১৭৮ বার পড়া হয়েছে
ভারাক্রান্ত মন
জেবুন্নেছা
দিন পেরিয়ে রাত নিঝুম, মাসের শেষে বছর গড়ায়! দীর্ঘকাল যাবত তোমার দেখা নেই!
কোনও রকম যোগাযোগ করছো না!
আজও তোমার জন্য কাঁদি। কিন্তু কেনো কাঁদি তাও বুঝি না! বিড়বিড় করে মনে-মনে কথাগুলো বলছে সুফলা!
সুফলার ভীষণ পছন্দের একজন মানুষ ছিল, নাম- শ্যামল।
হঠাৎ একদিন শ্যামল সুফলা কে জানিয়ে দিল, তোমার সঙ্গে আর আমি যোগাযোগ করতে পারছি না, কারনটা পরে বলব। তুমি শুধু আমার জন্য দোয়া কর। আমি অনেক বিপদে আছি। সুফলা অবাক হ’য়ে চুপচাপ শ্যামলের মুখপানে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে কঠিন কথাগুলো শুনছিল আর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে। ঠোঁটটা এমনভাবে কাঁপছিলো শ্যামলকে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না। শ্যামল সুফলার চোখের পানি মুছে দিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি আসলে তোর যোগ্য না। মনে হচ্ছে কখনো ই তোর যোগ্য হতে পারব না। এ বলে শ্যামল হন হন করে হেঁটে চলে গোলো।
সুফলা একা দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর হাত-পা ঠান্ডা হ’য়ে কাঁপতে কাঁপতে রাস্তায় আইল্যান্ডে উপর বসে পড়ল।
এমন অপ্রত্যাশিত কথা শুনে সুফলার মন এতটাই ভেঙ্গে পড়ল তিনদিন ভাত খেতে পারেনি শুধু পানি খেয়ে ছিল।
এমন অস্বাভাবিক কান্ড দেখে পরিবারের সবাই অবাক হলো। সুফলাকে জিজ্ঞেস করা হলো কি হয়েছে? প্রতিউত্তরে বলল, খেতে ভালো লাগছেনা। তিনদিন পর মোবাইলটা হাতে নিলো! ফোন থেকে শ্যামলের একটা ছবি বের করে বার বার দেখছে আর কাঁদছে।
মনে মনে বলছে, শ্যামল কেমন করে পারলো এমন বেইমানি করতে! আমি কী কোনো দোষ করেছি! বা কোনো ভুল! যদি ভুল করিয়া থাকি ক্ষমা চেয়ে নিতাম। কিন্তু সে তো কিছু ই আমাকে বলেনি! আমি কী করেছি কোন দোষে তুমি আমাকে শাস্তি দিচ্ছো!
আচ্ছা আমি কি শ্যামলকে একটা ফোন দিবো! না, থাক। দেখি সে আমাকে ছাড়া কেমন করে থাকে। আমি জানি সে আমাকে ফোন করে সরি বলবে। কারণ, আমার একলা আকাশে তার ছোঁয়া ছাড়া কেউ ছুঁতে পারেনি। আমি তার পরিপূর্ণ ভালোবাসা। আমার মতো করে কেউ তাঁকে এতো ভালো বাসবে না।
মনকে শান্ত করে শরীরে শক্তি সঞ্চয় করে সুফলা উঠে দাঁড়াল।
গোসল সেরে নতুন একটা ড্রেস পরল এবং হাল্কা করে একটু সাজল। ম্যাচিং করে জুতা পরল, ব্যাগ হাতে নিল। রাস্তায় বের হ’য়ে ঘন্টা হিসেব করে একটা রিক্সা ভাড়া করল। রিক্সাওয়ালাকে বলল, ভাই আপনি তো অনেক জায়গা চিনেন? যে রাস্তাগুলো গাছ দিয়ে ছায়াঘেরা থাকে, তেমন জ্যাম থাকে না,
আমাকে সেই রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাবেন। গন্তব্যহীন কোনো জায়গায়। যত ঘন্টা রিক্সা চলবে তত ঘন্টার টাকা পেয়ে যাবেন।
