দানব
– এটিএম ফারুক আহমেদ
তারিখ: ০৫.১২.২২ইং
দেও, দানব, দৈত্য, জ্বিন, পরি, ভূত পেতনীর কথা শুনেছি অনেক – বিশ্বাস করিনি কখনো। আর এ-ই অশরীরী ভীতি, ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ভয়ে জড়সড় হয়ে ভরদুপুরে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি, জানালা একটাও খোলা রাখিনি, যদি ওরা এসে ঢুকে পড়ে! জোরে শোঁ শোঁ বাতাস এলে, গাছগাছালি উল্টে বাতাস বইলে, ঘনকৃষ্ণ মেঘে আকাশ ভেঙে আঁধার নামলে, বিষম ঝড়ো হাওয়া, তুফান এলে এমনি করতাম। ভরদুপুর, গোধূলি বেলায়, মধ্যরাতে যদি গাছতলায়, বাঁশ তলায়, ঝোপের আড়ালে একলা দোকলা পেলে ওরা আছর করে, চেপে ধরে! যদি পানির তলদেশে চুবিয়ে ধরে, ঘাড় মটকিয়ে মেরে ফেলে! ঘরের ভেতর ঢুকে যদি আছাড় মারে! কাঁথা চেপে, বালিশ চেপে মেরেই ফেলে? তাই সব বন্ধ করে আলো নিভিয়ে, আলো জ্বেলে কতো কান্ড করেছি, তা কি আর বলতে! স্বপ্নে মাঝে মাঝে কল্পিত ভূতে ধরেছে, পরি খেলা করে গেছে কতো তার ইয়ত্তা নেই। তবে আস্ত জ্যান্ত এতটা দৈত্য একযোগে হামলে পড়ে রাতের আঁধারে ঘর হতে পাঁজা করে বাইরে নিয়ে যাবে এ-ই রকম আশংকা কখনো করিনি। আর সে-ইটি ঘটে গেলো এক রাতে! আশ্চর্য?
ক্লাস সেভেনে পড়ি। বাইসাইকেল চালানোর শখ হলো। মা কিনে দিবেন ওয়াদা করলেন। তুই বাবা সাইকেল চালানো শিখে নে। শখের হাতঘড়ি মা আগেই কিনে দিয়েছেন। এজন্য মাকে কষ্ট করতে হয়েছে জানি। মা গাছের সুপারি, নারকেল, নারকেল পাতা, খেজুরের রসের মওসুমের গাছ ছাটানো ডগা, মরিচ, কালাই, কলা বিক্রি করে ছেলের শখ পূরণ করেন। মায়ের ছেলে সুবোধ, মায়ের কথা শোনে, ক্লাসে প্রথম, দ্বিতীয় হয়। আর তা-ই মায়ের ভরসা।
এইবার আশা সাইকেল কিনবো। মায়ের কথামত ঘন্টা ঠিকা সাইকেল ভাড়া নিয়ে ছুটির দিনে, এমনকি ক্লাস শেষে গ্রীষ্মের খর রোদ তোয়াক্কা না করেই সাইকেল চালানো শিখতে থাকি। মাস পার হয়ে যায় শেখা আর হয়ে ওঠে না। শুধু শুধু পড়ে যাই, আবার উঠি, আবার শুরু। সাইকেল পড়ে চেইনে পা কেটে যায়, কতো কি? তবুও শিখে ফেলি। সাইকেল আমার চাই-ই। চরের খোলা মাঠে টাটকা রোদে সাইকেল শিখতে গিয়ে দাবদাহে, রোদে পুড়ে, ঘামে আমার জ্বর এসে যায়। লজিং বাড়ি হতে ছুটি নিয়ে নিজ বাড়ি ছুটি। মা গায়ে হাত দিয়ে অবস্থা বেগতিক দেখে শুইয়ে মাথায় পানি ঢালতে থাকেন। ও পাড়ার নরেন্দ্র মোহন ডাক্তারকে ডাকান। ছোট ভাই গিয়ে নরেন্দ্র বাবুকে নিয়ে আসেন। নরেন্দ্র বাবু মেশিন পত্র হাতে বগলে ঠেকিয়ে দেখে রায় দেন টাইফয়েড রোগ বাধিয়ে বসছেন বাবু। রোদে ছিলেন? হ রোদে সাইকেল চালানো শিখি চরে। মাকে বলবেন না। বললে আমাকে মারবে, বকুনি দিবে। আর আমিও ভালো হলে আপনার এই ঘটিবাটি সব পানিতে ফেলে দিয়ে আপনাকেও চুবিয়ে নেবো। হ্যাঁ.. মনে থাকে যেন! মা ভেতরের কক্ষ হতে আসতে শোনেন। রেগে আমাকে বললেন- কী.. তুই ওনার ঘটিবাটি পানিতে ফেলবি, ওনাকে চুবাইবি, এ-ই তুই কি কইলি! আশ্চর্য? এই নি তুই ভালো ছেলে! চরে