। ছোটগল্প ।
বিড়ালিনী।
নাজনীন নিশা।
প্রথম পর্ব :
বিড়ালিনী কোল ঘেষে চুপটি করে বসে আছে পৌষীর পাশে, আর পৌষী living room এর বন্ধ কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ঝিরঝির করে নিস্সব্দে ভেসে পড়া স্নো দেখছে সেই সকাল থেকে। বিড়ালিনীও পৌষীর সংঙ্গে বাইরে তাকিয়ে snowing দেখছে। কি আনন্দ দুজনের !! অনেকগুলো বছর ধরেই বিড়ালিনীটা এ বাড়িতে। পৌষী নিজের নামের সঙ্গে মিল করে ওর নাম দিয়েছিলো পুষ্পিতা। কিন্তু কেন যেন পুষ্পিতা নামে ওকে ডাকা হয়নি কোনদিন। শুধু এনিম্যাল ক্লিনিক এর ফাইলে পুষ্পিতা নামটি দেয়া হয়েছিল। পৌষী সেই প্রথম দিন থেকেই বিড়ালিনী বলে ডেকে আসছে। আর এ নামটিতে বিড়ালিনীও যেন অভস্ত্য হয়ে উঠেছে। পৌষীর নিজেকে আজকাল কেনযেন এই বিড়ালিনীর মতই মনে হতে থাকে। বিড়ালিনীটা বেশিরভাগ সময়ই লুকিয়ে বেড়ায় ঘরের এই কোনা থেকে ঐ কোনা, বাসি খাবার একদম খেতে চায় না, পৌষীরও বিড়ালিনীর মত বাসি খাবারে অভক্তি সেই ছেলেবেলা থেকেই। বিড়ালিনীর পরিবার পরিজন আত্মীয়স্বজন কে কোথায় আছে সেসবের কিছুই জানে না বিড়ালিনী। সে এ বাড়িতে আশ্রিতা হয়ে এসেছিলো কোন একদিন।
পৌষীও জানে না কোথায় তার বাবা মা আত্মীয়স্বজন। আশ্রিতা হয়ে পৌষীও জীবনের খুব বড় একটা সময় যাদের সঙ্গে কাটিয়েছিলো তাদের সে মামা এবং মামী হিসেবে সম্মোধন করে। যদিও তারা কেউই রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত নয় পৌষীর সঙ্গে। কিন্তু এই মামার আশ্রয় এবং মামীর যত্নে পৌষী ভুলে গিয়েছিলো বাবা-মা কে কাছে না পাবার কষ্ট ! কারণ মামা মামীই যেন তাঁর নিজের বাবা মায়ের স্থান দখল করে বসেছিলেন তার পুরো জীবন ধরে।
ছেলেবেলা থেকেই পৌষী খুব চটপটে স্বভাবের তবে ওর মনটা ভীষণ নরম। পড়াশোনায় ক্লাসের প্রতিটি বিষয়ে ভালো নম্বর পেলেও গণিতে পৌষী একেবারেই কাঁচা। বরাবরই গণিতে তাকে টেনেটুনে পাশ করতে হত। মামা তাই গণিতের একজন শিক্ষক জোগাড় করে বাড়ি আনলেন। যিনি প্রতি শুক্র এবং শনিবার বিকেল হলেই বাসায় চলে আসেন পৌষীকে গণিত করাতে। কিন্তু প্রথম দিন শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে তার পোশাকের ধরণ দেখে পৌষীর তাকে কেন যেন কিছুটা হাবাগোবা ধরনের মনে হলো। তাছাড়া তিনি কথাও বলছেন কেমন অগোছালোভাবে। পৌষী ভাবলো তিনিতো কথাই বলতে পারছেননা ঠিক করে, অংক করাবেন কেমন করে ? তিনি তাঁর নাম বললেন মোর্শেদ। পৌষীর পড়ার টেবিলের একটা পাশে তার জন্য পেতে রাখা নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে বসে আছেন তিনি। আর অন্যপাশে পৌষী বসে আছে। রুমে যথেষ্ট পরিমান লাইট এর আলো রয়েছে, কিন্তু রুমভর্তি মশা গিজগিজ করছে চারিদিকে। মশার কয়েল টেবিলের তলায় জ্বালানো থাকলেও এসব কয়েলে মশার শরীর সয়ে গেছে, তাই কয়েলের উপরে এরা পাখা মেলে দাঁড়িয়ে ভনভন করতে থাকে। মশাদের যন্ত্রনায় মোর্শেদ স্যার একটু পর পর পা নাড়ছেন আর পৌষীকে গণিতের বই মেলে ধরে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। পৌষী অন্যদিকে মন দেয়া বাদ দিয়ে এবারে স্যারের দিকে তাকিয়ে তার কথায় মনযোগী হচ্ছে।
ঠিক এমন সময় পৌষী লক্ষ্য করলো একটা মশা স্যারের ঠিক নাকের ডগায় বসে চুপচাপ রক্ত চুষেই যাচ্ছে কখন থেকে। কিন্তু স্যারের সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই বরং তিনি পৌষীর দিকে মনযোগ দিয়ে তাকে অংক বোঝানোর চেষ্টায় ব্যস্ত আছেন।
বিষয়টা দেখতে ভীষণ হাস্যকর লাগছে। একটা সময় পৌষী খিলখিলিয়ে হেসেই ফেললো। স্যার হয়ে গেলেন হতবিমুড়, তিনি কিছুতেই মিলাতে পারলেন না পৌষী কেন হাসছে। পৌষীকে হাসির কারণ জিজ্ঞেস করার আগে পৌষীই স্যারকে বলে ফেললো তাঁর নাকের ডগায় বসে থাকা মশাটাকে মেরে ফেলতে। স্যারও এতক্ষনে যেন টের পেয়ে তার একটা হাত নাকের উপরে চাপ দিতেই মশাটার শরীর থেকে পুরো রক্ত বের হয়ে স্যারের নাক মশার রক্তে ভেসে গেলো। তার একটু পরেই স্যার বিদায় হলেন, আর কোনোদিন মোর্শেদ স্যার আসলেননা পৌষীকে গণিত করাতে। না আসার কারণও কোনদিন জানা হলোনা ।
