আমার অতিপ্রিয় এক ছড়াকবির নাম রফিকুল হক। পঞ্চাশের দশকে তার লেখালেখির সূচনা। দীর্ঘজীবন তিনি ছড়ার সঙ্গে যুক্ত।
তার রক্তে ছড়ার সুর প্রবহমান। তিনি ছড়ার ছন্দে কথা বলেন। তিনি ছড়ার মতোই জীবনযাপন করেন। রাজসিক এবং বর্ণাঢ্য তার জীবন।
লৌকিক ঐতিহ্যের সুরে রং মিশিয়ে তিনি আধুনিক ছড়া রূপায়িত করেন। মূল ধারার প্রকৃত ছড়াকবি তিনি। তিনি আজীবন সৎ ছড়া লিখেছেন। কখনো ভেজাল ছড়া লেখেননি। বিপুল বিস্তারিত তার ছড়ার পৃথিবী। অজস্র লিখেছেন। লিখেছেন বলা ঠিক হবে না। তিনি ছড়া বানিয়ে তোলেন। মায়ের হৃদয়ের আকুতি তার ছড়ার ছত্রে ছত্রে।
ভালোবাসার গন্ধ পাওয়া যায় রফিকুল হক দাদুভাইয়ের ছড়ায়। আশ্চর্য রকমের মৌলিক তার ছড়া। কখনো মনে হয় না যে এসব ছড়ার কোনো লেখক আছে। যেন শত শত বছর ধরে মায়েদের মুখে মুখে তৈরি হওয়া ছড়া। রফিকুল হক তাই প্রকৃত ছড়াকার। বাঘের ছাল পরিধান করে তিনি বাঘের দলে প্রবেশ করেন না। বাঘের মতোই তিনি ছড়ায় গর্জন করেন।
আমাদের কালে ছড়া নিয়ে সবচেয়ে বেশি উচ্চকণ্ঠ ছিলেন রফিকুল হক দাদুভাই। ছড়ার প্রতি তীব্র আসক্তি ও ভালোবাসায় সমগ্র জীবন তিনি কাটালেন। তার এক পোশাকি নাম ‘দাদুভাই’। ‘চাঁদের হাট’ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে তিনি আমাদের সবার প্রিয় দাদুভাই। তিনি শিশুসাহিত্যের পাতা সম্পাদনা সূত্রে অনেক লেখক তৈরি করেছেন। তার স্নেহ ছায়ায় লালিত পালিত হয়েছেন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন আজকের অনেক খ্যাতনামা লেখক। আমিও সেই মিছিলের শেষ সারির একজন সৈনিক।
দাদুভাইয়ের ব্যক্তিগত মধুর ব্যবহারে আমরা মুগ্ধ হতাম। তিনি নিরাভরণ, সহজ শিশুতোষ, আন্তরিক এক ব্যক্তি। রাশভারি গুরুগম্ভীর চেহারায় দাদুভাইকে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। দেশের সব শিশুকিশোর ছিল তার কাছে চাঁদমনি। চাঁদের হাটের বন্ধু। দাদুভাই খুব অমায়িক। কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পেয়েছেন তার শিষ্যদের প্রাপ্তির পর। তা নিয়ে তার কোনো খেদোক্তি শুনিনি। শিষ্যদের সাফল্যে তাকে আনন্দিত হতে দেখেছি। এমন সদগুণ সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব আমাদের সমাজে খুব কম আছে।
একসময় সারা দেশে ‘চাঁদের হাট’ সংগঠন খুব জোরদার ছিল। দাদুভাই সব চাঁদের হাটের শাখার কর্তা-ব্যক্তিদের নামে চিনতেন। অসম্ভব স্মৃতিধর তিনি। তার ভান্ডারে জমা থাকত অনেক গল্প। তিনি তার পূর্ববর্তী অগ্রজ লেখকদের কাছে প্রিয়পাত্র ছিলেন। অনুজ লেখকদের কাছে প্রেরণাদাতা হিসেবে অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছেন।
রফিকুল হক দাদুভাইয়ের নানামাত্রিক পরিচয়। তিনি প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে জড়িত। তিনি দৈনিক পত্রিকায় ছোটদের পাতার সম্পাদক হিসেবেও সুখ্যাত। ছোটদের একমাত্র কিশোর সাপ্তাহিক ‘কিশোর বাংলা’র তিনি দীর্ঘদিন সম্পাদক ছিলেন। তিনি ‘চাঁদের হাট’ শিশু সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক।
এতসব বড় বড় পরিচয়ের বাইরে তার আসল পরিচয় একজন নিবেদিত প্রাণ ছড়াকার হিসেবে। প্রায় ষাট বছর ধরে তিনি ছড়া লিখে চলেছেন। অন্নদাশঙ্কর রায় ছাড়া এত দীর্ঘকাল কোনো ছড়াকার ছড়াচর্চা অব্যাহত রাখেননি। দাদুভাইয়ের রক্তে ছড়ারা প্রলয় নৃত্য করে। তিনি ছড়াসর্বস্ব প্রাণ। তার তুলনা তিনি নিজেই।
দুই
ছড়ার আইকন বলে যদি কিছু বোঝায় তবে সেটা রফিকুল হক দাদুভাই। তিনি আমার আদর্শ ছড়াকবি। দূর শৈশবে দাদুভাইয়ের ছড়ার আনন্দ রস উপভোগ না করলে হয়তো আমরা ছড়াই লিখতাম না। আমাদের ছড়াপ্রেম তৈরির নেপথ্যে দাদুভাইয়ের সরব প্রভাব রয়েছে। দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করি যে, আমার ছড়া রচনার গুরু প্রকৃতপক্ষে রফিকুল হক দাদুভাই।
