একটু দূরে থাকতে চাওয়ায় এসে উঠলাম পিতমচেয়েতে, ডাক বাংলো ছাড়িয়ে, খাদের ধারে ছোট্ট সাজানো ছিম ছাম বাড়ি ।বিলাস আর বৈভবের আড়ম্বর নেই অথচ আরামের সব ব্যাবস্থা মজুদ ।বেশ দুটো খোলামেলা বৈঠকী আড্ডার জায়গা।দিব্য লাগল ।খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম হাঁটা পথে লিংসে গুম্ফা দেখতে ।সেখানে পাথর বাঁধানো ছোট্ট পথের ধারে এক প্রাচীন গুম্ফা, মেরামতির কাজ চলছে ।স্বাভাবিক ভাবেই পরিচিত প্রশান্তির অভাব বোধ করেছি। কথা ছিল, কাছের প্রাকৃতিক ঝিল দেখতে যাব কিন্তু সারথির অভাবে প্ল্যান আপাতত শিকেয় তোলা থাকলো।
কথা ছিল জলখাবারের পরেই শিলিগুড়ির পথে রওনা দেব , সেখানে লোভনীয় চিতলমাছের লোভেই দুপুরের খাওয়া, সঙ্গে উপরি পাওনা শপিং ।সব ঘাটিত্সো(আরিটার লেকের নাম) র জলে স্বহা।তবে ৪৬০০ফিট ওপরে এই প্রাকৃতিকঝিল সিকিমের সম্পদ ,এটাই একমাত্র জলাশয় যেখানে বোটিং হয়।পথে শিবালয় মন্দিরে কপাল ঠুকে, কলীখোলা ঝরনা কে বুড়ি ছোঁয়া করে বেরিয়ে পড়লাম ।
গাড়ির অবস্থা বেগতিক ।কোন ক্রমেই সময়মতো পৌঁছানো সম্ভব নয় বুঝে রংলী তে অন্য গাড়ি নিতে হলো ।রংলীতেই দেখলাম আকাশের মুখ ভার। ছেলেবেলায় পছন্দের মানুষগুলো চলে যাবে শুনলেই আমরা তার যাওয়া আটকাতে সব চেষ্টা করতাম । সবেতে বিফল হয়ে শেষে কাঁদতে বসতাম।তেমনি পাহাড় যেন আমাদের ফেরা আটকাতে যাবতীয় চেষ্টা সফল না হাওয়ায় মক্ষম অস্ত্রতুলে নিল। এবার শুরু হলো পাহাড়ি ঝড়।রাস্তায় কত যে গাছ উপড়ে পড়লো তার ঠিক নেই ।দু একটা তো আর ফুট চারেক এগিয়ে পড়লেই রাস্তা সেদিনের মত বন্ধ হয়ে যেত। কিছুতেই যাওয়া আটকানো যাবে না বুঝেই বোধহয় শুরু হলো কান্না ।অঝোরে আকাশ ভাঙা জল ঝরছে।ইচ্ছে হল মাথায় হাত বুলিয়ে, বুকে টেনে নিয়ে ভুলিয়ে দি।জানলার কাঁচ নাবিয়ে হাত বাড়িয়ে দিতেই যেন বুক চিরে অভিমানে ডুকরে কেঁদে উঠল । লোকে দেখল বিদ্যুতের চমক, শুনলো মেঘের ডাক। আমি দেখলাম প্রিয় জনের বিরহে ছোট্ট মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ।প্রতি বছর পাহাড় ছেড়ে চলে আসার সময় আমি কাঁদি, এবারে দুজনেই কাঁদতে কাঁদতে এন জে পি পৌঁছালাম। একঘন্টা পরই ট্রেন ।
বাই বাই পাহাড় । হ্যেলো কলকাতা..
শিলিগুড়ি ও সেবক ছাড়িয়ে গাড়ি চললো পাহাড়ি চড়াই উতরাই পেরিয়ে ।পাশাপাশি নেচে নেচে, গানে গানে কখনও বাঁদিকে কখনও ডান দিকে লাফিয়ে লাফিয়ে চললো তিস্তা সুন্দরী । কখনও বা অষ্টাদশীর চাঞ্চল্য কখনও বা প্রখরতা হারিয়ে প্রৌঢ়তার শিথিলতায় সল্থ। কখনো সে সবুজ শ্যামল জীবনের প্রতীক । কখনও সে ধূসর ছাই রঙের নুড়ির উপর বয়ে যায় জীবন যুদ্ধে বিধ্বস্ত শরীরে শুধুমাত্র জীবনের নিয়মে । কখনও এক্কা দোক্কা খেলতে খেলতে ।কখনও পাহাড়ি সূর্যের ওম্ মেখে এলো চুল পিঠে ছড়িয়ে আলস্যে মাখামাখি হয়ে ।শুরু হলো যাত্রা । ডেস্টিনেশন জুলুক ।গাড়ি চললো পাহাড়ি চড়াই উতরাই পেরিয়ে ।অনেকটা পথ ।প্রায় 160 কি .মি যেতে হবে। রংপো তে গাড়ি বিভ্রাট । আগত্যা গাড়ি বদল । সেখানে দেখি আমাদের নতুন সারথি কাজি , তার সঙ্গে মিষ্টি একটি নেপালি মেয়ে পার্বতী, কাজির বৌ। জরুরী সওদা নিতে এসেছিল শহরের বাজারে।বেশ মিশুকে মেয়ে পার্বতী, টুক টুকে রং, গাল দুটো গোলাপি,ছিপছিপে গড়নে আধুনিক পোষাক বেশ মানিয়েছে। অনেক শহুরে আধুনিকা কে টেক্কা দিতে পারে এই সরল প্রানবন্ত মেয়েটি। কল কলিয়ে কথা বলছে, খিল খিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ছে, কিশোরীর মতো খাবো খাবো বলে বায়না করছে, টুক্ করে ঘুমিয়ে পড়ছে , আবার গাড়ি বাঁক নিতেই চোখ কচলে উঠে বসছে। আমি দুচোখ ভরে দেখছি আর ভাবছি কোথায় যেন দেখেছি ।হঠাৎ উপলব্ধি করলাম …এ যে আমার তিস্তা!!! তিস্তার মানবী রূপ নিশ্চই ঠিক এইরকম । ইসস্ এতক্ষণ এই সহজ সাদৃশ্যটা বুঝিনি? বুঝলাম শহুরে আদব কায়দায় মনের চোখে ছানি পড়েছে ।এত দিনে মনটা কিছুটা বিবর্ণ, বিষাদের ধূসর রঙে চাপা পড়ে যাচ্ছে ।