কিছুদিন যেতেই মামা পৌষীর জন্য পাভেল নামক দ্বিতীয় আর একজন স্যার নিযুক্ত করলেন, যার পড়াশোনার ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক উচ্চমানের। পড়াশোনায় তিনি ভীষণ তুখোড়। জীবনের এতটুকুন বয়সে প্রথম থেকে কোনদিন দ্বিতীয় হননি। তিনি দেখতেও ভীষণ ভালো। কিন্তু কথা বলার সময় প্রতিবার বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন তাঁর নিজের দ্বারা। কেননা তিনি একই শব্দ দুবার, তিনবার করে উচ্চারণ করছেন এবং কিছু কিছু শব্দ ভীষণ টেনে টেনে বলছেন, আর এভাবেই কথার লাইনগুলো তিনি শেষ করছেন। অর্থাৎ খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে তিনি সোজা বাংলায় তোতলা। স্ট্যামারিংজনিত সমস্যায় ভুগছেন। তার কাছে পৌষীর অংক বুঝতে কিছুটা কষ্ট হলেও সে ধর্য্য হারা হচ্ছেনা। তাই স্যারও নিয়মিত আসছেন । যে করেই হোক গণিতে পৌষীকে তিনি ভালো নম্বর পাইয়ে ছাড়বেন এটাই পাভেল স্যারের একমাত্র বাসনা।
এবারের মত স্যার এর অক্লান্ত পরিশ্রম এবং পৌষীর নিজের চেষ্টায় সে গণিতে ভালো নম্বর পেতে শুরু করলো। মামামামি পৌষীর উপরে কোনোদিন অখুশি না থাকলেও পৌষীর গণিত পাশের খবরে তাদের খুশির মাত্রা যেন চতুর্গুণ হয়ে গেলো। এদিকে পৌষীর জন্য তারা ভালো পাত্রের সন্ধান করতে লাগলেন। ভালো পাত্রে পৌষীকে শপে দেয়া এখন তাদের গুরু দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বলে তারা মনে করেন।
সেদিন ছিল শুক্রবার। এই দিনটি অন্যান্য দিনগুলো থেকে বরাবরই যেন একটু আলাদা ধাঁচের হয়। কারণ এ দিনে জুম্মার নামাজ আদায় করার জন্য সব পুরুষ মানুষগুলো দলবেঁধে মসজিদের দিকে দৌড়াতে থাকে। আর তাই এই দিনের অন্য কাজগুলো সবাই তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করে অথবা পরের দিনের জন্য জমা করে রাখে। পৌষীর প্রিয় মামা সেদিন নামাজ শেষ করে খুব তড়িৎগতিতে পৌষী পৌষী করে কয়েকদফা ডেকে পৌষীর ঘরে এসে ঢুকলেন। পৌষী কিছুটা অবাক হয়ে বিছানা থেকে নেমে মামার সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো —
“কি হয়েছে মামা۔۔۔? তূমি এত চিৎকার দিয়ে ডাকছো কেন۔۔? আমিতো তোমার সামনেই আছি ।”
মামা বললেন — “তোর মামী কোথায়۔۔? তাকেতো দেখছিনা, ডেকে নিয়ে আয়, তারপর দুজনকে একসঙ্গে বলি।”
কথাগুলো বলতে বলতে মামা নিজেই পৌষীর মামীকে
“কইগো۔۔۔ শুনছো ?” এটা বলে বলে কয়েক দফা ডেকে ফেললেন।
মামার ডাকে মামি তৎক্ষণাৎ সামনে এসে হাজির। মামা কোনোরকম কোন ভনিতা ছাড়াই বলে ফেললেন–
“আল্লাহ আমার পৌষীর দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন। পৌষীর জন্য আমি পাত্র পেয়েছি। পাত্র খুব অমায়িক, পৌষীকেও তারা পছন্দ করে নিতে চেয়েছে।”
মামার কথা থামিয়ে মামী বললেন —
“কবে۔۔? কখন۔۔? কোথায়۔۔? কিভাবে পাত্র পেলে ? আগে খুলে বলবেতো !”
মামা বললেন — “মসজিদে জুম্মার নামাজের মোনাজাত পড়ে বাইরে বের হতেই পাশের গলির ইমতিয়াজ চৌধুরী সাহেব এবং তার ছেলের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেলো। ইমতিয়াজ ভাই আমাকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে গেলেন, তারপর বললেন তার ছেলে পৌষীকে স্কুলে আসতে যেতে দেখে সবসময়। পৌষীকে তার ছেলের খুব মনে ধরেছে, তাই ছেলে তার বাবাকে জানিয়েছে পৌষীকে সে বিয়ে করতে চায়। ছেলে আমি নিজে দেখেছি, খুব ভালো চাকরি করে। গায়ের রং টা একটু শ্যামলা তবে চেহারাটা মন্দ নয়, পৌষীর সঙ্গে খুব মানাবে।”
মামার কথা মামী খুব মনযোগ দিয়ে শুনলেন
এবং পৌষীর দিকে তাকাতেই পৌষী বললো — “আমার কোনো আপত্তি নেই তোমরা যা ভালো মনে করবে আমি তাই মেনে নেবো।”
মামা আবেগাপ্লুত হয়ে চোখের জ্বল মুছে পৌষীকে জড়িয়ে ধরলেন, মামীও তাদের সঙ্গে মিলে গেলেন। মামা শুরুতে রাজি থাকলেও কিছুদিন যেতেই কিছুটা আপত্তি জানালেন এই ভেবে۔۔۔ যেখানে পৌষী মাত্র দশম শ্রেণীর ছাত্রী সেখানে পাত্র বিয়ে পাশ দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছে। তাদের দুজনের বয়সের যথেষ্ট ফারাক রয়েছে !