স্কুল জীবনে যখন ছড়া লেখা শুরু করি তখন আমাকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করে রফিকুল হকের ছড়া। তখনও তার কোনো ছড়াগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। পুরনো টাপুর টুপুর, কিশোর বাংলা, শিশু, সাত ভাই চম্পায় তার ছড়া পড়তাম। জাদুকরি, মোহনীয় শক্তি ছিল তার ছড়ায়। একটা ছড়া দু’তিনবার পাঠ করলেই কিছু পংক্তি চিরকালের জন্য স্মৃতিতে গেঁথে থাকত।
তার দুটি ছড়ার বই আশি দশকে প্রকাশিত হলো। অসাধারণ দুটি বই। একটির নাম ‘বর্গী এলো দেশে’। অন্যটি ‘পান্তাভাতে ঘি’। প্রথমটির ছবি এঁকেছেন হাশেম খান। ‘পান্তাভাতে ঘি’ এর প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেন রফিকুন নবী।দুটি বই আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে।
ছেলে ঘুমালো বুড়ো ঘুমালো
ভোলা দ্বীপের চরে
জেগে থাকা মানুষগুলো
মাতম শুধু করে।
ঘুমো বাছা ঘুমোরে
সাগর দিলো চুমোরে।
খিদে ফুরালো জ্বালা জুড়ালো
কান্না কেন ছিঃ
বাংলাদেশের মানুষ বুকে
পাথর বেঁধেছি।
৭০ এর গোর্কি ঝড়ের পর লেখা ছড়া। প্রসঙ্গত বলি, তখন এই ছড়া নিয়ে উপ-সম্পাদকীয় লেখা হয় দৈনিক অবজারভারে। আমাদের সমকালের প্রায় সবাই দাদুভাইয়ের দু’চারটে ছড়া মুখস্ত বলতে পারত। রাজার হাতিশালে ছিল হাতি আর ঘোড়াশালে ছিল ঘোড়া। কিংবা আজ বর্ষা ফের বর্ষা কিংবা রেলগাড়ির গান কিংবা গেল হাঁস পাতালে, যায়নিকো হাসপাতালে, গ্রামের নাম হিজুলি, ঝড়ের রাতে বিজুলি- এইসব পংক্তি এখনো কানে সুর হয়ে বেজে যায়।
দাদুভাই সহজ-সরল সৎ ছড়া লিখেছেন। লোকছড়ার সুর ও ছন্দে তিনি আধুনিককালের ভাবনাকে তুলে ধরেছেন। তার ছড়া চিরকালের সম্বন্ধযুক্ত।
চকিত চটুল যে উজ্জ্বলতা দাদুভাইয়ের ছড়া পড়লে সেটা উপলব্ধি করা যায়। দৈনিক পত্রিকায় প্রতিদিন ছড়া লেখার প্রচলন দাদুভাইয়ের হাত দিয়ে। সমকালীন বিষয় নিয়ে তিনি ফোঁড়ন কেটে এখনও ছড়া লিখে থাকেন। দাদুভাইয়ের এই তরুণ তাজা হৃদয়কে আমরা ঈর্ষা করি। তার ছড়ার সতেজতায় মুগ্ধ হই। তিনি কোনো উপাধি পাননি। ছড়াসম্রাট, ছড়ার জাদুকর এমন কোনো উজ্জ্বল বিশেষণে তিনি ভূষিত নন। কিন্তু আমরা জানি যে তিনিই প্রকৃত ছড়াকার। তিনিই ছড়া কেটে কেটে জীবনকে পূর্ণভাবে উপভোগ করেছেন।
তিন
আশি ঊর্ধ্ব একজন তরুণ বন্ধু আমাদের রফিকুল হক দাদুভাই। পঁচাশি ছুঁই ছুঁই তরুণ তিনি। এখনও নিয়মিত অফিস করেন। সুঠাম দেহের অধিকারি। ঢাকার বাইরে যে কোনো ছড়া উৎসবে তিনি সশরীরে উপস্থিত হন। এখনও হইচই আনন্দে তার দিন কাটে। কবি আসলাম সানী তার বন্ধু। আবার কবি আল মাহমুদও তার বন্ধু ছিলেন। ইমরান পরশ, মামুন সারওয়ারও তার তরুণ বন্ধু। এক আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব দাদুভাই। বয়স তার কাছে কোনো বাধা নয়। আশি ঊর্ধ্ব বয়সেও গোগ্রাসে পোলাও বিরানি খান। পারিবারিক শাসন তিনি মানতে চান না।
আজকাল শুনতে পাই, দাদুভাই প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন। কখনো কখনো হাসপাতালে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। শুনে মন খারাপ হয়ে যায়। সুঠামদেহী দাদুভাইয়ের কখনো শরীর খারাপ হতে পারে তা আমরা কখনো ভাবি না। সবসময় আমরা দাদুভাইয়ের সুস্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনা করি। বাংলা আধুনিক ছড়ার সাফল্যের সঙ্গে দাদুভাইয়ের নাম প্রথম পংক্তিতে যুক্ত হয়ে আছে। দাদুভাই, আপনাকে শত সহস্র শ্রদ্ধা ভালোবাসা।.
বরেণ্য ছড়াকার দাদু ভাই ভালো নেই…
বার্ধক্যজনিত কারণে গত দুই-তিন মাস থেকে তিনি চিকিৎসাধীন আছেন এবং সকল কাজ থেকে অবসর নিয়ে একদম বাসায় দিন কাটাচ্ছেন।
সকলের কাছে দোআ কামনা। দাদু ভাই আবারো আমাদের মাঝে ফিরে আসবে সুস্থ হয়ে, সেই প্রত্যাশায় ।