উপলব্ধি
দিল আফরোজ রিমা
পর্ব – ১
“তোমারেই যেন ভালো বাসিয়াছি আমি শতরূপে শতবার,
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার,
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার
কতরূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।”
ঘুমের মধ্যেই কবিতার কথাগুলো নির্ঝরের কর্ণগোচর হয়। সে ডেকে ওঠে-“নীলাঞ্জনা —
ছোট্ট হাতটি বাবার কপালে বুলিয়ে দেয় রিমঝিম, বলে-কি হয়েছে বাবা এইতো আমি তোমার পাশে বসে আছি। আমি কবিতা পড়ছিলাম। মাকে ডাকছ কেন ?
নির্ঝর আবার চুপচাপ শুয়ে পড়ে। সে মনে মনে বলে- নীলাঞ্জনা শুনেছ ? তোমার মেয়ে তোমার পছন্দের কবিতাটি ঠিক তোমার মতো করেই আমাকে আবৃত্তি করে শোনায়। জানতো নীলাঞ্জনা, রিমিঝিম ছাড়া আমার আর কেউ নেই।
কলকাতা রাজার হাটে টাটা মেডিকেল সেন্টার ক্যন্সার হাসপাতালের একটি কেবিনে শুয়ে মৃত্যুর জন্য দিন গুনছে। তার ব্লাড ক্যন্সার । অনেক দিন আগেই একটি কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে এবং সেটা অপারেট করা হয়েছে। তাছাড়া উচ্চ রক্তচাপ হাই সুগার। ডাক্তার বলে দিয়েছে সময় বেশি নেই।
বাংলাদেশে অনেক দিন চিকিৎসারত ছিল। চিকিৎসা করাতে কলকাতা যেতে চায়নি নির্ঝর। কিন্তু ছোট্ট মেয়েটার আকূল আবদার আর ওর চোখের পানি উপেক্ষা করতে না পেরে তাকে আবার যেতে হলো তার স্মৃতিময় সেই কলকাতায়। কলকাতায় আছে অনেক সৃতি নেই নীলাঞ্জনা। আছে বহু লোকজন, নেই কোন আপন মানুষ। নেই কোন বন্ধু।
দু’ মাস হলো নির্ঝর টাটা মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি আছে।
কলকাতায় তার একজন দূর সম্পর্কের আত্মীয় আছে। সেই নির্ঝরকে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করছে।
অনেক নিষেধ করার পরও রিমিঝিম বাবার সাথে কলকাতায় এসেছে। ছোট্ট একটি মেয়ে ওকে কে দেখবে তাই নির্ঝরের মা হালিমা বেগম অতো অসুস্থ বাবার সাথে কলকাতায় যাওয়াটা ভালো মনে করেনি। কিন্তু কারো বাঁধা ওকে বাবার কাছ থেকে মুহুর্তের জন্যও সরাতে পারেনি। ছোট্ট রিমঝিমই সারাক্ষণ অসুস্থ বাবার পাশে। হঠাত অনেক খারাপ অবস্থা হলে আই সিউতে নিয়া যাওয়া হয়। তখন রিমঝিম একা বসে শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, বাবার প্রাণ ভিক্ষে চায়। নির্ঝর খুব বেশি অসুস্থ হলেও তার স্মৃতিশক্তি ঠিক আছে। মনের দিক থেকে সে ভারাক্রান্ত হলেও ভারসান্য হারায়নি। সে সব বুঝতে পারে। তাই সে চিন্তা করে রিমঝিমের জন্য। মেয়েটার মা নেই, বাবাও থাকবে না। তাছাড়া নির্ঝরের কোন আত্মীয় -স্বজনও নেই যে রিমঝিমের ভবিষ্যতের অভিভাবক হবে।
দু’বছরের মেয়েটাকে রেখে নীলাঞ্জনা চলে গেল। তখন থেকেই রিমঝিম বাবার কাছেই মানুষ। বাবার বড়ই কোল ঘেঁষা মেয়েটা।
অসুস্থ নির্ঝরের মনে পড়ে গত হয়ে যাওয়া জীবনের কথা।
