১৭২ বার পড়া হয়েছে
বাবা
গল্প
আফছানা খানম অথৈ
গল্প
আফছানা খানম অথৈ
রফিকুজ্জামান হাই স্কুল টিচার ছিলেন। দু’ছেলে এক মেয়ে হওয়ার পর উনার স্ত্রী মারা যান। তিনি ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আর বিয়ে করেননি। যাক দু’ছেলে ভালো ভাবে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে।আর মেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর ভালো বর দেখে তার বিয়ে দিয়ে দিলেন।রফিকুজ্জামান এক সময় চাকরী থেকে অবসর নিলেন।ততদিনে দু’ছেলের চাকরী হয়ে গেল।বড় ছেলে জাবেদ ব্যাংক অফিসার, ছোট ছেলে আবির অডিট অফিসার।যাক ভালো ভাবে বাবা ছেলের দিনকাল অতিবাহিত হচ্ছে।বড় ছেলে জাবেদ রিলেশন করে বিয়ে করল।তার কয়েক মাস পর ছোট ছেলে আবির ও বিয়ে করে বউ ঘরে তুলল।
এর ফাঁকে কেটে গেল কিছু সময়।এক দিন দু’ছেলে প্রস্তাব করল।
বাবার ভিটেবাড়ি বিক্রি করে টাকা দেয়ার জন্য।তার আলাদা বাড়ি করবে।বাবা রাজি হয়ে গেলেন।ভিটেবাড়ি বিক্রি করে সব টাকা দু’ভাইকে সমান ভাগে ভাগ করে দিলেন।মেয়ে পাপিয়া সুলতানাকে কিছুই দিলেন না।দু’ভাই আলাদা বাড়ি করল।বাবার থাকার জায়গা হল দু’ছেলের বাসায়।মাসের এক তারিখ থেকে পনেরো তারিখ পর্যন্ত বড় ছেলের বাসায়,আর ষোলো থেকে ত্রিশ তারিখ পর্যন্ত ছোট ছেলের বাসায়। প্রথম প্রথম রফিকুজ্জামন’র সময় ভালো ভাবে কাটলেও পরবর্তীতে তা বিষিয়ে উঠে।দুবউ উঠতে বসতে খোটা দেয়, আজে বাজে কটু ভাষা ব্যবহার করে।সেবা যত্নতো দূরের কথা ঠিকমতো খেতে পরতে ও দেয়না।
এমনি অযত্ন অবহেলার মাঝে কেটে গেল কিছু সময়। অযত্ন আর অবহেলার কারণে রফিকুজ্জামান খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন।গায়ে প্রচণ্ড জ্বর,মাথা ব্যথা বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না।জ্বরের তাড়নায় প্রলাপ করছে,বড় ছেলের নাম ধরে ডাকছে,
তখনি বড় বউ ছুটে এসে ঝাঁঝালো কন্ঠে গজগজ করে বলে,
এমন ছেঁছামেছি করছেন কেনো?আপনার ছেলে বাসায় নেই।চুপচাপ শুয়ে থাকেন।আমার ঘুমের ডিস্টার্ব হচ্ছে।
বউমা জাবেদ আসলে বল ঔষধ আনতে। জ্বরে গা ফুড়ে যাচ্ছে, খুব ক্লান্ত লাগছে।
বউ ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে বলে,
আপনার আয় রোজগার নেই।আমরা কেনো আপনার জন্য টাকা ব্যয় করব।চুপচাপ শুয়ে থাকেন। জ্বর এমনিতে সেরে যাবে।
এমন সময় মেয়ে পাপিয়া সুলতানা বাবার খবর জানার জন্য তার ভাবীর মুঠোফোনে ফোন করলো।ভাবী রিসিভ করে বলে,
হ্যালো কে বলছেন?
ভাবী আমি পাপিয়া সুলতানা। কেমন আছেন?
ভালো।তুমি কেমন আছ?
ভালো।বাবা কেমন আছে?
বাবাকে ফোনটা দাওতো। আমি বাবার সঙ্গে কথা বলব।
সত্য বললে মেয়ে বাবাকে দেখতে আসবে তাই বানিয়ে মিথ্যে বলল,
বাবা ভালো আছে ঘুমাচ্ছে।এখন উনাকে ডিস্টার্ব না দেওয়ায় ভালো।
রফিকুজ্জামানের সামনে এত বড় মিথ্যে, তিনি আর থেমে থাকতে পারলেন না।আস্তে করে বললেন,
বউ মা তুমি এত বড় মিথ্যে বলতে পারলে আমি ভালো আছি…!ফোনটা দাও আমি আমার মেয়ের সঙ্গে কথা বলব।
বউ চোখ রাঙিয়ে বলে,
চুপ একদম চুপ আর কোন কথা নয়।
রফিকুজ্জামান বউয়ের ভাবমূর্তি বুঝতে পেরে আর কোন কথা বাড়ালেন না,চুপসে গেলেন।
এদিকে পাপিয়া সুলতানা কিছুতে মনকে বুঝাতে পারছে না।বাবাকে এক পলক দেখার জন্য মন প্রাণ আকুলি বিকুলি….।
তাই আর দেরী না করে কিছু ফলফলাদি নিয়ে বাবাকে দেখতে আসল।এসে একি দেখল বাবা খুব অসুস্থ জ্বরে গা ফুড়ে যাচ্ছে।বাবার এ অবস্থা দেখে মেয়ে আর থেমে থাকতে পারল না,ডুকরিয়ে কেঁদে উঠল।কেঁদে কেঁদে বলে,
বাবা তুমি এত অসুস্থ,অথচ আমাকে খবর দিলে না..!
