বিকেলের রোদ
মোহাম্মদ খয়রুজ্জামান খসরু
প্রিয় কবি,
স্মৃতিতেও বুঝি মরচে ধরে, কিংবা স্মৃতি পিতলের কলসির মতো। আবছা হলো তো গেলো! তাই মেজে-ঘষে রাখতে হয়, নাহলে প্রিয়মুখগুলো যে বড্ডো ঝাপসা হয়ে থাকে!
সম্পর্ক হলো যত্নের জিনিস, মায়ায় জড়িয়ে-মড়িয়ে রাখতে হয়, যেমন করে আলমারিতে গুছিয়ে রাখি প্রিয় পোশাক, গহনা কিংবা আরও অমূল্য কিছু…!
কিছু রত্ন লুকানো থাকে হৃদয়ের গহনে।
ক’দিন ধরেই ভাবছি তোমাকে লিখব, কিন্তু আর হয়ে ওঠে না। জানো অনেক- অনেক কথা জমে আছে – একসময় তোমার পাশে বসে, তোমার ছায়ায় বসে মনের সব কথা তোমাকে বলতাম, যে কথা জীবনেও কাউকে বলা যায় না তাও নিঃসংকোচে তোমার কাছেই…।
আসলে সময় হয় না, সময় পেলেই — কোথা থেকে যে শুরু করবো সেটাই বুঝে উঠতে পারিনা।
বিস্তর কথা জমে গিয়ে যা হয় আমার হয়েছে তাই !
আজ এই দূরের শহরে বসে মনে পড়ছে তোমাকে।
মনে পড়ছে বললে ভুল বলা হবে -আসলে তুমি সবসময়ই আমার মনে থাকো অক্টোপাসের ন্যায়, ভেতরে-ভেতরে হয়তো রক্তের সঙ্গে বয়ে বেড়াও।
আজ ভোরে উঠেই জানালায় গেলাম রোজকার সকাল দেখতে। আর্শ্বিনের এই সকালে সামনের মাঠ ঘিরে কুয়াশা চোখে পড়লো। অন্যসব দিনের চেয়ে বেশ ঘন। নাকে এলো কুয়াশার ঘ্রাণ। কুয়াশার কিন্তু গন্ধ আছে!
একদিন ঘন হয়ে কুয়াশা পড়লে বাইরে এসে চোখ বন্ধ করে নিবিড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে দেখো। দেখবে ছেলেবেলার শীতের সকাল একটানে সামনে চলে এসেছে। এমনটি আমারও হয়।
আর ঠিক একসঙ্গে তুমি এসে ঝাঁপিয়ে পড়লে সামনের রাস্তা থেকে শেকসপিয়রের বাড়ি পর্যন্ত।
এখান থেকে দেখা যায় না ভাঙারপারের তিন তালগাছ, এই পর্যন্ত। শুধু তুমিই…
শুনতে পাচ্ছো যৈবনের খুনসুটি, টুকরো টুকরো কথা -অভিমান-অনুযোগ।
একটা কথা কি বিশ্বাস করো ? ভালোবাসা ভিতরে যতদিন থাকে কারো জন্য, তার উপরই মানুষ অভিযোগ করে যাতে আরও একটু বেশি ভালোবাসা পায়।
বয়স বাড়বে কিন্তু কোনোদিন হয়তো তেমন করে আর বড়োই হবো না। বয়স বাড়ছে কিন্তু সেটা মনেই থাকেনা। না থাকলেই ভালো। কিন্তু পার্থিব দায়িত্ব? এগুলো কি এড়ানো যায় ? সাধ্য আছে?-নেই। একটু অসাবধানে সংসারের, পরিবারের কতোকিছু যে ওলট-পালট হয়ে যায়! সেটা কী হতে দেয়া যায়? সংসার হলো আশ্রয়, যা’ই হোক- যেমন হোক, সংসারতো! সেটাই কম কি সে ? রোদে, বৃষ্টিতে একটু ঠাঁই তো মিলে। এখনও মাঝে মধ্যে মনে হয় ঘরে থেকেও যেন বাইরের লোক, সংসারে থেকেও অসংসারী সারাটাজীবন। কেন যে এমন হয় নিজেও জানি না।
একটা গল্প তোমাকে বলি শোন,
প্রথম ঘোরলাগা কালের একটা ঘটনা। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম পিতা যখন মারা গেলেন প্রচুর আত্মীয়স্বজন থাকলেও ভরসা করার মতো অভিভাবক তেমন কেউ ছিলেন না মেঝো আপা ছাড়া। তখন ক্যারিয়ার গঠনের জন্য টিউশনি, পড়ালেখা ছাড়া অন্যভাবনা হারাম ছিল।
মনে আছে, তখন বসন্তকাল।
হু-হু করা বাতাস আর তাল-নারিকেল-সুপারীগাছের পাতায়- পাতায় সরসর বাতাস লাগা শব্দ এবং বিশেষ করে পদ্মপুকুরপাড়ের সারিসারি কৃষ্ণচূড়াগাছের টকটকে লালরঙের ফুল আস্তে-আস্তে একটা ঘোরের ভিতর ফেলে দিল।
চারদিকে এতো ফুল! এতো রঙের মেলা!