নির্ঝরের গ্রামের বাড়ি বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে। ঢাকায় তার নিজস্ব বাস ভবনেই বহুদিনের বাস। নির্ঝর ঢাকা কলেজ থেকে এইচ এসসি পাশ করার পর কলকাতায় চলে যায়। কলকাতার সল্ট লেক সিটির ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। নির্ঝর আর নীলাঞ্জনা একই ক্লাসে লেখাপড়া করত। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নির্ঝরের সাথে নীলাঞ্জনার পরিচয় হয়। নীলাঞ্জনা ছিল সভ্য ভদ্র খুব সাধারন একটি সুন্দর মনের মেয়ে। দেখতে লম্বা, ফর্সা, হালকা পাতলা গড়নের একটি সুন্দরী মেয়ে। মুসলমান, হিন্দু , খ্রিস্টান নানা ধর্মের নানা দেশের ছাত্র-ছাত্রী ওখানে পড়াশোনা করত। নীলাঞ্জনাও ছিল নির্ঝরের মত মুসলমান। কলকাতারই মেয়ে। সে পর্দায় চলতে পছন্দ করত। নির্ঝরও তেমনটিই পছন্দ করত।
ক্রমেই ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। নির্ঝর ও নিলাঞ্জনা দু’জনই মেধাবী ছাত্র ছিল। ওদের দু’জনের আলোচনা বিষয় বস্তু ছিল পড়াশোনা। এভাবে সময়ের গতির সঙ্গে ওদের বন্ধুত্ব আরো নিবিড় হয়ে উঠে।
নির্ঝর দেখতে বেশ মানামসই। ভালো ছেলে বলে ইউনিভার্সিটিতে তার একটা সুনাম ছিল। নির্ঝর নিলাঞ্জনাকে খুব পছন্দ করত। নীলাঞ্জনার বিণয়ী আচরণ, বলিষ্ঠ সততা, নির্মল মিষ্টি হাসি, পরিচ্ছন্ন স্বভাব নির্ঝরকে আকৃষ্ট করেছিল। নীলাঞ্জনাও তেমনি কারনে নির্ঝরকে পছন্দ করত। ওরা দু’জনে অনেক দিন গল্প করেছে তবে শুধু দু’জনে একা বসে নয়। সবাই মিলে। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গিয়েছে নিন্তু একা নয় অনেকের সাথে। কখনো সম্পর্কের সীমা অতিক্রম করে কিছু করেনি। বিরলা ট্যামপেল, ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল হল, হাউড়া ব্রিজ, পার্কস্ট্রিট, জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি, সায়েন্স সিটি, ফোর্ট উইলিয়াম, রবীন্দ্র ভারতী ইউনিভার্সিটি মিউজিয়াম, ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম, রবিন্দ্র সরোবর ইত্যাদি জায়গাগুলোতে ওরা ঘুরেছে। তথ্য সংগ্রহ করেছে। বিভিন্ন জায়গার ছবি তুলেছে।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা নির্ঝর, দারুণ একাকিত্ব অসহায় হৃদয়ের ব্যকূল নিঃশ্বব্দ বিলাপ নিয়ে স্মৃতির অতলে ডুবে যায় বার বার। আজ বহুদিন পরে সে যেন নীলাঞ্জনার জীবনের সুখ শান্তি, কষ্ট, ব্যাথা বেদনাকে তিল তিল করে উপলব্ধি করতে বসেছে। নিলাঞ্জনা ছিল তার হৃদয়ের মানষ প্রতিমা। হয়তো কোন দামি হীরা জহরত বা তার চেয়েও দামি কিছু। কিংবা তার দাম কখনো হিসেব কারাই যাবেনা। কিন্তু নির্ঝর কি পেরেছিল সেই দামি জিনিষের পূর্ণ দাম দিতে। নাকি তার অপব্যবহার করেছিল। নির্ঝর রুগ্ন দেহে মৃত্যুর হাতছানি উপেক্ষা করে সেই হিসেব করছিল বারবার।
চলবে–।