বিদায় অভিশাপ
সাদ্দাম বিশ্বাস
নিন্ম মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে মরিয়ম বুক ভরা আবেগ থাকলেও উচ্ছ্বাস একদম তলানিতে,এজন্য অনেকেই তাকে রসকষহীন বলে। কেউ তার প্রেমে পড়েনি সে কেউকে ভালোবাসেনি।মরিয়ম কে গ্রামের কেউ জিজ্ঞেস করলে সে সাফ জানিয়ে দেয় ,আমার ভালোবাসার যোগ্যতা নেই।
কারণ সে দেখতে হতকুৎসিত না হলেও রূপবতী নয়।
কোনো উচ্চ বিত্তের ঘরে জন্মালে হয়তো গায়ের রঙ আরেকটু উজ্জ্বল হতো তার বাইরে কিছু নয়।লেখাপড়াও সে যে চাউর করেছে চারদিক এমনটাও নয়। পাশ করেছে ইন্টারমিডিয়েট। ভীষণ একাকি জীবন তার।
উনিশ বছরের মেয়েটার শরীরে তেজ সবার সামনেই ঠিকরে পড়ছে। দেখার কেউ নেই কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার অসহায় চাহনি কেউ দেখে না।
নব্দিপাড়ায় তার বাবার ছোট্ট একটা মুদি দোকান আছে,এই এলাকায় বিদ্যুৎ এসেছে অনেক আগে,যদি আগে মাঝে মাঝে আসতো কিন্তু দিন বদলে যাওয়ায় এখন মাঝে মাঝে যায়,লম্বা একটা বাঁশের দুই মাথা গোঞ্জা করে কেঁটে লম্বা তার ঝুলিয়ে তার মাথায় লাগানো হয়েছে বাল্ব যেন অনেকটা দূরে আলো ছড়াতে পারে। মরিয়মের বাবার আরেকটি পরিচয়ও আছে তিনি গ্রামের মসজিদের মুয়াজ্জিন,ত্রিশ বছর একই কাজ করে যাচ্ছে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে,একদিনও তার আজান দিতে দেরি হয় নি।অত্যন্ত সজ্জন হিসেবে পরিচিত মরিয়মের বাবা। ওজনে এককাচ্চা কম দেওয়াকে মহাপাপ জ্ঞান করে।কিন্তু সহজ সরল নিপাট এই ভদ্রলোকটি তার মেয়ে মরিয়মকে নিয়েই পড়েছে মহা এক ফ্যাসাদে।
এশার নামাজের পর মরিয়মের মা বাড়ির উঠানে বসে মরিয়মকে উদ্দেশ্য করে বলে,কি রে মা তর আব্বা তো অহনো বাইত আইলো না,প্রতিদিন তো এই সময়েই আয়া পড়ে।আইজ আবার কি অইল?
চিন্তা কইরো না তো মা,আব্বা অহনই আইসা পড়বো দেইখো।
তুই ঘরে যা রে মা,তর আব্বায় আইলে আমি ঘরে যা।
বড়দোয়া পড়তে পড়তে বাড়ির উঠানের এসে হাজির মরিয়মের বাবা।মরিয়মের মাকে বাইরে বসে থাকতে দেখে তার বাবা বলে,তুমি অহনো বাইরে বইসা আছো,মাইয়ায় কই?
ঘরে।
হুন মরিয়মের মা,একটা কাজ কইরা আইলাম তোমারে না জানায়া।
ওমা,কি করলা হেইডা কন?
কইতাছি খাড়াও।
মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে দেখে মরিয়মের মাকে তার বাবা বলে,এমনে দেহ ক্যা?
যেমনেই দেহি তুমি যা কইতে চাইলা হেইডা কও।
মরিয়মের বিয়া দিমু,ছেলে দেইখা আইলাম।
ছেলে কিমুন গো?
আছে ভালাই,মাইয়ার লগে মানাইবো।
মাশাল্লাহ।
পাঁকা কথা দেই নাই।
ক্যা,দেও নাই ক্যা?
তোমার লগে একটা কথা না কইয়া পাকাকথা দেই ক্যামনে।
অ,অহন তো কথা কইলা অহন কথা দিয়া দেও।
একটু এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে মরিয়মের মা৷ বলে, ছেলে করেডা কি?