এতো ভালোলাগা। আবার বুকের ভিতর কী যেন করে! অজানা একটা কষ্ট না কি সেটা বুঝতাম না।
এখন মনে আসে, শুধু কিছু ভালো লাগতো না। সারাটাদিন নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে সেখানে পড়ে থাকতাম।কেউ বারবার ডাকলেও ঘরে আসতামনা। লালমাটির টিলায় ছুটে যেতাম অথবা ইটাছড়ার তীরে।
মনে আছে তখন হঠাৎ একদিন মাথায় এলো যে –
দেখি জলে এই পদ্মফুলের কোনো ছায়া পড়ে কী- না এবং সেটা কেমন দেখায় ? গাছ, ডাল, পাতার ছায়া তো পড়েই, সেই ছায়া একটু কালো ছায়া হয়।
এবার তোমায় বলি শোন –
একদিন দেশে আর থাকা হলো না। গ্রাম ছেড়ে আসার মতো করে এই শহরেই থিতু হলাম। আমার খুব বলতে ইচ্ছে করে তোমাকে – এখানে, এই শহরের যা কিছু স্মৃতি আছে, আমি তার সব, স-ব তোমার কাছে জমা দিয়ে রাখলাম। তুমি যত্ন করে রেখো। এই শহর ছাড়াও আরোও কতো জায়গায় কতো স্মৃতি পড়ে আছে ! আমি যেখানেই যাই তুমি আমার সঙ্গে আছো , গুনগুন স্বরে কবিতা আওড়াও । আমি যেখানে যাই তুমিও সেখানে… সবসময়। আজীবন।
তোমাকে খুব খুব খুব বলতে চাই যে-
সব সময় না পারো , মাঝে মধ্যে সময় করে এখানে, এই দূর প্রবাসে এসো মনের মন্দিরে। আমিও থাকবো।
তোমার মনে থাকবে তো?
তোমার সঙ্গে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে-দেখতে যে ফিরে যাবো চিরচেনা পাহাড়ের কাছে, নদীর কিনারে।
খুব ইচ্ছে করে প্রতি পূর্ণিমায় চাবাগানে, হাকালুকির হাওরে তোমার পাশে থেকে চাঁদ দেখি।
একদিন তুমি খুব শীতের রাতে এই মাঠের কুয়াশায় এসে দাঁড়িয়ে দেখো ? কুয়াশারও গন্ধ আছে। তুমি এসে এর গন্ধটুকু নিয়ে যেও। প্রিয় পদ্মপুকুরের বুকে সাঁতরিয়ে হাত বুলিয়ে একটু আদর করে দিয়ে যেও ।
আর আসতে পারবো না আমি জানি ,
হয়তো খুব শীঘ্রই কোনও একদিন সবকিছু ছেড়ে একেবারেই চলে যাবো। তুমি এসো , নাহলে এইসব স্মৃতিগুলো কষ্ট পাবে। একটুও মিথ্যা না। সত্যি বলছি। মনের মুকুরে গেঁথে রেখো আমার অব্যক্ত কথাগুলো।
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১,লন্ডন।
Copyright @Khosru
London/UK
১ Comment
very good job. congratulations.