ঢাকার পল্টন, আছে না বলা কথা
— রেজাউল করিম মুকুল।
ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানের জনসভায় দলে দলে যোগদিন। এইতো সেদিনের কথা, লোকের মুখে মুখে ছিলো পল্টন ময়দান। আর আজ? প্রতিদিন হাজার কিংবা লাখ, কত মানুষ ছুটে চলে পল্টনের বুক চিড়ে, কেউ কি থমকে দাড়ায়, খানিকটা ফিরে দেখে পল্টন পানে। এই পল্টনেরও আছে অনেক কথা, জানতে চায় না কেউ। পল্টনের ইতিহাস মানেইতো ঢাকার ইতিহাস। আজকের পল্টন সেদিন ছিলো ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একটি সেনানিবাস। প্লাটুন শব্দটি ঢাকার মানুষের মুখে স্হায়ী রুপ নেয় এই পল্টন। পুরানা পল্টন, পল্টন লেন, নয়া পল্টন, তোপখানা থেকে ফুলবাড়িয়া রেললাইন পর্যন্ত গোটা এলাকাটাই ছিলো ব্রিটিশদের সেনানিবাস বা ক্যান্টোনমেন্ট। তোপখানা লেন বা তোপখানার তোপ তুর্কি শব্দ থেকেই সুপ্রিয় পাঠক অনুমান করতে পারেন এখানে ছিলো কামান বাহিনীর অস্ত্রাগার। ১৮৪০খ্রিঃ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর এই সেনানিবাস পল্টন খেকে রমনা, বেগুনবাড়ী ও লালবাগে স্হানান্তরিত হয় এবং কয়েক বছর পরে ১৮৫৭খ্রিঃ কোম্পানীর হাত থেকে রানী নিজে ভারত উপনিবেশের শাসন ক্ষমতা গ্রহন করলে মিল ব্যারাকে সরিয়ে নেয়া হয়। খালি হয়ে যাওয়া গোটা এলাকাটি দিয়ে দেয়া হয় ঢাকা পৌরসভাকে। পৌরসভা এর কিছুটাতে একটা বাগান তৈরী করে নাম দেন কোম্পানী বাগিচা। এর বাকি অংশের কিছুটা ব্যবহৃত হলো ঢাকা কলেজের খেলার মাঠ, বৃটিশ লেফ্টন্যান্ট গভর্নরের প্যারেড গ্রাউন্ড, ক্রিকেট খেলার মাঠ এবং একপাশে জনসভার বিরাট ঐতিহাসিক পল্টন ময়দান। ১৯৩০খ্রিঃ পর্যন্ত এই পল্টনে খুব কম মানুষই বাস করতো। ভৌগলিকভাবে আজকের গোটা পল্টন এলাকাটি অতিতের হারিয়ে যাওয়া পান্ডু নদীর তীরে অবস্হিত ছিলো। জায়গাটি ছিলো সৈনিকদের বাসস্হান হিসেবে অস্বাস্হ্যকর। কারণ পান্ডু নদীটি গতিপথ হারিয়ে ক্রমসঃ মজা পুকুরে পরিনত হোয়ে গিয়েছিলো। এটি সে সময়ে মশার জন্মভূমিতে রুপ নিয়েছিলো। এ্যানোফিলিক্স ও কিউলেক্স মশার কামড়ে সৈনিকরা ম্যালারিয়া জ্বরে আক্রান্ত হোয়ে পড়ছিলো। অফিসাররা কোয়াটার ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো অন্যত্র। ১৮৪০খ্রিঃ বৃটিশ কর্ণেল ডেভিডসন তার তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছেন এলাকাটিতে সবুজের সমারোহ থাকলেও মশার উপদ্রপে পল্টন সেনানিবাস মনুষ্য বসবাস উপযোগি ছিলো না। এখানে কোন সৈনিককে বদলী করা হলে মনে করা হতো নিশ্চয় সে কোন অপরাধ করেছে। ১৮৫২খ্রিঃ কোলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি ম্যাপে ঢাকার পল্টন লাইনকে স্যাতস্যাতে, অস্বাস্হ্যকর এবং ঝোপ-জঙ্গল চিহ্ন দিয়ে দেখানো হোয়েছে। ঐতিহাসিক হৃদয়নাথ মজুমদার পল্টন সম্পর্কে লিখেছেন ১৯৩০খ্রিঃ আগে এখানে কোন মানুষ বাস করতো না। রাস্তা, বিদ্যুত এসব কিছুই ছিলো না। তার বর্ণয়ায় বাবুবাজার খাল তখনকার গোটা ঢাকা শহরকে দুইভাগে ভাগ করেছিলো। এই খালের পশ্চিম ও উত্তর অংশটাই ছিলো পুরনো যা রায়ের বাজার থেকে উত্তরে এগিয়ে আসছিলো। এই ক্রমবর্ধমান শহরের পূর্বেই ছিলো পুরানা পল্টন, রমনা মাঠ। আর অন্য অংশে ছিলো দক্ষিণ বংশাল, উত্তর তাতীবাজার এবং কামাড়নগর ।