করে করে চারহি করে।
খুব ভালা,
তয় দেহ মাইয়া আমার একটাই তার যেন দুঃখ না অয়।খেয়াল রাইখ্যাই কথা দিও।
ঘর থেকে সব শুনেছে মরিয়ম, বিয়ে হবে তার।না থাকুক বাদ্য-বাজনা, রেশমি চুড়ি, শাড়ি গহনা,একটা স্বামি তো পাবে,যার সেবা করে সে বাপ মায়ের কঠিন সংগ্রামের জীবন থেকে তাদের মুক্তি দেবে।
আশিক দেখতে শুনতে বেশ,মাস্টার্স পাশ করেছে,তিন ভাই বোনের মাধ্যে সে ছোটো। বড় বোনদের বিয়ে হয়েছে,এখন বাড়িতে বাপ-মা আর সে।সংসার সচ্ছলতা তেমন নেই।একটা এনজিওতে চাকরী করে বলে দুবেলা খেতে পারছে,খাতির নেই তেমন পাড়া প্রতিবেশীর কাছে,বয়স হয়েছে বিয়েও দিতে হবে তাই বাবা-মা’র এই সিদ্ধান্ত।
পাকা দেখার আগে মরিয়মের সাথে আশিকের কথা হয় পাশে ভাবীর বাড়িতে।দুজনের দিকে দুজন তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিরবতা ভেঙে কথা বলে উঠল মরিয়ম,নিন্মবিত্তের ঘরে আমার জন্ম, বাবা-মায়ের আমাকে দেওয়ার মতো তেমন কিছুই নেই।
তেমন কিছু আমি চাই না,বিয়ে করে একটা বউ চাই।আগে সবাই এমন বলে,পরে আবার বলবেন না তো,বাপের বাড়ি থেকে এটা আনো ওটা আনো।
আমার বাবার দেওয়ার মতো তেমন সামর্থ নেই,তবে হ্যাঁ বাবা-মা মারা গেলে বাড়ি ভিটা আর খুব অল্প চাষের জমি পাবেন।এখন বলেন।
চাওয়ার হলে আগেই চেয়ে নিতাম।তাছাড়া আমি তো একটি সামাজিক সংগঠনে কাজ করি।রোজগার কম, অনেক সুখ হয়তো দিতে পারবো না।শান্তি তাই জন্য মাঝেমধ্যে নাও থাকতে পারে।
নিন্মবিত্ত ঘরের মেয়ে আমি না পাওয়ার অহংকার অনেক পুরনো। ভাববেন না, শান্তির জন্ম আমি দিবো।
তাহলে কি বাবাকে বলবো আয়োজন করতে।
একটু মুচকি হাসি দিয়ে মরিয়ম বলল,বলেন।
সামান্য কিছু টাকা দিয়ে মেয়ে জামাইকে দোয়া করে চোখের পানি মুছতে মুছতে ঘরে চলে গেল মরিয়মের বাবা।একমাত্র মেয়ে অভাব ফণিমনসার মতো পেচিয়ে ছিল সর্বক্ষণ কিন্তু অভিযোগ ঘেঁষতে পারেনি তার কাছে।
মরিয়মের মা কাছে বসে তার বাবাকে বলে, আল্লাহ সুখের মালিক,আর কাইন্দ না,মা আমার সুখেই থাকবো।
নতুন বউ ঘরে আসার পর থেকে কেমন যেন বদলে গেছে আশিক একটু বেশি বউ পাগল,কাজে যায় দুপুরের আগে, দীর্ঘ সময় ঘুমায়।
এই অবস্থা বেশ কিছু চলতে দেখে তার বাবা একদিন বলেই বসে,এভাবে অফিস ফাঁকি দিলে আর চাকরি থাকবে না।
যদিও তার মা সেদিন তার বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল,নতুন বউ ঘরে আর ক’টা দিন যেতে দাও এমনি ঠিক হয়ে যাবে।
ছেলে তোমার চাকরি করে আট হাজার টাকা বেতনের। তাও যদি এমনে অফিস কামাই দেয় তাহলে থাকবে?আর ক’টা দিন গেলে ঘরে বসে থাকতে হবে, চাকরি আর থাকবে না।
আশিকের ইচ্ছে হচ্ছিলো বাবাকে এসে কিছু কথা শুনিয়ে দিতে কিন্তু বউয়ের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল,কিছু বললে সব দোষ গিয়ে পড়বে ঐ বেচারি নয়া বউয়ের উপর।
বউ তাকে সেদিন রাতে অনেক বুঝিয়ে বলে, এখন বউ হয়েছে চাপ সামলে কাজে মন দাও।
বউয়ের দিকে মুচকি হেসে বলে, ঠিক আছে।এখন একটু কাছে আসো।সুখ নিঃশব্দে চলে যায়,দুঃখ আসে হৈচৈ করে।
