বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী মাহমুদুন্নবীর ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
১৯৩৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন
১৯৯০ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৯০ সালের আজকের এই দিনে না ফেরার দেশে চলে যান তিনি। মৃত্যুর এত বছর পরও গুণী এই শিল্পী অসংখ্য কালজয়ী গান দিয়ে এখনো দর্শকহৃদয়ে অমর হয়ে আছেন। তার উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে- ‘আমি সাত সাগর পাড়ি দিয়ে’, ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘তুমি যে আমার কবিতা’, ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’, ‘ও মেয়ের নাম দিব কি’, ‘এক অন্তবিহীন স্বপ্ন ছিল’, ‘আমি তো আজ ভুলে গেছি সবই’, ‘মনে তো পড়ে না কোনো দিন’, ‘সুরের ভুবনে আমি আজও পথচারী’, ‘বড় একা একা লাগে তুমি পাশে নেই বলে’, ‘তুমি কখন এসে দাঁড়িয়ে আছো আমার অজান্তে’, ‘গীতিময় এই দিন সেই দিন চিরদিন রবে কি’, ‘ওগো মোর মধুমিতা’, ‘আমি ছন্দহারা এক নদীর মতো ছুটে যাই’ প্রভৃতি। ১৯৭৬ সালে ‘দি রেইন’ চলচ্চিত্রে ‘আমি তো আজ ভুলে গেছি সবই’ গানটির জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
১৯৩৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতের বর্ধমান জেলার কেতু নামক এক অজপাড়াগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করেন মাহমুদুন্নবী। তিনি ছিলেন সহজ-সরল, মিষ্টভাষী এবং গানপাগল অভিমানী এক মানুষ। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কেবল গানই লালন করেছেন ধ্যানে-জ্ঞানে-মননে। গাওয়ার পাশাপাশি সুরকার হিসেবেও অনন্য ছিলেন। উচ্চারণ, আবেগ আর মেলোডি- এ তিনের মিশেলে মাহমুদুন্নবী ছিলেন একজন জাত শিল্পী। গুণী এ কণ্ঠশিল্পীর প্রয়াণ দিবসে আমাদের সময়ের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
পারিবারিক জীবনে রাশিদা চৌধুরীকে বিয়ে করেন মাহমুদুন্নবী। তাদের চার সন্তান- ফাহমিদা নবী, সামিনা চৌধুরী, রিদওয়ান নবী পঞ্চম ও তানজিদা নবী। মৃত্যুবার্ষিকীতে বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন দুই মেয়ে ফাহমিদা ও সামিনা…
ফাহমিদা নবী
আব্বা শুধু আমাদের কাছে নয়, পুরো বিশ্বের বাঙালির কাছেই অত্যন্ত অমায়িক-অসাধারণ একজন মানুষ ও শিল্পী। তার কণ্ঠ, গায়কি আর ব্যক্তিত্ব নিয়ে সবাই গর্ব করেন। কেউ কেউ বলে ওঠেন- আব্বা ছিলেন দারুণ বিনয়ী, বিশাল মনের মানুষ। এই যে দারুণ মানুষ ছিলেন বলে ওঠেন, তখন আমাদের বাবা সবার হয়ে যায়। আর সেটাই আমাদের ভালো লাগত, এখনো লাগে। আব্বা এমন এক সোনার কাঠি দিয়ে গেছেন, যার ছোঁয়ায় স্বর্ণকমল হয়ে ফুটে থাকতে হবে- যতদিন বেঁচে আছি। মাঝে মধ্যে মনে হয়, আব্বা যদি আর কিছুদিন বেঁচে থাকতেন! আব্বার খুব ইচ্ছা ছিল- একটা ক্যাসেট প্রকাশ করবেন, যেখানে একসঙ্গে ১২টা গান থাকবে। সেই গানগুলো আজ এত বছর পর আরও কতগুলো ভালো গানের খাতায় নাম লেখাত। কিন্তু আব্বার সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি! আজ ক্যাসেটের যুগ চলে গেছে, কিন্তু রয়ে গেছে সেই গান, সেই ছায়া। আব্বা এমনই ছিলেন- যেখানেই যেতেন, আসর জমে যেত তাকে ঘিরে। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখতাম, এখনো অনুভব করি সেই সব মুহূর্ত।
