১৬২ বার পড়া হয়েছে
যখন–তমসা ঘনায়, গাঢ় তমিস্র ঢেকে দেয় দীপ-দীপ্তি…
লুৎফর রহমান রিটন
আমার কোনো সম্পদ নেই ভালোবাসা ছাড়া।
ভালোবাসার শক্তি অনেক।
এক জীবনে এতো এতো মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি আমি যে নিজেকে রীতিমতো বিপুল সম্পদশালী বলে মনে হয়।
মানুষের ভালোবাসার বিত্ত বৈভবের প্রাবল্যে জীবন আমার ঐশ্বর্যমন্ডিত।
অতিসম্প্রতি শিকাগোর কাছাকাছি আকাশে আমার কয়েক মিনিটের ব্ল্যাক আউট হয়ে যাওয়ার ঘটনায় বন্ধুরা যে রকম উদ্বিগ্ন হয়েছেন, যে পরিমান প্রার্থণা ও শুভ কামনা আমার ওপর বর্ষণ করেছেন তাতে আমি অভিভূত। আপনাদের পরামর্শ আমার মনে থাকবে বন্ধুরা। শার্লি আমার জ্যাকেটের পকেটে, প্যান্টের সাইড পকেটে, গাড়িতে সর্বত্র ক্যান্ডির যোগান রেখেছে।
ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসাই ফিরিয়ে দিতে হয়। এই পোস্টটা ভালোবাসা ফিরিয়ে দেয়ার নিমিত্তে। ভেবেছিলাম প্রত্যেকের নাম উল্লেখ করে আমি কৃতজ্ঞতা জানাবো। কিন্তু মন্তব্যগুলো পড়তে গিয়ে পড়ে গেছি মহা সংকটে! এতো হাজার হাজার মানুষের নাম লিখতে হলে তো আমার পুরো একটা দিনই লাগবে!
আমায় ক্ষমা করবেন বন্ধুরা। এই লেখাটা লিখবার সময় আপনাদের প্রত্যকের নাম আমার হৃদয় মন্দিরে ঘন্টা ধ্বনির মতো বেজে যাচ্ছে।
এয়ার হোস্টেসদের কাছ থেকে এবং এক ডক্টর যাত্রীর কাছ থেকে আমি জেনে গিয়েছিলাম যে সুগার ফল করেছিলো আমার। আমি আক্রান্ত হয়েছিলাম হাইপোগ্ল্যাসিমিয়ায়। সংক্ষেপে যাকে বলা হয়ে থাকে হাইপো। হাইপোর মাত্রাটা বেশি হলে পেসেন্ট ব্ল্যাক আউটের শিকার হয়। এবং হাইপো হলে সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি জাতীয় কিছু যেমন ক্যান্ডি বা চিনি বা অরেঞ্জ জুস খেতে হয় দ্রুত। তাতে আক্রান্ত মানুষটা কামব্যাক করে। নইলে খুব বড় রকমের দুর্ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। কিছু ব্ল্যাক আউট শরীরে বড় ধরণের ছোবল মারে। তাতে হার্ট কিংবা কিডনি এমনকি ব্রেইনও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ক্ষতিটা কখনো কখনো স্থায়ী মাত্রার।
ব্ল্যাক আউট সংক্রান্ত লেখাটা পড়ে কানাডায় গভীর রাতে ঢাকা থেকে প্রখ্যাত সাংবাদিক আবেদ খান ফোন করে তাঁর উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার কথা জানিয়ে সতর্ক করতে চেয়েছেন আমাকে। বলেছেন–এরকম ব্ল্যাক আউট কিন্তু অনেক সময় বেশ কিছু ডেমেজ করে দিয়ে যায় বডিকে। যেমন হার্টকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কিডনির ক্ষতি করে। ডেমেজ করে ব্রেনকেও। স্মৃতিশক্তিও লোপ পেতে পারে।
আমি ঠাট্টাচ্ছলে বললাম, আমার স্মৃতি ঠিক আছে। আমি তোমাকে ঠিক ঠাক চিনতে পারছি। তুমি বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক আবেদ খান।
তিনি রেগে যাবার চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। শেষে কঠিন স্বরে বলেছেন–হারামজাদা তোর ডাক্তারের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলে হার্ট কিডনি আর ব্রেইনের টেস্ট করা দ্রুত।
আমার পোস্টে অনেকের মন্তব্যেও আবেদ খানের এই উৎকণ্ঠা আর সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়েছে। এই যেমন শহিদ ভাই, (সাবেক মন্ত্রী) শেখ শহীদুল ইসলাম লিখেছেন–
Be careful in future. Hypoglycemia is dangerous.
