১৪২ বার পড়া হয়েছে
বাবা-মায়ের পাপের ফসল নাকি প্রতিবন্ধী সন্তান
মনিজা রহমান, এস্টোরিয়া, নিউইয়র্ক, আমেরিকা
শিরোনামটা দেখে সবাই চমকে উঠেছেন নিশ্চয়ই। কারণ এতদিন সবাইকে বলে এসেছি সৃষ্টিকর্তা স্পেশাল প্যারেন্টসকেই শুধু স্পেশাল সন্তান দেন! কিন্তু সম্প্রতি ঈদুল আজহা উপলক্ষে প্রচারিত এক বিশেষ নাটকে এমন ‘বার্তা’ ই দেয়া হল দর্শকদের।
নাটকের নাম- ঘটনা সত্য, পরিচালক রুবেল হাসান, চিত্র নাট্যকার মাইনুল শানু এবং বাবা ও মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আফরান নিশো ও মেহজাবিন চৌধুরী। নাটকটি প্রচারিত হবার পরে চারদিকে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। স্পেশাল নিডস সন্তানের বাবা-মায়ের আপত্তির মুখে নাটক সংশ্লিষ্টরা ক্ষমা চেয়ে ভুল স্বীকার করেছেন। আর জানিয়েছেন ‘অসাবধানতাবশত:’ এই কাজটি করেছেন তারা।
একটি নাটক নির্মাণ এক-দুই ঘন্টার ব্যাপার নয়। তারজন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি থাকে। চিত্রনাট্য রচনা, কুশীলব নির্ধারণ, শূটিং-এডিটিং মিলে এলাহি কান্ড। এত লম্বা সময়ের মধ্যে তাদের কারো উপলব্ধি হয়নি বিষয়টা! সত্যি আশ্চর্য্যজনক। আরো অবাক হলাম, নাটকটি বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতির আঁধার বলে খ্যাত চ্যানেল আইতে প্রচারিত হয়েছে!
কি ছিল ‘ঘটনা সত্য’ নাটকে? সেখানে দেখানো হয়, নায়ক আফরান নিশো এক বাসার গাড়ীর ড্রাইভার, সে তেল চুরি করে বিক্রি করে দেয়। আর গৃহকর্মী চরিত্রে মেহজাবিন মালিকের বাসার ফ্রিজের খাবার না বলে নিয়ে যায়। দুজনের মধ্যে এক সময়ে প্রেম হয়, তারপর তারা বিয়ে করে, এবং নাটকের শেষে তাদের একটি প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম হয়। নাটকের শেষে অনেকটা দৈববাণীর মত একটা কণ্ঠ এসে দাবি করে, এই শিশু তাদের বাবা-মায়ের পাপের ফল।
এই একুশ শতকে এসে মানুষ যখন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন, সেখানে বাংলাদেশের দুই শীর্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রীর নাটকের মাধ্যমে সমাজে কুসংস্কার প্রচার করা হয়েছে এভাবে। নাটকের শেষে যে বার্তাটি তারা দিতে চেয়েছেন, তার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এই গবেট লোকজন হয়ত জানেনা, আইজ্যাক নিউটন, আলবার্ট আইনস্টাইন, ওয়াল্ট ডিজনি, স্টিভেন হকিন্স তারা সবাই স্পেশাল নিডস ছিলেন।
ধর্মগ্রন্থে স্পেশাল নিডস শিশুদের বাবা-মায়েদের বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয়েছে। বলা হয়, সৃষ্টিকর্তা সবাইকে এই দায়িত্ব দিতে চান না, তিনি সেই বাবা-মাকেই এই দায়িত্ব দেন, যারা তার যোগ্য এবং তাদের জন্য বিশেষ পুরস্কার রয়েছে। স্পেশাল নিডস সন্তান যে কোন পরিবারের জন্য আশির্বাদ। আমি অন্তত আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় তাই দেখেছি। স্পেশাল নিডস শিশুরা এতটা সহজ-সরল আর আনন্দময় হয় যে মনে হবে যেন কোন দেবদূতের সঙ্গে বাস করছি।