ভাবতে ভাবতে এসে পড়ল রঙলি, এই পথের শেষ জনপদ ।এর পরে কদিন থাকবো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সীমানার বাইরে । হাওয়ায় একটা শীতল আমেজ ।ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মুঠো ফোনে যোগাযোগ করতে তৎপর হলাম । বাড়িতে ছেলে আছে যে ।যদিও সে পূর্ণ যুবক কিন্তু মায়ের মন, একই কথা বার দশেক না বললেই নয়। তাই যতক্ষণ পারলাম বকবক করে উলু বনে মুক্ত ছড়ালাম ।
ততক্ষণে কাজী কাজের কাজটা সেরে ফেলেছে, মানে এই অঞ্চলে ঢুকতে যে বিশেষ অনুমতি পত্র (permit) লাগে তা যোগাড় করে ফেলেছে । তিব্বত ও চীনের সীমান্তবর্তী এলাকায় যাচ্ছি একটু নিয়মের বেড়াজাল থাকবে এটাই স্বাভাবিক ।
পথের ধারে কোন এক অচেনা ঝরনা দেখে ঠেলাঠেলি করে নেবে পড়লাম ।কর্তা চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে বুঝেও কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা জলের ধারে ।কর্তা রে রে করে করে আঙুল নেড়ে তেড়ে এল… খবরদার বুবলি আর এক পা এগোবেনা। অতীতের ” বুবলি গিরা ” মনে করে রণে ভঙ্গ দিলাম ।বাধ্য, গোবেচারা, ভালো মানুষের মত সুর সুর করে গাড়ি তে উঠে বসলাম ।
এদিকে মেঘ ঘনিয়ে আসছে ।জুলুক পৌঁছাতে না পৌঁছাতে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। দেখলাম কারেন্ট নেই। ঝড়ে পোস্ট ভেঙে পড়েছে ।সুতরাং মোমবাতি ও টর্চই ভরসা ।
বাইরে উথাল পাতাল বৃষ্টিি , মোমের নিভু নিভু আলো, গায়ের শালটা মুড়িয়ে বসলাম । হঠাৎ মনটা উদাস হয়ে গেল … বন্যা কি অমিতের সঙ্গে এমন বর্ষা মুখর পরিবেশে মুখোমুখি বসেছিল .. কে জানে?
হঠাৎ রোমান্টিক মুড পরিবর্তন হলো । ঝুলুক্ (zuluk/Dzuluk) নামের এই ছোটো পাহাড়ি গ্রামে কত ঐতিহাসিক রোমাঞ্চ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । একসময় এই পথ বেয়ে চলতো তিব্বত বা চীনের ব্যাবসায়ীরা।সঙ্গে থাকতো মাখনের মতো নরম রেশমি কাপড় । লাসা থেকে জে -লেপ -লা বেয়ে কালিংপং হয়ে ভারতের মাটিতে । এই পথেই এসেছিলেন বিখ্যাত হিয়ুঙ স্যেং। হয়তো এমনি কোন পথের ধারে কোন এক অচেনা অজানা জায়গায় রাতের অন্ধকারে আশ্রয় নিয়েছিলেন কোনো গাছের তলায় ।ভাবতে অবাক লাগে আমি ও সেই একই জায়গায় । তার থেকেও অবাক করে হাজির হলো গরম চা সঙ্গে মুচমুচে পিঁয়াজী। সুতরাং সব চিন্তা ভাবনা ঝেড়ে ফেলে ডুব দিলাম পিঁয়াজীর বোলে।সঙ্গে নির্ভেজাল আড্ডা । ডেডলি কম্বিনেশন ।এমনিতেই একটু সকাল সকাল ওঠা অভ্যাস, তার ওপর কানে আসছিল বেশ কয়েকটি নাম না জানা পাখির ডাক ।প্রচন্ড উৎসাহে গায়ের মোটা কম্বলটা সরিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসলাম বিছানায় ।জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে মনে হলো মেঘ বাড়িতে আছি । সবে একটু আলো ফুটে উঠেছে । ইতিমধ্যে একবার গম্ভীর হুঁশিয়ারি- -‘ বেরুবে না’ । বাধ্য সুবোধ বৌ এর মত এক হাত জিভ কেটে ” ননা না.. একদম না” বলে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিলাম ।
