শেষ বিকেলের গল্প
তসলিমা হাসান
নদীর তীরেই বাংলো।
রাতে নৌকা থেকে যখন নামি বুঝতে পারিনি। বিদ্যুৎ ছিল না। অফিসের দুজন কর্মচারী ঘাট পর্যন্ত এসেছিলেন । বাংলোয় পৌঁছে দিয়ে চলে যান। দেখভাল করার জন্য কেয়ারটেকারকে বার বার বলে গেলেন।
কেয়ারটেকার মোতালেব খুব বিনীত ছেলে। বয়স ১৩-১৪ হবে। যা বলি তা-ই শোনে। কাছাকাছি থাকে। বাবার চাকরি সে করে। বাবা অসুস্থ । গত তিন বছর ধরে সে ই দায়িত্ব পালন করে। তিনদিনব্যাপী আমার পরিদর্শনের কাজ আজ শেষ। বাক্সপেট্রা গোছানো শেষ। ফাইনাল রিপোর্ট দাঁড় করানোর জন্য কাটাছেঁড়া করছিলাম । কলম চালাচ্ছিলাম নিমগ্ন হয়ে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার ।
ডাকলাম, মোতালেব !
সন্তর্পণে দ্রুততার সাথে হাজির, জ্বী স্যার।
মোমবাতি নিয়ে এসো তাড়াতাড়ি।
যখনই মোতালেবকে ডাকি সঙ্গে সঙ্গে সে হাজির হয়। সে কি কাছেই থাকে ? দেখতে পাই না।
বাইরে চেয়ার নিয়ে বসলাম। বাংলো ঘেঁষে পুব পাশে নদী। সন্ধ্যার কোলে ভর করেছে রাত্রি। কিছু নৌকায় মালামাল ওঠা-নামা করছে । দুটি নৌকা ছেড়ে গেল। পানির ওপরে ছুটে চলা একখণ্ড আলোকপিণ্ড । নিরুদ্দেশ হল সেটিও।
সময় কত বেগে ধায়! তিনদিন শেষ হয় এত দ্রুত।
মোতালেব মোম নিয়ে এসেছে। কাজটি শেষ না করা পর্যন্ত স্বস্তি নেই।
লম্বা লম্বা বাক্যে গাণিতিক অংক বসিয়ে, কখনও ছক করে রিপোর্ট দাঁড় করছিলাম। একতলা বাংলোর এ বারান্দায় হঠাৎ মনে হল একটা ছায়ার মত কিছু একটা সরে গেল। কী তাহলে ?
মোতালেব ছাড়া তো কেউ নেই এখানে। দৃঢ় স্বরে উচ্চারণ করলাম, কে ?
দ্রুত হাজির হয়ে বলল, ‘ স্যার, আমি মোতালেব। কিছু লাগবে স্যার ?’
বললাম, না। তুমি বসো।’
লেখার মাঝে মাঝে মোতালেবের কথা শুনলাম। তার মা অসুস্থ বেশ। মাথা আউলা। কথার ঠিক নেই। মোতালেবের কাছে আমার কথা শোনার পর এ পর্যন্ত তিন চার বার আমাকে দেখতে চেয়েছেন। মোতালেব সাহস করে বলতে পারে নি। মোতালেব তার মায়ের প্রেসক্রিপশন, টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে এসেছে। ঢাকার কোন নার্ভ বিশেষজ্ঞের পরামর্শের জন্য । ঢাকায় ফিরে সহযোগিতা দিতে পারলে সে তার মাকে ভাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসবে।
রাত বারোটার পর দেখি চাঁদ উঠেছে। বারান্দায় চেয়ারখানা পেতে বসলাম। সামনে নদী। নদীর বুকে জ্যোৎস্নাস্নাত কার্তিকের কুয়াশা । জ্যোৎস্না গলে গলে পড়ছে নদীর বুকে। নদীর পানির সাথে জ্যোৎস্নার মাখামাখি। এক ধুম্র পৃথিবীর মায়াবী রহস্য। হঠাৎ মোতালেবের কথা মনে পড়ল । সকালবেলা ওর মায়ের সাথে দেখা করা দরকার। অতঃপর রওনা।
বাক্সপেট্রা গোছানোই ছিল। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে তাড়াতাড়ি রওনা করলাম নদীরঘাটে। মোতালেব পাশেই ছিল। লাগেজ টেনে নদীরঘাট পর্যন্ত এল। নৌকা ঠিক ছিল। ইঞ্জিন স্টার্ট দেবার আগে মোতালেবের হাতে গুজে দিলাম একটি নোট। দাঁড়িয়ে আছে মোতালেব। নিষ্পলকচোখে। সে চোখে রাজ্যের বিষন্নতা। বহু দূর অবধি মোতালেবকে মূর্তির মত দেখা গেল। এক সময় হারিয়ে গেল।
সহসা মনে পড়ল মোতালেবের মায়ের কথা। তাঁর সাথে দেখা করার কথা ছিল আমার ! প্রেসক্রিপশন আর টেস্টের কাগজও তোষকের নিচেই রয়ে গেল। এই কটা দিন যে মোতালেব ছায়ার মত পাশে ছিল, তার কথাটাই ভুলে গেলাম !
আমাদের ব্যস্ত জীবনে মোতালেবদের মত মানুষের মূল্য নেই। মূল্য শুধু কাজ করিয়ে নেয়ার।
মোতালেবরা মানুষ না। মানুষের ছায়া। ছায়ার মতই এরা পাশে থাকে। আর আমরা ভুলে যাই।
তসলিমা হাসান
কানাডা, ৩১-১০-২০২২