১৯১ বার পড়া হয়েছে
ট-বর্গীয় বর্ণগুলোর আগে ’ণ’ স্থলে ‘ন’ দিয়ে যুক্তব্যঞ্জন : ফেসবুকে সচরাচর দৃশ্যমান বানান বিভ্রাট
===============ঃ
ফেসবুকে প্রায়শ দেখা যায় যে, অনেকেই নির্বিচারে ট-বর্গের (ট, ঠ, ড, ঢ, ণ) বর্ণগুলোর আগে ণ’ স্থলে ‘ন’ দিয়ে যুক্তব্যঞ্জন গঠন করে থাকেন। অল্পসংখ্যক লেখক ব্যতীত অনেকেরই এটি অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। এই ভুল ঘটার কারণগুলো হলো :-
১. ব্যাকরণসম্মত নিয়ম না জানা
২. শুদ্ধ ভাষার চর্চায় মজ্জাগত অনীহা
৩. লেখায় ও বর্ণ-মুদ্রণে অসাবধানতা
৪. ক্ষুদ্রাকৃতি মনিটরে দৃষ্টিবিভ্রম
আলোচ্য যুক্তব্যঞ্জন তৈরিতে ফেসবুকের অনেক বন্ধু সচরাচর যে-সব ভুল করে থাকেন, সে-গুলোর কিছু দৃষ্টান্ত নিম্নে তুলে ধরা হলো :-
১. “চব্বিশটা ঘন্টাও পেলাম না,
অথচ মনে হয় যেন পেয়েছি।”
মন্তব্য : ‘ঘন্টা’ ভুল বানান। ’ন্ট’ (ন+ট) নয়, হবে ’ণ্ট’ (ণ+ট)। শুদ্ধ বানান ‘ঘণ্টা’।
২. ”লুন্ঠিত মানবতা আজ,
কুসুম মরছে সেই ধকলে।”
মন্তব্য : ‘লুন্ঠিত’ ভুল বানান। ‘ন্ঠ’ (ন+ঠ} নয়, হবে ‘ণ্ঠ’ (ণ+ঠ)। শুদ্ধ বানান ‘লুণ্ঠিত’।
৩. ”আমার হৃৎপিন্ড রে, তোকে ছাড়া কী করে বাঁচবো ত্রিভুবনে!”
মন্তব্য : ’হৃৎপিন্ড’-ও ভুল বানান। ’ন্ড’ (ন+ড), নয়, হবে ’ণ্ড’ (ণ+ড)। শুদ্ধ বানান ‘হৃৎপিণ্ড’।
৪. ”এ ধরনের উক্তি মর্যাদা ক্ষুন্ন করে।”
মন্তব্য : ’ক্ষুন্ন’ ভুল বানান। ’ন্ন’ (ন+ন) নয়, হবে ‘ণ্ন’ (ণ+ন)। শুদ্ধ বানান হলো ‘ক্ষুণ্ন’।
এ ক্ষেত্রে যে ণত্ববিধি রয়েছে তা হলো, যুক্তব্যঞ্জনে ট-বর্গের বর্ণগুলোর (ট, ঠ, ড, ঢ, ণ) আগে ‘ণ’ হবে। যেমন—
ণ্ট (ণ+ট) : কণ্টক, ঘণ্ট, ঘণ্টা, ঘণ্টি, নির্ঘণ্ট, নিষ্কণ্টক, বণ্টন, বণ্টিত
ণ্ঠ (ণ+ঠ) : অকুণ্ঠ, অবগুণ্ঠন, কণ্ঠ, কণ্ঠস্থ, কুণ্ঠা, কুণ্ঠিত, গুণ্ঠন, শুণ্ঠি (শুকনো আদা), সুকণ্ঠী
ণ্ড (ণ+ড) : অণ্ড, আণ্ডা, উচ্চণ্ড, কাণ্ড, কুণ্ড, কুণ্ডলী, খণ্ড, খণ্ডন, খণ্ডিত, খাণ্ডা (খড়্গ), গণ্ড, গণ্ডা, গণ্ডি, গণ্ডার, গণ্ডূষ (হাতের কোষ), গাণ্ডিব (ধনুক), চণ্ড, চণ্ডী, চণ্ডাল, তণ্ডুল (চাল), তাণ্ডব, দণ্ড, দণ্ডিত, দণ্ডনীয়, দণ্ডবিধি, দণ্ডমুণ্ড, দণ্ডাজ্ঞা, দণ্ডায়মান, পণ্ড, পণ্ডশ্রম, পণ্ডিত, পাণ্ডিত্য, পাণ্ডব (পাণ্ডুরাজের পঞ্চপুত্র), পাণ্ডা (তীর্থস্থানের পূজারি), পাণ্ডু, পাণ্ডুর, পাণ্ডুলিপি, পাষণ্ড, পিণ্ড, প্রচণ্ড, বিতণ্ডা, ভণ্ড, ভণ্ডামি, ভণ্ডুল, ভাণ্ড, ভাণ্ডার, ভাণ্ডারী, ভেরেণ্ডা, মণ্ড, মণ্ডন (সাজসজ্জা, প্রসাধন), মণ্ডপ, মণ্ডল, -মণ্ডলী, মণ্ডা, মণ্ডিত, মুণ্ডু, মুণ্ডন (কেশ কামানো বা ন্যাড়া করার কাজ), মুণ্ডিত, মেরুদণ্ড, লণ্ডভণ্ড, শুণ্ড (শুঁড়), শুণ্ডাল (হাতি), শুণ্ডিকা (আলজিভ), শিখণ্ডী, ষণ্ড (ষাঁড়), ষণ্ডা, হৃৎপিণ্ড