আশিক গতমাসে প্রোমোশন পেয়েছে বেতনও দিগুন হলো।বাবা এবারে ছেলের বউয়ের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলে,মা আমার ভাগ্যবতী,ঘরে আসতে না আসতেই সুখবর।
পাশে বসা শ্বাশুড়ি বলে,বউ ছেলে সুখে থাকলেই সুখ আমার,শাশুড়ীর এমন কথায় বুকে ভরসার জোয়ার এলো মরিয়মের।
এই শহরের বুকে একখণ্ড জমি মানে বিশাল একটা আকাশ তার।তিনটা রুম টিনশীটের ছোট্ট বাড়ি আশিকদের,সামনে একটু যায়গা ফাঁকা,তাতেই গাছ লাগানো, নয়া করে মরিয়ম দুটো ড্রাগন চারা লাগিয়েছে।
বিয়ের পর এই প্রথম মরিয়মের বাবা-মা তার বাড়িতে এসেছে দূর সম্পর্কের এক নানাকে নিয়ে।খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই বাইয়ে বসেছে বাড়ির বড় আমগাছটার নিচে,হঠাৎ-ই মরিয়মের নানা বলে বসে, আহারে মাইয়াডার কপালে কত সুখ লেইখ্যা রাখছে আল্লায়।সেইসম কত্তো কথা কইছে মাইশে কেডায় বিয়া করবো এই মাইয়ারে?আৎকা এমন কথা শুনে বেশ অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ মরিয়মের শ্বশুর। মরিয়মের মা কথা ঘুরাতেই বেশ নড়েচড়ে বসে মরিয়মের শ্বশুর।
তালই সাহেব কোন সময় কি হইছিল একটু খুলে বলেন। নাইলে আমরা বুঝবো কেমন করে?
তওবা তওবা কিছু না বা-জান।কথাটি বলার পর বুইড়া জিভে কামর দিয়ে মুখে কুপুল এটে বসে আছে।
মরিয়মের মা-বাপের রীতিমতো মাথা নিচু।
অনেক জোড়াজুড়ির পর মরিয়মের নানা সব বলে বসে।
চার বছর বয়সে তার এক মদ্যপ মামার হাতে ধর্ষণের শিকার হয় মরিয়ম।নিজের মায়ের মৃত্যু পর সৎমা তাকে সন্তান স্নেহে মানুষ করে আর সেই সৎমামা কিনা তাকে এমনে বলাৎকার করে।যদিও তখন থেকে মরিয়মের সৎমা তার মায়ের বংশের কারোর সাথেই আর সম্পর্ক রাখেনি,এমন কি মরিয়মকে কখনো পরও ভাবে নি।সেই যৌবনহীন বয়সে মেয়েটি যখন ধর্ষিত হয়েছে তখন না ছিল তার শরীরের চাহিদা না ছিল তার মনের চাহিদা।তথাপি সে আজও ধর্ষিত। আমাদের এই সমাজে একটি মেয়ের সুনাম রটে পিপীলিকার মুখে আর দুর্নাম রটে কাকের মুখে।
পাঁচবার নামাজের জন্য যে মানুষটা সবাইকে আহ্বান করে সেই আহ্বানকারীকে আল্লাহ এমন অপমান আর কলঙ্কের কালি লাগিয়ে দেবে এ ভাবনা একজন পরহেজগার মানুষের কল্পনায়ও আসে না।তাই করলো আশিকের বাবা,সত্য লুকানোর অপরাধে নিজের মেয়ের হাত দিয়ে মায়ের গালে জুতা দিয়ে মারিয়ে নিলেন আর বাবাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ালেন।নানা বেশ আদরে কুটুম হিসেবে আরো তিন-চারদিন থাকার প্রস্তাব পেল যদিও তা তিনি প্রত্যাখ্যান করে চলে গেল।
যে মা তাকে মাথায় রাখেনি উকুনের ভয়ে মাটিতে রাখেনি পিপীড়ার ভয়ে তার গালে আজ সে নিজের জুতা দিয়ে চড় মারলো।এই পাপ সে কি করে মুছবে, কোন পানিতে ধৌত করবে সেই মহাপাপ।জায়নামাজে বসে গোটা সন্ধ্যা শুধু কেঁদে কেঁদে মোনাজাত করে গেল আল্লাহর দরবারে।তবু্ও তার শান্তি নেই,চোখের সামনে সেই ভয়ানক দৃশ্য বাবাকে অর্ধচন্দ্র মাকে জুতার বারি।
জায়নামাজ থেকে উঠে গ্যাসের আগুনে নিজের হাত পুড়িয়ে তবে সে শান্তি পেল যদিও তার শ্বাশুড়ি দেখে সরিয়ে দিয়ে পোড়া হাতে লবণ লাগিয়ে দিয়েছে কিছুটা জ্বালা কমানোর জন্য তবুও ঔষধ আসেনি।