বাবা ও আর থেমে থাকতে পারল না।কেঁদে উঠে বলে,
মারে খবর দিব কিভাবে আমার হাতে কি মোবাইল আছে।
বাবার চোখের পানি মুছে দিয়ে মেয়ে বলে,
কেঁদো না বাবা, চলো তোমাকে আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
মেয়ে আর দেরী করল না।বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল।ডাক্তার থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে বলল,
জ্বর কত দিন থেকে?
প্রায় পনেরো দিন হবে।
বলেন কি!এতদিন জ্বর অথচ আজ এনেছেন ডাক্তারের কাছে।আর ও আগে আনেননি কেনো?
স্যার আমি খবর পাইনি।আজ দেখতে এসে দেখি বাবার অবস্থা খুব সিরিয়াস…।সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে এলাম।
আপনার ভাই নেই?
আছে স্যার।তারা বাবাকে তেমন একটা কেয়ার করে না।সংসার বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে ব্যস্ত…।
তাই বলে বাবাকে দেখবে না।এরা কেমন ছেলে?
স্যার এসব বলে আর লাভ নেই।এখন আমার বাবাকে ভালো ভাবে চিকিৎসা দিন।
ঠিক বলেছেন। এইতো আমি ঔষধ পথ্য লিখে দিচ্ছি।
ডাক্তার পাপিয়া সুলতানার হাতে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বলল,
এই ঔষধ গুলো ঠিকমতো খাওয়াবেন।সাতদিন পর ভালোমন্দ জানাবেন।
পাপিয়া সুলতানা ঔষধ পথ্য কিনে বাবাকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসল।বাবার অবস্থা খুব সিরিয়াস সেবা যত্নের প্রয়োজন তাই সে থেকে গেল।দুদিন থাকার পর ভাবী তার ভাইকে ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং বলে,
এটা কি বাসা না নঙ্গল খানা?
কেন কি হয়েছে?
কি হয়নি বল।বাবার সামান্য জ্বর।পাপিয়া সুলতানা এসেছে যে আর যাওয়ার নাম গন্ধ নেই।আহলাদ একেবারে উপছে পড়ছে।ওদের রান্না করে খাওয়াবে কে শুনি।আমি আর কাজ করতে পারব না।
আস্তে বল সুলতানা শুনলে কষ্ট পাবে।
আড়াল থেকে পাপিয়া সুলতানা সব শুনেছে।তারপর কেঁদে কেঁদে বাবাকে বলে,
বাবা চলো আমার বাসায়। এখানে থাকলে তুমি মরে যাবে।
না মা আমি যাব না।
কেন বাবা?
কোন মুখে যাব আমি তোর বাসায়।তোকে যে আমি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছি।
তাতে কি হয়েছে বাবা।আমাদের অনেক আছে।স্বামী স্ত্রী দুজনে চাকরী করি।ভালোই চলছে আমাদের সংসার।
রফিকুজ্জামান রাজী হলেন না মেয়ের সঙ্গে যেতে।মেয়ে চলে গেল।
পাপিয়া সুলতানাকে দেখে তার স্বামী বলল,
বাবা কেমন আছে?
ভালো না।খুব জ্বর।
নিয়ে এলে না কেন?
বাবা জেদ ধরেছেন আসবেন না।
কেন কেন?
বাবার এক কথা আমাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছেন।এখন আমার বাসায় কোন মুখে আসবেন।
তাই বলে উনি আমানুষদের বাসায় থেকে মরবেন নাকি?
সেটা বাবাই ভালো বুঝেন।
এর ফাঁকে কেটে গেল কিছু সময় রফিকুজ্জামান মোটামুটিভাবে আল্লাহর রহমতে সুস্থ হয়ে উঠলেন।বড় ছেলের বাসায় থাকার মেয়াদ শেষ হল।তিনি ভাবলেন ছোট ছেলের বাসায় আর একদিন পরে।যাবেন।তাই চুপ চাপ শুয়ে রইলেন।কিন্তু বউ মানলে তো,ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,
বাবা আজ না আপনার আবিরের বাসায় যাওয়ার কথা।
হ্যাঁ বউ মা।
তাহলে শুয়ে আছেন কেন?