কিন্তু মামী মামাকে বুঝিয়ে বললেন মেয়েমানুষের বড় হতে সময় লাগেনা। তাছাড়া ভালো পাত্র সবসময় মিলবেনা। বাবা মা হারা সন্তান, আমরা মরে গেলে ওকে দেখার কেউ থাকবেনা। এসব শুনে মামার মন আরো একবার নরম হয়ে গেলো।
একমাস পর মামার সাধ্যমত বিয়ের সানাই বাজিয়ে, ধুমধাম করে লোকজন খাইয়ে পৌষীর বিয়ে হয়ে গেলো ইমতিয়াজ চৌধুরীর ছেলে- চাকুরী করা বি এ পাস ছেলেটির সঙ্গে। এখন এই ছেলেটি পৌষীর বর। যার নাম আরাফ, আরাফ চৌধুরী।
শশুর বাড়িতে প্রবেশ করেই পৌষী গৃহবধূ সেজে সংসার নামক মায়ার জ্বালে ধীরে ধীরে আটকে যেতে লাগলো তার বর আরাফকে নিয়ে। যথাযথভাবে বাঙালির উত্তরীয় প্রথায় সংসার শুরুর দিন থেকে বর বাসায় আসবার আগেই ঘরের সমস্ত কাজগুলো শেষ করে তার অপেক্ষায় খাবার নিয়ে বসে থাকে পৌষী প্রতিদিন। কিন্তু মনে মনে অপেক্ষা করে তার বর ঘরে ঢুকে জানতে চাইবে সারাটাদিন পৌষীর কেমন কাটল ? কোন অসুবিধে হয়নিতো ঘরের কাজ করতে গিয়ে ? নিজে খাবার আগে একবার জানতে চাইবে পৌষী খেয়েছে কিনা কিংবা তার আঙুলের ডগা দিয়ে ভাতের একটি লোকমা তুলে দিবে পৌষীর মুখে।
পৌষীর এসব ছোট ছোট আশা কিংবা প্রত্যাশাগুলো নিতান্তই অবান্তর হতে হতে নিরশ হতে লাগলো যেন প্রতিমুহূর্তে। এদিকে মামা মামী চাইলেন পৌষী স্কুল টা পাশ করুক। অবশ্য পৌষীর নিজের ইচ্ছেটাও তাই। কিছুদিন পর সবার ইচ্ছেটা পৌষী তার বরকে জানালো। প্রথমদিকে আরাফ কিছুটা দ্বিমত পোষণ۔۔ করলেও মামা মামীর অনুরোধ ফেলতে না পেরে রাজি হয়ে গেলো। আর সেই সুবাদে পরীক্ষার ক’দিন আগ থেকে পাভেল স্যার নিয়ম করে বাসায় আসতে লাগলেন পৌষীকে গণিত করাতে ।
এদিকে পাভেল স্যার পৌষীকে পড়াতে বাসায় আসলেই প্রতিদিন কোননা কোন ছুতোয় আরাফ পৌষীর সঙ্গে কিছুটা খিটখিটে মেজাজ দেখাতে শুরু করে দিলো। পৌষী শুরুতে এ বিষয়টা নিয়ে কষ্ট কিংবা বিরক্ত হলেও শেষের দিকে আরাফের এসব বিষয়গুলো গায়ে না নিয়ে টানা তিনমাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে এস এস সি পরীক্ষাটা শেষ করে ফেললো। পাশাপাশি সংসারের হালটাও তাকেই আগাগোড়া ধরে রাখতে হয়েছে।
একদিন হঠাৎ মনে হল বিয়ের পর এতগুলো দিন এবং মাস কেটে গেলো অথচ পৌষী এ অব্দি কোথাও যায়নি তার বরকে নিয়ে। পরীক্ষার দিনগুলোতে বরকে ছাড়াই গেছে পরীক্ষা দিতে, মামা এগিয়ে দিতেন। গত কয়েকটা দিন পৌষী তার বরকে একটু পীড়া দিতে লাগলো তাকে নিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরে আসার জন্য। অবশেষে বর তার রাজি হলো কিন্তু পৌষী তার মনের মত করে সেজেগুজে বরের সঙ্গে সেদিন বাইরে যেতে পারেনি। কিছুটা গোছালো এবং কিছুটা অগোছালো ভাবেই পৌষী বেরিয়ে পড়ে।
রিকশায় উঠার সময় পায়ের দিকে চোখ পড়তেই দেখা গেলো পৌষী ঘরে পড়ার অনেক দিনের পুরোনো নিচু হিলটা পড়েই রিক্সায় উঠেছে। কিছুদূর যেতেই রাস্তার পাশে চটপটির দোকান চোখে পড়লো, তাজা চটপটি মশলার ঘ্রানে রিকশা এবং গাড়ি থামিয়ে সবাই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে, কেউবা বসে চটপটি এবং ফুচকার থালা হাতে। এ দৃশ্য দেখে খাবার লোভ সামলানো ভারী মুশকিল! পৌষী রিকশাওয়ালাকে রিকশাটা থামাতে বললো। রিকশা থেকে নেমে চটপটিওয়ালার কাছে অর্ডার করতেই পৌষীর চোখে চোখ পড়ে গেলো পাশের বেঞ্চিতে বসে থাকা তার অংকের শিক্ষক পাভেল স্যারের দিকে, যিনি তার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে বসে বসে ফুচকা খাচ্ছেন। পৌষী তাকে হাসিমুখে সালাম দিতেই ওর বর মুখ ঘুরে তাকালো। পাভেল আরাফকে সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের জায়গাটা তাকে দেখিয়ে বললো বসুন ভাই। আরাফ “ঠিক আছে۔۔۔”, একথাটা বলেই অন্যপাশটায় চলে গেলো বসার জন্য। পৌষীও তার পেছন পেছন এসে বসলো। ততক্ষনে চটপটিওয়ালার চটপটিও রেডি। কিন্তু পৌষীর বর চটপটি না খেয়েই লোকটির পয়সা চুকিয়ে উঠে দাঁড়ালো এবং পৌষীকে বললো চল চলে যাই। কোন কথা না বাড়িয়ে বরের পেছন পেছন পৌষী গিয়ে রিকশায় চেপে বসলো। যাবার সময় পেছন ফিরে একবার ঘুরে তাকালো পাভেল স্যার তাকিয়ে আছেন বলে। রিকশায় কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ আরাফ পৌষীকে বলে উঠলো۔۔
“তোমার পাভেল স্যার কে তূমি চটপটির দোকানে থাকতে বলেছিলে ?”