গতকালের প্রবল বৃষ্টিতে সুটকেসটা কিছুটা ভিজেছিল, ভিতরে রাখা জামা কাপড় ও হাল্কা ভেজায় সেগুলো সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । ঘরটা এখন অনেকটা পার্সনালাইজ্ড ওয়েটিং রুমে পরিবর্তিত হয়েছে ।তার মধ্যেই এটা সরিয়ে, ওটা সরিয়ে কিছুটা জায়গায় করে জানলার গা ঘেঁষে বসে পড়লাম ।নিশ্বাসে বার বার কাঁচ টা ঝাপসা হয়ে আসছে ।ঘরটা তখনো আধো আধো অন্ধকারে । কারেন্ট আসে নি তাই ব্যাগটা টেনে নিয়ে মোবাইল খোঁজা শুরু করলাম ।উদ্দেশ্য অতি মহান ,মেঘেদের বন্দি করবো । অন্তত মিনিট দশেক কুস্তি করে অবশেষে তিনি হস্তগত হলেন।কিন্তু বিধি বাম । কারেন্টের অভাবে একটা লক্ষ্মণের লাল রেখা টেনে তিনি একবার সতর্ক বার্তা দিয়ে দেহ ত্যাগ করলেন আর সেই সাথে আমার সব উৎসাহে ভাঁটা পড়ল ।
কিন্তু আমার কাছে উৎসাহের ” ওয়াটার ওফ্ ইন্ডিয়া ” আছে ।তাই একটু ঝিমিয়েই আবার স্বমহিমায় ফিরে যেতে সময় লাগে অল্পই। ইতিমধ্যে দুটো পাখি এসে হাজির । ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তদন্তকারী অফিসারদের মত সরোজামিনে তদন্ত শুরু করেছে ।” হাইলি সাস্পিসিয়াস” চরিত্রটির পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টে দিতেই বোধহয় উড়ে গেল ।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল দলবদ্ধ মেঘ আর কুয়াশা ঢাকা পাহাড়ের কুমির ডাঙা খেলা দেখে।পাহাড় একটু উঁকি মারলেই মেঘেরা দল বেঁধে ছুটে যায় ।ওমনি পাহাড় টুক্ করে লুকিয়ে পড়ে ।দেখতে দেখতে চোখ বুজে গেছে কখন বুঝতে পারিনি । চটকা ভেঙ্গে গেল একটা মিষ্টি গানের সুরে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১১১০০ ফিট ওপরে ভাটিয়ালি সুর!!! মন ভরে গেলো। তার সঙ্গে মিষ্টি হাসির রোল।উড়ো কথাও কানে আসছিল।সেদিক থেকে মন সরতে চোখে পড়লো হোম স্টের দিদি সেজেগুজে তৈরি ।একটু চা জলখাবারের পর্ব মিটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম থাম্বি পয়েন্টের উদ্দেশ্যে।
মাত্র ১৪ কি মি পথ।কিন্তু বেশ চড়াই । পাকদন্ডীর ঘুর পথ বেয়ে ওপরে উঠে এলাম ।ঘন মেঘ থাকায় ইয়েতিপয়েন্টে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করে সোজাসুজি চলে এলাম থাম্বিপয়েন্টে। কথিত আছে যে এখানে নাকি ইয়েতি দেখা গেছে ।নানান স্থানীয় উপকথাও আছে সে নিয়ে ।
বিখ্যাত জিগ জাগ (zig zag ) পথ টাই প্রধান আকর্ষণ । অন্তত এক ডজন বাঁক পেরিয়ে পৌঁছালাম ১২২০০ ফিট ওপরে ।কনকনে ঠান্ডা হাওয়া ।মেঘে ঢাকা চারিদিকে শুধুই প্রশান্তি। মাঝেমধ্যে একটুকরো ছেঁড়া মেঘের টুকরো সরে গিয়ে বেরিয়ে পড়ছে বিখ্যাত তিন চার থাকের জিগ জাগ্ রোড। সঙ্গে সঙ্গে সবার মোবাইল আর ক্যেমেরা ঝলসে উঠেছে । আমারটি দেহ ত্যাগ করেছে তাই বান্ধবীর তোলা ছবিতেই ভাগ বসাবো কাড়ার করে নিলাম । অদূরে পুরোনো সিল্ক রুটের অবশিষ্ট অংশ বিশেষ ও দেখলাম।ঘন কুয়াশা ও মেঘ নেমে এসেছে দেখে বৃষ্টির আশঙ্কায় বাড়ি ফিরতে হল।গরম গরম খাবার খেয়ে কাছের মন্দির টা ঘুরে আসব ঠিক হলো। ছোট্ট পরিস্কার পরিচ্ছন্ন মন্দির । যাওয়ার পথটাও সুন্দর করে বাঁধিয়ে রেখেছে । দুধারে বুনো ফুলের গন্ধ ।
গ্রামটা ছোট্ট, খুব বেশি হলে শ’খানেক পরিবারের বাস।চাষ বাস খুব একটা হয় না ।শুধু আলু । বাকি সবকিছু হয় রংলী থেকে অথবা ভারতীয় সেনাবাহিনীর দাক্ষিন্যে চলে।মহিলা শাসিত সমাজে মহিলারা অসম্ভব পরিশ্রমী ।
