বিষণ্ন এক স্বর্গীয় সুখ।
সুরমা খন্দকার।
মার্চ মাস। এই সময় থেকে এখানে গরম শুরু হয়ে যায়। আমরা থাকতাম মফস্বলে। থানা শহর। গ্রামটা ছিল সবুজে ঘেরা বনানি। আশি এর দশকে রাস্তাগুলো ভাঙাচোরা। সড়কের দু’ধারে মুদি দোকান, বাজার, চা-শিঙাড়ার দোকান, হোমিওপ্যাথি ফার্মেসী এই হলো ছোট বাজার। পায়ে চলা মেঠো পথে পাশাপাশি কিছু বসতি। বেশিরভাগই টিনের ছাউনি মাটির ঘর। দালান বাড়ি ঘর ছিল মাত্র কয়েকটা। খাল পাড়ে মোটা রাস্তায় ধানক্ষেতের কোনায় আমাদের জুবুথুবু প্রাইমারি স্কুল। বাড়ি থেকে স্কুলে যেতে লাগত মাত্র ৫/৬মিনিট।
রমজান মাসের এই শুরুটা এখানে আনন্দে আর হই হুল্লোড়ে কাটে। রোজা আসলেই মা রোজার বাজার করাতেন ঘটা করে। আমরা ভাই বোনরা থাকতাম মহা আনন্দে। রোজা আসলেই আনন্দ আনন্দ একটা আমেজ আসে এখানে।
বাবা ছিলেন সূদুর প্রবাসী। প্রতি মাসে চিঠি আসতো আর আমরা
সবাই ঘটা করে চিঠি লিখতাম আব্বার কাছে। এবার রোজার মধ্যে পর পর আব্বার দুটি চিঠি ফিরে আসলো যা আমরা পাঠিয়েছিলাম। আর মা তো যারপরনাই টেনশন, মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। আমার মা ছিলেন পুরো দুস্তর একজন গোঁড়া মুসলিম।চাঁদে সূর্যে যাকে দেখেনি।
সারা রোজার প্রতিটা দিন কাটতেছিল বিষন্ন মন খারাপে। পাড়া-পড়শীর বাড়ি থেকে দেওয়া নেওয়া নানা রকম ইফতারের মজাটাও এবার লাগছেনা।ভোর রাতে দাদী সেহেরীতে ডাকাডাকি টাও কেমন মনমরা।
দেখতে দেখতে চাঁদ রাত চলে এলো আব্বার আর কোন খবর পাইনি। সন্ধ্যার আকাশে চাঁদ দেখার সে কি আনন্দ, আহা বলে বুঝানো যাবে না। মাঠে-ঘাটে সবাই ঈদের বাঁকা চাঁদ দেখার জন্য আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়তাম। চাঁদের দেখা মিললে শুরু হয়ে যেত ঈদের উৎসব আমেজ। এবার এখানেও আনন্দ নেই। সবাই সুনসান নীরবতায় দিন কাটে মন খারাপে। আর মা সারদিন ইবাদতে মশগুল থাকেন।
ঈদের দিন সকাল। আমরা সবাই যে যার মতো মনমরা হয়ে বসে আছি।ঈদের নামাজের পর পাশের বাড়ির এক দাদা মহল্লায় যার দোকান আছে।বাড়িতে এসে হাঁক মেরে ডাকতেছে আমার মাকে বৌমা বৌমা বলে। বলে যে তোমাদের চিঠি আসছে ডাকপিয়ন কাল আসি দেয়ে গেছে আমার দোকানে।চিঠি পেয়ে দেখি আব্বার চিঠি
খুলে মা পড়া শুরু করলো।
আব্বা ভালো আছেন।নতুন জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছেন।কোন যোগাযোগ করতে পারেন নি। আমাদের জন্য চিন্তায় আছেন। আমরা কেমন আছি তা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন।
যেন আমাদের বুকে মৌসুমী বায়ু আদ্র হয়ে উঠল।
যেন হৃদয়ের বন্ধ জানালা ঝাপটা দিয়ে খুলে দিল।
ঈদের আনন্দে স্বর্গীয় এক সুখ অনুভূত হলো। এক টুকরো ইনভিলাপে আমাদের অনাবিল আনন্দে ভরে দিল।