আরাফের এমন অপ্রাসঙ্গিক কথায় পৌষী ভীষণ আহত হলো, রাগতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। আরো কিছুদূর এগিয়ে আরাফ রিকশাওয়ালাকে রিকশা থামাতে বললো এবং পৌষীকে নিয়ে কোন একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়লো। কিছুক্ষন পর খাবার এলো। পৌষী দু একটি কথা বললেও আরাফ কোন কথা না বলেই ভীষণ গম্ভীর মুখ করে খাবার খেলো। পৌষী খুব একটা খেতে পারলোনা। অসমাপ্ত খাবার রেখেই সেদিন রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো ওরা দুজন।
সময় গড়িয়ে পৌষী এস এস সি পরীক্ষাটা দিয়ে ফেললো। তিন মাস পরেই রেজাল্ট বেরুনোর অপেক্ষায় দিন গুনতে লাগলো। পাভেল স্যার এখন আর পড়াতে আসেননা। তবে পৌষীর রেজাল্ট বেরোনোর এক সপ্তাহ পর একদিন সন্ধ্যা বেলায় কলিংবেলের আওয়াজে আরাফ দরজা খুলে দেখে পাভেল স্যার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। আরাফকে তিনি সালাম দিলেন। এবং বললেন পৌষীর মামামামীর কাছে গিয়েছিলেন তিনি রেজাল্ট জানতে, কিন্তু তারা বাসায় নেই তাই তিনি সরাসরি এ বাসায় চলে এলেন পৌষীর কাছে ওর রেজাল্ট শুনতে। তবে পাভেল স্যারের তোতলামোর কারণে তিনি কথাগুলো বলতে গিয়ে ভীষণ বাধাগ্রস্থ হলেন, অনেক টাইম নিয়ে কথাগুলো শেষ করলেন। ততক্ষনে পৌষীও পেছনে এসে দাঁড়ালো। আরাফ সামনে থেকে সরে গিয়ে পাভেলকে ভেতরে ঢুকতে দিলো। পাভেল স্যার ভেতরে ঢুকে সোফায় বসতে বসতে ভীষণ কৌতুহলী হয়ে পৌষীর দিকে তাকিয়ে ওর রেজাল্ট জানতে চাইলো। পৌষী বললো স্যার অমি খুব ভালো করেছি, A+ পেয়েছি। তবে মার্কস এখনো হাতে আসেনি। পাভেল স্যার খুব খুশি মনে আর দেরি না করে উঠে যেতে চাইলো, কিন্তু পৌষী চা সাধলো স্যার কে। স্যার আর বসলেন না। তিনি চলে যাবার পর পৌষী দরজা লাগিয়ে আরাফকে চায়ের কথা জিজ্ঞেস করলো ও চা চায় কিনা। আরাফ কোন কথার জবাব দিলোনা পৌষীকে।
পৌষীর খুব ইচ্ছে কলেজে ভর্তি হবার কিন্তু আরাফকে বলার সাহস সে পাচ্ছেনা। মামা-মামীকে দিয়ে রাজি করবে ভাবলেও এ মুহূর্তে আরাফের যেরকম মেজাজ সে দেখতে পাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে মামা-মামীকেও হয়তো কঠিন কিছু শুনিয়ে দিতে পারে। তাই আপাতত আর এ বিষয় নিয়ে কথা না বলাই ভালো মনে করলো।
সময়ের চাকায় দিন ঘুরে রাত, রাত পেরিয়ে নতুন আরেকটি দিন, সপ্তাহ, মাস এভাবে কাটতে কাটতে পৌষীর বিয়ের তারিখটি যেন ঠিক মাথার উপর দাঁড়িয়ে আছে। আর মাত্র ক’টা দিন কাটলেই বিয়ের তারিখটা মাথার উপর থেকে ঠিক নিচে এসে দাঁড়াবে। অবশ্য এই এক বছরের ভেতরে পৌষী আরাফকে রাজি করে কলেজে ভর্তি হয়ে ক্লাস করে যাচ্ছিলো। সেই সুবাদে কলেজে কিছু নতুন বন্ধু তৈরী হয় পৌষীর। তাই বিবাহ বার্ষিকীর দিনটিকে নিয়ে পৌষীর অনেক কিছু করার ইচ্ছে থাকলেও সেসবের কিছুই প্রকাশ না করে এর ঠিক দুদিন আগে আরাফকে বললো সে এ দিনটিকে স্বরণীয় করে রাখার জন্য মামামামীসহ কাছের কয়েকজন বন্ধুকে কোন একটি রেস্টুরেন্ট এ খাওয়াতে চায়। আরাফ এতে খুব একটা আপত্তি টানল না।
তারিখমতো মামামামীসহ পৌষীর সব বন্ধুরা চলে এলো নির্দিষ্ট রেস্টুরেন্ট এর ঠিকানায়। যদিও ঠিকানাটা পৌষীর আগে জানা ছিলোনা। বাসা থেকে বের হবার ঠিক আগ মুহূর্তে আরাফ পৌষীকে এড্রেস টা দিয়েছিলো এবং পৌষীও মামামামিসহ তার সেই দু-তিনজন বন্ধুকে জানিয়ে দেয়। একঘন্টার মধ্যেই পৌষী আর আরাফ পৌঁছে গেলো সেখানে। গিয়ে দেখলো তার মামামামি রেস্টুরেন্ট এর সামনেই দাঁড়িয়ে, বাকি তিন বান্ধবী তারাও মাত্র এসে পৌঁছলো। সবাই মিলে ভেতরে ঢুকে পড়লো। বাইরের কাঠফাটা রোদ থেকে রেস্টুরেন্ট এর ভেতরে এসে শরীরে এয়ার কন্ডিশনের নরম, কোমল আর শীত শীত আবহাওয়া অনুভূত হতে লাগলো। চারদিকে তাকিয়ে দেখা গেলো প্রতিটি টেবিল এবং তার সঙ্গের চেয়ারগুলো সাদা কাপড়ে আবৃত। টেবিলের উপর ফুলদানিগুলোতে তাজা ফুলের বাড়তি সমাহার। ভীষণ অন্যরকম একটি পরিবেশ! এরকম ফকফকে সাজানো গোছানো একটা পরিবেশে এলে হাজারো কষ্ট ভুলে মানুষের মন এমনিতেই নরম হয়ে যায়।
আরাফ কোনার দিকের একটা টেবিল দেখে পৌষীকে ইশারা করতেই পৌষী সবাইকে নিয়ে ঐ টেবিলটায় বসলো। পছন্দ অনুযায়ী খাবারের অর্ডার দেয়া হলো। সবাই খাবারের অপেক্ষায়। মাঝারি আকৃতির এ রেস্টুরেন্ট এ অনেক মানুষের আনাগোনা। কেউ ওদেরই মত খাবারের অপেক্ষায়, কেউ খাবার শেষ করে বিল চুকিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকেই খাবার খেতে ভেতরে ঢুকছে, ঠিক এমন সময় ভেতরে প্রবেশ করা দুজন আগুন্তকের দিকে একই সঙ্গে চোখ পড়ে গেলো আরাফ এবং পৌষীর। আগুন্তকের একজন পাভেল স্যার এবং অন্যজন হয়তো তার কোন বন্ধু কিংবা পরিচিত। পৌষী এবং আরাফের চোখে চোখ পড়তেই তিনি এদিকটায় এগিয়ে এসে আরাফ এবং মামামামীসহ সবাইকে সালাম দিতে গিয়ে মুখে কিছুটা বাঁধলেও দু’বারে সালাম দেয়া শেষ করে দূরে একটি টেবিলে গিয়ে বসলেন।
জীবনের কিছু কিছু ঘটনা একটি আরেকটির সঙ্গে অনেকসময় মিলে গেলেও ঘটনাগুলোর একটি থেকে আরেকটি থাকে সম্পূর্ণই অপ্রত্যাশিত কিংবা কাকতালীয়। চটপটি খাওয়া কিংবা আজকের এ দিনে পাভেল স্যার এর রেস্টুরেন্ট এ আসার বিষয়টিও ঠিক এরকমই ছিল।
একটু পরেই আরাফ পৌষীকে বললো তোমরা বস, খাবারের বিল পরিশোধ করা হয়েছে, অমি কিছুক্ষনের মধ্যেই ফিরে আসছি। আজকের মত আরাফ এখানেই বিদায় নিলো এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, সেটা আর কেউ বুঝতে না পারলেও পৌষী ঠিকই বুঝতে পারলো। এই এক বছরের সংসার জীবনে পৌষী আরো অনেক কিছুই বুঝে ফেলেছে আরাফের।
বাসায় ফিরে আজকের রাতটিতে পৌষী আরাফের সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে কোন কথাই বললোনা ।
দু তিনদিন পর পৌষী আরাফের কাছে জানতে চাইলো কেন আরাফ রেস্টুরেন্ট এ সেদিন এমন সিনক্রিয়েট করে চলে এলো?