মেঘের ঘনঘটা অব্যাহত রয়েছে। তাই বারান্দায় আমি আর মিতু মেতে উঠলাম আড্ডায়। বিষয়ের ব্যেপ্তি বিশাল ।অনেক দিনের গল্পের ঝুলি খুলে বসলে যা হয় ।আমাদের ও তেমনি সময় জ্ঞান ছিল না । ইতিমধ্যে দিনের আলো নিভে আসছে দেখে চা চা করছে মন।কারেন্ট বার কয়েক ঝিলিক দেখিয়ে গেছে ।বিধি মোতাবেক স্বাস্থ্য বিষয়ক সতর্কতামূলক সব বাধা নিষেধ অতিক্রম করে নিমেষে উড়ে গেল পকোড়া ও মোমো । কারেন্ট কিশোরীর মত লাফ দড়ি খেলছে ।মোবাইলে চার্জ হচ্ছে দেখে ধড়ে যেন প্রাণ এল ।” বুঝিলাম স্নেহ থুড়ি, মোবাইল একটি বিষম বস্তু ।”গাজরের হালুয়া দেখেছেন? ঘি চপচপে,ইতি উতি ছড়ানো কাজুবাদাম আর কিসমিস, দু চারটে সরু লম্বা তেজ পাতা।ওপরে হাল্কা রূপোর তবক। কাঁচের পাত্রের মধ্য স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত ।দূর থেকেও সেই প্রাণ আকূল করা গন্ধ পাগল করে । মনটা দোটানায়- –” To eat or not to eat is the question”.. (মহান লেখকের লেখায় কলম চালানোর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।নিজ গুণে মাফ করবেন ।)
জুলুকে দুই রাত কাটিয়ে আজ আবার পথ চলা ।
ঘরের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জামা কাপড়, টুকটাক জিনিস পত্র যথাসম্ভব বাক্স বন্দী করে ফেলেছিলাম রাতেই ।আজ্ঞে না ।আমি মটেই খুব গুছিয়ে রাখতে পারি না । বরং ভীষণ অগোছালো । রেগুলার বেসিসে ভুলভাল করি ।সেটা যে অনিচ্ছাকৃত সেটা আমার অফিসের বড়কর্তা মানেন না। “বস ইজ অলওয়েজ রাইট” সুতরাং এইবার আমি খুব সতর্ক আছি ।রাতেই ব্যাগ গোছানো সেরে ফেলেছি, তাই সকালটা নিশ্চিন্তে জুলুককে শেষ বার একটু খুঁটিয়ে দেখতে বসলাম ।আর তখনই ওই গাজরের হালুয়ার কথা মনে পড়লো। তফাত একটাই রংটা শুধু উজ্বল গৈরিক নয়, শ্যামল সবুজ।তেজ পাতার মতো পথ, তার আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ঘুমন্ত গ্রামের টিনের চাল দেওয়া বাড়ি, কারুর অবস্থাই খুব স্বচ্ছল নয়। বেশির ভাগই দিন মজুরের কাজ করে কিন্তু সবাই বেশ সৌখিন। সবার বাড়ির সামনে, বারান্দায় ফুলের গাছ, দরজা জানালায় সৌখিন পর্দা ।প্রায় সব ঘরেই আছে কুকুর, বিড়াল ও মুরগি । পাতলা কুয়াশা আর মেঘের আস্তরণের চাপা রয়েছে এলাকাবাসীরা। বৃষ্টির জলে ভিজে গোটা এলাকাটা যেন সুস্বাদু হালুয়া । নাক সিঁটকে বলতেই পারেন …শেষে গাজরের হালুয়া!!! আমি বাপু খাঁটি ভোজন রসিক, সুতরাং একে রবিবারের সকাল তার ওপর ঠান্ডা আবহাওয়া উপরি পাওনা লুচি আর আলুর তরকারি । বাঙালি মনটা একটু হালুয়া চাইতেই পারে ।তাই না?
আর একটা জিনিস নজরে পড়ল, এরা সকাল সাতটার আগে ওঠে না যদিও নির্জন বলেই নজর বোলাতে সুবিধা হলো ।ইতিমধ্যে কাল যারা শিলিগুড়ি থেকে রওনা হয়েছিলেন তাঁরা অনেকেই শিলারীগাঁও তে রাতে কাটিয়ে আজ সকালে জুলুক পৌঁছাবেন। দু চারটে গাড়ি আসতে শুরু করেছে দেখে আমরাও রেডি হয়ে রওনা দিলাম নাথাঙ ভ্যালির দিকে ।
থাম্বি পয়েন্ট ছাড়িয়ে উঠে আসতেই শেষ হলো চড়াই উতরাই ।এবার শুরু হলো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চলা।অদ্ভুত ভাবে মেঘের দল বিদায় নিয়েছে ।নীল আকাশটা কেমন ন্যাড়া লাগল, অনেকটা স্কুলে ক্লাসের ঘন্টা পড়ার শব্দে যেমন হঠাৎ ভর্তি মাঠটা যেমন নিমেষে শান্ত হয়ে যায় তেমন। চার দিকে দেওয়াল তুলে আকাশেটাও এই সুযোগে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে ।
এই অঞ্চলের আর একটা জিনিস ভীষণ ভাবে নাড়া দিল । বড় বড় পাইন জাতীয় গাছ আর চোখে পড়ছে না। ঘনসবুজ যুবক পাহাড় হঠাৎ যেন হৃত যৌবন প্রৌঢ়।ঠিক যেন মহাভারতের যুবরাজ পুরু, অকালে হৃত যৌবন ।প্রকৃতি রূপী যযাতির খামখেয়ালিপনায় ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ।এই রূপ ও কিন্তু বাক্য হারা করে দিল।রুক্ষ পাহাড়ের প্রেমে পড়লাম আবার ।