পরদিন সকালে আশিকের মাকে চা করতে দেখে কাছে গিয়ে মরিয়ম বলে,মা,আমি চা বানাই আপনি বিশ্রাম নেন।
একবার বাঁকা চোখে তাকিয়ে আশিকের মা বলে, বউ তুমি কেমন করে ভাবলে তোমার হাতে চা আমরা খাবো।ছিঃ ছিঃ ছিঃ মামার হাতে ধর্ষণের শিকার তুমি এই কথা একবারও মুখে আনো নাই। আর আজ হাত পোড়ায়ে জাত বাঁচাইতে আসছো।দূর হও আমার ঘর থেকে।
দিন সাতেকে জন্য আশিক ট্রেনিংয়ে এসেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।মানবেতর জীবন কাকে বলে এখানে এসে সে বুঝতে পেরেছে,একটা চার বছরের ছোট্ট মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে এসেছে তার আট বছরের ভাইয়ের সাথে আধো আধো বাংলা বলে, ছেলেটা যখন সে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছিল ওখানে?
উত্তরে ছেলেটা বলে, আরার বহিনেরে বলাৎকার করিয়েলছে আর্মি।
চোখে তার ভয় নেই, আবার পানিও নেই,হয়তো এই আশায় যে তারাও একদিন স্বাধীনতা পাবে, ফিরে যাবে নিজ দেশে।স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য বোনের ইজ্জত এতো একাত্তরের ছায়া।
মনে মনে আশিক ভাবে একাত্তর কি আমাদের উপর এমন বর্বর আর নির্মম হয়ে এসেছিল।একাত্তর দেখি নি কিন্তু এদের দেখছি।
তার টিমে থাকা আরেকটি ছেলে এসে বলে স্যার মেয়েটার জন্য কিছু ঔষধ পাওয়া যাচ্ছে না।
আশিক বলে তাহলে ছেলেটাকে কাল আসতে বলো,আর সব ধরণের খাবার দিয়ে দাও,চার বছরের মেয়েটা শুধু মাঝে মাঝে গোঙায়।
মূলত তারা এখানে খাবার দিতে ও দুর্গত মানুষদের কিভাবে দ্রুত সেবা দেওয়া যায় তার প্রশিক্ষণ নিতে এসেছে তবুও অসহায় মানুষগুলো একমুঠ খাবারের জন্য প্রচণ্ড রোদকে উপেক্ষা করে লাইনে দাঁড়িয়েছে কিন্তু অপর্যাপ্ত খাবার থাকায় সবাইকে দেওয় সম্ভব হয়’নি।
রাত হয়েছে কিন্তু কিছু খায়নি মরিয়ম, তার শ্বশুর একবার গলা উচিয়ে বলে, ও রে হাজি সাহেবের বেটি কিছু খাও।
তার শ্বাশুড়ি বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ খাইতে কও নইলে তো আবার বউ নির্যাতনের মামলা হবে।
দুয়ারের বাইরে থেকে এককাপ চা আর পিরিচে একটু শুকনো মুড়ি ঠেলে দিয়ে চলে যায় তার বড় ননদ।
আশিকের মা সব খবর তার দুই মেয়েকে জানিয়েছে তাই মরিয়ম এক প্রকার কক্ষবন্দি।তারাও এসে মায়ের মতো একই আচরণ করছে।আশিককে যে জানাবে তাও ভয় পাচ্ছে সে তো ব্যস্ত।আবার ভাবে কি জানাবে, তার জীবনের কলঙ্কের কথা।পোড়া জায়গাটাও টনটন করছে, অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে অমনি ঘুমিয়ে পড়ে মরিয়ম।
সন্তানের হাতে মার খেয়ে কোন বাবা-মায়ের বেঁচে থাকার কথা নয়,কিন্তু তারা বেঁচে আছে, আছে এইজন্য যে তারা যতটা অপমান হয়েছে তার জন্য কিছুটা দায়ি তারা নিজেরা আর বাকিটা দায়ি মরিয়মের দূরসম্পর্কের নানা।আজ তিনদিন হয় মরিয়মের বাবা আজান দেয় না,ঘরে বসে শুধু তসবি জপে আর কাঁদে, মরিয়মের মায়েরও একই দশা।কিন্তু পেটের দায়ে সকাল বিকাল রান্না করে।বাকিটা সময় ধ্যান ধরে বসে থাকে আর কেঁদে কেঁদে বলে, মরিয়মের বাপ,আমার মাইয়াডার কি অইবো,জামাই সব জাইন্না যদি ঘর থাইকা বাইর কইরা দেয়।তাইলে কি অইবো?