আরাফ পৌষীর কথার জবাবে বললো পৌষী পাভেল স্যারকে সেদিন ঐ রেস্টুরেন্ট এ যাবার কথা আগেই বলে রেখেছিলো, তা না হলে এত রেস্টুরেন্ট থাকতে তিনি বেছে বেছে ওখানেই কেন গেলেন ?
পৌষীর কথার জবাবে আরাফ এমনটিই বলবে সেটা পৌষী আগেই জানতো তাই বিষয়টি নিয়ে কোন উচ্চবাক্য না করে চুপ হয়ে নিজেকে সেদিনের মত সামলে নিলো ।
সংসারের সময় দীর্ঘ হতে হতে পৌষীকে নিয়ে আরাফের সন্দেহের মাত্রাও যেন দীর্ঘ থেকে আরো দীর্ঘ হতে শুরু করে।
এরই ভেতরে পাভেল স্যার পি এইচ ডি করতে আমেরিকায় চলে গেছেন, এবং সেখানে তার স্ট্যামারিং বা তোতলামো রোগটিরও তিনি চিকিৎসা করাবেন। যাবার আগে পৌষির মামা মামীর কাছে বিদায় নিতে এসে তিনি ঠিক এমনটিই বলে গেলেন।
কলেজে পড়তে এসে পৌষী আর অংকে ঠিক সেই স্কুলের মত আটকে যাচ্ছেনা। পাভেল স্যারের কারণেই পৌষী এস এস সি পরীক্ষায় অংকে পাশ করে যেতে পেরেছে। শুধু এই একটি বিষয় ভাবলে পৌষীর কৃতজ্ঞতা অনেক বেড়ে যায় স্যার এর প্রতি ।
সংসার মানে জীবনের সমস্ত চাওয়া, আবেগ, উচ্ছাস, ভালোলাগা, ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা। সংসার মানে ঘরের বারান্দায় রাখা বেলি ফুলের মিষ্টি সুগন্ধ! যার সৌরভে মৌ মৌ করবে ঘরের প্রতিটি কোনা। আর এর পাশাপাশি সংসার মানে তেল ফুরিয়ে যাওয়া, নুন ফুরিয়ে যাওয়া কিংবা মশারি কে টানবে অথবা রাতে বিছানায় এসে বেডরুমের বাতিটা কে নিভাবে এসব ছোটখাট বিষয়গুলো নিয়ে একে অন্যের সাথে ঠোকাঠুকিতে লেগে থাকা। আবার পরক্ষনেই রাগ অভিমান ভুলে একজন আরেকজনকে নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরা। পৌষী তার বিয়ের আগে সংসারটাকে ঠিক এমন করেই ভাবতে শিখেছিল। কিন্তু বিয়ের পর এসব ধারণা পাল্টে সম্পূর্ণ নতুন ধারণা তৈরী হল যার সঙ্গে পৌষীর স্বপ্নে দেখা ধারণাগুলোর কোনরকম মিল নেই।
দ্বিতীয় এবং শেষ পর্ব :
পৌষীর এখন শুধু মনে হয় সংসার মানে তিক্ততা, সংসার মানে সন্দেহের দেয়াল। পৌষী তার স্বপ্নে দেখা সংসার হতে নিজেকে বিচ্যুত করতে চায়না। আর তাই কলেজ শেষ করে সেই আগের মত পৌষী প্রতিদিন বাসায় ফিরে আরাফের জন্য এটাসেটা রান্না করে টেবিল সাজিয়ে অপেক্ষায় থাকে। এদিকে সন্ধ্যে হতেই আরাফও অফিস থেকে বাসায় ফিরে। কিন্তু ওর মুখে কোনদিন হাসি দেখেনি পৌষী।
পৌষী ভাবে হয়তো আরাফ ক্লান্ত। পৌষীর প্রতিটি কথায় প্রতিটি কাজেই আরাফ কেন যেন বিরক্ত হয়ে যায়। উচ্চস্বরে জবাব দেয়।
আজকাল পৌষীর এসব একদম সয়ে গেছে । শুনেও না শোনার ভান করে, দেখেও না দেখার ভান করে।
কলেজ শেষ করে পৌষী ইউভার্সিটির গন্ডিতে পা রাখলো। গত এক বছর ধরেই পৌষী ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে। গণিতে ফেল করা পৌষী আজ গণিত নিয়েই অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছে। ৭’টা ৫৫ মিনিটে প্রতিদিন ক্লাস শুরু হয়। আজও ঠিক তাই। বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশা খুঁজে ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছুতে পৌঁছুতে ৫ থেকে ৭ মিনিট দেরি হয়ে যায় প্রায়শই। আজও ঠিক ৫ মিনিট দেরি হলো। তড়িঘড়ি করে ক্লাসে ঢুকতে ঢুকতে ক্লাস প্রফেসরকে সালাম দিতে গিয়ে পৌষী ভীষণ চমকে গেলো। কৌতূহল ভেতরে রেখেই পৌষী শুধু বললো পাভেল স্যার আপনি এখানে! পাভেল স্যারও পৌষীকে দেখে কিছুটা চমকে গেলেন ! নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন তূমি এই ইউনিভার্সিটি পড়ছো ? অমি ভীষণ আনন্দিত যে আমার একজন স্কুল ছাত্রীকে অমি ইউনিভার্সিটির ক্লাসেও পেয়ে গেলাম। ক্লাসের সবাইকে পাভেল স্যার খুলে বললেন পৌষীর স্কুল জীবনে তিনি তাকে অঙ্ক করিয়েছিলেন। একটু পরই পৌষী পাভেল স্যারের মুখে জানতে পারলো তিনি আমেরিকা থেকে ম্যাথ এর উপরে পি এইচ ডি করে এসেছেন। এই ইউনিভার্সিটিতে তিনি আজই প্রথম ম্যাথ টিচার হিসেবে ক্লাস নিতে শুরু করেছেন। পুরো ক্লাস জুড়েই সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা পাভেল স্যারকে ভীষণ এটেনশন দিলো। স্যার এর পড়ানোর ধাঁচেই বোঝা গেলো তিনি খুব ব্রিলিয়ান্ট! অতিরিক্ত মেধা সম্পন্ন একজন শিক্ষক! পৌষীরও একটানা মনযোগ স্যার এর দিকে। কিন্তু মনযোগ দিতে দিতে পৌষী লক্ষ্য করলো অন্য আরেকটি বিষয়। যে বিষয়টি সে পূর্বে দেখেছে স্যার এর ভেতরে তার বিন্দুমাত্র এখন নেই। স্যার অনর্গল ম্যাথ বুঝিয়ে যাচ্ছেন ক্লাসের সবাইকে। একটি কথাও তার আটকাচ্ছেনা কোথাও কিংবা তিনি টেনে টেনে কোন কথাই বলছেননা। পৌষী বুঝতে পারলো স্যার সেই পূর্বের তোতলামো কিংবা স্ট্যামারিংজনিত সমস্যায় আর ভুগছেননা। স্যারকে অবশ্য এ বিষয়ে পৌষী একটি কথাও জিজ্ঞেস করেনি । পৌষীর সেটা জিজ্ঞেস করবার কথাও নয়।