৪কি, মি পথ পেরিয়ে এলাম লুংথুং, ১৩০০০ ফিট ওপরে ছোট্ট একটা তিব্বতি অধ্যুষিত অঞ্চল । চীনের আক্রমণে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসে এঁদের পূর্ব পুরুষ ।এর থেকে অল্প দূরে টুকলা।এইখানে ১৯০৩ সনে ইংরেজ ও তিব্বত সৈন্যদের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়ে ।দু হাজার তিব্বতি সৈন্য মারা যান।মৃত ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য এখানে একটা সৌধ আজও রয়েছে । এখান থেকে দুটো পথ দুদিকে বেঁকে যাচ্ছে ।একটা যাচ্ছে সোজা নাথাঙ, অন্যটি বাবা মন্দির হয়ে নাথাঙ।
সেটা ১৯৬৮ সাল, অক্টোবরের শেষ ।এক তরুণ শিখ সৈনিক হরভজন সিং ,ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্লাটুনের সঙ্গে সীমান্তবর্তী এলাকায় অতন্দ্র পাহারায় ছিল । একদিন নাথুলা অঞ্চলে টহল দিতে গিয়ে সে আর ফিরে আসেনি । এটা ওই অঞ্চলে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা । মৃত সৈনিকের দেহ খুঁজে না পাওয়াও ছিল স্বাভাবিক ঘটনা ।কিন্তু এর পর শুরু হল আসল চমক । মৃত হরভজন সিং তার সঙ্গী কে স্বপনে জানান তার দেহ ঠিক কোথায় পড়ে আছে ।উদ্ধার করা হয় দেহ।কিছু দিন পর আবার স্বপনে এসে শক্রর আক্রমণের কথা জানিয়ে জান। বেঁচে যায় অনেক গুলো তাজা প্রাণ ।
ক্রমেই এমন হুঁশিয়ারি বাড়তে লাগল ।আসতে আসতে সবার মনে হরভজন সিং এর অশরীরী উপস্থিতি ঐশ্বরীয় রূপ নিল । এমনকি চীনের সীমান্তবর্তী সৈনিকরাও নাকি এই ঐশ্বরীয় ক্ষমতাসীন সৈনিক কে বিশ্বাস করে। ততদিনে হরভজন সিং “বাবা হরভজন সিং” হয়ে গেছেন। তার সম্মানে গড়ে উঠেছে বাবা মন্দির ।সেনাবাহিনীর কাছে এটি একটি পবিত্র তীর্থ স্থান । বাবা হরভজন সিং এর ব্যবহারের সমস্ত জিনিস এখানে সংরিক্ষত । জুতো, জামা, খাট, বিছানা এমনকি বাঙ্কার অবধি । বিশ্বাস এতটাই প্রবল যে সৈন্যবাহিনীর সমস্ত নিয়ম তাঁর জন্য মানা হয়।এমনকি ছুটিতে বাড়ি যাবার টিকিট অবধি সংরিক্ষত হয়।এহেন বাবার মন্দির না দেখে ফিরে গেলে বাবার রোষানলে কি হবে জানা নেই তাই চান্স না নিয়ে ঠকাঠক্ পেন্নাম ঠুকে দিলাম । বেরিয়ে প্রসাদ হিসেবে এক মুঠো কিসমিস পেয়ে মহানন্দে চিবুতে চিবুতে গাড়িতে উঠলাম । ফেরার রাস্তার দুধারে সেনা ছাউনি ।সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্লাটুন, বাঙ্কার পেরিয়ে পৌঁছালাম নাথাঙ ।একদিন ঝড় থেমে যাবে ।
পৃথিবী আবার শান্ত হবে।
কথাটা সত্যি করে তিন দিনের ঝড় বৃষ্টি কাটিয়ে উঠল নাথাঙ ।আমিও যথারীতি আলো ফুটতেই তিন লাফে বারান্দায়।দেখি সারাটা গ্রাম লেপ,কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে ।সামনেই দেখা যাচ্ছে আমাদের ড্রাইভারের বাড়ির খাড়কির দরজা ।দূর থেকে দেখে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মনে হলো ।নজর পড়ল পোষ্যের জন্য তৈরি ছোট্ট ঘরটার দিকে ।আপাত দৃষ্টিতে কোন বৈশিষ্ট্য চোখে পড়বে না ।আর পাঁচটা সাধারণ মুরগি বা কুকুরের ঘর যেমন হয়ে থাকে তেমনি ।কিন্তু যা দেখলাম তাতে অভিভূত হয়ে গেলাম। ঘর থেকে বের হয়ে আসছে লোমশ কুকুরটি আর তার চারটি ছানা আর সঙ্গে ক’টা মুরগির ছানাও।আরো অবাক করে হাজির হলো এইয়া বড় হাই তুলতে তুলতে মিনি রাণী ।সত্যি বলতে কি এত অবাক বোধহয় অনেক দিন হই নি।একই ঘরে কুকুর বিড়াল আর মুরগি তাদের ছানা পোনা নিয়ে থাকে ।অথচ আমরা বিবর্তনের শীর্ষ পর্যায়ের অধিকারী হয়েও নিজেদের মধ্যে মারামারি করে সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে রক্ত গঙ্গা বওয়াচ্ছি। একটা কুকুর ছানা নিয়ে গেলে বেশ হতো ।এক বন্ধু বলেছিল নিয়ে যেতে ।কিন্তু এই গরমে কষ্ট পাবে ।তার ওপর আবার …. না বাবা থাক্।গোল বাঁধিয়ে কাজ নেই।