মাইয়াডার কপাল পুড়লো,আমরা যে ক্যান গেলাম হেইহেন,মাটিতে কপাল চাপড়ায় আর এই কথা বলে।
আজ সকালে যখন আশিক কল করে তার মায়ের ফোনে তখন একবার তার বোন ধরে তো একবার তার বাবা।এ দিকে সেও ব্যস্ত। কোন নিস্তার নেই।রোহিঙ্গা ক্যাম্প মানুষ ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে ছুটে আসছে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে, আশ্রয় যতটুকু পায় তাতে জীবন তো বাঁচবে, আজ দুপুর নাগাদ একটা ট্রলার ডুবি হয়েছে, কেউ বলছে বারো’শ মানুষ মরেছে আবার কেউ বলছে পনের’শ কিন্তু যত জনই মরুক মানুষ তো মরছে মানুষের হাতে এই সভ্য পৃথিবীতে।
যদিও আশিক খাবার বণ্টন নিয়ে ব্যস্ত তবুও মাঝে মাঝে দুই একজন সাংবাদিক দেখে জিজ্ঞাস করে কি অবস্থা সর্বশেষ? তারাও সর্বশেষ খবর জানে না।হঠাৎ-ই এক বিদেশি ভদ্রলোক এসে দাঁড়ায় লাইনে দুটো রুটি আর কলার জন্য।
আশ্চর্য হয়ে এগিয়ে যায় আশিক,you?
হামি বাংগলা পারি, টুমি বাংগলায় বলটে পারো।
উনি কে?
আমার স্ত্রী
ওনার এই অবস্থা কেন?
লাইন থেকে সরিয়ে নিয়ে তাকে এক বোতল পানি দিয়ে বলে,বসুন এখানে।
আমার স্ত্রীর উপর অনেক অত্যাচার করেছে ওরা।কোন রকমে জান দিয়ে এছেছি,আমাডের ডুজনকে ধরে নিয়ে গেসে ওরা।
oh no.আমরা আছি।
হামি কিছু খাবার চাই।
হ্যাঁ হ্যাঁ পাবেন।
NEWS Cover করতে করতে ভীষণ ক্ষুধা পেয়েসে,আমার যতো খাবার শিল হামি সব দিয়ে দিয়েসি আরাকান শিশুদের।
তাই ওরা আমার স্ত্রীকে রেইপ করেছে।
এ কথা শুনে যখন চারটে প্যাকেট আশিক এনে সাংবাদিক ভদ্রলোকের হাতে দিল, সেখান থেকে সে দুটোটি প্যাকেট নিতে রাজি হলো কিন্তু লাইন শেষ হলে।তখন তার সামনে আট থেকে দশ জন।কথার ফাঁকে সে জানতে পারলো ভদ্রলোক একজন বিবিসির সাংবাদিক তার স্ত্রীও।
মরিয়ম আজ সকাল থেকে অনেকটা বেহুশ হয়ে নিজের ঘরে পড়ে আছে অনেক পরে তার শ্বাশুড়ি দেখতে পায় সে নিচে শুয়ে আছে ঘরের কপাট খুলে ভিতরে গিয়ে তার দুই মেয়েকে বলে খাটে শোয়াতে কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে, শ্বাশুড়ির মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, মরতে যদি ইচ্ছে হয় তাহলে আমার ঘর থেকে বেড়িয়ে গিয়ে মরো।
খুব রাগ হলো এবার মরিয়মের তবুও শান্ত গলায় বললো, কোথায় যাবো?
বাবার বাড়ি যাও, ননদ এই কথা বলায়।
মরিয়ম বলে, সে মুখ তো আর আপনারা রাখেননি আপা। মেয়েকে দিয়ে বাবাকে গলা ধাক্কা দিয়ে নিয়েছেন।মায়ের গালে জুতা….. বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে।
তার ননদ বলে,নিজের মা তো আর না।
আপনারা আপন পর বুঝেন?