বউ মা ভাবছি আর একদিন পর যাব।
আর একদিন পর কেন,এক্ষণি যান।
এইসব কড়া কথা বলতে বলতে বউ শ্বশুরে সুইটকেচটা ধপাস করে বাসা থেকে ফেলে দিল।তারপর বলে,
তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বেরিয়ে যান। এই আমি দরজায় খিল দিলাম।
সত্যি বউ দরজায় খিল দিয়ে দিল।
শ্বশুর নিরুপায় হয়ে ভাঙা সুইটকেচটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।সময় মতো ছোট ছেলে আবিরের বাসায় উঠল।কিন্তু একি!বাসায় তালা ঝুলছে।দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতে বলল,
সাহেব ম্যাডামকে নিয়ে মালেশিয়াতে হ্যানিমনে গেছে।দুসপ্তাহ পর ফিরবে।
ছেলে জানে আজ তার বাবা আসবে তবুও বউকে নিয়ে হ্যানিমনে গেছে।
এবার রফিকুজ্জান যাবে কোথায়। দু:খে ক্ষোভে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন।যাবেন আর কোথায়,একমাত্র মেয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য ভাঙা সুটকেচটা হাতে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন।কিছু দূর গাড়ি রানিংর পর কর্তৃপক্ষ বলল,
সবার টিকিট হাতে নেন।সবাই টিকিট হাতে নিলো।কিন্তু রফিকুজ্জামানের হাতে কোন টিকেট নেই।গাড়ি কর্তৃপক্ষ গলিতে হেটে হেটে টিকিট চেক করছেন।রফিকুজ্জামানের কাছে আসতে বলল,
এই যে মুরব্বী আপনার টিকেট কোথায়?
আমার টিকেট নেই।
টাকা দিয়ে টিকেট করিয়ে নিন।
আমার হাতে টাকা ও নেই।
তাহলে গাড়িতে উঠেছেন কেন?নেমে যান বলছি।
গাড়ি কর্তৃপক্ষ কি আর থেমে থাকেন।ইচ্ছেমতো ভাষা ব্যবহার করল।এমন সময় একটা মেয়ে বলল,
এই উনাকে আর কিছু বলবেন না।উনার ভাড়া আমি দিচ্ছি।
মেয়েটি আর দেরী করলো না।ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিল।তারপর রফিকুজ্জামানকে জিজ্ঞেস করল,
চাচা আপনার কেউ নেই?
আছে মা আছে।তুমি কি আমার কথা শুনবে?
জ্বি চাচা শুনব,আপনি বলেন।
আমি হাই স্কুলের একজন বি এস সি মাস্টার ছিলাম।
সত্যি চাচা?
হ্যাঁ মা।
তাহলে আপনার এ করুণ অবস্থা হল কি করে?
সে এক লম্বা কাহিনী। আমার দু”ছেলে এক মেয়ে।বড় ছেলে ব্যাংক অফিসার,ছোট ছেলে অডিট অফিসার।
তবু আপনি গাড়ি ভাড়া দিতে পারেন নি।
হ্যাঁ মা পারিনি।কারণ এর জন্য দায়ী আমি।
কেন চাচা?
আমি ভিটেবাড়ি বিক্রি করে দু’ছেলেকে দিয়েছিলাম।মেয়েকেকে এক কানা কড়ি ও দিনি।এখন ছেলের বউ বোঝা মনে করে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
আপনার ছেলেরা কিছু বলেনি।
না মা তারাও বউদের সুরে কথা বলে।
রফিকুজ্জামান প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল ঘটনা মেয়েটির কাছে প্রকাশ করল।সব কথা শোনার পর মেয়েটি বলল,
চাচা এখন কোথায় যাবেন?
মেয়ের বাসায় যাব।
মেয়ে আপনাকে গ্রহণ করবেতো?
মেয়ের হাতে পায়ে ধরে মাফ চাইব।
মেয়ে জানে আপনি যে তার বাসায় যাচ্ছেন?
না জানেনা।
ফোন নাম্বার দেন আলাপ করিয়েদি।
রফিকুজ্জামান ফোন নাম্বার দিলেন।মেয়েটি তার ফোন থেকে কল দিলো,
পাপিয়া সুলতানা রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলল,
কে বলছেন?
আমাকে ছিনবেন না।তবে আপনার একটা সুসংবাদ আছে।
বলুন কি সুসংবাদ?
আপনার বাবা আসছে।গাড়ি ষ্টেশনের দিকে আসুন।
পাপিয়া সুলতানা আর দেরী করল না।স্বামী ছেলে মেয়ে সবাইকে নিয়ে ষ্টেশনে ছুটে আসল।বাবা গাড়ি থেকে নামতেই মেয়ে পায়ে ধরে সালাম করে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরিয়ে কেঁদে উঠে বলে,
বাবা তুমি অনেক শুকিয়ে গেছ।তোমাকে আর যেতে দেব না।তুমি আমার কাছে থাকবে।
থাকবরে মা থাকব।
এ দৃশ্য দেখে মেয়েটি বলে,
বা:কি চমৎকার দৃশ্য,মেয়েকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার পরও বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আর গভীর ভালোবাসা।এ হলো সত্যিকার ভালোবাসা।
বাবা মেয়ে মিট হলো।বাবাকে মেয়ে রেখে দিলো।