নাথাঙ ভ্যালিতে এলে সূর্যোদয় দেখতে যাওয়া যায় ঈগলস্ নেস্ট বাঙ্কার পয়েন্ট (Eagle’s Nest Bunker point ) থেকে ।খুব বেশি হলে ডের কিলোমিটার দূরে, একটু চড়াই উতরাই পেরিয়ে যাওয়া যায় অনায়াসেই।এক সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর বাঙ্কার ছিল এটা ।এখন প্রযোটকদের প্রধান আকর্ষণ । এখানে বাঙ্কারটির গায়ে আজও খুঁজে পাওয়া যাবে শক্রপক্ষের গুলির ক্ষত । এখান থেকে 360′ তে কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ হিমালয়ের পর্বত শ্রেণী দেখা যায় ।ভুটান ও চীনের দিগন্তরেখা ছুঁয়ে সূর্যোদয় হয়।নিমেষে তার সোনার কাঠির ছোঁয়ায় ব্রহ্মপুত্র কে নববধূর রাঙা সীমন্তিণীর মত রাঙিয়ে ছোঁয় কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া ।নিমেষে ঘটে ঐশ্বরীয় বিস্ফোরণ।গলানো সোনার ছোঁয়া লেগে কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ হিমালয়ের পর্বত শ্রেণী যেন স্বালংকারা গৌরী। দেখে চক্ষু সার্থক । এই ঐশ্বরীয় দৃশ্য দেখে জীবন সার্থক করতে তিন বন্ধু পাড়ি দিয়েছিল।কিন্তু বৃষ্টি না হলেও মেঘলা আকাশের কারণে সে দৃশ্য দেখা যায়নি ।যাবে না সেটা অবশ্য কাল রাতেই আমরা জেনে গিয়েছিলাম এলাকাবাসীদের থেকে ।
আজ সকালে আরো কিছু জানলাম নাথাঙবাসীদের জীবন যাপন সম্পর্কে।এখানে জীবন পুরোপুরি ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর নির্ভরশীল ।মে থেকে সেপ্টেম্বর ঠান্ডা থাকলেও সেটাই গ্রীষ্মকাল,এবংএই সময় পর্যটক বেশি আসে, বিয়েথাও এই সময় হয়। বেশির ভাগ ছেলেরাই নেপালি মেয়ে বিয়ে করে । বিয়ের সময় কন্যা পণ দিতে হয়। টাকা পয়সা, বাড়ি জমি সব যৌতুক দেওয়া রীতি ।নেপালি বিয়ে করলে যৌতুক হিসাবে শুধু দারু ।তার ওপর বাপের বাড়িতে যাওয়া আসার পাট নেই। সুতরাং নেপালি মেয়ের কদর বেশি ।যা বলছিলাম, এদের অঞ্চলে বরফের পুরু আস্তরণ বাকি সারা বছর, তখন জল মানে আশে পাশে থেকে কুড়িয়ে আনা বরফ কাঠের আঁচে গলানো , খাদ্য বলতে চালে ডালে সেটাও রেশন করে দেয় সৈন্যবাহিনী। তবে সুখ একটাই, বাড়ির পুরুষরা বাড়ি আসে ।এই সময়ে সৈন্যবাহিনীর জন্য যে রসদ হেলিকপ্টার করে পৌঁছানো হয় তা বয়ে আনতে মোটা অঙ্কের টাকা দেয় সরকার ।তাই সারা বছরের খরচের আর চিন্তা থাকে না ।শুনে বুকের ওপর যেন পাথর চেপে বসল।শুধু চোখের কোণে জলটা আর বাধা মানলো না যখন মেয়েটি হাত ধরে বললো” জেনারেটর চলা নহি ।আপকো তকলিফ্ হুয়া মেডামজী, মাফ কিজিয়ে।”
রিমঝিম বৃষ্টি শুরু হল দেখে আমরা ধরাচুরো পরে ছাতা টুপি নিয়ে বেরুলাম। বাবা মন্দির পার হয়ে এলাম কুপূপ। এখানে ও সবাই আসে সূর্যোদয় দেখতে ।তবে আমরা দুচোখ ভরে রোডোডেনড্রন দেখলাম ।লাল আর গোলাপি রঙের আগেই দেখেছি, এবার দেখলাম হলুদ ও নীল রঙের । ধূসর পাহাড়ে যেন রঙের ঝরনা নেবছে। ছোটো ছোটো ঝোপ, ফুলের সাজে যেন যত্ন করে সাজানো গোছানো ড্রয়িংরুমে সাজানো ফুলের তোড়া । কিছু টা এগিয়ে আবার গাড়ি থামলো । কিছুটা দূরে একটা ঝিল।খেয়াল করলে দেখা যাবে যেন অবিকল হাতির অবায়েব । ডানদিকে শুঁড় আর বাঁ দিকে লেজ। তাই এর নাম এলিফ্যান্ট লেক ( Elephant Lake) বা বিতানচু, ১৩০৬৬ফিট ওপরে এই ঝিল এক পবিত্র তীর্থ স্থান ।
আর একটু এগোলেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর তৈরি ১৮ হোল যুক্ত য়াক্ গল্ফ কোর্স, পৃথিবীর মানচিত্রে দ্বিতীয় উচ্চতম( ১৩০৫০ ফিট) । ভাবলেই গর্বে বুক ভরে ওঠে।অজন্তেই হাত উঠে আসে স্যেলুটের ভঙ্গিতে।