খিদে লাগলে আমি যা খাবো আপনিও তাই খাবেন। সারাদিন মন খারাপ করে রিকশার হুট ফেলে ঘুরাঘুরি আর যা মন চাইলো তাই করলো! বলতে গেলে একরকম নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া। তবুও সুফলার মনটা শান্ত হলনা। বারবার একই প্রশ্ন ঃ কেনো শ্যামল এমন সিদ্ধান্ত নিলো! আমার কী কোথাও ভুল ছিলো! ভুলটা ধরিয়ে না দিয়ে এমন করে চলে গেলো! কোনও ভাবেই নিজেকে বুঝাতে পারছেনা। এমন সময় রিক্সাওলা বললো আপা এবার বাসায় চলেন আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি, আর পারছিনা।
সুফলা নিজের ধ্যান ভেঙ্গে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল চার ঘন্টা পার হয়ে গেছে।
এবার বলল চলো বাসায় ফিরে যাই।
বাসায় এসে রিক্সাওলা ভাইকে জিজ্ঞেস করলো সময় পাঁচ ঘন্টা হয়েছে আপনাকে কতো দিতে হবে? বেচারা বললো, আপনার যা খুশি দিন। পাঁচ শ টাকা দিয়ে বললো আর লাগবে? উনি খুশি হয়ে একগাল হেসে বললো, না আপা আপনার জন্য দোয়া রইলো। খুব শীঘ্রই আপনার মন ভালো হয়ে যাবে।
এমন হতাশায় দিনে পর দিন বুকের ভেতর কষ্ট ক্লেদ লুকিয়ে নিজের মত করে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেই যাচ্ছে সুফলা।
সুফলার মনটা যখন অনেক বেশি উদাস হয়,তখন ফোন হাতে নিয়ে শ্যামলের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে।
একদিন আনমনে ভুলে শ্যামলকে ফোন দিয়ে দিল। কিন্তু রিং হলোনা। ব্যাপারটা কি! শ্যামল কি সিম পাল্টে ফেলেছে! এমন করে বেশ কয়েকদিন পর পর ফোন দিল। রিং বাজলো না। পরে অভিমান করে আর ফোন করেনি। নিজের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। কার কাছে ভালোবাসার অধিকার খাটাবে! সে তো আমার না।
তিন বছর পর। সুফলার মাত্র অনার্স পরীক্ষা শেষ হল। চারিদিকে বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু করলো। পরিবার সিদ্ধান্ত নিলো তাদের পছন্দ হলেই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিবে। কারণ মেয়ে কখনো বিয়েতে মতামত দিবে না। এ যাবত অনেক প্রস্তাব এসেছে কোন প্রস্তাবে ই সুফলার পছন্দ হয়নি! সব প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে।
পরিবার অনেক গুলো বায়ো ডাটা থেকে একটা বায়ো ডাটা সিলেক্ট করলো।
সুফলাকে বললো, আমাদের কথা যদি না শোনো, তবে আমরা জোর করে তোমাকে বিয়ে দিব। কয়েকটা বায়ো-ডাটা তোমাকে দেওয়া হল। দেখে শুনে তুমি এখান থেকে একটা পছন্দ করো। টেবিলের উপরে রাখা বয়ো-ডাটা গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে সুফলা। ফ্যানের বাতাসে সব উড়ে চারিদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রইলো। সুফলা অন্যমনস্ক ভাবে তাকিয়ে আছে বায়ো-ডাটা গুলোর দিকে। হঠাৎ চোখ পড়লো শ্যামল এর ছবি! বুকের ভেতর কেমন খচখচ করে উঠলো। আস্তে-ধীরে গিয়ে বায়ো-ডাটাটা হাতে নিলো। বেশ কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলো ছবির দিকে। কিন্তু পড়ে দেখেনি। মায়ের হাতে দিয়ে বললো এটা দেখতে পারো, আমি রাজি।
যথা সময়ে মা-বাবা শ্যামল সহ সবাই সুফলা দের বাড়ি আসলো। বিয়ের কথাবার্তা শুরু হলো। শ্যামল সুফলার চোখে চোখ রেখে বলছে, সুফলা তোমাকে আমি অনেক ভালো বাসি। কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বলোতো?