আমার লেখাটির নিচে মন্তব্যের ঘর উপচে পড়চে পড়ছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ভালোবাসা মমতা আর শুভ কামনায়।
বিটিভির বিখ্যাত নাট্যকার কাজী মাহমুদুর রহমান লিখেছেন–এই হঠাৎ করে অন্ধকারে চলে যাওয়া, চোখ মনিশূন্য হয়ে যাওয়া, জাগতিক সব শব্দ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মৃত্যুর প্রথম সংকেত বা ঘন্টা ধ্বনি। আল্লাহ কে ধন্যবাদ যে তিনি আবার আপনাকে পৃথিবী দেখার সুযোগ দিয়েছেন।
নাসিমা আখতার লিখেছেন–হাইপো থেকে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হয়। বারবার হাইপো হলে স্মরণশক্তিও লোপ পায়। এটা আমার কথা না ডাক্তারের কথা। অতএব সাবধান।
এখানে মানে মন্তব্যের ঘরে চিকিৎসা পেশার সঙ্গে জড়িত আমার বন্ধুরা অর্থাৎ ডাক্তার বন্ধুরা তাঁদের মূল্যবান টিপসও দিয়েছেন আন্তরিক ভালোবাসায়। এই তালিকায় আছেন সর্ব ডাক্তার–আরিফুর রহমান, আবদুন নূর তুষার, জাকির তালুকদার, শাহাব আহমেদ, হাসান আল জামী, নাফিস রহমান, সজল আশফাক, আবুল হাসনাত মিল্টন, রেজাউল করিম এবং রোমেন রায়হানও।
ডাক্তারদের কয়েকটা মন্তব্যের দিকে একটু চোখ ফেরানো যাক। (আমি চাই এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে আমার প্রিয় বন্ধুরা বিপদ কাটিয়ে উঠবেন দ্রুত, ডাক্তারদের পরামর্শগুলো মেনে।)
ডাক্তার নাফীস রহমান লিখেছেন–
ভাইরে, মানসিকভাবে বয়সটা হয়তো বেশী বাড়েনি, কিন্তু শরীরটার বয়স যে বেড়েছে, এটা মেনে নিন। ওটা তো একটা মেশিন। ওটার একটা এক্সপায়ারি ডেট আছে। ওটা আংশিক বা সম্পুর্নভাবে বিকল হতে পারে। স্পেয়ার পার্টস লাগতে পারে। নিয়মিত ফুয়েলের বাইরেও সাপ্লিমেন্টারী ফুয়েলটুয়েলও লাগতে পারে। কখনও চোখে অন্ধকার, কখনও সর্ষে ফুল, কখনও বা অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে সাদা আলোর কিরণ দেখার ঘটনাও ঘটতে পারে। এগুলি মেনে নিয়েই মেশিনটাকে আবার সচল রাখতে হবে। কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসলে তা সাদরে গ্রহণ করুন, সমস্যা তো নেই! মেশিন সচল রাখাটাই মূল বিষয়।
সুস্থ্য শরীরে ও সুস্থ্য মনে দীর্ঘজীবি হোন। ছড়ায় ছড়ায় আলো ও আনন্দ বিকিরণ চলতে থাকুক!
ডাক্তার আসিফ (এএমএ টিটো রহমান) লিখেছেন–ইমিডিয়েটলি কোনো ফিজিশিয়ানের কাছে যান প্লিজ, এটাকে অবহেলা করা ঠিক হবে না।
প্রীতিভাজন ডাক্তার আবদুন নূর তুষার লিখেছে–Please ভাই। consult a physician.