আজ ভীষণ চিন্তিত মন নিয়েই বাসায় ফিরতে ফিরতে সে ভাবলো আরাফ যদি কোনভাবে জানতে পারে পাভেল স্যার এই ইউনিভার্সিটির প্রফেসর তাহলে হয়তো এ যাত্রা আর বেঁচে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। আপাতদৃষ্টিতে এ বিষয়টি খুবই সাধারণ একটি বিষয় হলেও আরাফের চোখে পাভেল স্যার এবং পৌষীর বিষয়টি ভীষণ সন্দেহজনক সেই বিয়ের পর থেকেই ।
পৌষী একবার ভাবলো ইউনিভার্সিটি বদলে অন্য নতুন কোনটিতে ভর্তি হবে। কিন্তু আরতো মাত্র একটি বছর অনার্স শেষ হতে। দেখতে দেখতে বছরটি শেষ হয়ে যাবে এই ভেবে পৌষী এই ইউনিভার্সিটিতেই রয়ে গেলো।
সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার আরাফকে বাজারে যেতে হয়। আজও শুক্রবার। পৌষী ঘরের কিছু প্রয়োজনীয় বাজারের ফর্দ ধরিয়ে দিলো আরাফকে। সকাল ১০ টা নাগাদ চা নাশতা শেষ করেই আরাফ বাজারের দিকে চলে গেলো। বাজার শেষ করে রিক্সায় উঠতে যাবে এমন সময় আরাফ দেখতে পেলো তার রিকশার পেছনেই এসে আরেকটি রিকশা থামলো এবং সে রিকশা থেকে পাভেল স্যার নামলেন। অনেকদিন পর দেখতে পেয়ে একটু অন্যরকম মনে হলেও আরাফ ঠিকই চিনতে পেরেছিলো পাভেল স্যারকে। আরাফের মুখোমুখি হতেই তিনি আরাফের দিকে তাকিয়ে বললেন —
“আস্সালামুআলাইকুম, কেমন আছেন আরাফ ?”
“ওয়ালাইকুমআসসালাম, আপনি ? কোথা থেকে এতদিন পর ? কেমন আছেন ?”
“কেন পৌষী আপনাকে বলেনি ? আমিতো ঐ ইউনিভার্সিটিতে পড়াই এখন, এক সপ্তাহ হল শুরু করেছি।”
“ও আচ্ছা, জ্বি ভালো থাকবেন, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, আসি অমি আজ।” এ কথা বলেই আরাফ রিকশা ডেকে উঠে গেলো।
আসলে আরাফ পাভেল স্যারকে এড়িয়ে গিয়েছিলো।
বাসায় ফিরে বাজারগুলো হাত থেকে নামিয়ে আরাফ পৌষীকে ডেকে বললো এগুলো গুছিয়ে রাখতে। পরক্ষনেই বললো তূমি প্রতিদিন ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছ নাকি তোমার পাভেল স্যার এর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ ?
আরাফের এরকম আক্রমণাত্মক কথায় পৌষী আরাফকে রুক্ষ ভাষায় কিছু বলতে চেয়েছিলো, কিন্তু তা না করে শুধু আরাফের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে শান্ত নরম স্বরে বললো—
“আরাফ তূমি বরাবরই আমাকে ভুল সন্দেহ করে আসছো।” তোমার এ সন্দেহ করা তূমি বন্ধ কর।
এ সংসারে আরাফের সাথে প্রতিটা মুহূর্তে নিজেকে খাপ খাওয়াতে খাওয়াতে পৌষী ভীষণ ক্লান্ত আজ। পৌষীর মনে হল তাদের দুজনের সম্পর্কটা খুবই নড়বড়ে একটি সাঁকোর উপরে দাঁড়িয়ে আছে। যে কোন বাতাসেই যেন সাঁকোর দুপাশের বাঁধন খুলে সাঁকোটি ঠিক নিচে তলানিতে চলে যেতে পারে। তখন আর একে খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
পৌষী আর এই ইউনিভার্সিটিতে যাবেনা বলে সিদ্ধান্ত নিলো। অন্য যে কোন ইউনিভার্সিটিতে সে ভর্তির কথা ভাবলো।
গত কয়েকদিন যাবৎ আরাফ পৌষীর সঙ্গে একদমই কথা বলছেনা। পৌষী কিছু জিজ্ঞেস করলেও ভীষণ মেজাজ দেখিয়ে জবাব দিচ্ছে। সে মেজাজের মাত্রা যেন আগের তুলনায় দ্বিগুন। এভাবে কথা না বলে এই পরিস্থিতিতে ঘরের ভেতরে থাকতে যেয়ে যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো।
পৌষী কিছুদিন তার মামামামীর কাছে যেয়ে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো এবং আরাফকে কথাটা বলতেই সে বলে উঠলো —
“মামামামীর কাছে গিয়ে থাকলে কি খুব সুবিধে হয়? ইউনিভার্সিটিতেতো প্রতিনিয়ত স্যার এর সঙ্গে তোমার দেখা হচ্ছেই, তাহলে ?”