দুপুরের গনগনে রোদে গ্রীষ্মের দুপুরে সাইকেল চালানো শিখতে গেলি! তোর মামা তোর ক্লাসমেট তোকে কতো না করলো, তুই শুনলি না। ডাক্তার আমাকে ঘটনা বললে তুই ওঁর ঘটিবাটি পানিতে ফেলবি, ওঁকে পানিতে চুবাইবি! উনি হিন্দু হইছে তো কি হইছে? কয়েক গেরাম মিলে একজন হিন্দু ডাক্তার, সবার ভরসা তিনি। সাহস থাকলে টু শব্দ করে দেখিস- তোর বারোটা যদি না বাজাই। মা তেড়ে এসে থাপ্পড় দেবেন, ডাক্তার বাবু ফিরালেন। মা বললেন ছাড়েন- ওরে কটা লাগাই। একবার পেয়ারী মোহন বাবু একজন ভালো ডাক্তার ওপার চলে গেলেন। কেন গেলেন জানি না। নিশ্চয়ই কেহ এমন ভয় দিছিল ঠিকই। নইলে তিনি না বলে রোগী রেখে ভারতে লুকালেন কেন! বহু বছর পরে একবার এসে তো পেয়ারী বাবু ওর বাবারে সব দুঃখের কথা বলে গ্যাছেন- কেন তিনি নিজ গাঁ ছাড়লেন? পেয়ারী মোহন বড়ো ভালো মানুষ ছিলেন, বড়ো ভালো ডাক্তার ছিলেন। আমাদের ফ্যামিলির সঙ্গে তাঁর খুব সখ্যতাও ছিল। হায়রে দেশ বিভক্তি! তুই আপনকে পর করলি? হিন্দুরা হিন্দুস্তানে, মুসলিমরা পাকিস্তানে! নিজের জন্মভূমি, পরিচিত পরিবেশ, নদী জল ফসলের মাঠ, খেয়াঘাট, স্কুল, মাঠ, বাজারঘাট, পাহাড়ি শ্যামলিমা ছেড়ে যাবো? অচেনা অজানা পরিবেশে? এ যে শ্মশানে যাওয়া, কবর দেশের আঁধারের গহীনে যাওয়া! ওয়াক থু.! দ্বিজাতিতত্ত্ব, মরার ওপর খাঁড়ার ঘা, বাংলা, বাঙালির জন্যে। একবার বঙ্গভঙ্গ, আবার জোড়া লাগানো, আবার আজব থিউরি! ‘৪৭ এর ১৪ আগষ্ট সকালে ভঙ্গুর বাংলা পূর্ব পাকিস্তান! পূরব বাংলা? সিরাজ, তুমি বৃথাই কেঁদেছ, তুমিও পারনি, পাকিস্তানও ডুবিয়েছে। অমন কাজ ভেতরে কে করেছে? তাঁকে, তাদেরকে বাঙালি চেনে। থাক সেসব কথা। আমাদের ভূতের গল্পই সীমারেখা, ওর বাইরে ইতিহাস ঘেঁটে কাজ নেই, ঐতিহাসিকরা তা বুঝুক! অগ্নিশালা আগুনে পুড়ে মারে! ভারত বিভক্তির সময় অনেকে অপশন দিয়ে, কয়ে না কয়ে দেশান্তর হয়েছেন। কেহ পাকিস্তানে, আবার কেহবা হিন্দুস্তানে গেলেন স্বজন ছেড়ে। সেই টানেও পরবর্তী সময়ে সুযোগে সুযোগে অনেকে দেশ ত্যাগ করে যোগ বিয়োগ করেছেন। এ যাওয়া আসার কাজগুলো রাতে, অজ্ঞাতে হয়েছে। সীমান্ত কি করলো? সেটি সীমান্ত জানে। রাতে হয়তো সীমান্তও তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ফাঁকিতে ফাঁকি, গোপনে গোপন!
সংযোগ, সম্পর্ক- মিলন, লোভ লালসা, কর্মের সন্ধান, জীবনে বাঁচার তাগিদ কতো কি জীবনের পথে দাঁড়ায়! তখন মানুষ- প্রাণী একদেশ হতে অন্যদেশে, একবন হতে অন্য বনে যায়, ঢুকে পড়ে। আর বিপত্তিতে পড়ে, উপায়ও খুঁজে নেয়। ইতালি যাবে, গ্রীসে যাবে, ইউরোপে, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা যাবে? কতো মত, কত পথ খোঁজে! ভূমধ্যসাগর নৌকায়, বোটে পাড়ি দিতে গিয়ে কতো জীবন না-ই হয়ে গেলো। বঙ্গোপসাগরও ক্ষমা করেনি। এমনি চলে অনাদি যাত্রা! অশরীরী দানব, শরীরি দানবে রূপ নিয়ে মানুষকে পণ্য করে জীবনে মারে! আহ্ জীবন!
– চলবে
১ Comment
very good job; congratulations