ণ্ঢ (ণ+ঢ ) : ঢুণ্ঢন (অন্বেষণ), ষণ্ঢ (নপুংসক)
ণ্ন (ণ_ন) : অক্ষুণ্ন, ক্ষুণ্ন, বিষণ্ন। কিন্তু এই নিয়মের ব্যতিক্রম ‘বিপন্ন, বিপদাপন্ন, আসন্ন। আর ’ক্ষুণ্ন’’ শব্দের সাথে ’ক্ষুন্নিবৃত্তি’ শব্দটিরও সম্পর্ক নেই। এটি সন্ধিজাত (ক্ষুৎ+নিবৃত্তি=ক্ষুন্নিবৃত্তি)। তাই বানানে ’ন’-এর দ্বিত্ব হয়েছে।
তবে বিদেশি শব্দের বেলায় ট-বর্গীয় বর্ণগুলোর আগে ’ণ’ স্থলে ‘ন’ দিয়ে যুক্তব্যঞ্জন গঠন করতে হবে। যেমন—ব্যাডমিন্টন, ব্যান্ড, কিন্ডারগার্টেন, ক্যান্টিন, এজেন্ট, ওয়ারেন্ট, কম্পাউন্ডার, টেন্ডার, ফান্ড, বন্ড ইত্যাদি।
দ্রষ্টব্য :
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি গৃহীত বানানবিধি’র ১৩ সংখ্যক ক্রমিকে ট-বর্গীয় শব্দের আগে ‘ণ’ দিয়ে অতৎসম শব্দ গঠনের কথা বলা আছে, যথা— আন্ডা, ঝান্ডা, ঠান্ডা, পিন্ডি, মুন্ডা। কিন্তু ’কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গৃহীত বাংলা বানানের নিয়ম’-এর ৭ সংখ্যক ক্রমিকে বলা হয়েছে—”অসংস্কৃত শব্দে কেবল ‘ন’ হইবে, যথা— ’কান’, ’সোনা’, ’বামুন’, ’কোরান’, ’করানোর’। কিন্তু যুক্তাক্ষর ‘ণ্ট’, ’ণ্ঠ’, ’ণ্ড’, ’ণ্ঢ’ চলিবে,” এর মানে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অ-সংস্কৃত বা অ-তৎসম শব্দে ট-বর্গীয় বর্ণগুলোর আগে ’ণ’ সহকারে যুক্তাক্ষর গঠন বিধিসম্মত বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, যথা— আণ্ডা, ঝাণ্ডা, ঠাণ্ডা, পিণ্ডি, মুণ্ডা ইত্যাদি। । আর ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকার পুরানো সংস্করণের ৪.০১ ক্রমিকে দেখা যায় যে, সশ্লিষ্ট বিষয়ে কমিটির সদস্যগণ একমত হতে পারেন নি। ‘ণ’ এবং ‘ন’ পক্ষে দ্বিধাবিভক্ত মত ছিল। কিন্তু এর পরিমার্জিত সংস্করণ, ২০১২-এর ২.৭ সংখ্যক ক্রমিকে বলা হয়েছে, অতৎসম শব্দে ট ঠ ড ঢ -য়ের আগে ন হবে, যথা– গুন্ডা, ঝান্ডা, ঠান্ডা ইত্যাদি। কিন্তু বাংলা একাডেমির অভিধানসমূহে ’ণ’ দিয়েই এসব অ-তৎসম শব্দ সংকলিত করা আছে,
যথা— পিণ্ড, পিণ্ডি, মুণ্ড, ঠাণ্ডা, লণ্ডভণ্ড ইত্যাদি ।।।
চলবে:ঃ