নিউইয়র্কে আমার মত যারা স্কুলে চাকরী করেন, তাদের অনেককেই স্পেশাল নিডস শিশুদের সঙ্গে কাজ করতে হয়। তারা প্রত্যেকেই জানে, এই ধরনের শিশুদের সঙ্গে কাটানো সময়টা কত মধুর হয়। আশেপাশের সবার প্রতি তাদের কত মায়া। নিউইয়র্ক তথা আমেরিকায় স্পেশাল নিডস শিশুদের জন্য প্রতি বছর কত টাকা যে সরকার ব্যয় করে তার কোন হিসেব নেই। আমার এক এগারো বছর বয়সী অটিস্টিক সন্তানের স্কুলের বেতন, বাস সুবিধা, হোম এটেনডেন্ট, হোম থেরাপিস্ট, চিকিৎসা- সব মিলে বাংলাদেশী টাকায় দুই কোটি টাকার কাছাকাছি প্রতি বছর সরকার খরচ করে।
সাপ্তাহিক বাঙালি প্রত্রিকায় মিজান রহমানের লেখা ‘আমেকিরায় আমাদের নতুন প্রজন্ম’ আর্টিকেলে পড়েছিলাম- আমেরিকায় আঠারো বছরের কম বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে শতকরা ১২.৮ ভাগ স্পেশাল নিডস শিশু। অর্থাৎ প্রতি নয়টি পরিবারের মধ্যে একটি পরিবারে এমন শিশু থাকে। এবং সবাই এই সুবিধা পায়।
আমার স্পেশাল নিডস সন্তান নিয়ে বাসে-ট্রেনে যেখানে ভ্রমন করেছি, সবার সহায়তা পেয়েছি। মনে আছে একটি ঘটনার কথা, এই দেশে আমরা তখন নতুন এসেছি। কোন স্টেশনে ট্রেন থামার পরে আমার ছেলে সৃজন কোন কারণে নামতে চাইছিল না, সম্ভবত ও আরো কিছুক্ষণ ট্রেনে চড়তে চাইছিল, তখন ওকে নিয়ে আমি বিপদে পড়ে যাই। সঙ্গে ওর বাবা ছিল না। আমি ছুটে গিয়ে ট্রেনের দরজায় পা দিয়ে রেখেছিলাম, যাতে দরজা বন্ধ না হয়ে যায়। আমার বড় ছেলে মনন, সৃজনকে টানাটানি করতে থাকে ওঠার জন্য।
যখন সৃজন উঠতে চাইছিল না, তখন আমার বড় ছেলে, তখন সে নিজেও এক শিশু, ভাইয়ের কান ধরে উঠিয়েছিল। ট্রেনের দরজার কাছে সতের-আঠারো বছর বয়স কয়েকটি মেয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওদের সেকি রাগ আমার বড় ছেলের ওপর! ‘ইউ শুডন্ট ডু দিস’ ‘হি ডাজংন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড’ –রীতিমত হুমকি দিচ্ছিল আমাদের উদ্দেশ্যে। সেদিন কিছুটা ভয় পেলেও মনে মনে মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছিলাম- আমেরিকার তরুণ সমাজের ‘স্পেশাল নিডস’দের ব্যাপারে সচেতনা দেখে।
এই যখন এখানকার চিত্র, তখন সমাজের দর্পণ বলে পরিচিত নাটকে বার্তা দেয়া হচ্ছে বাবা-মায়ের খারাপ কাজের জন্যেই সন্তান প্রতিবন্ধী হয়। নাটকটির কথা জানার পরে লজ্জায়-ঘৃণায়-তিক্ততায় পুরো মন ছেয়ে আছে। কেমন যেন বিবমিষা হচ্ছে। কারণ একটি স্পেশাল নিডস সন্তানের পরিবারকে সব সময় একটা লড়াইয়ের মধ্যে যেতে হয়। এখন যদি কোন বাবা-মাকে বলা হয়, তোমাদের অতীত পাপের ফসল এই সন্তান, তাহলে তাদের জন্য কষ্টের আর শেষ থাকে না।
নাটকটির কথা আমাকে প্রথম জানায় চাইল্ড ফাউন্ডেশনের কর্ণধার আনা আমান ও তাহরিন আমান। ইতিমধ্যে তাদের সংস্থার পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানিয়েছে এই ঘটনার। তারা জানিয়েছে, স্পেশাল নিডস সন্তানদের নিয়ে এমনটি ভুল বার্তা সমাজকে দেয়া মানে সাধারণ মানুষের মূল্যবোধে আঘাত হানা। এটা শুধু নিন্দনীয় নয়, আইনত দন্ডনীয়।
মনিজা রহমান
এস্টোরিয়া, নিউইয়র্ক, আমেরিকা
১ Comment
nice response.