ভাই বাড়িতে আসুক তারপর দেখ কি হয় তোমার হাল।বিয়ের সময় কিছু যদি আনতে তা দিয়েও না হয় এই কলঙ্ক ঢাকতে পারতে।
তার আরেক ননদ বলে এমনি তো ফকিন্নির মেয়ে তার উপর এমন হতকুৎসিত দেখতে, তাকালেই বমি আসে।
মরিয়মের ননদ তার মায়ের দিকে তাকিয়ে এবার বলে,দশটা না পাঁচ টা একটা মাত্র ছোটো ভাই আমাদের,গ্রাম থেকে ঘরণী মেয়ে আনার স্বাদ এবার বোঝ।
কি যে বলিস আপা,আমরা তো শহরে মানুষ আমরা খারাপ হয়ে গেছি তাই মা আর কিছু না পেয়ে মামার হাতে ধর্ষিত এই মহাপবিত্র নারীকে বউ করে এনেছে।
তোর মাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলা বন্ধ কর।আমি বা তোর মা কেউ-ই এসব জানতাম না,বলে আশিকের বাবা।
কি বীভৎস হতে পারে মানুষের রূপ।কত ভয়ানক হতে পারে মানুষ।এদের না দেখলে বোঝার কোন উপয়ায় থাকে না।
আজ শেষ দিন তাই খুব ব্যাকুল হয়ে আছে আশিক ফেরার জন্য।সন্ধ্যায় গাড়ি ছুটবে, প্রতিদিনের নানা ঘটনা আশিক তার ডায়েরিতে লিখে রাখে বউকে দেবে বলে।সেই লেখাগুলো বাসে বসে বসে পড়ে ভুল বানানগুলো ঠিক করছিল কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টের পায় নি আর একঘুমেই সকাল,একদম বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় অফিসগাড়ি।
আশিক বাড়িতে ঢুকেই দেখে তার মা চা বানাচ্ছে, মরিয়মের ঘরের কপাট বন্ধ, একটু ইতস্তত হয়ে দরজা ধাক্কালো আশিক।
দরজা খুলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো মরিয়ম।
কেমন আছো? জিজ্ঞেস করায় শান্ত গলায় মরিয়ম বললো ভালো।
পিঠের ব্যাগটা নিয়ে মরিয়ম বলে গোসলে যাও।
হুম,বলেই চলে গেল আশিক।
তখন বোঝার উপায় নেই এই বাড়িতে এতোবড় ঝড় বইছে।
মরিয়ম নিরব হয়ে ভাবছে এবার ঝড় কোনদিকে বইবে, এবার তারা কাকে অপমান করতে বলবে,মরিয়মের আপনজন বলতে এখন তো শুধু অপমানের বাকি আছে আশিক।
যাহোক গোসল থেকে ফিরে আশিক খাবার আনতে বললে মরিয়ম চুপ করে দাঁড়িয়েই রইলো।
কিছুক্ষণ পর আবার বললো,আমার ক্ষুধা লেগেছে খাবার আনো।
এবার মরিয়ম আস্তে করে বললো, আমার ও ঘরে যাওয়া নিষেধ।
মানে কী!আমি কিছুই বুঝতে পারছি না মরিয়ম।বুঝায়ে বলো।
দুজনের কথার মাঝখানে তার বড়বোন এসে হাজির নাস্তার ট্রে নিয়ে।
আপা তুই কবে আসলি?
এই তো কয়েকদিন।
কয়েকদিন বলতে…..
কয়েকদিন বলতে, কয়েকদিন….
আপা বাড়িতে কি হয়েছেরে বলতো।
কি হয়েছে আমি কিভাবে বলবো বল?
তাহলে মা কই,মাকে ডাক।
এমন সময় জোরে জোরে আশিকের নাম ধরে ডাকে তার বাবা।
আশিক এসে তার বাবাকে সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, আব্বা কেমন আছেন?
ভালো, কখন আসলি?
এইতো আব্বা কিছুক্ষণ আগে?
কিছু খেয়েছিস?
না আব্বা।মরিয়মকে বলেছিলাম, সে বললো তার নাকি রান্না ঘরে যাওয়া নিষেধ।
এই সাত দিনে এমন কি ঘটনা ঘটলো আব্বা?
তুই কি কিছু জানতে চাস?