ঢাকার কবি বুদ্ধদেব বসুর একটা বিখ্যাত উপন্যাস, “মনের মতো মেয়ে” যারা পড়েছেন দেখবেন সেখানে একটি চরিত্র বিকাশ বলছে, “আমি যখন ১৭ বছর, আমি পল্টনে একটি বাড়ীর খোঁজে এসে দেখলাম এই এলাকায় মোট বাড়ীর সংখ্যাই মাত্র তিন”। উল্লেখ্য বুদ্ধদেব বসুর জন্ম হয় কুমিল্লায়। তার পিতা ভূদেব বসু পেশায় ঢাকা বারের উকিল ছিলেন। তার পৈতৃক আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রামে। ১৯২১ সালে ১৩ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় আসেন এবং প্রায় দশ বৎসর ঢাকায় শিক্ষালাভ করেন। বুদ্ধদেব বসু ১৯২৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৫ সালে ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান, ১৯২৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে ইংরেজিতে ১৯৩০-এ প্রথম শ্রেণীতে বি. এ. অনার্স এবং ১৯৩১-এ প্রথম শ্রেণীতে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন মেধাবী এক ছাত্র। বি. এ. অনার্স পরীক্ষায় তিনি যে নম্বর লাভ করেন তা একটি রেকর্ড; এবং অদ্যাবধি (২০০৯) এ রেকর্ড অক্ষুণ্ণ আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বুদ্ধদেব বসু ঢাকার পুরানা পল্টন থেকে তার ও অজিত দত্তের যৌথ সম্পাদনায় ১৯২৭ – ১৯২৯ পর্যন্ত সচিত্র মাসিক ‘প্রগতি পত্রিকার সম্পাদনা করেন। পরবর্তিকালে এই পল্টনে বেশ কয়েকটি বড় পরিবার বাস করেন যেমন গাজী, আবেদিন, রউফ, চৌধুরী এনারা পল্টনকে সমৃদ্ধ করেন। বুদ্ধদেব বসুর সেদিনের সেই পল্টনের যে তিনটি বাড়ীর কথা লিখেছেন তার উপন্যাসে এখন সেখানে কি কি আছে এবং কি কি নাই তার বিবরণ সত্যিকার অর্থে আকাশের তারাগণানার মতো। এটাকে একটা থানা করা হলো ২৭ জুন ২০০৫খ্রিঃ। মুদিদোকান থেকে আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম, ক্লিনিক, হাসপাতাল, গাজী ভবন, রাজমনি, জোনাকি সিনেমা, পলওয়েল মার্কেট, রাজমনি ঈশাখাঁ হোটেল, ওর্চার্ড, ভিক্টরী, গ্রান্ড আযাদ, মিডনাইট সান, মৌরী, ল্যানহুয়া এবং বায়তুল মোকারম মসজিদসহ কয়েক শত শপিং কমপ্লেকস, সুপার মার্কেট ও হাজার হাজার হোটেল রেষ্টাউরেন্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও দোকানপাট শোভিত পল্টনের ১২০ফুট রাস্তা এবং রাস্তার অলিতে গলিতে এখন দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা যানবাহন আর মানুষ উৎলায়।বৃটিশদের সেই উপনিবেশিক শাসনামল থেকে অদ্যাবধি এই পল্টনের বাসিন্দারা ছিলেন স্বনামে সুখ্যাতিতে, অর্থবিত্ত বৈভবে সমুজ্জল মানুষ। এদের মধ্যে গাজী গোলাম মোস্তফা, আব্দুর হালিম চৌধুরী, ভারতীয় বাংলা সিনেমার বিখ্যাত চরিত্রাভিনেতা পাহাড়ী সান্যালের মেয়ে নমিতা আনোয়ার, বাম রাজনীতির নেতা নির্মল সেন, গায়ক খুরশিদ আলম, শাহনেওয়াজ রহমতুল্লাহ, আবেদা সুলতানা, মিউজিশিয়ান আনোয়ার পারভেজ, রইসুল ইসলাম আসাদ, মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু এনারা সবাইতো এই পল্টনের বাসিন্দা। ১৯৫০ খ্রিঃ এর সামান্য আগে পল্টনের পাশের জায়গাটির নাম ছিলো রামকৃষ্ণপুর। এখানে দুটি গলিতে সর্বসাকুল্যে বাস করতো প্রায় ২৫ ঘর পরিবার। ১৯৪৭খ্রিঃ এখানকার হিন্দুরা ভারতে চলে গেলে মুসলিমরা জায়গাটির নাম বদলে রাখলো আল্লাহরসুলপুর। কিন্তু সামান্য একটা গলির জন্য অতবড় ঐ নামটি টেকসই হলো না। লোকে ডাকতে শুরু করলো নয়াপল্টন। বাস, সেই থেকে হয়ে গেলো। সেদিনের সেই পল্টন আর নয়াপল্টনের ছিলো কত যে কথা, আজ ব্যস্ত জীবণ, জিজ্ঞেস করারও কেউ নেই। (রেজাউল করিম মুকুল, প্রাবন্ধিক ও গবেষক)।