এর পর সোজা সামঙ্গো বা ছাঙ্গো লেকের (tsomngo )দিকে । ডানদিকে নাথুলার রাস্তা ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে বাঁ দিকে দেখলাম মেনমেচো(menmecho) লেক। এটাই হলো তিস্তার উপনদী রংপোচু র উৎস । এখানে ট্রাউট মাছ পাওয়া যায় ।এই লেকের পাশে সরকারি গেস্ট হাউজে থাকা যায়, কিন্তু তার জন্য অনুমতি নিতে হবে গ্যংটক থেকে ।
যেহেতু আসল বাবা হরভজন সিং মন্দির অনেকটা দূরে তাই নাথুলা আর সামঙ্গো র মাঝামাঝি তৈরি হয়েছে নতুন বাবা মন্দির ।অন্যটির মত এটিকেও পরিচালনা করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর যোয়ানরা। মন্দির কে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি দোকান পাট ও গড়ে উঠেছে ।তবে সব কিছুতেই শৃঙ্খলার ছাপ স্পষ্ট ।
যদিও নাথাঙ ভ্যালি থেকে বেশ কিছু টা নেবে এসেছি তাও পথের ধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বরফের স্তুপ।এবং সেই দেখতে সবাই গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে নেবে পড়েছে ।ঝুরঝুরে বরফ রঙিন সিরাপে ডুবিয়ে খেতে অভ্যস্ত আমি ।খুব বেশি হলে লম্বা কাঁচের গ্লাসে মার্গারেটা আকারে খাওয়া।সেই বরফ স্তুপাকৃত দেখে মন নেচে ওঠে, এটাই স্বাভাবিক।সুতরাং হৈ হৈ করে নেবে পড়লাম ।বরফের ওপর লুটোপুটি খেতে খুবই ইচ্ছা কিন্তু একজোড়া সতর্ক চোখ এড়িয়ে যেতে পারলাম না। আমাকে নিয়ে আগে এত ভুগেছে যে ইদানিং আমার গতিবিধির ওপর কঠিনতম নিয়ন্ত্রণ চলছে । ম্যনেজ করা গেলনা কিছুতেই ।অগত্যা ভাজা মাছ কি করে খেতে হবে বুঝতে না পারার মুখে চেষ্টা ত্যাগ করলাম ।খানিক ছবি তুলে ,ভালো কানা মামার কথা ভেবে উঠে বসলাম, আবার গাড়ি ছাড়ল।
পথ বাঁক নিতেই চোখে পড়ল ছাঙগো বা সংমো বা সংগো (tsongmo)লেক। কি বিশাল জলাশয়!!! ২৭৪৩ ফিট লম্বা, ১৪০১ ফিট চওড়া এই লেক ১২৩১৩ফিট উচচতায় অবস্থিত । গুরু পূর্ণিমায় এখানে উৎসব হয়।সেই সময় ধর্মীয় গুরুরা জলের রং দেখে ভবিষ্যত বাণী করেন। এখানে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলে এই বিশালাকার হৃদ মনে অদ্ভূত একটা অনুভূতি জাগায় ।এখানে দাঁড়িয়ে, ছাঙ্গোর বিশালত্ব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে নিজের ক্ষুদ্র ,দৈন্য , অতি সামান্য অস্তিত্বকে।আমি ছোটো বলেই এত অহং, সে বৃহৎ বলেই শান্ত মৌনী জলাধার নিজেকে চিনতে এমন বিশালত্বের মুখোমুখি দাঁড়ানো প্রয়োজন। এই ঐশ্বরীয় অনুভূতিতে জীবন সার্থক । স্বর্গে গেলে হয়তো এমনি অনুভূতি হয়( যদিও আমার সেখানে প্রবেশ নিষেধ) । তাই হয়তো স্বর্গের অন্য নাম নাথাঙ ।
মনে এক আশ্চর্য প্রশান্তি নিয়ে ফেরার পথে নতুন বাবামন্দির পার হয়ে সেনা বাহিনীর এক মিউজিয়ামে নেবে কিছুটা সেখানকারই যুদ্ধের ইতিহাস শিখে, বুঝে নিলাম ।
ফিরে সন্ধ্যাটা কাটলো জমাটি আড্ডা দিয়ে ।কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে ।হাতে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপ, সামনে সেই ডেডলি কম্বিনেশন!!! মোগাম্বো ফুলটু খুশ হো গয়া!!!কটা দিন ঠান্ডায় কাটিয়ে মনটা বেশ ফুরফুরে ।বেড়ানোর দিন শেষ হয়ে আসছে । মনটাও একটু বাড়ি বাড়ি করছে।বিশেষ করে ছাদ ভর্তি ছানাপোনা গুলোর জন্য ।কলকাতার গরমে ঝলসে যে কি অবস্থা কে জানে । পরক্ষণেই ভেবে দেখলাম, আবার তো সেই কংক্রিটের জঙ্গলে থাকা,মন খারাপের দুপুর বেলা••• সেগুলোতো রইলোই।বরং আশপাশের সবকিছু কে মনের ক্যেনভাসে এঁকে নিয়ে যাই।এগুলোকেই ফ্লুরিনের মত ব্যাবহার করবো ভালো না লাগা গুলোকে অক্সিডাইজ করতে ।প্রতিটা দুঃখ ইলেকট্রনের মতো খসে পড়ে রোজ উঠে আসবে নতুন ফিনিক্স পাখি। তাই বাক্স প্যেঁটরা গোছা রে মন , চলো বৃন্দাবন থুড়ি … আরিটার।
