গানের জগতে তাঁকে বলা হতো ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’। সেই ব্ল্যাক ডায়মন্ড বাংলাদেশের সংগীতজগৎ থেকে বহুদিন দূরে। ছয় বছরের বেশি সময় ধরে তাঁকে দেখা যায় না বাংলাদেশের কোনো মঞ্চে। মাঝেমধ্যে নতুন গান প্রকাশ করলেও বিনোদন অঙ্গনের কোনো আড্ডায়ও উপস্থিতি নেই তাঁর। বেবী নাজনীনকে শ্রোতারা এখনো তাঁর গানের মতো করেই সারা বাংলায় খুঁজে বেড়ান, কিন্তু তিনি এখন কোথায়।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে পরিবার নিয়ে থাকেন বেবী নাজনীন। তবে এই মুহূর্তে একমাত্র ছেলে মহারাজ অমিতাভকে নিয়ে নিউইয়র্কের এস্টোরিয়াতে আছেন। ছেলে ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টোন থেকে আইটি নিয়ে স্নাতক শেষ করেছেন। ইন্টার্ন করছেন। বুধবার সকালে বেবী নাজনীনের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। বললেন, ‘করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর নিউ জার্সি থেকে নিউইয়র্কের বাসায় আসি। এরপর লকডাউন শুরু হয়। আর যাওয়া হয়নি। চার মাসের বেশি এখানেই আছি। মা-ছেলের সময় কেটে যাচ্ছে।’
করোনায় লকডাউনের কারণে বাসা থেকে বের হন না খুব একটা। জরুরি প্রয়োজনে বাজার–সদাই করতে মাঝেমধ্যে বের হতে হয় বলে জানালের বেবী নাজনীন। যে বাড়িতে থাকেন, তার আশপাশেও করোনায় আক্রান্ত রোগী নেই। তাই কিছুটা স্বস্তি। কীভাবে সময় কাটছে জানতে চাইলে বললেন, ‘বাসায় রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া আর ধর্ম-কর্ম করেই কেটে যাচ্ছে। সাধারণত বাড়িতে থাকলে যা করতে হয় আরকি।’
রান্না করতে ভীষণ পছন্দ করেন বলে জানালেন বেবী নাজনীন। তাঁর সবচেয়ে পছন্দের খাবার গরম ডাল, ডিম ভাজি ও আলু ভর্তা। ছেলের পছন্দ আমেরিকান খাবার। তাই এই সময়ে মাকে ছেলের পছন্দের খাবারই বেশি রান্না করতে হয়।
মাত্র সাত বছর বয়স থেকে মঞ্চে গান গাওয়া শুরু বেবী নাজনীনের। সেই যে শুরু, চলেছে টানা ২০০৮ পর্যন্ত। এরপর তাঁর স্টেজ শো কমতে থাকে। এই কমে যাওয়ার প্রধান কারণ, তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়। ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশের কোনো স্টেজ শোতে দেখা যায়নি এই শিল্পীকে। দেশের মঞ্চে গাইতে না পারলেও ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন মঞ্চে গান গেয়ে চলছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার কারণেই আমার গানের কার্যক্রমে প্রতিনিয়ত বাধা এসেছে। তা ছাড়া আমাদের সময়ে যেভাবে কনসার্ট হতো, তা এখন আর নেই। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যেসব অনুষ্ঠান হয়, তা–ও সুনির্দিষ্ট শিল্পীদের দিয়ে করানো হয়।’
তার মানে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়াটাই আপনার জন্য কাল হয়েছে? বেবী নাজনীন বলেন, ‘একদমই তা–ই। গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতি করাটা সবার স্বাধীনতা, আমিও তা–ই করেছি। অথচ এই রাজনীতি করার কারণে একের পর এক আমার কনসার্ট বাতিল হয়েছে। এমনকি টেলিভিশনের সরাসরি অনুষ্ঠান থেকেও অজ্ঞাত কারণে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। রাজনীতির কারণে আমাকে কোণঠাসা করা হয়েছে। একজন জাতীয় শিল্পী হিসেবে আমি কিন্তু নানা সময়ে দেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছি। গানের মাধ্যমে আমি আমার ইন্ডাস্ট্রিকে এনহেন্স করেছি। বিএনপির রাজনীতির কারণে অনেক বছর ধরে রাষ্ট্রীয়ভাবেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাকে ডাকা বন্ধ। কিছুই বলি না, মনে মনে কষ্ট পাওয়া ছাড়া কিছুই তো করার নেই।’
ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করার কারণে সংগীতশিল্পী মা বেবী নাজনীনকেও ঘন ঘন যাওয়া–আসা করতে হতো। তাই দেশে স্টেজ শো বন্ধ থাকলেও বাইরের দেশে শো নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন।
বেবী নাজনীনের গানের হাতেখড়ি বাবা মনসুর সরকারের কাছে। তারপর জীবনের দীর্ঘ চলার পথে সংগীতের নানা দীক্ষা এবং সাধনায় নিজেই নিজেকে গড়ে তুলেছেন তিনি। ১৯৮০ সালে প্রথম সিনেমার গানে কণ্ঠ দেন তিনি। এহতেশামের ‘লাগাম’ সিনেমার গানটির সুর ও সংগীত করেন আজাদ রহমান। ১৯৮৭ সালে মকসুদ জামিল মিন্টুর সংগীত পরিচালনায় প্রকাশিত প্রথম অ্যালবাম ‘পত্রমিতা’। এটিই তাঁর সংগীতজীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তারপর ‘নিঃশব্দ সুর’, ‘কাল সারা রাত’, ‘প্রেম করিলেও দায়’, ‘দুচোখে ঝুম আসে না’ অ্যালবামগুলো আধুনিক গানে বেবী নাজনীনের অবস্থান শক্ত করে। ‘ওই রংধনু থেকে’, ‘কাল সারা রাত ছিল স্বপনের রাত’, ‘এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ির আঁচল’, ‘দুচোখে ঘুম আসে না তোমাকে দেখার পর’, ‘আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া গেল রে মরার কোকিলে’, ‘মানুষ নিষ্পাপ পৃথিবীতে আসে’, ‘কই গেলা নিঠুর বন্ধু রে সারা বাংলা খুঁজি তোমারে’, ‘পুবালী বাতাসে’, ‘ও বন্ধু তুমি কই কই রে…, এমন অনেক জনপ্রিয় গান আজও দেশের মানুষের মুখে ফিরে। তাঁর সর্বশেষ একক অ্যালবাম ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড বেবী নাজনীন’।
বেবী নাজনীন বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহসম্পাদক।