হ্যাঁ আব্বা, জানতে চাই। এতো হাসিখুশি রেখে গেলাম সবকিছু আর কি এমন ঘটলো যে মাত্র সাতদিনে সব বদলে গেল,বলেন?আপনি নিঃসঙ্কোচে বলেন।
আগে নাস্তা খা।পরে তোর মা সব খুলে বলবে।
ততোক্ষণে তার মা নাস্তা নিয়ে হাজির।
ছেলের জন্য রুটি, সুজি, ডিম।সব নিয়ে এসেছে, এবার আশিক আবার মরিয়মকে ডাকে, মরিয়ম আসলে, বলে এবার খাবার বেড়ে দিতে তোমার কোনো বাঁধা নেই তো?
কথা শেষ হলে তার মা বলে আমি বেড়ে দিচ্ছি।
থাক মা, তুমি অনেকদিন দিয়েছ,এখন আমার বউ আছে সে দেবে।
মরিয়মকে বা হাত দিয়ে খাবার দিতে দেখে এবার সত্যি খুব ক্ষেপে গেল আশিক চিৎকার করে বলে,আমি কি কুকুর আমাকে খাবার দেওয়ার সময় ডান হাতটাও ব্যবহার করতে পারছো না।
মরিয়ম একটু থামানোর চেষ্টা করে আশিককে, বলে রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়ে গেছে,
তার ননদ এবার মুখ ফুটে বলেই ফেলে, না ভাই,তোর বউ মিথ্যে বলছে সে ইচ্ছে করে হাত আগুনে ধরেছে।
কিছু না ঘটলে কেউ চুলার আগুনে হাত ধরে না আপা।
তোর বউকে জিজ্ঞেস কর?
আপা কথা কিন্তু আমি তোকেও জিজ্ঞেস করেছিলাম।উত্তর পাই নি।
উত্তর আমার কাছে নেই।
উত্তর তোর কাছে নেই, মরিয়মের কাছে নেই তাহলে মা তুমি বল।
বড় স্বাধ করে গ্রামের মেয়েকে বউ করে এনেছিলাম কিন্তু বউ আমার মামার হাতে ধর্ষিত।
একদম স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আশিক বলে, মরিয়ম সত্যি করে বল,মা যা বলেছে তা কি সত্যি।
যদিও কাঁদছিল মরিয়ম তবুও সে সত্যটাই বলে, হ্যাঁ সত্যি।কারণ সে জানে আজ লুকনোর কিছু নেই।চাঁদের মতো অমাবস্যারয় মুখ লুকিয়ে ছিল মিথ্যা, অমাবস্যার কেটে গেছে তাই আবার চাঁদের আলো পড়েছে, আর সেই আলোতেই সে পুড়ে ছাই।
কিছু না বলে মরিয়ম কিছুক্ষণ পর একটা ছোট ব্যাগ হাতে নিয়ে আশিকের সামনে এসে বলে, আমি চলে যাচ্ছি দোয়া কর, যেন আশায় বাঁচতে পারি।
তখন আশিক নিরব ছিল,পায়ে ধুলোটুকুও দিল না আশিকের বাবা-মা।
সারারাত মরিয়মের মা তার নাম করেছে, এক নজর মেয়েকে দেখতে তার কি সে আকুলি বিকুলি,তবুও মরিয়মের বাবা মেয়েকে আনার অনুমতি দেয়’নি।পাছে মেয়ের ঘর ভেঙ্গে যায়,পাছে মেয়ের অন্য বিপদ হয় সেই আশঙ্কায়।ভোরের দিকে মরিয়মের মা দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়,চারিদিকে ঝুম বৃষ্টি আর ঘন ঘন মেঘের গর্জন, সকাল থেকে বৃষ্টি নেই কিন্তু বইছে বাতাস ছোট ছোট ডালপালা ভেঙ্গে রাস্তায় পড়ে আছে আশ্বিনি ঝড় খানিকটা নাড়িয়ে দিয়ে যায় মানুষকে।এরই মধ্যে অনেক কষ্টে দাফন করে মরিয়মের মাকে।হাপিত্যেশ করতে করতে একজন মা চলে গেল,লজ্জায় মেয়ে আসলো না মাকে দেখতে।জীবনের বিচিত্র খেলায় মানুষ হেরে যায়।জিতে যায় মানুষের মতো কেউ কেউ।