সুফলা শ্যামলের চোখের ভাষা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। দুই পরিবার কথাবার্তা ফাইনাল। আগামী মাসে বিয়ে। সুফলা খুব স্বাভাবিক ভাবেই অনুষ্ঠান শেষ করে মাকে বললো, আমি ছেলের সঙ্গে একান্তেই কথা বলতে চাই এবং কিছুদিন ছেলের সঙ্গে কথা বললো। মা অনুমতি দিলো। তারা দুই জন ই পরিবারকে বুঝতে দেয়নি যে তারা পূর্ব পরিচিত। সময় নিয়ে দুই জন ঘুরতে বের হলো। শ্যামল আগের মতো আচরণ করলেও সুফলা একেবারেই গম্ভীর শান্তশিষ্ট আচরণ করছে। তারা তাদের পরিচিত জায়গায় গিয়ে বসলো। সুফলা শ্যামলের দিকে তাকিয়ে বললো, আচ্ছা মনে পড়ে তোমার, সেই সন্ধ্যা ক্ষণে দু’জন পুকুর পাড়ে গল্পের ছলে স্বপ্ন এঁকে স্বর্গ খুঁজে পেতাম। সেই স্বর্গের জমিনে বীজ বুনেছিলাম। চারা গজিয়ে অনেক ডালপালায় পরিণত হয়েছিলো। শিকড়ের সন্ধানে শুধু তোমাকেই চেয়েছিলাম।
শ্যামল বললো, হ্যাঁ খুব মনে আছে।
সুফলা আবার বললো,
ভাবনায় দীর্ঘ শ্বাসে হৃদয়ে স্পন্দনে শুধু তুমি ছিলে। তুমি বলতে “আমি তারা তুমি চাঁদ” আমি বলতাম,”তুমি আকাশ আমি চাঁদ”
আড় চোখে চেয়ে নাক টেনে দুষ্টু হাসির ঠোঁটে
নিয়ে বলতে,”বুদ্ধি আছে বটে, তারার ভিড়ে হারানো ভয় নেই”।
আমি বলতাম, চাঁদ হয়ে তোমার বুকেই তো লেপ্টে থাকি। মাতাল কন্ঠে নেশা ভরা চোখে কপালে কপাল ঠুকে নাকে নাক ঘষে বলতে “পাগলী আমার জান রে…।
শ্যামল খুব খুশি ভাব নিয়ে বললো, সব মনে আছে। সেদিন শেষ রাতে, আকাশ ভরা পূর্ণিমায় তারারা ছিলো। ম্লান,ঝিঁঝিঁ পোকারা ক্লান্ত শব্দ বিহীন রাত কাটিয়ে ছিলাম আমরা,
সব মনে পড়ছে।
তুমি কি যানো বাসা থেকে কি বলে আমি বের হয়ে ছিলাম?
শ্যামল বললো, না। সুফলা একটু রেগে গিয়ে বললো, জানবে কি করে! তুমি তো জানতে চাওনি। সেই দিন আমি বাবা-র হাতে ভীষণ পিটুনি আর মায়ের অনেক বকাঝকা খেয়েছিলাম। কারণ আমি প্রথম বার, বাবা-মা এর সঙ্গে মিথ্যা বেলেছি যে আমি খালার বাসায় ছিলাম। সেই দিন ক্রোধে, কষ্টে দুয়ারে কুলুপ আটকিয়ে কেঁদেছি।
বাতায়ন খুলে বোবা চাহনিতে আকাশের দিকে চেয়ে দেখি তোমার ছবি! মনে হচ্ছে তুমি আমার সঙ্গে ছায়ার মতো আছো।
যে দিন তুমি চলে গেলে কিছু না জানিয়ে।
সেদিন থেকে আমি সঙ্গীহীনা একা আকাশের তারা দেখার ছলে আমার আমিকে খুঁজেছি।
শ্যাম আকাশের বুকে নিজেকে পাইনি খুঁজে।
চলো এবার বাড়ি ফেরে যাই।
শ্যামল চুপচাপ সুফলার কথা শুনছিলো।
বাড়ি ফেরার কথা শুনে বললো, অনেক দিন পারে আমরা দু’জন একসঙ্গে আর একটু বসো প্লিজ।
সুফলা শ্যামল এর কথা কর্ণপাত না করে হনহন করে হেঁটে চলে গেল। এবং বাসায় গিয়ে পরিবারকে জানিয়ে দিল, এই বিয়ে আমি করবো না।
হাজার চেষ্টা করেও শ্যামল সুফলাকে বিয়ে করতে না পেরে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আবার বিদেশে চলে গিয়েছে।