ফজলার বাপ
ফেলে আসা দিনগুলো স্মৃতির মনিকোঠায় আজ-ও ভাসে
মনে হয় ওরে যেন কতো কি,
কতো সোনাদানা রূপকথা রেখে এসেছি!
ওই গ্রামে আজ যেন নেই আজ কোন জনরব
সন্ধ্যার পরে নেই কোন কলরব
এখন আর সন্ধ্যা সাঁজে মজমা বসে কিরে গ্রামে বল ভাই বল–
আমি অভাগা দূর্ভাগা হয়ে দূরে এসে হয়েছি রসাতল
গ্রামের মুক্তো হাওয়া, মিষ্টি জলে নাওয়া হয় না আর মোর
খেলার সাথীরা সবে বুড়িয়ে গেছে, কেহ গেছে ওপারে চলে, সকলে হয়েছে পর!
আমিও ধূপ চন্দন সুগন্ধি মেখে বসে আছি সেজে
কখন ডাক এসে যায়… ভাই ওরে
তখন আর বলার সময় হবে না, নিশ্বাস যাবে পড়ে
আজরাইল এসে গেলে আর কি সময় দেয় রে?
আযাযিল শয়তান হতে দূরে থাকিস সজ্জন সবে
মরবার আগে বলে যাই সবে
যা-ই করিস গ্রাম স্বভূম ছাড়িস নারে
ওখানেই আছে সবসুখ, ঐখানেই শৈশব মেলে
ঐখানেই সকলে কোলাহল কলরবে সকলে ছিলাম মেতে
এখন স্রোতস্বিনী নদী মরে গেছে কবে কাঙাল হলো গ্রাম
পুরনো বটগাছ শ্মশান কবর, পুরনো সেই ঐতিহ্য আর পাবি না ওহে, ও- পবন
আমি নেই, তুই নেই, সেই লঙ্কা রাবণও নেই
সব যেন কেহ তুলে নিয়ে আগুনে পুড়ে ভস্ম করে করেছে ছাই।
এখন আমি যেতে চাই সোনার গাঁয়ে
একদিন গিয়ে দিনেও নিজ গ্রামে নিজেই পথ হারিয়ে যবে
একজনকে জিজ্ঞাসিলে সে কহে মোরে
মোর বাপের নাম ধরে তুই কি অমুকের ছেলে?
আমি বলি হ-রে তুই কি সৌহান না-রে
সে কয় হ, আমিতো সব খুইয়ে বুড়ো হয়েছি
তাই তুই বুঝি মোরে চিনিসনিরে শফি?
এই বলে আরো পঞ্চ কাহিনি জুড়ে সে মোরে সাথে করে বাড়ি পৌঁছে দিল
তালাবদ্ধ ঘর, খুলে দেখি ইঁদুর, তেলাপোকা সব সাবাড় করিয়া দিল!
বাতি নেই, মোমের আলো জ্বেলে রাতে জোনাকি খুঁজি দেখা পাইনি,
দোয়েল, কোয়েল গেলো কই রে…!
সৌহান হেসে বলে গ্রামের শ্রী আর না-ই রে
এখন শহর এসে এখানে ভিড় করে
তোর ঘরে বিদ্যুত লাগিয়ে বাড়ি ঘর দে আলোকিত করে
কাল চলিস সারা গ্রাম ঘুরিয়ে সকলের সাথে দেবো পরিচয় করে
তোর গ্রামে তুই পরবাসি চেনে না তোরে কেহ
আমি যে-ই হই, যে করেই খাই তবুও আছি গ্রামে পড়ে
গ্রামের মাধবী তলে কতো ফুল ফোটে কতো যায় ঝরে
সবাই মোরে ফজলার বাপ বলিলে চেনে
বুঝলি সোনা গ্রামের চিত্র গেছে টুটে
আমি অহন ফজলার বাপ সকলে চেনে
হেঃ, হেঃ হেঃ মোর নামও গ্যাছে মুছে!