ডাক্তার আরিফুর রহমান লিখেছেন–
কোন একটা ওষুধ আপনার হাইপো ঘটিয়েছে। কাইন্ডলি ওষুধগুলির নাম আমাকে জানান ইনবক্সে।
কিন্তু আমি জানাইনি আরিফ ভাইকে।
আমার বন্ধু ডাক্তার আরিফ একজন বহুতই বুজুর্গ আদমি।
তাঁকে অনেকেই স্মরণে আনতে পারবেন। আমার বন্ধুদের স্মৃতিতে একটু টোকা মারি।
সত্তুরের দশকে দৈনিক বাংলা ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং পাঠকপ্রিয় পত্রিকা। আরিফ ভাই তখন দৈনিক বাংলার ঢাকা মেডিকেল কলেজের রিপোর্টার। দৈনিক বাংলার ফ্রন্ট পেজে মেডিকেল ছাত্র আরিফুর রহমান খলিলুল্লাহ্ নামের ভয়ংকর এক ব্যক্তির ওপর দুর্ধর্ষ একটা প্রতিবেদন রচনা করেছিলেন, যে খলিলুল্লাহ গোপনে কবর থেকে তুলে লাশের কলিজা ভক্ষণ করতো! মনে পড়ে?
প্রতিবেদনের সঙ্গে লাশের কলিজা ভক্ষণরত খলিলুল্লাহ্র ছবিও ছাপা হয়েছিলো। নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী তখন সম্পাদক। শুনেছি, সেইদিন দৈনিক বাংলার সাত সাতটি মুদ্রণ হয়েছিলো সারাদিনে।
সারা দেশের মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন দৈনিক বাংলার ফ্রন্ট পেজের সেই অবিশ্বাস্য সংবাদের ওপর।
আরিফ ভাইয়ের দ্বিতীয় কীর্তিটা বলি। বিটিভির শাদাকালো যুগে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সপ্তবর্ণা অনুষ্ঠানের দর্শকরা তাঁকে চিনতে পারবেন। তিনি সেই অনুষ্ঠানের প্রতি পর্বে একটা করে হাস্যরসের টোটকা পরিবেশন করতেন স্মার্ট ভঙ্গিতে। আমরা দর্শকরা খুব উপভোগ করতাম তাঁর মজাদার হাস্যরস।
কী? মনে করতে পারছেন?
পরবর্তীতে দীর্ঘদিন এই কীর্তিমান ডাক্তার আরিফ সৌদি আরবে ছিলেন চাকরিসূত্রে। সৌদি রাজ পরিবারের চিকিৎসক হিশেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে। বর্তমানে বাংলাদেশের একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর চিকিৎসাপরামর্শক বা চিকিৎসক তিনি।
ডাক্তার আরিফ আমার ব্ল্যাক আউটের পোস্টটি পড়ে মন্তব্যের ঘরে আমার অষুধগুলোর তালিকা চেয়েছিলেন। কিন্তু আলস্য বশত আমি দিইনি। তাই পরদিন ডাক্তার আরিফ নিজেই আমাকে ফোন করেছেন ঢাকা থেকে।
তারপর পাক্কা এক ঘন্টা পঞ্চান্ন মিনিট ধরে আমাকে ইন্টারভিউ করলেন। অষুধের ফিরিস্তি শুনলেন। তারপর একগাদা পরামর্শ ও সুস্থ ভাবে বাঁচার কায়দা কানুন বাতলে দিলেন পরম মমতা আর ধৈর্যের সঙ্গে। (ফেসবুকে আমার গদ্য কিংবা পদ্যের একজন কঠিন পাঠক এবং শর্তহীন সাপোর্টার আরিফ ভাই। আমার লেখালেখিটা যেনো সহসা থেমে না যায় সে চিন্তাতেই অস্থির তিনি বিনা ফিতে দুই ঘন্টা ধরে চিকিৎসা সহায়তা করলেন আমাকে। কৃতজ্ঞতা স্যার। কৃতজ্ঞতা বন্ধু।)
০২
উৎকণ্ঠা আর মমতায় সিক্ত আরো কয়েকটা মন্তব্য আমি অনেক যত্নে তুলে রাখতে চাই আজকের রচনায়।
জনপ্রিয় কথাশিল্পী প্রীতিভাজন আনিসুল হক লিখেছে–রিটন ভাই…এমন বিচলিত লাগছে…
পশ্চিম বঙ্গ থেকে বিশিষ্ট কথাশিল্পী অমর মিত্র লিখেছেন–কী ভয়ানক। সাবধান হতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ শুনুন রিটন ভাই।।আপনি আমার ভাই। আপনি ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকব।