আরাফের কথা শেষ হওয়া মাত্রই এই প্রথমবারের মত পৌষী কিছুটা উচ্চবাক্য করে উঠলো আরাফের সঙ্গে! পরক্ষনেই আবার শান্ত হয়ে আরাফকে বললো — “আরাফ তূমি যা সন্দেহ করছো তা ভুল, এবং সম্পূর্ণই ভুল, এসব সন্দেহের কোন ভিত্তি নেই, তোমার আমার সম্পর্কের মাঝে তূমি ভীষণ জটিল এক দেয়াল তুলেছো এই মিথ্যে অপবাদের রেশ টেনে। অমি চাই তূমি আমাকে এমন সন্দেহ করা থেকে বেরিয়ে আসো, আমরা নির্ভেজাল একটা সংসার করি ।”
পৌষীর কথা শেষ হতেই আরাফ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রাত ঠিক ১০ টা নাগাদ বাসায় ফিরে এসে পৌষীকে বললো–
“তূমি তোমার মামামামীর কাছে চলে যাও। অমি তোমার সঙ্গে আর থাকতে চাই না।” একথা বলে পৌষীর পাশ থেকে বালিশ খানা নিয়ে সোফায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
পুরো রাত একা একা বিছানায় শুয়ে ভীষণ এক অস্বস্থিকর পরিস্থিতি নিয়ে রাত পার করলো পৌষী।
সকাল হতেই মনে হলো এ বিষয়টি সম্পর্কে পাভেল স্যার কে এবারে জানাতেই হবে । ওনাকে নিয়ে যেহেতু এতো কথা সেখানে অবশ্যই তাকে সবকিছু খুলে বলতে হবে। সবকিছুর একটা সীমারেখা থাকে। সেটা যখন অতিক্রম করে ফেলে তখন তাকে আটকানোর চেষ্টা করা উচিত।
অপমান অবহেলা সবকিছুর দ্বারপ্রান্তে এসে পৌষীরও মনে হলো কিছুদিনের জন্য ওর আরাফ থেকে দূরে সরে গিয়ে নিজেকে সময় দেয়া উচিত। এতে হয়তোবা আরাফেরও মনের পরিবর্তন হতে পারে।
পৌষী পরের দিনই মামার সঙ্গে তাদের বাসায় চলে গেলো। নিজের মনের সাথে বোঝাপড়া করতে গিয়ে পৌষীও পারছেনা ক্লাসে মনযোগী হতে। তাই ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখলো। দিন পনের বাদে পৌষী ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া শুরু করলো। এ কয়দিনে ওর যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে ক্লাস না করতে পেরে। বন্ধু বান্ধবদের থেকে যতটুকুন সম্ভব তাকে সাহায্য নিতে হলো।প্রায় তিনমাস ধরে পৌষী মামামামীর সঙ্গেই আছে। এই তিনমাসে আরাফকে দেখতে দু দুবার ওর বাসায় ফেরত গিয়েছে। কিন্তু আরাফ পৌষীকে প্রতিবারই অপমান করে তাড়িয়ে দেয়।আরো কয়েকটি মাস কেটে যায়। পৌষী খুব অপেক্ষায় থাকে আরাফের। আরাফ হয়তো ওকে নিতে আসবে। কিন্তু সে অপেক্ষা শুধু অপেক্ষাতেই রয়ে যায়।এদিকে পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এসেছে। ইদানিং পৌষী পড়াশোনায় নিজেকে এত ব্যস্ত রাখতে শুরু করেছে যে আরাফের দেয়া যন্ত্রনা আর অপবাদগুলো যেন ভুলতে বসেছে। গত কয়েকটা দিন পাভেল স্যারও ক্লাসে আসেননি। ছুটিতে ছিলেন। পাভেল স্যারকে ছাড়া কারোরই যেন ক্লাস জমে উঠেনা, নিরশ মনে হয়। ছুটি কাটিয়ে আজ হঠাৎ করে পাভেল স্যার ক্লাসে ঢুকা মাত্রই সবাই মহা খুশি। পৌষী স্যার এর দিকে এক পলক তাকিয়ে বইয়ের দিকে মনযোগ দিতে লাগলো। বই থেকে মুখ তুলে আবারো পৌষী স্যার এর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিজের অজান্তেই। হঠাৎ যেন তার নিজেকে নিজের ভীষণ অস্থির মনে হলো। স্যার বুঝতে পারলেন পৌষী ক্লাসে মনযোগ দিতে পারছে না। কোন কারণে হয়তো কিছুটা অসামঞ্জস্যতা তৈরী হয়েছে। তিনিও পৌষীকে একটু পর পর ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন । এবং এক পর্যায়ে তিনি পৌষীকে বললেন —“পৌষী তোমাকে কিছুটা ক্লান্ত মনে হচ্ছে, তূমি চাইলে কিছু সময় ক্লাসের বাইরে থেকে হেঁটে আসতে পারো ”
ক্লাস থেকে পৌষী বের হতেই স্যারও আসলেন পৌষীর পেছন পেছন। স্যার পেছন থেকে পৌষীকে ডেকে বললেন —
“পৌষী কি হয়েছে? তোমাকে ভীষণ অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে, তূমি ঠিক আছো ?