আশিক ঘরে অনেক কেঁদেছে তার কান্নার শব্দ হয়তো ঘরের দেয়াল ভেদ করে অন্য ঘরে যায়নি তাই কেউ শুনতে পায় নি।কিন্তু সে সারাজীবন একাএকা কেঁদে গেলেও কেউ তার কান্না শুনবে না।রাত অনেক হয়েছে তাই বাড়ির কেউকে না জানিয়ে নিরবে বাইকটা বেড় করে নিয়ে আসে। উদ্দেশ্য শ্বশুরবাড়ি গ্রামের রাস্তা বেয়ে চলছে তার বাইক,মনে কত শঙ্কা পাছে সব সত্যি হয়,হউক সত্যি, ভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সেই চার বছরের শিশুটির কথা ভাবে বিদেশি সেই সাংবাদিকের কথা।
আবার ভাবে মরিয়ম তো ধর্ষিত হয়েছে তার মামার হাতে, তখন তো দেশে যুদ্ধ ছিল না তাহলে কি মরিয়ম নিজের ইচ্ছায় নোংরামো করে ধর্ষণ বলে চালিয়ে দিয়েছে কতকিছু তার ভাবনায়।কেউ নেই রাস্তায় জঙ্গলাকীর্ণ পথ বেয়ে ছুটে যাচ্ছে তার বাইকটা।
মরিয়মকে আশ্রয় দিয়েছে দুদিন হয় সেই নানার ছোটছেলে, নানা এখন প্যারালাইজড হয়ে পড়ে আছে, কথা বন্ধ হয়েছে, বন্ধ চলা ফেরা,এই লোক অন্যায় করতে করতে এতোটাই নিচে নেমে গেছে যে আল্লাহও তাকে আর নিতে চায় না।পিপড়ে ধরেছে তার পুরো শরীরে। নিজের মলমূত্র অনেক সময় নিজের মুখে চলে যায়,
এসব একহাত দিয়ে অনেক কষ্টে পরিষ্কার করে মরিয়ম। বারণ করে তার আশ্রয়দাতা মামা।
মরিয়ম, তোমার সংসারটাই তো হেয় ভাইঙ্গা দিল আর তুমি তার লাইগ্যা এইগুলো করতাছো।
থাউক না মামা উনি মুরব্বি মানুষ বেবুঝের মতো একটা কথা কইয়া ফালাইছে।
আসো পরিষ্কার করছো অহন আইসা পড়।
তোমারে একটা কথা কই মা।
কন মামা।
মুখে একটু হাসি থাকলেও মুহুর্তে মিলিয়ে গেল,যখন শুনলো তার মা মারা গেছে।
চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ব্যাকুল হয়ে উঠল বাড়িতে যাওয়ার জন্য।সেই রাতে তাকে যখন বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হলো তখন রাত্রি দ্বিপ্রহর।
বাপ মেয়ের আরেকবার আলিঙ্গন হলো।
কেঁদে কেঁদে মরিয়ম তার বাবাকে বললো,তোমার বাড়ি থাইকা আমারে তাড়ায়া দিবা না তো বাবা।
বাবা শুধু কাঁদলো।
কিছুক্ষণ পর একটা বাইক এসে থামলো তাদের বাড়ির সামনে,বাপ মেয়ে বাইরে বেড়িয়ে দেখে এতো রাতে আশিক।
জামাই বাবা তুমি এতো রাইতে?
একটা কথা জানতে চাই। ভিতরে আইসো বাপ।সব জানামু।
আশিক ভিতরে যায়,কিন্তু মরিয়ম কোন কথা বলে নি।
পাশাপাশি শুয়ে থাকে বাকি রাতটুকু কিন্তু নেই তাতে ভালোবাসার স্পর্শ।
নেই উষ্ণতা চাওয়ার ব্যকুলতা, মনের ক্ষিধেটুকু যেন কোন বক তার লম্বা ঠোঁটে সাবার করে দিয়েছে।
ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে থেকে জামাই শ্বশুরে কথাগুলো শুনছিল মরিয়ম,দেখছে কাঁদছে আশিক, ভুলের বোধ জেগেছে শতবছর পানির নিচে তলিয়ে থাকা চরের মতো।
ঘরে ঢুকে যখন মরিয়মকে জড়িয়ে ধরে বলে চার বছরের একটা ছোট্ট মেয়েকে এক আরাকান আর্মি বলাৎকার করেছিল, আর তার অসহায় ভাইটি তাকে নিয়ে আমার ক্যাম্পে ঔষধ নিতে এসেছিল,তখন আমার কাছে মনে হয়েছে সেই ধর্ষিত মেয়েটির সাথে গোটা পৃথিবী আছে।
আর আজ যদি তুমি আমার পাশে থাকো তাহলে আমিও গোটা পৃথিবীকে আমার করে পাবো।
কিন্তু আমি যে ধর্ষিতা!
না,তুমি বীরঙ্গনা।
বাইকের পিছনে মরিয়ম,বাইকটা চলেছে একটা অচেনা পথে।