কথাশিল্পী আতা সরকার লিখেছেন– টেনশন তো হবেই রিটন। কেন জানি চোখে পানি এসে গিয়েছিল। আগে বুঝিনি, এতোটা ভালো লাগার মানুষ আপনি। ভালো থাকবেন।
আলোকচিত্র সাংবাদিক অনুজপ্রতিম বন্ধু খান মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম লিখেছে–দয়া করে এবার নিজেকে ভালবাসুন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় মেধাবী ব্যাংকার অগ্রজ বন্ধু শাহ সারওয়ার লিখেছেন–ওস্তাদ কানের পাশ দিয়া গেছে। মানুষের দোয়া আছে আপনার ওপর। ভালো থাকবেন। পকেটে সব সময় চকোলেট রাখবেন। বাঁইচা থাকনের দরকার আছে।
শেলী শামস লিখেছেন–বেলা শেষে রোদ ফিকে হয়ে আসছে যে, তাই সাবধানে থাকবেন।
অতি সম্প্রতি অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপক অঞ্জন নন্দী লিখেছেন–
নো চিন্তা বন্ধু, মহসিন কলেজ নিয়ে না লেখা পর্যন্ত কেউ তোমাকে টাচ করতে পারবে না, শার্লি ছাড়া।
(–হাহ হাহ হাহ। খুব মজা পেয়েছি চট্টগ্রাম মহসিন কলেজের সাবেক প্রিন্সিপল আমার লেখক বন্ধু অঞ্জন নন্দীর এই মন্তব্যে।)
রেজাউল করিম লিখেছেন–শরীরের যত্ন নিবেন। আমাদের ১৮ কোটি মানুষের মাঝে ১৮ জন রিটন নেই কিন্ত।
ইনবক্সে আমার তরুণ ডাক্তার বন্ধু ছড়াকার জহিরুল ইসলাম নাদিম লিখেছেন–প্লিজ স্বাস্থ্য নিয়ে অসতর্ক হবেন না। আমাদের আর কোনো রিটন নেই……।
এরপর আমার চোখে জলের কণা ভিড় করলে কিছু কি আর করার থাকে!
থাকে না।
০৩
অনেকেই বলেন, হেন বিষয় নেই যা নিয়ে আমি ছড়া লিখিনি বা যা আমার ছড়ায় আসেনি। হাইপোগ্ল্যাসিমিয়া বা হাইপো নিয়ে কি কোনো ছড়া আছে আমার?
খোঁজ দ্য সার্চ করে একটা ছড়া অবশ্য পাওয়া গেলো যাতে হাইপোর স্বগর্ব উপস্থিতি বিদ্যমান। ছড়ার নাম ‘অতীনের ভাইপো’। ২০১১ সালের লেখা।
আমার ধন্যবাদ সূচক রসকষহীন এই গদ্যটি পড়তে পড়তে কাহিল আমার বন্ধুদের জন্যে ‘অতীনের ভাইপো’কে পাকড়াও বা পেশ করা হলো–
[ অতীনের ভাইপো
লুৎফর রহমান রিটন
চটপটে স্মার্টবয় অতীনের ভাইপো
বানানটা ভুল লিখে বলে–এটা টাইপো!
হাইপার টেনশন হলে বলে–হাইপো!
অতীনের ভাইপো।
তার কোনো জুড়ি আছে?
সুবিশাল ভুঁড়ি আছে
গজ ফিতে দিয়ে তুমি তার ভুঁড়ি মাইপো!
কাগজে সুযোগ পেলে তার কথা ছাইপো!
অতীনের ভাইপো।
২৬.১১.২০১১
সূত্রঃ এই বইটা তোমার, প্রচ্ছদ ও ছবি/ সুজন চৌধুরী। প্রকাশক/চন্দ্রাবতী একাডেমি। ]
০৪
অজস্র মানুষের ভালোবাসায় আপ্লুত ও প্রাণিত আমি।
অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা আপনাদের প্রতি।
শীতের দেশের উষ্ণ আলিঙ্গন গ্রহণ করুন।
জয় হোক ভালোবাসার।
[ পুনশ্চ > আগের পোস্টের মতোই আবারও বলছি, বন্ধুরা উদ্বিগ্ন হবেন না প্লিজ। আমি ঠিক আছি। কিচ্ছুটি হয়নি আমার। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে আমি এখন একদম সুস্থ ও স্বাভাবিক। ]
অটোয়া ২২ অক্টোবর ২০২২
[আলোকচিত্র/ অটোয়ায় সূর্যাস্তের সময় ফিকে হয়ে আসা আলোয় লুৎফর রহমান রিটন। ছবিঃ শার্লি রহমান।]
১ Comment
কবির জন্য শুভকামনা।