পৌষী স্যার কে কিছু বলতে গিয়েও পারলোনা বলতে, তবে নিজের মনের অজান্তেই যেন কিছু একটা পৌষী বলতে চাইছে এই প্রথমবারের মত। এর আগে সে কখনোই এমনটি ভাবেনি। আজ কি হয়েছে সে জানেনা। অথচ মানুষের মনের উপরে কোন জোর নেই, কোন হাত নেই। পৌষী পাভেল স্যার এর দিকে তাকিয়ে আবারো কিছু একটা বলতে চেষ্টা করে আটকে গেলো। নিজের মনকে নিজে বোঝালো। আর মনকে বললো আজ নয় অন্যদিন পৌষী তার মনের কথাটা স্যারকে বলবেই। যে কথাটা আজই সে বুঝতে পারলো এবং আজই তার মনে এটা প্রথমবারের মত অনুভূত হলো।
স্যার এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পৌষী সোজা বাইরে বেরিয়ে রিকশা নিলো। টকটকে রোদের প্রচন্ড তাপে রিকশার হুডি ফেলে চলতে শুরু করলো ঘরের উদ্দেশ্যে । মামামামীর ঘরই এখন তার নিজের ঘর ।
ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল চাপতেই মামী দরজা খুলে দিয়ে পৌষীকে জড়িয়ে ধরলেন। পৌষীর কপোলে চুমু দিয়ে বললেন ওপরওয়ালা এবারে তোর দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন। পৌষী ঠিক বুঝতে পারল না এসব কথার মানে কি। ওদের শব্দ পেয়ে মামাও এসে হাজির। চোখের গ্লাস নামিয়ে চোখ মুছতে মুছতে মামা পৌষীকে বললেন —“আরাফ এসেছিলো আজ। তোকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলো। ও তার নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। সেজন্য সে ক্ষমা চাইলো আমাদের কাছে ও তোকে কষ্ট দিয়েছে বলে। তু্ই মা তোর কাপড়চোপড় গুছিয়ে ready থাক, ও আবার এসে তোকে নিয়ে যাবে বললো।”
মন বললো “মোটেইনা। তোমার নিজের স্বাধীনতাকে কেন তূমি বিসর্জন দিবে ? তোমার ইচ্ছের মূল্য যখন সে দেয়নি তাহলে তূমি কেন দিবে। সে যখন চাইবে, তূমি তখন তার সংসার করবে, সে যখন চাইবে তখন তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিবে, আবার যখন চাইবে, তখন তোমাকে কাছে টানবে! হয়তো আবারো কোনদিন সে তোমাকে দূরে ঠেলে দিবে। তূমি নিশ্চই কারো খেলার পুতুল নও! কারো ইচ্ছের কাছে কেন তূমি বলিদান হবে ?”নিজের মনকে বুঝিয়ে পৌষী সিদ্ধান্ত নিলো আর নয়! আরাফকে সে ফিরিয়ে দিবে।নিয়ম করে পৌষী প্রতিদিন ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে। এবং পাভেল স্যার এর সঙ্গেও প্রতিদিন তার দেখা হচ্ছে। আরাফ কিংবা কেউ দেখে ফেলবে, জেনে ফেলবে সে বিষয় নিয়ে এখন আর পৌষী মোটেও ভীত নয়, বিব্রত নয়।
কয়েকটাদিন এভাবে যেতেই খুব বৃষ্টির এক সন্ধ্যেবেলা পাভেল স্যার ক্লাস শেষে তার গাড়িতেই পৌষীকে মামামামীর বাড়িতে নামিয়ে দিলেন।
ভেতরে ঢুকে পৌষী কিছুটা আঁতকে উঠলো। প্রায় এক বছর পর পৌষী আরাফকে দেখছে। পৌষীকে দেখে চায়ের কাপটা নিচে নামিয়ে আরাফ পৌষীর খুব কাছে এসে দাঁড়ালো। মামামামি দুজনই ওদেরকে ছেড়ে ভেতরের রুমের দিকে চলে গেলেন । আরাফ ফট করে পৌষীর ডান হাতটি জড়িয়ে ধরলো। পৌষী অনেক কষ্টে নিজের হাত আরাফের শক্ত হাতের মুঠো থেকে সরিয়ে নিতেই আরাফ কিছুটা কান্নার স্বরে পৌষীকে বলে উঠলো —
“আমাকে মাফ করে দাও পৌষী, অমি ভীষণ অন্যায় করে ফেলেছি তোমার সঙ্গে, সেটা এখন বুঝতে পেরেছি, আর তাই সেদিন এসেছিলাম তোমাকে তোমার সংসারে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চিরদিনের মত।”আরাফের সব কথাগুলো পৌষী ওর দিকে নিষ্প্রাণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে শুনলো। কিন্তু আরাফের জন্য তার মনের কোথাও কোন প্রতিক্রিয়া হলোনা। নিজের অজান্তেই আরাফকে বলতে লাগলো –“আরাফ তূমি ফিরে যাও, আমার সঙ্গে তূমি যা করেছো অমি তার জন্য তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। অমি এখন আর পারব না তোমার সঙ্গে ফিরে যেতে, কারণ তূমি অনেক দেরি করে ফেলেছো।”
“দেরি কেন বলছো পৌষী ? তুমিতো এখনো এখানেই আছো, তাহলে !”
“আরাফ অমি তোমার জন্য অনেক অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে, ঐ বাড়ি থেকে এসে অমি ভীষণ নিঃস্বঙ্গ, দুর্বিসহ একটা জীবন কাটিয়েছিলাম। তূমি ফিরে যাও।”
“না পৌষী, অমি তোমাকে নিয়েই ফিরতে চাই, তূমি ফিরে চলো। আমার মনের সে দেয়াল অমি ভেঙে۔۔ ফেলেছি।”
“আরাফ তূমি চলে যাও। অমি চাইলেও এখন আর তোমার সঙ্গে ফিরে যেতে পারব না। কারণ আমি অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলেছি আরাফ।”
“অমি তোমার কথা বিশ্বাস করিনা পৌষী, তূমি মিথ্যে বলছো। তূমি এটা করতে পারোনা।”
“আমি পেরেছি, তোমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে আমি ভালোবাসতে শুরু করেছি।”
“তুমিতো আমার অপেক্ষায় ছিলে। তাহলে কিভাবে, কেমন করে, কবে থেকে তূমি অন্য কাউকে ভালোবাসতে শুরু করেছো ?”
“যেদিন থেকে তূমি আমাকে সন্দেহ করা বন্ধ করে দিয়েছো সেদিন থেকেই আমি পাভেল স্যার কে ভালোবাসতে শুরু করেছি আরাফ।”
বিড়ালিনীটা দৌড়ে চলে গেলো বাইরের কলিং বেলটা বাজতেই। কারণ এ সময়টা রূমঝুম স্কুল শেষ করে বাসায় ফিরে। পৌষীর একমাত্র মেয়ে রূমঝুম। ক্লাস থ্রীতে পড়ে। স্কুল বাস এসে ওকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে যায় প্রতিদিন ঠিক এই সময়টায়। বাইরের স্নোইং দেখতে দেখতে পৌষী আজ টেরই পেলোনা বাসটা কখন এলো ?