সামিনা চৌধুরী
কদিন আগে স্বপ্নে দেখলাম, আব্বা বাসায় আসছেন। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছেন। দৌড়ে আম্মার কাছে গেলাম। বললাম, আব্বা আসছেন। আম্মা বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমার আব্বাকে আসতে বলো।’ নুমা (ফাহমিদা নবী) আর অপেক্ষা করল না, সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে গেল। আব্বাও নুমাকে জড়িয়ে ধরলেন আর চুমু খেলেন। স্বপ্নটা ভাঙার পর অনেকটা সময় কেঁদেছি। আব্বা যেদিন মারা গেলেন, সেদিনটার কথা এখনো খুব মনে পড়ে। আব্বার মাথার পাশে আমার মাথাটা রেখে অনেকক্ষণ গল্প করেছিলাম। আব্বার সঙ্গে প্রয়োজন ছাড়া তো একদমই কথা বলতাম না। খুবই ফরমাল ছিলাম। আব্বাও খুব কম কথা বলতেন। আগেকার বেশিরভাগ বাবাই এমন ছিলেন। তাই আমরাও দূরে দূরে থাকতাম। এখন তাই সবাইকে বলি, বেঁচে থাকতেই মানুষের সঙ্গে মানুষের একটা লজ্জা, সংকোচ ও দূরত্ব থাকে- এটা দূর করে মনের সব কথা নিঃসংকোচে বলে ফেলা উচিত। আব্বাকে হারানোর পর এই মেসেজটাই পেয়েছি। আমরা অনেকে মনের মধ্যে ভালোবাসা পুষে রাখি, প্রকাশ করি না- এটা ঠিক নয়।
ফাহমিদা নবী, সামিনা চৌধুরী ও পঞ্চম
সুরের ভুবনের আজীবন পথচারী প্রয়াত শিল্পী মাহমুদুন্নবীর চার সন্তানের মধ্যে তিনজনই সঙ্গীতে খুঁজে নিয়েছেন আপন ঠিকানা। ফাহমিদা নবী আর সামিনা চৌধুরী আজ দেশের জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন প্রথম সারিতে। পঞ্চম ব্যান্ডসঙ্গীত নিয়ে আছেন। আধুনিক গানের শিল্পী মাহমুদুন্নবীর গাওয়া গান তার জীবদ্দশায় যেমন ছিল জনপ্রিয়, তেমনি তার মৃত্যুর ২০ বছর পরও জনপ্রিয়। ষাট ও সত্তরের দশকে এ দেশের সিনেমার গানে মাহমুদুন্নবী ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ১৯৯০ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
শিল্পী মাহমুদুন্নবীর আদর্শ নিয়েই এগিয়ে চলেছেন ফাহমিদা নবী ও সামিনা চৌধুরী। আধুনিক গানের পাশাপাশি সিনেমার গানেও তারা কণ্ঠ দিয়ে যাচ্ছেন। তবে অনেক প্রলোভন থাকার পরও এই দুই বোনকে কখনো নকল গান গাইতে দেখা যায়নি। গান নিয়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন রিয়েলিটি শোতে বিচারক হিসেবে ফাহমিদা ও সামিনার সপ্রতিভ উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। তাদের ছোট ভাই পঞ্চম দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন আর্ক ব্যান্ডের সঙ্গে। বর্তমানে সুরকার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে চেষ্টা করছেন।
বাবা মাহমুদুন্নবীর স্মৃতিচারণ করে ফাহমিদা নবী বললেন, গানের যা কিছু জানি সবকিছুই বাবার কাছ থেকে শেখা। বাবা অন্য সব সাংসারিক ব্যাপারে বেশ উদাসীন থাকলেও আমরা গান শিখছি কিনা সেই ব্যাপারে সবসময় খোঁজখবর নিতেন।
সামিনা চৌধুরী বললেন, গানের মধ্যেই আমাদের জন্ম। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, আমাদের বাসায় যা কিছু আলাপ-আলোচনা হচ্ছে তার বেশির ভাগই গান নিয়ে। তখন থেকেই সঙ্গীতচর্চা আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনের অংশ, আজও তাই আছে।