আরিটার নামে এই ছোট্ট জনপদ সৌন্দর্যের মোড়কে সাজানো একটুকরো সদ্য ওভেন ফ্রেস মোলটেন লাভা কেক। প্লিজ হাসবেন না। কি করবো বলুন, জীবনের অনেকটা সময় রান্নাঘর আর ডাইনিং টেবিলের মধ্যে স্প্রিন্ট করে কাটে তার ওপর খাদ্য রসিক ( পেটুক শব্দে আমার তীব্র আপত্তি) তাই এমন তুলনাই মনে আসে । যা বলছিলাম,চকো লাভা কেক ••• নরম তুলতুলে, সামনে রাখলেই মিষ্টি গন্ধে প্রাণ উথাল পাতাল, ওপরে ছড়ানো গুঁড়ো চিনির আস্তরণের মাঝে উঁকি মারছে ব্রাউন কেক, ভিতরে টলটলে গলে পড়া চকোলেটের হৃদপিন্ড।আরিটার ও ঠিক তেমন ,নরম সবুজের ঘন জঙ্গলের আস্তরণে মোড়া, নিশ্বাস নিলে বুনো ফুলের সোঁদা গন্ধ পাওয়া যায় । বিভিন্ন রংয়ের বাহারি ফুল ফুটে আছে পাহাড়ের গায়ে আর প্রতিটি বাড়ির চারপাশে, কিছু লাগিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা কিছু প্রকৃতির আপন খেয়ালে ফুটেছে । সবুজ শ্যেওলা ধরা, বাঁধানো পাহাড়ের আনাচে কানাচে সাদামাটা ছোটো ফুলগুলো যেন কেকের উপর আইসিং সুগারের মত ফুটে আছে । মধ্যিখানে আরিটারের হৃদপিন্ড, লাম্পোখারির , টলটলে স্বচ্ছ জল পরিস্কার করে বাঁধানো পথ ঘিরে রেখেছে হৃদটাকে।পথের একদিকে জল, অন্য দিকে আকাশ ছোঁয়া উঁচুউঁচু সবুজ গাছে ঘেরা ঘন জঙ্গল। দেখেও প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
আমরা যথারীতি একটু দূরে থাকতে চাওয়ায় এসে উঠলাম পিতমচেয়েতে, ডাক বাংলো ছাড়িয়ে, খাদের ধারে ছোট্ট সাজানো ছিম ছাম বাড়ি ।বিলাস আর বৈভবের আড়ম্বর নেই অথচ আরামের সব ব্যাবস্থা মজুদ ।বেশ দুটো খোলামেলা বৈঠকী আড্ডার জায়গা।দিব্য লাগল ।খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম হাঁটা পথে লিংসে গুম্ফা দেখতে ।সেখানে পাথর বাঁধানো ছোট্ট পথের ধারে এক প্রাচীন গুম্ফা, মেরামতির কাজ চলছে ।স্বাভাবিক ভাবেই পরিচিত প্রশান্তির অভাব বোধ করেছি। কথা ছিল, কাছের প্রাকৃতিক ঝিল দেখতে যাব কিন্তু সারথির অভাবে প্ল্যান আপাতত শিকেয় তোলা থাকলো।
কথা ছিল জলখাবারের পরেই শিলিগুড়ির পথে রওনা দেব , সেখানে লোভনীয় চিতলমাছের লোভেই দুপুরের খাওয়া, সঙ্গে উপরি পাওনা শপিং ।সব ঘাটিত্সো(আরিটার লেকের নাম) র জলে স্বহা।তবে ৪৬০০ফিট ওপরে এই প্রাকৃতিকঝিল সিকিমের সম্পদ ,এটাই একমাত্র জলাশয় যেখানে বোটিং হয়।পথে শিবালয় মন্দিরে কপাল ঠুকে, কলীখোলা ঝরনা কে বুড়ি ছোঁয়া করে বেরিয়ে পড়লাম ।
গাড়ির অবস্থা বেগতিক ।কোন ক্রমেই সময়মতো পৌঁছানো সম্ভব নয় বুঝে রংলী তে অন্য গাড়ি নিতে হলো ।রংলীতেই দেখলাম আকাশের মুখ ভার। ছেলেবেলায় পছন্দের মানুষগুলো চলে যাবে শুনলেই আমরা তার যাওয়া আটকাতে সব চেষ্টা করতাম । সবেতে বিফল হয়ে শেষে কাঁদতে বসতাম।তেমনি পাহাড় যেন আমাদের ফেরা আটকাতে যাবতীয় চেষ্টা সফল না হাওয়ায় মক্ষম অস্ত্রতুলে নিল। এবার শুরু হলো পাহাড়ি ঝড়।রাস্তায় কত যে গাছ উপড়ে পড়লো তার ঠিক নেই ।দু একটা তো আর ফুট চারেক এগিয়ে পড়লেই রাস্তা সেদিনের মত বন্ধ হয়ে যেত। কিছুতেই যাওয়া আটকানো যাবে না বুঝেই বোধহয় শুরু হলো কান্না ।অঝোরে আকাশ ভাঙা জল ঝরছে।ইচ্ছে হল মাথায় হাত বুলিয়ে, বুকে টেনে নিয়ে ভুলিয়ে দি।জানলার কাঁচ নাবিয়ে হাত বাড়িয়ে দিতেই যেন বুক চিরে অভিমানে ডুকরে কেঁদে উঠল । লোকে দেখল বিদ্যুতের চমক, শুনলো মেঘের ডাক। আমি দেখলাম প্রিয় জনের বিরহে ছোট্ট মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ।প্রতি বছর পাহাড় ছেড়ে চলে আসার সময় আমি কাঁদি, এবারে দুজনেই কাঁদতে কাঁদতে এন জে পি পৌঁছালাম। একঘন্টা পরই ট্রেন ।
বাই বাই পাহাড় । হ্যেলো কলকাতা..
.
১ Comment
very good job..