কাঁদিসনে শফি, কাঁদিসনে সৌহান- এ-ই তো জগতের রীতি
তুই গ্যাছস, মুই গ্যাছি, তাতে ক্ষতি কি?
ফজলার বাপই মূল বাপ ফজলা তা জানে কি!
২৩.০৭.২২ইং
হেমন্ত রঙে
যে হেমন্ত মোরে গিয়েছে ফেলে দুয়ারে
কাঁদায়ে গিয়েছে শত জনমের তরে
আজ এ-ই হেমন্ত রাগে তারে বেশ মনে পড়ে
শিউলি ফুলের মালা গেঁথে নীরবে মাধবী তলে এসে সে হাত ধরে কয়
কবি হেথায় দাঁড়িয়ে কেন চলনা নদীর কিনারায়
সেখানে তীর ঘেঁষে চামর দোলায় কিশলয়
ধানের কচি ডগায় টলমলে শিশির, শাপলা শালুকের নাচানাচি, বকুল শিমূল দোল খায় যেথায়
তুমি আর আমিও দুলি চল কাশ বনে কুয়াশায়
যেথায় ধান শালিকেরা পাখা ঝাপটায়
দোয়েল, কোয়েল, মাছরাঙা শীষ দিয়ে যায়
আলতো আলতো আলতোভাবে ধানের শীষে দুধে ভরে গাছের ডগায়
ফুলকলি দোলে, দোলে মহুয়া বনে, গজারি শালের ছায়ায়
বসে হরষে বক পাখি ঘুমিয়ে যায়
নীরব নিস্তব্ধ প্রকৃতি হেমন্ত শিশিরে পুষ্ট হয়
কার্তিক অগ্রহায়ণে আমন ধানে গোলা ভরে কৃষক
সবুজের বুকে বন বনানীতে খুশির জোয়ার বহে ঝলকে ঝলক
শুকনো ডোবা নালার জল ফেলে শিশু কিশোর ছলাৎছলাৎ
মাছ ধরার মরসুম যেন চলে হেমন্তের শেষতক
আষাঢ় শ্রাবণ ভাদর আশ্বিন শেষে জলের টানে
প্রকৃতি হেমন্তরে করে এমনি মোলাকাত
শুকনো মাঠ, আধো নদীজল খালে মাছ ধরার ধূম পড়ে যায়
শিউলি,বকুল,গোলাপ,জুঁই, চামেলি, চাম্বল ফুটে রয়
বনফুল, ঘাসফুল, ঘাসের ডগায় শিশিরের সমারোহ, মৃদু বায়ু বয়
আর সকালের সোনারোদে মন্জুরি কয়
বর্ষা, শ্রাবণ হলে কদম্বের সমারোহ কেমন হোত
কেমন শিহরণ উঠিত বালিকা বঁধূর অধর যুগলে- ওগো
ভয়ে ভয়ে রাঙা ঠোঁট কাঁপিত কত
হেমন্ত প্রকৃতি কেবলই কি সোনালি আমন ধানে গোলা ভরে দেয় ওগো
নয় কি শিম, শসা, কালাই,বেগুন, নয় কি সেথায় পাট, মূলো, লাউ,
কুমড়ো নাম না আসা অসংখ্য কতো লতানো গাছে পাতানো ফল
কী অপরূপ এ-ই বাংলা কী অপরূপ সোনালি দিগন্ত হেথা
ওরে হেমন্ত! তোর মেঘযুক্ত, মেঘমুক্ত নীল আকাশ
এ দেশের মাঠঘাট প্রান্তরে, নদী খাল বিল জলে সমুদ্রে,
বাহনে দিনে রাতে কী মধুর শিহরণে জাগে-রে মন
ঐ হেমন্ত বল, শুধু তুই-ই বল
তোর সকল শোভা আঁকিতে পারিনি
তবুও তোরে আমি বুঝেছি বল, তোর মুখে বল!
২০.১০.২২ইং
এটিএম ফারুক আহমেদ (সাবেক পুলিশ সুপার)